সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের নন-ফিকশন গদ্য বাংলা সাহিত্যের সম্পদ। এমন চমৎকার সুস্বাদু প্রবন্ধ লিখতেন তিনি, মনে হয় প্রবন্ধ পড়ছি না, জয়নগরের মোয়া খাচ্ছি। সংবাদ-প্রতিবেদনের মতো তাৎক্ষণিকতার দোষে দুষ্ট নয়, আবার কবিরা সচরাচর যেমন গদ্য লেখেন, সেই ললিত-লবঙ্গ-লতার প্রাদুর্ভাব নেই তাঁর গদ্যভাষায়। টানটান, ছিমছাম, নির্মেদ। শুনলে বিশ্বাসই হয় না, সুনীল নাকি গদ্যরচনা শুরু করেছিলেন নেহাতই বাধ্য হয়ে, গ্রাসাচ্ছাদনের উদ্দেশ্যে দুটো পয়সা অতিরিক্ত রোজগারের আশায়।
তিন চারটে ছদ্মনাম পকেটে ঢুকিয়ে এই মর্ত্যধাম ভ্রমণ করেছিলেন তিনি। বিখ্যাত সেই ছদ্মনামগুলির মধ্যে “সনাতন পাঠক” সম্ভবত সবচেয়ে প্রাচীন। মনেপ্রাণে তিনি ছিলেন কবি, কিন্তু স্রেফ কবিতা লিখে সংসার চালানো যায় না। তার জন্যে প্রচুর গদ্য লিখতে হয়। দু-হাত খুলে লেখালেখি করার উদ্দেশ্যে, পিতৃদত্ত নামের পাশাপাশি পত্রপত্রিকায় গদ্য লেখার জন্যে আরেকটি অতিরিক্ত নাম সৃষ্টি করে নিতে হয়েছিল তাঁকে। সনাতন পাঠক ছদ্মনামে তিনি দেশ বিদেশের সাহিত্য-সংক্রান্ত খবরাখবর সরবরাহ করতেন পাঠকদের। বলতে দ্বিধা নেই— পঞ্চাশ, ষাট কিংবা সত্তরের দশকে কলকাতা শহরে বসে সমসাময়িক বিশ্বসাহিত্যের যে-বিপুল তথ্য তিনি বাঙালি পাঠকের হাতে তুলে দিয়েছেন, আজকের এই “ইনফরমেশন ওভারলোড”-আক্রান্ত সাইবার-যুগেও, অন্তত বাংলা সাহিত্য-অঙ্গনে, ধারাবাহিকভাবে এই কাজ করতে আমি কাউকে দেখিনি, দেখছি না। সবাই কেবল সুললিত “ব্যক্তিগত গদ্য” লেখায় ব্যস্ত আজকাল। আর নয়তো দেশ-দুনিয়া-সমাজ-সময়-ধর্ম-অধর্মের মুণ্ডপাত!
অথচ সনাতন পাঠকের লেখা এই প্রবন্ধগুলি সুদীর্ঘকাল অপ্রকাশিত অবস্থায় আজকের অর্বাচীন পাঠকের চোখের আড়ালে পড়ে ছিল। ভাবতে অবাক লাগে! কতো হাবিজাবি সংকলন, সংগ্রহ, অমনিবাস কিংবা রচনাসমগ্র বেরোচ্ছে প্রায় প্রত্যেকদিন, কিন্তু বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্বের সামগ্রিক একটি প্রবন্ধ-সংকলন আজও বেরোয়নি, তিনি লোকান্তরিত হওয়ার এক যুগ পরেও! এই কাজ কেবল বাঙালির মতো কর্মনিষ্ঠ তৎপর জাতির পক্ষেই সম্ভব।
তবুও ভাগ্যের কথা, এবারের কলকাতা বইমেলায় অবশেষে পুনরাবির্ভাব ঘটেছে সনাতন পাঠকের। আমার বহুদিনের একটা আশা পূরণ হয়েছে। যে-সুনীলের গদ্যের এত ভক্ত আমি, তাঁর শুরুর দিকের গদ্যের স্বাদ বহু চেষ্টাতেও নিতে পারিনি এতদিন। কেমন ছিল সেই সুনীলের লেখা, যখন তিনি কবিতার গণ্ডি পেরিয়ে সদ্য পা ফেলছেন গদ্যের নিঃসীম জগতে? শুরুর দিকের একটি রচনায় তিনি লিখেছেন : “আমি জীবনে কখনো গল্প লিখিনি, কখনো লেখার ক্ষীণতম ইচ্ছা বা দুঃসাহসও আমার নেই।” কী আশ্চর্য কথা! গল্প রচনায় নিতান্ত অনিচ্ছুক সেই যুবকের বিপুল পরিমাণ গদ্যের প্রতি কটাক্ষ করে পরবর্তীকালে কবীর সুমন গান লিখেছেন : “সুনীল গাঙ্গুলীর দিস্তে দিস্তে লেখা...” (গানের নাম “আমাদের জন্য”)। বাকি গদ্যের কথা বাদ দিলাম, তাঁর শুধু উপন্যাস-সমগ্রই এখনও পর্যন্ত বেরিয়েছে ১৫টা খণ্ড (এবং এখনও শেষ হয়নি, আরো বেরোবে)!
এই সংকলনে রয়েছে মোট ১২৪টি রচনা। বেশিরভাগই আকারে ছোট। যেগুলোর আকার বড়, সেগুলোও আড়াই পৃষ্ঠায় এঁটে গেছে। সাময়িক পত্রিকায় এর চেয়ে বেশি জায়গা পাওয়া মুশকিল। মূলত সমসাময়িক সাহিত্য জগৎ নিয়ে আলোচনা করেছেন। প্রসঙ্গক্রমে মাঝে মাঝে চলে এসেছে সমাজের কথা, রাজনীতির কথা, ব্যক্তিগত আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা। পঞ্চাশের দশকে তিনি আমাদের জানাচ্ছেন এস্কিমোদের সাহিত্যের ব্যাপারে। ওড়িয়া সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ লেখকদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন। জেমস জয়েসের স্ত্রী কিংবা ফ্রাঞ্জ কাফকার প্রেমিকার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিচ্ছেন। সদ্য প্রয়াত জীবনানন্দের মৃত্যুর “প্রকৃত” কারণ খোঁজার চেষ্টা করছেন। রবীন্দ্রনাথের নোবেল প্রাপ্তির পরে নোবেল সংগঠনের সভাপতির ভাষণের উল্লেখ করেছেন, যেখানে সভাপতি মহাশয় লিখেছেন : “প্রফেট রবীন্দ্রনাথ কিছুদিনের জন্যে লেখা-টেখা ছেড়ে প্রাচীন ভারতীয় পদ্ধতিতে পবিত্র গঙ্গা নদীর বুকে একটা নৌকায় ধ্যানী তপস্বীর জীবন কাটিয়েছেন” (আসলে, পদ্মা নদীতে বজরা-ভ্রমণের ব্যাপারে লিখতে চেয়েছিলেন উনি। সভাপতি মশাই যদি জানতেন, সবচে সেরা প্রেমের গানগুলো নদীতে ভাসতে ভাসতেই লিখেছিলেন সেই ধ্যানী তপস্বী!)
তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে অতি কষ্টে জোগাড় করা “কালবেলা” নামক সাহিত্যপত্রিকায় (যেখানে “একটিও ছাপার ভুল নেই, ভাষার ভুল নেই”) শামসুর রাহমান নামের একজন অপরিচিত কবির কবিতা পাঠ করে মুগ্ধ হচ্ছেন। হাসান আজিজুল হক নামের একজন নবাগত গল্পকারের “আত্মজা ও একটি করবী গাছ” গল্পটির “ডায়ালেক্ট ও তেজী সাহিত্যের ভাষার” নিপুণতা দেখে বিস্ময় প্রকাশ করে মন্তব্য করছেন: “কালবেলা নয়, ওঁদের সাহিত্য এখন সন্ধিক্ষণের”। থিয়েটার প্রসঙ্গে জাঁ পল সার্ত্রে-র জরুরি মতামত অনুবাদ করছেন। ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের একুশ তারিখে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের আপামর বাংলাভাষী মানুষের জীবনে ঘটে যাওয়া একটি মর্মন্তুদ ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছেন। সৈয়দ মুজতবা আলীর মৃত্যুসংবাদ জানিয়ে একটি রচনায় সুনীল লিখছেন, “সাধু ভাষা থেকে চলতি ভাষায় উত্তরণ যেমন একটি বিরাট ঘটনা— তেমনভাবেই সৈয়দ মুজতবা আলী ভাষাকে আর এক ধাপ এগিয়ে দিলেন। তিনি দেখালেন যে, বিশ্বের যে-কোনো ভাষা থেকেই শব্দ নিয়ে আসায় কোনো ক্ষতি নেই— যদি ঠিক মতন ব্যবহার করা যায়”। আজকের ভাষা-নাৎসি এবং “কেবলমাত্র খাঁটি বাংলা ভাষা”-প্রেমী এবং অহেতুক উৎকট বাংলা প্রতিশব্দ/ পরিভাষা/ বিকল্প উদ্ভট বঙ্গশব্দ উৎপাদনকারীদের শ্রীচরণে এই উদ্ধৃতিটি বিনীত নিবেদন করলাম আমি। এরকম আরো কতো যে বিচিত্র ও কৌতূহলোদ্দীপক সাহিত্য-বিষয়ক সংবাদের রামধনু ছড়িয়ে আছে এই বইটির পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায়!
বইটির শুরুর দিকে গদ্যের বাঁধুনি ছিল কিছুটা যেন আলগা। বিষয়বস্তুর বিশ্লেষণে আবেগের পরিমাণ কিছুটা যেন অতিরিক্ত। ধীরে ধীরে পারদর্শিতা অর্জন করেছেন লেখক। ধীরে ধীরে চোখের সামনে নির্মিত হচ্ছে একজন অসামান্য গদ্যকারের শক্তিশালী কলম। যে-কলম পরবর্তী অর্ধ শতাব্দীরও বেশি সময় মাতিয়ে রাখবে বাঙালি পাঠকের রসনাকে। প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর, বৈচিত্র্যে বিচ্ছুরিত, অথচ বৈদগ্ধ্যের নিয়ন্ত্রিত প্রকাশে পারদর্শী— সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় নামক একজন অনবদ্য গদ্যশিল্পীর প্রারম্ভিক সাহিত্যভাবনার উপভোগ্য দলিল হয়ে থাকবে এই চমৎকার সংকলনটি। সুবিনয় দাস-এর আঁকা প্রচ্ছদটি বেশ সুচারু।
“পাকে-চক্রে লেখক হয়ে যাওয়ার পর এখন একটা অন্য স্বপ্ন প্রায়ই দেখি। আমরা ভাবি যে এই সময় বা এই যুগকে বদলে দেবার ক্ষমতা আছে আমাদেরই হাতে। এটা যে একেবারেই ভুল স্বপ্ন, তা মনেই পড়ে না!”
কোনও এক মাকোন্দো গ্রামের কোনও এক বুয়েন্দিয়া পরিবারের গল্প। ভিন্ন মহাদেশের ভিন্ন সমাজ, ভিন্নরকম মানুষের ভিন্ন ভিন্ন লোকাচার, স্বভাবচরিত্তির, পাগলামি। আমার কাছে এইসব অপরিচিত লাগে। তবু ভালো লাগে। আমি তো নিশ্চিন্দিপুরও চিনতাম না। দস্তইয়েভ্স্কির সেইন্ট পিটার্সবার্গও না। আর কে নারায়ণের মালগুড়িও না। তবু তো তারা অনুভূতির গভীরে অনুরণন তুলতে পেরেছিল। মাকোন্দোও পেরেছে ভীষণভাবে! শুধু তার অপার বিস্ময়ঘেরা পরিবেশ আর সময়ের সঙ্গে তার ঝিমধরা সম্পর্কের কারণেই নয়, গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের অতুলনীয় গদ্যশৈলীর কারণেও। যে গদ্য কিনা, বাংলা অনুবাদ সংস্করণের ভূমিকায় সাহিত্যিক হাসান আজিজুল হকের অবলোকনে : “বাস্তবকে গলিয়ে আলোময় প্রবাহে পরিণত করেছে”। কাহিনি নয়, চরিত্র নয়, এই অপ্রতিম গদ্যই উপন্যাসটির সবচেয়ে বড় সম্পদ।
অথচ এই গদ্য আমার কাছে এসেছে দুই দফা হাতফেরত হয়ে। স্প্যানিশ থেকে ইংরিজি, ইংরিজি থেকে বাংলা। গতবছর এই বইটি পড়েছিলাম গ্রিগোরি রাবাসার চমৎকার ইংরিজি তর্জমায়। কিন্তু বাংলা অনুবাদ পড়তে যেহেতু সবসময় আমি আগ্রহী হয়ে থাকি— ভালো বাংলা অনুবাদ হাতে পেলে কদাপি ইংরিজি অনুবাদ পড়িনা— তাই জি এইচ হাবীবের এই অনুবাদটি তো একদিন আমার পড়ার কথাই ছিল! ইংরিজি অনুবাদটি আগে পড়ার কারণে আরও ভালো বুঝতে পেরেছি, কী অসম্ভব মেধাবী একটা কাজ করেছেন অনুবাদক। মাকোন্দোর দুনিয়া শুধু আমার পরিচিত দুনিয়ার চেয়েই আলাদা নয়, এই দুনিয়ার যেকোনো দুনিয়ার চেয়ে আলাদা। রূপ-রস-বর্ণ-গন্ধ-শব্দ-স্পর্শশুদ্ধু তাকে সার্থকভাবে বাংলায় উপস্থাপন করা যে কতটা গভীর অভিনিবেশের কাজ, প্রথম কয়েকটা পৃষ্ঠায় প্রবেশ করলেই পাঠক সেটা বুঝে ফেলবেন! এমন উৎকৃষ্ট বাংলা অনুবাদ থাকলে ইংরিজি অনুবাদ পড়ার আদৌ প্রয়োজন নেই বোধহয়।
লাতিন আমেরিকার ‘জাদুবাস্তব' ঘরানার ব্যাপারে অজস্রবার আলোচনা হয়ে গেছে ইতিমধ্যে, তাই এই বিষয়ে নতুন করে আমার আর কিছু বলার নেই। আমি কিন্তু বইটিকে কোনও ঘরানার ছাঁচে ফেলে পড়িনি। এইভাবে সাহিত্য পড়তে পারিনা আমি। আমি তো সাহিত্যের তাত্ত্বিক পাঠক নই, সাধারণ ছাপোষা পাঠক। কেবল আনন্দের জন্য বই পড়ি। তাই এই উপন্যাস যদি আমাকে টেনে ধরে রাখতে না পারতো, স্রেফ “বিখ্যাত” কিংবা “অবশ্যপাঠ্য” কিংবা “অন্যরকম” হওয়ার কারণেই উপন্যাসটি আমি জোর করে গিলতাম না (তাও আবার দুবার)। উপন্যাসটির কাহিনিবিন্যাস আমার অভ্যস্ত রুচির বাইরে হওয়া সত্ত্বেও আমি অসম্ভব উপভোগ করেছি। ক্যানো? কারণ আমার মনে হয়েছে, উপন্যাসটি লেখার সময় লেখক “নতুন একখান তাকলাগানো জিনিস লিখছি রে ভাই” জাতীয় কোনও ভণিতার আশ্রয় নেননি। জিনিস নতুন বটে, কিন্তু সৃজনশীল অনুপ্রেরণার খুব সৎ এবং অকৃত্রিম বহিঃপ্রকাশ ছাড়া এইরকম ঘোরগ্রস্ত রচনা সম্ভব নয়।
উপন্যাসের শিরোনামে “নিঃসঙ্গতা” শব্দটি রয়েছে। নিঃসঙ্গতা কি “বিষন্নতা” শব্দের সমার্থক? সবসময় নয়। “একাকিত্ব” শব্দটি যেমন সবসময়ই বিষন্নতার সহচর। একটি পরিবারের প্রায় ছয়/সাতটি প্রজন্মের সদস্যদের মোটামুটি জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি যাপনচিত্র বর্ণিত হয়েছে উপন্যাসে। কিন্তু আবার স্মরণ করছি, গতানুগতিক রচনারীতির মতো সরলরৈখিক নয় এই বর্ণনা। তবে কি কাহিনির চলন বঙ্কিম? তাও নয়। তাহলে কাটাকুটি? এলোমেলো? এদিক সেদিক? এবড়ো খেবড়ো? তাও নয়। তাও নয়। তাও নয়। এই উপন্যাসের রচনারীতি নিঃসঙ্গতার মতোই অধরা রহস্যময়। কখনও এর রূপ বিষন্ন। কখনও বিরক্তি উদ্রেক করে। কখনও এর স্পর্শে পুলক জাগে। বারতিনেক পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম আমি। যেন স্বপ্নের ভেতর বৃষ্টি পড়ছিল। আমি বৃষ্টিপতনের সেই শীতল শব্দ পান করছিলাম। ঘুম ভেঙে আবার খুলেছি বইটির পৃষ্ঠা। তারপর ডুবতে গিয়েও ভেসেছি। আবার ভাসতে ভাসতে তলিয়ে গেছি কখন যেন। নিঃসঙ্গতার কুহেলি শিশিরে ভিজে গেছে আমার পাঠকহৃদয়, পাতার পোশাক...
যতই দিক না যুদ্ধ, খণ্ডকাল হবে পরাজিতএই তো জেনেছি শাস্ত্রে, যতোটুকু হয়েছে অধীত।অখণ্ড কালের পক্ষপাতধন্য আমি মহাশয়,আমাকে রাঙাবে চোখ, এতো শক্তি রাখে না সময়।
(নবনীতা দেব সেন)
উপন্যাসটিতে কয়েকজন অত্যাশ্চর্য নারীচরিত্রের দেখা পাই। এরকম চরিত্রবহুল একটি উপন্যাসে একটিমাত্র চরিত্রকে প্রধান ভূমিকায় অবতীর্ণ করানো যায় না। তবু উরসুলা ইগুয়ারান নামের একজন নারীকে উপন্যাসের প্রধান চরিত্র হিসেবে উল্লেখ করতে ইচ্ছে করছে আমার। ভেবে দেখলে, উপন্যাসের নামটি খুব সহজেই “উরসুলার নিঃসঙ্গতার একশ বছর” রাখা যেতেই পারতো। লক্ষ্য করলাম, উপন্যাসের পুরুষচরিত্রগুলি প্রত্যেকে কমবেশি প্রায় একইরকম (তাদের নামের মতোই)। কিন্তু নারীচরিত্রগুলি নিজস্ব স্বাতন্ত্র্য নিয়ে জ্বলজ্বল করছে। বাহ্যিক দৃষ্টিতে পুরুষরা বিপ্লবে অংশগ্রহণ করেছেন, উদ্দাম জীবনযাপন করেছেন, ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড়িয়ে গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজকে অনুপ্রাণিত করেছেন বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে অন্যতম বিখ্যাত ‘ওপেনিং লাইন'-টি লেখার জন্য (“বহু বছর পর, ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড়িয়ে, কর্নেল অরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার মনে পড়ে যাবে সেই দূর বিকেলের কথা...”)। কিন্তু আমার মনে হয়েছে, প্রকৃত বৈপ্লবিক কাজগুলো, অচিন্তনীয় কাজগুলো, সবচেয়ে বেশি প্রভাববিস্তারী কাজগুলো, আদপে করেছেন এই উপন্যাসের নারীরা। আমার হৃদয়কে সবচেয়ে গভীরভাবে স্পর্শ করেছেন তারাই।
বিপ্লবের কথায় মনে পড়লো, লাতিন আমেরিকার বিপ্লবজারিত অস্থির সমাজের বয়ান এই উপন্যাসের পৃষ্ঠায় খুব সন্তর্পণে প্রবেশ করিয়ে দিয়েছেন লেখক। এই মহাদেশটির রাজনৈতিক সচেতনতা পৃথিবীর বাকি অংশের চেয়ে আলাদা। একইসঙ্গে চরম প্রতিবাদমনস্কতা এবং প্রহসনসদৃশ অত্যাচারী ক্ষমতাসীন কতিপয় জন্তুর পেশীপ্রদর্শন— দক্ষিণ আমেরিকার এই রাজনৈতিক ইতিহাসের সঙ্গে আমরা প্রত্যেকেই পরিচিত। কেমন সুকৌশলে সেই বিপ্লব-প্রতিবিপ্লবের আন্তঃসম্পর্কটি যেন মঞ্চনাটকের উইংসের পিছনে সবসময় প্রস্তুত রেখেছেন লেখক। যখন দরকার দর্শকের সামনে এনেছেন, আবার ফিরিয়ে নিয়েছেন। আর এই উপন্যাসের কথন যেন একটা সুবিস্তৃত অর্কেস্ট্রার মতো। কতো অদ্ভুত যন্ত্র একসঙ্গে বাজছে। সুরের পর্দা উঠছে, নামছে। সিম্ফনি ছড়িয়ে পড়ছে অডিটোরিয়ামের আনাচে কানাচে। উপন্যাসটির মূল বক্তব্যটি কাহিনির একদম শেষের দিকে হঠাৎ আমার চোখে পড়ে গেছে। একইসঙ্গে অপরূপ এবং বিচিত্র এক ভাষায় লেখা দুর্গম এই উপন্যাসটির মর্মার্থ যেন খুব আবছাভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছি সেই লাইনটি পড়ে :
“...ওরা যেখানেই থাকুক না কেন একথা যেন সবসময় মনে রাখে যে অতীত একটা মিথ্যে ছাড়া কিছু নয়, স্মৃতির দিকে প্রত্যাবর্তন সম্ভব নয়, চলে যাওয়া বসন্তের দিন আর ফেরবার নয়, আর, সবচেয়ে উন্মত্ত, সবচেয়ে একনিষ্ঠ প্রেমও শেষঅব্দি একটা ক্ষণস্থায়ী সত্য ছাড়া কিছু নয়।”
আদৌ উপলব্ধি করতে পেরেছি কি? লেখকও মনে হয় চাননি আমি পুরোপুরি উপলব্ধি করি। মানুষের একটা গোটা জীবন কেটে যায় নিঃসঙ্গতাকে উপলব্ধি করতে করতে...
(আমার সঙ্গে একই সময়ে বইটি পাঠ করেছেন আমার বন্ধু আঞ্জুমান লায়লা নওশিন। উপন্যাসটি অবলম্বনে নেটফ্লিকস প্রযোজিত নতুন টিভি-সিরিজটির খবর এবং এই উপলক্ষ্যে বইটি আরেকবার পড়ে ফেলার পরামর্শ— দুটোই তিনি দিয়েছেন। মার্কেজ-অনুরাগী নওশিনকে কৃতজ্ঞতা!)
ঔপনিবেশিক ইয়োরোপের সবজান্তা ঐতিহাসিকরা দীর্ঘদিন যাবৎ একচক্ষু হরিণের মতো প্রাচীন গ্রিক সভ্যতাকে চিহ্নিত করতো সভ্য মানবসমাজের সূচনাবিন্দু হিসেবে। সেই হরিণদের আরেকটি চোখের ঠুলির নিচে চাপা দেওয়া ছিল চৈনিক সভ্যতা, আরব্য সভ্যতা এবং উপমহাদেশীয় সভ্যতার উৎকর্ষের কথা (পৃথিবীর আরো নানাবিধ প্রাচীন “ইন্ডিজেনাস” এবং প্রান্তিক অতি উন্নত সভ্যতাগুলোর কথা না হয় আপাতত বাদই দিলাম)। গ্রিক সভ্যতার পরে আরো প্রবল বেগে এলো রোমান সভ্যতা। প্রাচীন গ্রিক আর রোমান— এই দুটি সভ্যতা গোটা ইয়োরোপ মহাদেশের শৌর্য, বীর্য, চিন্তা, দর্শন, বিজ্ঞান এবং শিল্প-সাহিত্যের মাপকাঠি বেঁধে দিয়েছিল।
মহাপরাক্রমশালী সেই রোমান সভ্যতার পতন ঘটেছিল বড় মর্মান্তিকভাবে। এবং সেই পতনের পরে সমগ্র ইয়োরোপব্যাপী যে-অন্ধকার যুগের সূচনা হয়েছিল, টানা ১০টি শতাব্দী জুড়ে সেই মহাদেশ ডুবে ছিল এক অতল অনড় কুম্ভীপাকের গহ্বরে। ১০ শতাব্দী, মানে এক হাজার বছর (পঞ্চম থেকে পঞ্চদশ শতক)— বড় কম কথা নয়। মনুষ্যত্বহীনতার সেই থিকথিকে কাদা ঠেলে, পুনরায় জেগে উঠেছিল যে দেশটি তার নাম ইতালি। সেই দেশের তাসকেনি নামের একটি ছবির মতো অপূর্ব সুন্দর প্রদেশের সবচেয়ে সমৃদ্ধ শহরের নাম ফ্লোরেন্স। পৃথিবীর অল্প যে কয়েকটি শহরের নাম মানুষের পক্ষে কোনোদিন ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়, ফ্লোরেন্স তার একটি। শুরু হলো ইয়োরোপীয় ইতিহাসের রেনেসাঁস পর্ব।
সেই রেনেসাঁস যুগকে বাংলা ভাষায় কাহিনি-আকারে পড়বো বলেই সদ্য প্রকাশিত এই বইটা কিনে ফেলেছিলাম। সদ্য প্রকাশ হওয়া ফিকশন বই আমি সচরাচর পড়ি না। কিন্তু এই বইটির ক্ষেত্রে নিয়মভঙ্গ করেছিলাম দুটো কারণে। একটি কারণের নাম লিওনার্দো দা ভিঞ্চি। আরেকটি কারণের নাম মিকেলঅ্যাঞ্জেলো। ফরাসি “রেনেসাঁস” শব্দের আক্ষরিক অর্থ হলো পুনর্জাগরণ। মানে, হারিয়ে যাওয়া কোনো গৌরবকে পুনরায় জাগরিত করা। মানুষ নতুন কীর্তি গড়তে পারে, কিন্তু মাটির অনেক নিচে চাপা পড়ে যাওয়া গৌরবকে উদ্ধার করতে এমন মানুষের দরকার হয়, যাঁদের কাঁধ সাধারণের চেয়ে বেশি চওড়া। লিওনার্দো এবং মিকেলঅ্যাঞ্জেলো ছিলেন সেই গোত্রের মানুষ। এরকম দুজন অতিমানবকে ৪৩০ পৃষ্ঠায় মোটামুটি ঠিকঠাক ধরে ফেলা খুব কঠিন কাজ। আমাদের লেখক সেই কঠিন কাজটি করতে পারেননি।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের “সেই সময়” উপন্যাসের ব্লার্বে একটা কথা লেখা আছে, বইটির নায়ক কোনো মানুষ নয়, নায়ক হলো সময়। “সময়কে নায়ক” বানানোর এই ব্যাপারটা তারপর বাংলা সাহিত্যে একটা ক্লিশে অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। বহু চরিত্রের সমাবেশ ঘটলেই, কিংবা একাধিক শক্তিশালী চরিত্রের উপস্থিতি থাকলেই, লেখক “সময়” নামক বস্তুকে নায়ক বানিয়ে ফেলেন। এই বইয়ের মলাটের পিছনেও লেখা আছে, বইটি “খুঁজতে চেয়েছে সেই সময়কে”। কিন্তু সময় তো চলিষ্ণু একটি বস্তু, তাই তাকে খুঁজতে হলে সময়ের অগ্রপশ্চাৎকেও খুঁজতে হয়। ব্যাকগ্রাউন্ডকে যথার্থভাবে প্রতিষ্��া করতে না পারলে চরিত্ররা অসহায় হয়ে উপন্যাসের পৃষ্ঠায় থমকে থমকে চলাফেরা করতে বাধ্য হয়। রেনেসাঁসের মতো অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটা অধ্যায়কে ধরার জন্যে যে গভীরতার প্রয়োজন আছে, উপন্যাসটিতে সেই গভীরতার অভাব রয়েছে।
এই উপন্যাসে রেনেসাঁসের পশ্চাদপট হিসেবে প্রায় কিছুই দেখানো হয়নি। অন্ধকারময় মধ্যযুগের আঁধার কাটিয়ে ক্যানো ঘটেছিল এই নবজাগরণ? রেনেসাঁসের কুশীলব ছিলেন যাঁরা, কীসের তাড়নায় বিচ্ছুরিত হয়েছিল তাঁদের চোখধাঁধানো প্রতিভা? খামচা খামচাভাবে দুই-তিন জায়গায় উল্লেখ আছে বটে যে, এই সময়ে শিল্পের সঙ্গে বিজ্ঞানের সমন্বয় ঘটেছিল— ইতিহাসে সম্ভবত প্রথমবার। কিন্তু এই পয়েন্টটা ইতালিয়ান রেনেসাঁসের ক্ষেত্রে এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে আরো বিশদে সম্পৃক্ত হওয়া উচিত ছিল। খুব দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, অমিতপ্রতিভাধর লিওনার্দোকে একেবারেই যথাযথভাবে আঁকতে পারেননি লেখক (মিকেলঅ্যাঞ্জেলোকে তবু কিছুটা পেরেছেন)।
উল্টে অবাক হয়ে লক্ষ্য করি, লিওনার্দোকে “রক্তমাংসের” দেখাতে গিয়ে, মিকেলঅ্যাঞ্জেলোর সঙ্গে তাঁর দ্বৈরথ দেখাতে গিয়ে, কেমন ভিলেন বানিয়ে ফেলা হয়েছে তাঁকে! তাঁর রত্নখনির মতো নোটবইগুলো, সময়ের থেকে অনেক অগ্রগামী তাঁর বিস্ময়কর চিন্তাভাবনা— এইসব নিয়ে প্রায় কিছুই বলা হয়নি। এবং সবচেয়ে আফসোসের কথা, লিওনার্দো এবং মিকেলঅ্যাঞ্জেলো— দুজনেরই শিল্পকর্মগুলো নিয়ে ব্যাখ্যামূলক আলোচনা থেকে বিরত থেকেছেন লেখক (কেবল আহা, বাহা, কী-অপূর্ব, কী-চমৎকার, এই জাতীয় জেনেরিক বিশেষণ ছাড়া)। শিল্প ছাড়া শিল্পীর কোনো অস্তিত্ব আছে? শিল্পটাই যদি ভালো করে না চিনলাম তাহলে শিল্পীর জীবন জেনে কী লাভ আমার? কী এমন শৈল্পিক বিশেষত্ব আছে মিকেলঅ্যাঞ্জেলোর তৈরি “ডেভিড” নামের ভাস্কর্যে যে এখনও সেটিকে সর্বকালের সবচেয়ে সেরা মার্বেল ভাস্কর্য হিসেবে গণ্য করা হয়?
তাহলে উৎসাহী আধুনিক পাঠক, যাঁরা বিভিন্ন ডকুমেন্টারি দেখে, কিংবা বই পড়ে, কিংবা ইন্টারনেট ঘেঁটে ইতিমধ্যেই জেনে ফেলেছেন রেনেসাঁসের ব্যাপারে অনেক তথ্য, তাঁরা এই বইটি ক্যানো পড়বেন? চেনা চরিত্রগুলোকে স্রেফ ফিকশনাল ভার্শন হিসেবে দেখবার প্রয়োজনে? অনেক সম্ভাবনা থাকলেও উপন্যাসটি একটি গড়পড়তা ঐতিহাসিক উপন্যাস হয়ে থাকবে আমার কাছে। আচ্ছা বেশ, তাহলে ভালো কিছুই নেই এই বইতে? আছে। দুটো খুব ভালো দিক আছে। এক, আজকালকার “গবেষণাধর্মী” (মানে খান-পঞ্চাশেক বইপত্র পড়ে প্লটের মালমশলা জোগাড় করা আরকি) উপন্যাসের মতো রাশি রাশি ইনফর্মেশনের আবর্জনা পাঠকের মাথায় উপুড় করে ঢেলে দেওয়া হয়নি এই বইটিতে। লেখক পড়াশুনা করেছেন বিস্তর, কিন্তু তাঁর সেই অধীত জ্ঞান জামার কলার তুলে সোল্লাসে প্রদর্শন করার চেষ্টা করেননি। দ্বিতীয় ভালো দিক, লেখকের চমৎকার মসৃণ গদ্য। বিষয়বস্তু মোটেও সহজ ছিল না, তবুও ৪৩০ পৃষ্ঠার বইটি অনায়াসে পড়ে ফেলতে পেরেছি। প্লটের গঠন খাপছাড়া মনে হলেও একটি বিষয়ে লেখক লেটার মার্কস পেয়ে উৎরে গেছেন, সেটি হলো তৎকালীন সমাজজীবনের পরিবেশ বর্ণনা। বইটি পড়ার সময় মাঝেমাঝে মনে হচ্ছিল, নিশ্চিত আমি সশরীরে পৌঁছে গেছি সেই যুগে।
আক্ষেপ সত্ত্বেও লেখককে আমি সাধুবাদ জানাবো এই বিষয়টি বেছে নেওয়া এবং নিজের সাধ্যমতো পরিবেশনের চেষ্টা করার জন্যে। হাবিজাবি বিষয়বস্তু অধ্যুষিত বর্তমান বাংলা সাহিত্যে এমন একটি অফবিট বিষয় নিয়ে উপন্যাস লেখার সাহস দেখিয়েছেন লেখক, এটা অনেক বড় কথা। উপন্যাসটির কাহিনি এখনও সমাপ্ত হয়নি। বইয়ের অন্যতম মুখ্য চরিত্র, মোনা লিসা, প্রায় নাগালের বাইরে রয়ে গেছেন বলা যায়। উপন্যাসের অন্তিমে লেখক পরবর্তী আরেকটি খণ্ড লেখার পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন। বর্তমান খণ্ডটি পড়ে পুরোপুরি তৃপ্তি পাইনি ঠিকই, তবুও পরের খণ্ডের জন্যে সাগ্রহে অপেক্ষা করবো আমি। শেষ একটি কথা না বললেই নয়। সুবিনয় দাস পরিকল্পিত প্রচ্ছদটি দারুন। তীব্র লাল বর্ণের জমিতে অধরা মাধুরীর মতো ফুটে উঠেছে দুটি বিশ্ববিখ্যাত শিল্পকর্ম। আবেদনে রহস্যময় অথচ অনুভবে প্রগাঢ়। এবং হৃদয়ের গভীরে রক্তাক্ত। বইটির প্রধান দুই চরিত্রের অন্তর্জগৎ ঠিক যেমনটা ছিল।
it's not
the
history
of countries
but the lives of men.
fables are dreams
not lies,
and
truth changes
as
men change,
and when
truth becomes stable
men
will
become dead.
(Charles Bukowski, “It's Not Who Lived Here”)
আমাদের বাড়ির পিছনে পাশাপাশি দাঁড়ানো একজোড়া পাড়াতুতো লিচুগাছ ছিল। ছোটবেলার একটা প্রিয় অভ্যাস ছিল জানলা দিয়ে সেই গাছদুটো দেখা। আসলে তো গাছ দেখতাম না। দেখতাম সেই গাছে আশ্রয় নেওয়া কয়েক শ' টিয়াপাখিকে (সংখ্যাটা একটুও বাড়িয়ে বলছি না, বরং হয়তো কমিয়ে বলে থাকতে পারি)। একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখার জন্যে আমি তাকিয়ে থাকতাম গাছদুটোর দিকে। কী যেন এক সম্মিলিত আবেগের তাড়নায় অতগুলো টিয়াপাখি হঠাৎ একসঙ্গে গাছ থেকে হুউউউশ করে বেরিয়ে আকাশের দিকে সশব্দ উড়াল দিত। সে যে কী এক অপার্থিব সৌন্দর্য! আমার ছোটবেলার অন্যতম প্রিয় স্মৃতিদৃশ্য এটা। গাঢ় সবুজ গাছের পাতা থেকে অকস্মাৎ বেরিয়ে আসছে একঝাঁক ফিকে-সবুজরঙা চিৎকৃত টিয়াপাখি। সেই লিচুগাছদুটো এখন কেটে ফেলা হয়েছে। মানুষ বাড়ি বানিয়েছে সেখানে। সেই অগুনতি টিয়াপাখির দল, তাদের সন্তান-সন্ততি, আত্মীয়-পরিজন, বন্ধুবান্ধব, তাদের সযত্নে সঞ্চিত স্বপ্নগুলো নিয়ে আজ কোথায় চলে গেছে? অত টিয়াপাখি একসঙ্গে দেখেছি বলেই বোধহয় আমি এখন টিয়াপাখি দেখতে পাইনা। কোত্থাও না! কতদিন একটাও টিয়াপাখি দেখিনা আমি। (খাঁচায় যেসব টিয়াপাখি দেখি তারা তো পুরোপুরি পাখি নয়, ঠিক যেমন সেইসব খাঁচার মালিক যারা, তারা পুরোপুরি মানুষ নয়।)
মানুষ এবং প্রকৃতি-লালিত অন্যান্য প্রাণীদের সহাবস্থানের গুরুত্ব নিয়ে এই রিভিউতে কিচ্ছু লিখবো না আমি। পাখি নিয়েও লিখবো না। পাখিদের দুঃখ নিয়ে লিখবো না। হারিয়ে যাওয়া পাখিদের খোঁজে গুডরিডসের দেওয়ালে সাঁটাবো না কোনো নিরুদ্দেশের উদ্দেশ্যে ঘোষণা-পোস্টার। লিখবো একটা বইয়ের ব্যাপারে। বইটা আমি উপহার পেয়েছি। গত দুই দশকে ক্যামেরা এবং লেন্সের অভূতপূর্ব সহজলভ্যতা এবং সোশ্যাল মিডিয়াতে আত্মপ্রকাশের আয়াসহীনতার কারণেই সম্ভবত, আশেপাশে একটা নতুন নেশা তৈরি হয়েছে। পাখি দেখার নেশা। আগেও অবশ্যই ছিল এই নেশা, এখন বহুগুণে বেড়েছে। আমার বেশ কিছু পরিচিত মানুষ পূর্ণ উদ্যমে তাদের এই নেশার আগুনে নিয়মিত ঘি ঢেলে চলেছেন। বিশেষত শীতকালে, কাঁধে একটা ভারী ক্যামেরা আর গলায় বাইনোকুলার ঝুলিয়ে, পিঠে একটা ছোট ব্যাগ নিয়ে তারা ছড়িয়ে পড়েন নগরের বাইরে দূরে দূরান্তরে। নিবিষ্ট চোখে পর্যবেক্ষণ করেন পাখিদের। ছবি তোলেন। (পাখির ছবি তোলা পৃথিবীর কঠিনতম কাজের একটি)। গত তিন বছর ধরে তেমনই একজন পাখিনেশাড়ুর টানাটানিতে কয়েকদিন আমিও সঙ্গী হয়েছি তাদের অভিযানে। আমার শহরের খুব কাছে “কাষ্ঠশালী” নামের একটা জলাভূমিতে। এই জলাভূমিটার আরেকটা সুন্দর নাম আছে— “চুপি”।
সেখানে শয়ে শয়ে নয়, হাজারে হাজারে পাখিদের মুখোমুখি হয়ে চোখে ঝিলমিল লেগে যাওয়ার মতো অবস্থা। কত প্রজাতির কত ধরনের কত কিসিমের কত চরিত্রের পাখি যে দেখলাম! বিদেশ থেকে পরিযায়ী পাখিরা এসেছে। স্থানীয় দেশি পাখিদের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় করছে তারা। পাখিপ্রেমীদের কাছে সেই পরিযায়ী পাখিদের খাতির বেশি, কারণ কয়েকদিন পরেই আবার দেশান্তরী হবে তারা। তাদের তুলনায় দেশীয় পাখিদের জামাকাপড় যেন একটু কম স্টাইলিশ। নৌকা থেকে দেখলাম একটা বড় সাইজের “মঙ্গোলিয়ান রেড-ক্রেস্টেড পোচার্ড” জল থেকে ঝপাং করে উড়ে আমার ঘাড়ের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গ্যালো (নামটা বন্ধুর কাছে জেনেছি)। মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো : ওরেব্বাস! এই না হলে পাখি! আমার বন্ধুটি বললো, আমাদের দেশেও কিন্তু দারুন দারুন সব পাখি আছে, অরূপদা। মুখে কিছু না বললেও মনে মনে ভাবলাম, বিদেশি পাখির ব্যাপারই আলাদা। আমার এই কলোনিয়াল হ্যাংওভার-সুলভ হাভাতে মনোভাব আন্দাজ করেই কিনা জানিনা, সেই বন্ধুটি উপহার দিয়েছে এই দুর্ধর্ষ বইটা। শুধু দুর্ধর্ষ বললে শুনতে ঠিকঠাক লাগে না।
বলতে হবে : দু র ধ র ষো ও ও...!!
বইটা প্রকাশ করেছে ভারত সরকারের অধীনস্থ “জুলজিক্যাল সার্ভে অভ ইন্ডিয়া” সংস্থা। ছ'শো পৃষ্ঠার বই, পুরোটা রঙিন চকচকে মসৃণ দামি কাগজে মুদ্রিত, অথচ দাম মাত্র ছ'শো টাকা। পঁয়ষট্টিজন “বার্ড-ফটোগ্রাফার” এবং ছয়জন পক্ষীবিশারদ দুই বছর ধরে অক্লান্ত পরিশ্রম করে নির্মাণ করেছেন বইটা। বেশি সুন্দর বই দেখলে আমার জ্ঞানগম্যি লোপ পায়, বর্ণনক্ষমতা হাপিস হয়ে যায়। মুখ দিয়ে বারবার শুধু বেরিয়ে আসে : ক্কী সুন্দর মাইরি বইটা! ক্কী দুর্দান্ত বই রে ভাই এটা! সবমিলিয়ে ১৩৩১ রকমের ভারতীয় পাখির সচিত্র পরিচয় রয়েছে এতে। সবক'টি পাখির স্ত্রী এবং পুরুষের আলাদা রঙিন ছবি দেওয়া আছে। সাধারণ পরিচিত নামের পাশাপাশি দেওয়া আছে বৈজ্ঞানিক নাম, বাসস্থান, আকৃতি, বিশেষ দেহবৈশিষ্ট্যের তত্ত্বতালাশ এবং তাদের সংক্ষিপ্ত বিবরণ। এবং ছবি। আহা কী দারুন ছবি। এমন মনভোলানো রাশি রাশি পাখির ছবি দেখে আমি বিস্মিত! অভিভূত! “...and what is the use of a book without pictures and conversations?” — “অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড” বইয়ের শুরুতেই অ্যালিস এই কথাটা বলেছিল বটে, কিন্তু কথাটা যে এমন ভয়ংকর সত্যি সেটা আমি এতদিন পরে এসে বুঝলাম!
আমার প্রিয় পাখি কাক। তাদের মতো স্মার্ট, অ্যাটিটিউডওয়ালা এবং চালাকচতুর হতে চাই আমিও (যদিও বেচারাদের বাসায় কোকিল ডিম পেড়ে আসে
“শীতঋতু শেষ হলে আমরাও তুলেছি ঠোঁটে
একদিন ভালো-ভালো মন
আজ ঠোঁট পুড়ে ছাই... আজ মন পুড়ে ছাই...
ভাষা জানে প্রকৃত কারণ!”
.
মানিক বন্দোপাধ্যায়ের একদম শুরুর দিকের উপন্যাস এটি। পরের দিকে মানিক তাঁর উদ্ভাবিত নিজস্ব স্টাইলে মানুষের মনের দূরতম অন্দরমহলে গভীর সার্চলাইট ফেলে পর্যবেক্ষণ করতেন, কিংবা প্রচলিত বাংলা উপন্যাসের গঠন থেকে সরে এসে নিজের লেখাতে নিরীক্ষা আর নতুনত্ব নিয়ে আসতেন ; কিন্তু এই উপন্যাসে সেই ট্রেডমার্ক মানিক কিছুটা অনুপস্থিত। তবু একটা দিক দিয়ে এই উপন্যাস আমাকে ভাবিয়েছে, তা হলো মানিকের তীব্র তীক্ষ্ণ রিয়েলিজম।
জননী মানেই তো নিঃস্বার্থ, দরদী, ভালোবাসার অপার আশ্রয়— পৃথিবীর সব মা যেমন হয়ে থাকেন— সাহিত্যে! মানিক এইসব চিরাচরিত রোমান্টিসিজমকে নিজের সাহিত্যজীবনের শুরু থেকেই এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। ‘জননী' উপন্যাসের শ্যামা নামের মুখ্য চরিত্রটি দোষে-গুণে, ক্রোধে-কান্নায়, লাজে-ভয়ে, স্বার্থপরতায়-স্বার্থহীনতায়, আহ্লাদে এবং অভিসম্পাতে, বুদ্ধি এবং নির্বুদ্ধিতায়, চালাকি এবং চতুরতায়, শোকে এবং সাবধানতায়— সব দিক দিয়ে একজন রক্তমাংসের জ্যান্ত মানুষ। নিছক সস্তা বাঙালি সেন্টিমেন্টের ধার ধারেননি মানিক। জীবনের শুরুতেই ঘোষণা করেছেন : আমি এসে গেছি পাঠক, আপনি মানসিকভাবে প্রস্তুত তো?
আধুনিক “ফুলের ঘায়ে মূর্ছা যাওয়া” পাঠকদের কাছে ত্রিশের দশকে রচিত এই উপন্যাসের অনেক কিছুই আপত্তিকর মনে হবে। রমণীর অচ্ছেদ্য পতিপ্রেম (তা হোক-না সেই পতিদেব একজন মার্কামারা অপদার্থ এবং শারীরিক অত্যাচারকারী), কিংবা ভাগ্যের হাতে মেয়েদের অসহায় আত্মসমর্পণ, কিংবা সংস্কারে আচ্ছন্ন মানুষের হৃদয়— এইসব দেখে অনেকে ভয়ানক অপমানিত বোধ করতে পারেন। কিন্তু সমাজ তো তখন এমনই ছিল (এখনও যেন কতো শুধরেছে!)। লেখকের কাজ “আদর্শ সমাজ”-এর রূপরেখা ফুটিয়ে তোলা নয়, সমাজে ঠিক যেমনটা দেখা যায় তেমনটা পাঠকের সামনে তুলে ধরা— উপন্যাসটি পড়ার সময় এটা ভুলে গেলে চলবে না। আমি মাঝেমাঝে ভুলে গিয়ে ভীষণ অপমানিত বোধ করছিলুম, তারপর আবার নিজেকে বোঝাচ্ছিলুম, চিল ব্রো, এটাই তো স্বাভাবিক চিত্র।
বহু বছর আগে পড়েছিলাম এই উপন্যাসটা। সেই অল্প বয়েসে কী যে বুঝেছিলাম কিছুই মনে নেই। এবার আবার পড়তে গিয়ে মানিক বন্দোপাধ্যায়ের অসামান্য চরিত্র-বিশ্লেষণ দেখে অবাক হলাম। কেমন অন্ধকার গোপন গহীন ফাঁকফোকরে পোকামাকড়ের সূক্ষ্ম নড়াচড়াও খুঁটিয়ে দেখবার নজর ছিল তাঁর! মানুষের মনের পোকামাকড়।
স্বতই বিমর্ষ হয়ে ভদ্রসাধারণচেয়ে দ্যাখে তবু সেই বিষাদের চেয়েআরও বেশি কালো-কালো ছায়ালঙ্গরখানার অন্ন খেয়েমধ্যবিত্ত মানুষের বেদনার নিরাশার হিসাব ডিঙিয়েনর্দমার থেকে শূন্য ওভারব্রিজে উঠেনর্দমায় নেমে—ফুটপাথ থেকে দূর নিরুত্তর ফুটপাথে গিয়েনক্ষত্রের জ্যোৎস্নায় ঘুমাতে বা মরে যেতে জানে।এরা সব এই পথে ওরা সব ওই পথে— তবুমধ্যবিত্তমদির জগতে আমরা বেদনাহীন— অন্তহীন বেদনার পথে।
রবীন্দ্রনাথ সবচেয়ে বেশি ‘এক্সপেরিমেন্ট' করেছিলেন বোধহয় তাঁর লেখা নাটকগুলি নিয়ে। প্রায় প্রতিটি নাটকের গঠনশৈলী গতানুগতিক নাট্যরীতির চেয়ে অন্যরকম। এর মধ্যে ‘রক্তকরবী' এবং ‘মুক্তধারা'-র নাম একসঙ্গে উচ্চারিত হতে শোনা যায় প্রায়ই। দুটোই রূপক-আশ্রিত নাটক। যদিও ‘রক্তকরবী'-র ব্যঞ্জনা এবং ব্যাপ্তি অনেক বেশি গভীর।
‘মুক্তধারা' নাটকটিতে কোনো দৃশ্যবিভাগ নেই। হরেকরকম চরিত্ররা ক্রমাগত আসা-যাও���়া করে মঞ্চে, দৃশ্যের মাঝে কোনো বিরতি থাকেনা। ফলে পুরো নাটকে একটা নিরবচ্ছিন্ন flow লক্ষ্য করা যায়। নাটকের বিষয়বস্তু হলো, আধুনিক সমাজব্যবস্থায় যন্ত্র এবং কারিগরিবিদ্যার সাহায্যে মানুষের দ্বারা প্রকৃতিকে পোষ মানানোর (অপ)চেষ্টা এবং তার পরিণতি।
১৯২২ সালে রচিত এই নাটকটি আজকের দিনেও প্রাসঙ্গিক। একটু বেশিই প্রাসঙ্গিক। নাটকের আখ্যানটি এরকম: একটি প্রাকৃতিক জলস্রোতের উপর বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। বাঁধটির কারণে বিস্তীর্ণ অঞ্চলের মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, তবু কারো ভ্রুক্ষেপ নেই। মানবিক চেতনার চেয়ে অর্থনৈতিক এবং ক্ষমতার স্বার্থই বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়েছে। শুভবুদ্ধিসম্পন্ন কেউ কি এগিয়ে আসবেন সেই বন্দী জলধারাকে মুক্ত করে দিতে?
নাটকটি পড়ে বেশ ভালোই লেগেছে। নাটকের সংলাপ খুব জোরালো। তবে নাটকটিকে কেন জানি পূর্ণাঙ্গ বলে মনে হলো না। ক্লাইম্যাক্সও বড্ড তাড়াহুড়ো করে নিষ্পত্তি করা হয়েছে। হয়তো মঞ্চায়িতরূপে দেখলে নাটকের বার্তাটি আরো বেশি অর্থবহ মনে হবে। কারণ অভিনয়েই তো নাটকের সার্থকতা। তবু বলবো, একশো বছর আগে লেখা নাটকে একেবারে সমসাময়িক ইস্যুর প্রতিফলন দেখে অবাক হয়েছি। দূরদর্শিতা বটে!
“যে জিনিসটা ছেলেবয়স থেকে বেশ ভালোই পারতাম সেটা হল ছবি আঁকা।”
ইন্টারনেটের গলিঘুজিতে মাঝে মাঝে একটা লিস্ট দেখা যায় : পৃথিবীর বিখ্যাত মানুষ যাঁরা মাঝপথে পড়াশুনা ছেড়ে দিয়েছিলেন (‘ড্রপ-আউটস')। এইসব লিস্টে দুজনের নাম কখনই দেখা যায়না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং সত্যজিৎ রায়। প্রথমজন পড়াশুনা ছেড়েছিলেন বিরক্ত হয়ে। দ্বিতীয়জন বাধ্য হয়ে। সত্যজিতের স্ত্রী বিজয়া রায়ের আত্মকথায় দেখতে পাই, জীবনে কখনও মায়ের কথা অমান্য করেননি তিনি। মায়ের প্রবল ইচ্ছেতেই শান্তিনিকেতনের কলাভবনে ভর্তি হয়েছিলেন চিত্রশিল্প শেখার উদ্দেশ্যে (অথচ তার আগে গ্র্যাজুয়েশন করেছিলেন ইকোনোমিক্সে অনার্স নিয়ে)।
রবীন্দ্রনাথ ছিলেন সুকুমার রায়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। যদিও শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের চেয়েও বেশি সান্নিধ্যলাভ করেছিলেন শিল্পাচার্য নন্দলাল বসু এবং বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের (পরবর্তীকালে বিনোদবিহারীকে নিয়ে বিখ্যাত ডকুমেন্টারি বানিয়েছিলেন— “The Inner Eye”)। শান্তিনিকেতনের পাঠ কিন্তু শেষ করতে পারেননি তিনি। জীবিকার তাগিদে চার বছরের কোর্স আড়াই বছরে ছেড়ে দিয়ে, শান্তিনিকেতনের নিবিড় প্রকৃতি-সন্নিহিত স্তিমিত জীবন ত্যাগ করে, সারাজীবনের মতো প্রবেশ করলেন কলকাতার প্রবল নাগরিক জঙ্গলে। কিন্তু শান্তিনিকেতনের শিল্পশিক্ষার আঁচড়টি তাঁর মননে সযত্নে ধারণ করে রেখেছিলেন আমৃত্যু।
অতিরিক্ত প্রতিভাধর মানুষদের কিছু কিছু প্রতিভার কথা তুলনামূলক আড়ালে রয়ে যায়। লিওনার্দো দা ভিঞ্চি দুর্দান্ত আতশবাজি বানাতে পারতেন। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী দারুন বেহালা বাজাতে পারতেন। স্বামী বিবেকানন্দ অসাধারণ রান্না করতে পারতেন। রিচার্ড ফাইনম্যান খুব ভালো বোঙ্গো বাজাতে পারতেন। সত্যজিতের সিনেমা-নির্মাতা পরিচয়ের আড়ালে রয়ে গেছে তাঁর অলংকরণ পারদর্শিতার ব্যাপারটা। এমনকি লেখক সত্যজিৎও ইলাস্ট্রেটর সত্যজিতের চেয়ে অধিক আলোচিত। শিল্পী সত্যজিৎকে নিয়ে কিছু কিছু প্রবন্ধ লেখা হয়েছে বটে, কিন্তু পূর্ণাঙ্গ বই একটাও ছিল না। দেবাশীষ দেব সেই অভাব পূরণ করেছেন।
দেবাশীষ দেব নিজে একজন স্বনামধন্য ইলাস্ট্রেটর। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের অদ্ভুতুড়ে সিরিজের ভীষণ জনপ্রিয় উপন্যাসগুলোর জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ হলো দেবাশীষবাবুর অলংকরণ। দীর্ঘদিন আনন্দবাজার পত্রিকায় চাকরি করলেও তাঁর শিক্ষানবিশি শুরু হয়েছিল সত্যজিৎ-সম্পাদিত ‘সন্দেশ' পত্রিকায় ছবি আঁকার মধ্যে দিয়ে। সত্যজিৎ রায়কে খুব কাছ থেকে দেখেছেন তিনি, এবং নিজে একজন অলংকরণশিল্পী হওয়ার সুবাদে সত্যজিতের চিত্রশিল্পী সত্তাটিকে তিনি বিশেষ নজরে পর্যবেক্ষণ করেছেন। সেই পর্যবেক্ষণ এবং দীর্ঘকালীন চিন্তার ফসল হলো এই অসামান্য বইটি। বইটির উৎসর্গপত্রে লেখা আছে : “যাঁরা দীর্ঘদিন ধরে এই বইটির জন্য অপেক্ষা করে রয়েছেন, তাঁদের জন্য”। আমি নিজে এই অপেক্ষাকারীদের একজন। প্রকাশ হওয়ার তিনদিনের মধ্যে হস্তগত করেছিলাম বইটিকে।
বাকি সবকিছুর কথা বাদ দিলাম। শুধু ‘সন্দেশ' পত্রিকার প্রচ্ছদগুলো দেখেই আমি বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে যাই। তিন অক্ষরের ‘সন্দেশ' শব্দটিকে নিয়ে সত্যজিৎ যেন ছেলেখেলা করেছেন। কতো বিচিত্র টাইপোগ্রাফিতে ধরতে চেয়েছেন পত্রিকার এই অর্থবহুল নামটিকে। প্রচ্ছদগুলোর কতো বর্ণময় বৈচিত্র্য। কল্পনার কী অবাধ বিচরণ! (প্রায় একই কথা বলা যায় “এক্ষণ” পত্রিকার প্রচ্ছদগুলোর ব্যাপারেও)। কর্মজীবনের শুরুতে তিনি ছিলেন কলকাতার বিখ্যাত একটি বিজ্ঞাপন সংস্থার কমার্শিয়াল ডিজাইনার। সেই সংস্থার ম্যানেজার দিলীপকুমার গুপ্ত পরবর্তীকালে ‘সিগনেট প্রেস' নামের বিখ্যাত প্রকাশন সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। এবং সত্যজিতের সামনে খুলে যায় ইলাস্ট্রেশন এবং প্রচ্ছদ নির্মাণের অত্যাশ্চর্য দুনিয়া। সিগনেট প্রেস থেকেই বেরিয়েছিল ‘আম আঁটির ভেঁপু' (‘পথের পাঁচালী'-র সংক্ষিপ্ত সংস্করণ)। এই বইটির প্রচ্ছদ এবং অলংকরণ করার সময়ই সত্যজিতের মাথায় আসে একটি সিনেমার আইডিয়া, যা কিনা বদলে দেবে তাঁর নিজের জীবন এবং ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসকে।
জীবনে যে কাজেই হাত দিয়েছেন, ছকবাঁধা একঘেঁয়েমিকে অতিক্রম করে নিজস্ব অভিনব প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন সত্যজিৎ। ছবি আঁকাও ব্যতিক্রম নয়। কোনো একটি গল্প কিংবা উপন্যাসের সঙ্গে অলংকরণের ব্যাপারটি আগে ছিল নিছকই একটা ফাঁকা জায়গা ভরানোর অভিপ্রায়। বেশিরভাগ সময়ে অলংকরণশিল্পীর নামটুকুও উল্লেখ করা থাকতো না। প্রচ্ছদশিল্পীর নাম তো এখনও বহু সময় উল্লেখিত থাকেনা। এমন একটি পেশাদারী অবজ্ঞার পরিবেশে কাজ করতেন শিল্পীরা। নিজের অলংকরণ-কৌশলেই প্রচলিত প্রথাটিকে এক ধাক্কায় পাল্টে দিলেন সত্যজিৎ। প্রকাশকরা এই নবাগত শিল্পীর নামটিকে উপেক্ষা করতে পারলেন না। এমনকি অনেক সময় দেখা গেলো, বইয়ের চেয়েও বইটির প্রচ্ছদশিল্পীর খ্যাতি বেশি ছড়িয়ে পড়েছে! বইয়ের বিজ্ঞাপনে বড়ো বড়ো অক্ষরে লেখা থাকতো প্রচ্ছদশিল্পীর নাম— এমন বিস্ময়কর কাণ্ড বাংলা প্রকাশনা জগতে কেউ কখনও দ্যাখেনি!
অলংকরণ তো শুধুমাত্র একটি বই কিংবা একটি রচনার সৌন্দর্যবৃদ্ধির উপায় নয়। একটি গল্পের সঙ্গে একই পৃষ্ঠায় মুদ্রিত একটি অলংকরণ যেন গল্পটির অন্যতম একটি চরিত্র। গল্পটির অন্তর্নিহিত বিষয়বস্তুকে আরো গভীরতা দ্যায় সেই অলংকরণ। কিন্তু তার জন্যে চিত্রশিল্পীর তরফে বুদ্ধিদীপ্ততার প্রয়োজন। খেয়াল গায়কের সঙ্গে যদি আনাড়ি তবলাবাদক সঙ্গত করে, তাহলে সেই গানের রসহানি ঘটে। কিন্তু যোগ্য সঙ্গতকারীর সহায়তা পেলে গায়কের পরিবেশনা অন্য মাত্রা পায়। সত্যজিৎ তাঁর অলংকরণের মাধ্যমে এই বুদ্ধিদীপ্ত সহায়তা করেছেন অগুনতি গল্প উপন্যাস কিংবা বইয়ের প্রচ্ছদে। তাঁর নিজের লেখাপত্রে তো বটেই, প্রচুর অখ্যাত লেখক আছেন যাঁদের রচনা উৎরে গেছে স্রেফ সত্যজিতের অলংকরণের অসামান্য শিল্পগুণে।
ছবি আঁকার এই তুলনামূলক অনালোচিত ক্ষেত্রটিতেও কী না করেছেন সত্যজিৎ! বিজ্ঞাপনের লে-আউট এঁকেছেন, বই এবং পত্রপত্রিকার প্রচ্ছদ এঁকেছেন, গল্প উপন্যাসের ইলাস্ট্রেশন করেছেন, ক্যালিগ্রাফি বা হরফ চর্চা করেছেন, নিজস্ব ইংরিজি ফন্ট তৈরি করেছেন, সিনেমার পোস্টার ডিজাইন করেছেন, সিনেমার সেট ডিজাইন করেছেন, এমনকি লোগো ডিজাইন করেছেন (কলকাতার বিখ্যাত প্রেক্ষাগৃহ ‘নন্দন' কিংবা ভারতের ‘সাহিত্য আকাদেমি' সংস্থার লোগো কিংবা বিখ্যাত ভারতীয় প্রকাশন সংস্থা ‘রূপা পাবলিকেশনস'-এর লোগো কিংবা ‘দেশ' পত্রিকার সুপরিচিত লোগোটিও তিনি তৈরি করেছেন)। ‘জয় বাবা ফেলুনাথ' সিনেমাতে একটি বিখ্যাত দৃশ্য আছে। মগনলাল মেঘরাজের ডেরায় বেচারা লালমোহনবাবুর সঙ্গে ছুরি দিয়ে বিপজ্জনক খেলা দেখানোর দৃশ্যটি। এই দৃশ্যে লালমোহনবাবু একটি চিত্রপটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকেন। সেই ভয়ানক চিত্রপটটিও সত্যজিতের স্বহস্ত-অঙ্কিত!
এই বিচিত্র মানুষটির কর্মকাণ্ড দুই মলাটে আঁটিয়ে ফেলা প্রায় অসম্ভব একটি কাজ। তবু পরম অধ্যবসায়ের সঙ্গে, শ্রদ্ধার সঙ্গে, ভালোবাসার সঙ্গে এবং তন্নিষ্ঠ গবেষকের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সত্যজিতের শিল্পীসত্তার বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছেন দেবাশীষ দেব। এমন একটি কাজের জন্য কোনো প্রশংসাই যথেষ্ট নয়! ঠিক যেমন সত্যজিৎ রায় মানুষটির প্রতি আমার অপার মুগ্ধতার পরিমাপের জন্য কোনো মাপকাঠির দৈর্ঘ্যই যথেষ্ট লম্বা নয়!
(‘সন্দেশ' পত্রিকায় প্রকাশিত একটি গল্পের হেডপিস)
মাতৃভাষার প্রতি আমাদের ভালোবাসাও আছে আবার অবহেলাও আছে। ভালোবাসার মানুষকে অবহেলা করার মতো। যদিও এমনটা যে করা উচিত নয় তা আমরা সবাই জানি। আমরা সবাই ছোটবেলা থেকে বাংলা ভাষাতেই কথা বলি, চিন্তা করি, স্বপ্ন দেখি। কিন্তু মুখের ভাষা আর লেখার ভাষায় তো পার্থক্য আছে। মুখের ভাষার বাক্যগঠন আর লেখার ভাষার বাক্যগঠন অনেকটাই আলাদা। তাই ভাষাকে যদি ভালোবাসি, তাহলে লেখার সময় আমরা সবাই আরেকটু যত্নবান হলে আখেরে বাংলা ভাষারই উপকার হয়। অনেকে আছেন যারা নিয়ম ভাঙতে চান। কিন্তু নিয়ম ভাঙার আগে নিয়মগুলো না জানলে কেমনে কী?! একটা ভাষা গড়ে ওঠে শত শত বছরের পরিচর্যায়। তাকে নাড়াচাড়া করার সময় একটু যত্নবান হওয়া উচিত নয���, বলুন?
অভিধান থেকে সাধারণত আমরা শব্দের অর্থ খুঁজে বের করি। অনেকসময় কোনো একটি শব্দের সঠিক বানানের খোঁজ করতেও অভিধানের শরণাপন্ন হই। সাধারণ অভিধানের সঙ্গে ‘প্রয়োগ অভিধান'-এর পার্থক্য আছে। প্রয়োগ মানে বাংলা ভাষার বিভিন্ন শব্দের ব্যবহার কিংবা ব্যাকরণসম্মত প্রয়োগ। ‘ওতপ্রোত' লিখবো নাকি ‘ওতঃপ্রোত'? যেটা লিখবো সেটা ক্যানোই বা লিখবো? ‘ছন্দপতন' লিখবো নাকি ‘ছন্দোপতন'? ‘ইতিমধ্যে' কিংবা ‘ইতিপূর্বে'— এই দুটো শব্দ নাকি ভুল। ক্যানো ভুল? তাহলে সঠিক বানান কোনটা? এমনিতে দেখতে গেলে ভাষা নিয়ে এত খুঁটিনাটি তলিয়ে ভাবার কি আদৌ কোনো দরকার আছে? ভাষাকে ভালোবাসলে অবশ্যই দরকার আছে। আর অবহেলা করলে দরকার নেই।
যে বইগুলো সবসময় আমার হাতের কাছাকাছি থাকে, তার মধ্যে এটি একটি। যেমন খানিকক্ষণ আগেই ভাবছিলাম, ‘কোনো' এবং ‘কোনও' শব্দদুটির পার্থক্য কী? জানিয়ে রাখ���, এই দুটো শব্দের অর্থগত আদৌ কোনো পার্থক্য নেই। দুটো বানানই লেখা যেতে পারে। কিন্তু একটি রচনায় যেকোনো একটি বিকল্প লেখা বাঞ্ছনীয়। প্রসঙ্গত, প্রায় একই ধাঁচের আরেকটি খুব কাজের বই আছে। কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী সম্পাদিত “বাংলা কী লিখবেন কেন লিখবেন”। যারা শুদ্ধ বাংলা লিখতে আগ্রহী, এই বই দুটি তাদের পড়ার টেবিলে না থাকলেই নয়! ভাষাকে অত্যাচারের হাত থেকে রক্ষা করতে এই দুটি বই রীতিমত অস্ত্রের মতো ব্যবহার করা যেতে পারে! তাই বলে “self-appointed ভাষা-Nazi” হতে হবে না! অন্যের বানান ভুলও ধরতে হবে না (ধরলেও সবার সামনে নয়, আড়ালে জানাতে হবে
মানিক বন্দোপাধ্যায়ের ক্লান্তিহীন ছদ্ম-দার্শনিক বকবক, নাকি অপদার্থ নায়কের হাবভাব আর চালচলন— কোনটা বেশি বিরক্তিকর লাগলো জানি না। “শেষের কবিতা”-র কথা মনে পড়ে গেলো। সেই একইরকম অকর্মণ্য বুকনিবাজ “লাভার বয়” পুরুষ চরিত্র। সেই একইরকম প্রেমের মহিমা কীর্তন (সরি, কীর্তন নয়, হরিবোল সংকীর্তন!)। সেই একইরকম অসহ্য ন্যাকামি।
পড়া শেষ হয়েছে, বাঁচা গেছে!
আবুল হাসানের নামই জানতাম না আজ থেকে বছর চারেক আগেও। দোষ আমার নয়। কোনো এক বিচিত্র উন্নত-নাসিকা-syndrome-জনিত কারণে, বাংলাদেশের অনেক প্রথিতযশা কবি সাহিত্যিকদের ব্যাপারে আমাদের এই বঙ্গভূমে আলাপ আলোচনা হয় না। তবে সুখের কথা, এই বদভ্যাস ক্রমশ কমছে। যদিও এখনও বাংলাদেশের বইপত্র আমাদের এখানে সহজলভ্য নয়। গোটা কলেজ স্ট্রিট তল্লাশি করে আবুল হাসানের কবিতার বইয়ের অন্তত একপিস কপিও খুঁজে পাইনি।
অথচ মনের মধ্যে নিত্য আসা যাওয়া করে, এখান থেকে ওখান থেকে কুড়িয়ে পাওয়া, কয়েকটা ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন পঙক্তি। জেনেছি মানুষ তার চিবুকের কাছেও ভীষণ অচেনা ও একা! মৃত্যু আমাকে নেবে, জাতিসংঘ আমাকে নেবেনা। আমি আমার ভালোবাসার স্বীকৃতি চাই, স্বীকৃতি দে স্বীকৃতি দে স্বীকৃতি দে! ঝিনুক নীরবে সহো, ঝিনুক নীরবে সহে যাও। এ ভ্রমণ আর কিছু নয়, কেবল তোমার কাছে যাওয়া। অতটুকু চায়নি বালিকা!
মনের ভিতর আকুলিবিকুলি করে এই কবির কবিতা ছুঁয়ে দেখার জন্য। অবশেষে হারুন পাঠিয়েছিল আবুল হাসানের রচনা সমগ্র। সেই সমগ্র থেকে কবির প্রথম প্রকাশিত কবিতার বইটি পড়েই ডাউন ট্রেনের মতো বৃষ্টি এসে জলডাকাতের মতো উৎপাত শুরু হয়ে গেছে আমার চেতনা জুড়ে! “রাজা যায় রাজা আসে” কাব্যগ্রন্থের পয়লা লাইনটি :
সে এক পাথর আছে কেবলই লাবণ্য ধরে, উজ্জ্বলতা ধরে আর্দ্র, মায়াবী করুণ এটা সেই পাথরের নাম নাকি?
কী আশ্চর্য, কবিতাটির নাম “আবুল হাসান”! কবির মতো আমাদের প্রত্যেকের নিজের প্রস্তরীভূত আত্মনামটিও তো সময়ের ঘষা লেগে ক্ষয়ে ক্ষয়ে গেছে। আমরাও তো সেই নামটির অনিচ্ছুক দাস। আমরাও কি ভালোবেসেছিলাম কোনো যুবতীর বামহাতে পাঁচটি আঙুল?
তারপর পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা জুড়ে বয়ে চলে স্মৃতি সত্তা ও ভবিষ্যতের অজস্র অনিকেত কোরাস। এক জায়গায় চোখে পড়ে আমার আরেকজন প্রিয় কবি শহীদ কাদরীকে উৎসর্গ করা একটি কবিতায় (“গাছগুলো”) যেন অতিপরিচিত এক ব্যক্তিগত দেয়াল লিখন :
আমরা যখোন শার্টের তলায়নিজস্ব গোপন ছুরি নিয়ে চলা ফেরা করিপ্রতিমুহূর্তের আয়নায় আত্মহত্যা করি আরপ্রতিমুহূর্তের অবিশ্বাসেএর ওর সাথে কথা বলি,সে মুহূর্তে ওরা বিলায় ওদের নিজস্ব সম্পদনির্বিশেষে চুপিচাপি
বিষাদের আমলকি-ছায়ায় বসে কবি আমাকে সরবরাহ করেছেন তাঁর গভীর গোপন দুঃখ। তাঁর বাবা, একজন ‘নিম্নমানের মানুষ', যাঁকে নাকি তাঁর মা বলতেন :
তুমি এই সমস্ত লোক দ্যাখোনা?ঘুস খাচ্ছে, জমি কিনছে, শনৈঃ শনৈঃ উপরে উঠছে,কত রকম ফন্দি আঁটছে কত রকম সুখে থাকছে,তুমি এসব লোক দ্যাখোনা?
আমি যেন মানস কর্ণে শুনতে পাই কবির নিচু গলায় উচ্চারিত, চামেলী হাতে সেই ব্যর্থ মানুষটি, তাঁর বাবার কথা। আবার পরের পৃষ্ঠাতেই সংকোচ ঝেড়ে ফেলে দৃপ্ত তিনি :
এই কবিতা তোমার মতো সমালোচকের ভুলশোষকের শাসনত্রাশন ভেঙে ফেলে, মুখের উপর থুথুড়ি দেয়ইচ্ছে হলেই শিল্প দেখায় রক্ত মাখায় এই কবিতা!
এমন অজস্র পঙক্তি নির্ভুল নিশানায় আমার চুলের কাছে ফেরার বাতাসের মতো স্পর্শ করে যায় আমাকে। আমিও সেদিনের ঝঞ্ঝাপীড়িত মেঘলা আকাশের দিকে তাকিয়ে কবির সঙ্গে গলা মিলিয়ে বিড়বিড় করি :
মেঘেরও রয়েছে কাজওকে ছুটি দাওওকে দিয়ে দাও ওর কালো আমব্রেলাটি,ফিরে যাক ও তার তল্লাটে!
তারপর আমার কব্জির নীল ডায়ালের তারার থেকে মুখ তুলে দেখতে পাই যেন খুব পরিচিত একটি দৃশ্যকুসুম :
তোমার কথার মতো নরম সবুজকেকগুলি পড়ে আছে একটি পিরিচেতোমার চোখের মতো কয়েকটি চামচ!তোমার হাসির মতো উড়ছে চাইনিজ পর্দা রেস্তোরাঁয়...
আবুল হাসানের এই নিবিড় এবং আত্মগত কবিতাগুলো পড়তে পড়তে, তাঁর শৈশব ও শিল্প, প্রেম ও প্রতিনির্জন, মেঘ ও ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের মিসট্রেসের বৃত্তান্তগুলি পড়তে পড়তে, তাঁর মাতৃভূমির মতো অসহায় মা এবং বৃষ্টি চিহ্নিত ভালোবাসার ব্যক্তিগত পোশাকগুলির কথা পড়তে পড়তে, আমার দিকে জ্যোৎস্নাসিক্ত নির্জন সাইকেলের মৃদু ঘণ্টাধ্বনির মতো বারবার ফিরে ফিরে আসে একটি অনপেক্ষ দীর্ঘনিঃশ্বাস :
পাখি হয়ে যায় এ প্রাণ ঐ কুহেলী মাঠের প্রান্তরে হে দেবদূত!
আহা, কী অপূর্ব!!
.
জাপানি সংস্কৃতির মতো অভিনব সংস্কৃতি এই দুনিয়ায় আর একটা নেই। চারুশিল্প কিংবা সৃজনশিল্পের হরেক নমুনা তো পৃথিবীতে রয়েছে। অঙ্কন, স্থাপত্য, ভাস্কর্য, আরো কত কি। কিন্তু, ফুল সাজানোর শিল্প “ইকেবানা”, কিংবা বড় গাছকে উদ্ভিদবিদ্যাগত উপায়ে ছোট সাইজের বানিয়ে ফেলার শিল্প “বনসাই”, কিংবা ভাঁজ-করা পাতলা কাগজের হাতপাখার উপর সূক্ষ্ম উডব্লক-প্রিন্ট ও ক্যালিগ্রাফি করার শিল্প “সেনসু”, এসব জিনিস জাপানিরা ছাড়া আর কেউ ভাবতে পারেনি। সামান্য চা খাওয়াকেও তারা একটা সৃজনশিল্প বানিয়ে ফেলেছে। কিন্তু সেই ছোটবেলা থেকে তাদের যে-শিল্পটা আমাকে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করে তার নাম “অরিগামি”।
ছোটবেলায় ইশকুলে পড়ার সময় কাগজের নৌকা কিংবা কাগজের এইরোপ্লেইন কে না বানিয়েছে? কিন্তু তবু, কাগজ ভাঁজ করে যে আরো কত কত জিনিস বানানো যায়, এই বিষয়টার ব্যাপ্তির আন্দাজ আজকের দিনেও খুব বেশি মানুষের নেই। ১৯৮০ সালে (বইটা যখন প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল) তো আরো ছিলো না। নারায়ণ সান্যাল একজন আশ্চর্য মানুষ ছিলেন। কতো ভিন্ন ভিন্ন বিচিত্র বিষয়ে যে তিনি কেতাব লিখেছেন! (আচ্ছা, তাঁর ব্যাপারে আরেকদিন বলা যাবে)। তাই বলে “অরিগামি” বিষয়েও বই লিখেছেন তিনি, ভাবা যায়? এলেবেলে বই নয়, রীতিমত বিস্তারিত গবেষণাসমৃদ্ধ বই। যেখানে নিজের হাতে ছবি এঁকে এঁকে তিনি শিখিয়েছেন অরিগামি মডেল বানাবার উপায়। আজকের দিনে ইউটিউবের কল্যাণে এই বইটির মূল্য হয়তো আর কিছুই নেই। কিন্তু আজ থেকে অনেক বছর আগে (ভুলে গেছি কত বছর আগে) আমি যখন প্রথম এই বইটির সংস্পর্শে এসেছিলাম, একটা সম্পূর্ণ অজ্ঞাত আনন্দময় জগতের দরজা খুলে গেছিলো আমার সামনে!
শুধুমাত্র একটুকরো কাগজ দিয়ে কি কি জিনিস বানানো সম্ভব? মাছ, উড়ন্ত ঈগল, শুকরছানা, উড়ন্ত সারস পাখি, টিয়াপাখি, পেলিক্যান, রাজহংস, বাইসন, মোরগ, কুকুর, সিংহ, অক্টোপাস, ব্যাঙ (যেটা আবার নাচেও), ঘোড়ায় চড়া বেদুইন, ময়ূর (যার পুচ্ছটি গুটিয়েও রাখা যায়), দাড়িয়ালা রামছাগল, আরো অনেক অনেক অনেক কিছু। এমনকি, পৃথিবীর সর্বকালের শ্রেষ্ঠ অরিগামি-মাস্টার বলা হয় যাঁকে, সেই আকিরা যোশিযাওয়া, কাগজ ভাঁজ করে নিজের সেল্ফ-পোর্ট্রেট বানিয়েছিলেন! এখানে একটা কথা জানিয়ে রাখা আবশ্যক। অরিগামি মানে কিন্তু শুধুই কাগজ-ভাঁজ-করা। কোনো আঠার ব্যবহার নয়, কাঁচির ব্যবহার নয়। শুধু একটুকরো কাগজ, দুটো হাত, আর উৎসাহ। এর বাইরে কিছু ব্যবহার করলে সেটাকে অরিগামি বলা যাবে না।
একসময় খুবই উৎসাহিত ছিলাম অরিগামি নিয়ে। ইশকুলের বার্ষিক প্রদর্শনীতে সবাই যখন সেই একঘেঁয়ে থোড়-বড়ি-খাড়া সায়েন্স-মডেল, ইলেকট্রনিক্স মডেল, থার্মোকলের মডেল, কিংবা দেশলাই কাঠি দিয়ে আল্পনার মডেল বানাতো, তখন, বলতে একটু লজ্জাই লাগছে, রঙিন কাগজ দিয়ে বানানো আমার অরিগামি মডেলগুলো দেখতে সবচেয়ে বেশি মানুষ ভিড় করতো। এখন আর ততটা উৎসাহ নেই। কিন্তু পুরোনো বই গোছাতে গিয়ে আজকে সকালে যখন এই বইটা হাতে পড়লো, দমকা হাওয়ার মতো চোখের সামনে ভেসে এলো : ঘরময় লাল-নীল-হলুদ-সবুজ কাগজের টুকরো ছড়িয়ে রয়েছে, সারাটা দুপুরবেলা আমি মগ্ন হয়ে ভাঁজ করে বানাবার চেষ্টা করছি একটা কাগজের কাঠবেড়ালি। বিকেলবেলা মা আমার ঘরে ঢুকে কাঠবেড়ালিটা দেখে বেশি খুশি হলো নাকি আমার খুশিতে উজ্জ্বল মুখটা দেখে, বলা মুশকিল।
বই নিয়ে আমাদের প্রায় সবারই কমবেশি রোমান্টিকতা আছে। কেউ হয়তো কাগুজে বই পড়তে পছন্দ করেন, কেউ ইবুক, কেউ বা কাজের ফাঁকে অডিওবুক। একটা বই পড়ার পরে আমরা সেই বইটির বিষয়বস্তু এবং আঙ্গিক নিয়ে চিন্তাভাবনা করি। বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনা করি। গুডরিডসে/ফেসবুকে রিভিউ লিখে আমাদের ভালোলাগা/মন্দলাগার কথা আরো পাঁচজনকে জানাই। কেউ কেউ ইউটিউবে ভিডিও বানিয়ে বইটির ব্যাপারে কথা বলি। কিন্তু সবকিছুর বাইরে গিয়ে, শুধুমাত্র “বই” নামক বস্তুটিকে নিয়ে কতোটা চিন্তা করি? বইয়ের প্রচ্ছদ, কাগজ, হরফের রকমসকম, বাঁধাই, অলংকরণ— পাঠক হিসেবে আমাদের অবচেতনে এই বিষয়গুলো ঘোরাফেরা করে হয়তো, কিন্তু বইয়ের নির্মাণগত দিকটি নিয়ে আমরা প্রায় কেউই সচেতনভাবে চিন্তা করিনা।
কীভাবে তৈরি হয় একটা বই? একটা বইয়ের “বই” হয়ে ওঠার পিছনে সবটুকু দায় কি লেখকের? নাকি প্রকাশকও সেই দায়ের ভাগীদার? বইটি যিনি মুদ্রণ এবং বাঁধাই করলেন, তিনি ভাগীদার নন? বইয়ের পৃষ্ঠাগুলো যিনি ডিজাইন করলেন? যিনি অখণ্ড মনোযোগ দিয়ে প্রুফ সংশোধন করলেন? এমনকি, বইটি যিনি বিক্রি করলেন, তিনি?
একজন খ্যাতনামা প্রকাশক গ্রন্থনির্মাণকে বলেছিলেন “অদৃশ্য শিল্প”। বইতে ত্রুটি বিচ্যুতি থাকলে সেগুলো আমাদের চোখে পড়ে এবং আমরা বিরক্ত হই (বেশি বিরক্ত হলে সোচ্চার হই)। কিন্তু ত্রুটির পরিমাণ যখন কম থাকে কিংবা বইটির পরিবেশনগত গুণমান যখন আমাদের পছন্দসই হয়, আমরা কিন্তু প্রায় কখনোই বলিনা, আহ, বইয়ের হরফগুলো দেখতে কী সুন্দর! বইয়ের কাগজের রংটা চোখের পক্ষে কী আরামদায়ক! পৃষ্ঠার লে-আউটটা কী চমৎকার! অথচ কেউ-না-কেউ যত্ন নিয়ে এইসব ভেবেছেন এবং তাঁর ভাবনাকে গ্রন্থটি নির্মাণের কাজে প্রয়োগ করেছেন। এটা জেনেও যে, তিনি তাঁর পরিশ্রমের কাঙ্ক্ষিত মর্যাদা পাবেন না। সেই জন্যই, গ্রন্থনির্মাণ একটি “অদৃশ্য শিল্প”।
যদিও অনেকেই কিন্তু “বই” নিয়ে ভাবছেন। মুদ্রণসৌষ্ঠবকে আরও পাঠকবান্ধব করার জন্য মাথা ঘামাচ্ছেন। নতুন নতুন টাইপফেস (আমরা যাকে খানিকটা ভুল করে “ফন্ট” নামে ডাকি) ডিজাইন করছেন। বইনির্মাণের সঙ্গে যুক্ত হাজারো খুঁটিনাটি বিষয়ে প্র্যাকটিকাল উদ্যম ব্যয় করছেন। এই বইটির ���েখক তেমনই একজন মানুষ। বইয়ের ৩৮টি ছোট ছোট প্রবন্ধে তিনি পাঠকের সামনে উন্মোচন করেছেন একটি অদৃশ্য দিগন্ত। যে-দিগন্তে আমরা প্রতিনিয়ত ঘুরেফিরে বেড়াই, অথচ চোখ মেলে তাকাই না।
বইটা পড়ে আমি প্রভূত আনন্দলাভ করেছি। এতোটাই যে, ইচ্ছে করেই একটানা পড়িনি, যাতে শেষ না হয়ে যায়। কত যে আকর্ষণীয় এবং অভিনব তথ্যে ভরপুর এই বইয়ের পৃষ্ঠাগুলো! একটা উদাহরণ দিই। “প্যানগ্রাম” কাকে বলে আমরা অনেকেই জানি। কোনো ভাষায় লেখা সাধারণত অর্থবহ এমন একটি বাক্য, যাতে সেই ভাষার বর্ণমালার যাবতীয় অক্ষরসমূহ স্থান পায়। ইংরিজি ভাষার সবচেয়ে পরিচিত প্যানগ্রামটি আমরা সবাই জানি :
The quick brown fox jumps over a lazy dog.
এই বাক্যটিতে A থেকে Z সবকটা অক্ষর আছে। কিন্তু বাংলা ভাষারও যে প্যানগ্রাম আছে তার ব্যাপারে আমি অন্তত এতোদিন কিছুই জানতাম না। এই বইতে উল্লেখিত দুটো বাংলা প্যানগ্রামের একটা :
বিষন্ন ঔদাসীন্যে ঊষাবৌদি বাংলা ভাষায় প্রচলিত ঈশপের নিখুঁত গল্পটির অর্ধেক বলতেই ঋতু ভুঁইঞা আর ঐন্দ্রিলা দারুণ হৈ হৈ করে উঠল— ওঃ, ব্যাস্, এবার থামো! বুঝেছি, বড্ডো পুরানো ঢঙের কেমন এক গল্প যার নীতিবাক্য হল— ‘মূঢ় আড়ম্বর ও আত্মশ্লাঘার ফল জীবনে বিঘ্ন ও বৃহৎ ক্ষতি'— তাই না, অ্যাঁ?
(প্যানগ্রামটি তৈরি করেছেন মনোজকুমার মিত্র)
“বই” নামক অতিপ্রিয় বস্তুটির হালহদিশ জানবার এমন বই বাংলা ভাষায় এখনও পর্যন্ত আমার চোখে পড়েনি। ইংরিজিতেও আছে কি? বাংলা হোক বা ইংরিজি, কারো জানা থাকলে দয়া করে আমাকে জানাবেন।
পুনশ্চ : প্রতিক্ষণ প্রকাশনীর বইয়ের গুণমান এমনিতেই সুরুচিসম্পন্ন হয়; কিন্তু বিষয়বস্তু এবং সৃজনশীল নির্মাণ— দু'দিক দিয়েই বইটি এত দুর্দান্ত, হাতে নিলে আর নামিয়ে রাখতে ইচ্ছে করেনা!
‘Until one has some kind of professional relationship with books one does not discover how bad the majority of them are. In much more than nine cases out of ten the only objectively truthful criticism would be, “This book is worthless”...The best practice, it has always seemed to me, would be simply to ignore the great majority of books and to give very long reviews... to the few that seem to matter.'
Amen.
.
নিখাদ বিনোদনের উদ্দেশ্যে হোক কিংবা প্রতিবাদের উদ্দেশ্যে, উজ্জীবিত করার উদ্দেশ্যে হোক কিংবা প্ররোচিত করার উদ্দেশ্যে, শিল্প হিসেবে নাটক পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন একটি মাধ্যম। কিন্তু নাটকের একটা মৌল প্রতিবন্ধকতা আছে। পৃথিবীর সর্বত্র থিয়েটারের ঐতিহ্য মোটাদাগে দুই ভাগে বিভক্ত। লোকনাট্য (বা গ্রামীণ থিয়েটার) আঙ্গিক হিসেবে খুবই আকর্ষণীয়। এতে গ্রামের মানুষের সুখ-দুঃখের বর্ণনা কিছু-কিছু থাকে বটে, কিন্তু তার চেয়েও বেশি প্রাধান্য পায় রাজা-রানি, দেব-দেবী কিংবা পৌরাণিক বৃত্তান্ত। এসবের সঙ্গে গ্রামের সাধারণ মানুষের ব্যক্তিজীবনের খুব বেশি সম্পর্ক নেই। অন্যদিকে শহুরে থিয়েটার অনেক বেশি সফিস্টিকেটেড এবং কৃত্রিম।
ধরা যাক শহরের শীতাতপনিয়ন্ত্রিত প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শিত হচ্ছে চমৎকার একটি নাটক যার বিষয়বস্তু হলো : রাজনৈতিক পেশীশক্তির বিরুদ্ধে সর্বহারা কৃষকদের জাগরণ। এখন প্রশ্ন হচ্ছে... বুঝতেই পারছেন প্রশ্নটা কী। যারা নাটকটি দেখছেন তাদের মধ্যে “সর্বহারা কৃষক” আছেন কয়জন? গণজাগরণের নাটকের দর্শকাসনে “গণ”-দের বদলে বসে থাকেন শৌখিন মজদুরেরা। সুতরাং লোকনাট্য হোক কিংবা শহুরে থিয়েটার, যবনিকা নেমে যাওয়ার পরে আদপে বেশিরভাগ নাটকই, শুনতে খারাপ লাগলেও বলতে হয়, অশ্বডিম্ব প্রসব করে। আর নাটকের ক্ষেত্রে “art for art's sake” বাহানাটা খাটেনা। কারণ অ্যাজেন্ডা-বিহীন নাটক আর গুলিবিহীন বন্দুক একই জিনিস।
গ্রামের নাটক এবং শহরের নাটক ছাড়া তৃতীয় কোনো বিকল্প নাটক কি নির্মাণ করা সম্ভব? যার মধ্যে একইসঙ্গে থাকবে লোকনাট্যের মেঠো আবেদন এবং শহুরে থিয়েটারের কারিগরি সফিস্টিকেশন? যেখানে গণদের নাটক দেখার সুযোগ পাবে স্বয়ং গণরাই? সারা পৃথিবীর নাট্যকর্মীরা নাটকের এই সমস্যা সমাধানের কথা ভেবেছেন। ভারতীয় নাট্যকারদের মধ্যে বাদল সরকার শুধু চিন্তাভাবনার মধ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি, তৃতীয় বিকল্পটিকে সফলভাবে প্রয়োগ করে দেখিয়েছিলেন। বিকল্প নাট্যধারাটির নাম দিয়েছিলেন— কোনো ধানাইপানাই ছাড়াই—“থার্ড থিয়েটার”। যেখানে মঞ্চ নেই, প্রপস্ নেই, পশ্চাৎপট নেই, স্পটলাইট নেই, সাজ-সরঞ্জাম নেই, মেকআপ নেই। আছে শুধু অভিনেতারা, আর আছে দর্শকরা (সেই প্রকৃত “গণ” দর্শকরা যাদের জন্য নাটকটি লেখা হয়েছে)। যেখানে দর্শককে টিকিট কেটে নাটকের কাছে যেতে হয় না, নাটকই পৌঁছে যায় দর্শকের দোরগোড়ায়। তাঁর আত্মজীবনীমূলক বই “পুরোনো কাসুন্দি”তেও বারবার দেখতে পাই তাঁর এই সোজাসাপ্টা ভঙ্গিটি। বাদল সরকারের নাম শুনলে যে-তিনটি শব্দ সবার আগে মাথায় আসে : অকপট, জেদি এবং সুরসিক!
বইটি একটানা লেখেননি তিনি। পাঁচটি পর্যায়ে বিভক্ত এই বইটির প্রতিটি পর্যায় লেখার মাঝে ছিল অনেকদিনের বিরতি। ফলে কিছু পুনরাবৃত্তি আছে। কিন্তু লেখকের অসামান্য রসবোধ এবং চাঁছাছোলা এক্সপ্রেশনের কারণে কখনোই লেখাটা ঝুলে যায়নি। উত্তর কলকাতার বনেদি পরিবারের সন্তান ছিলেন, কিন্তু তাঁদের পরিবার যে খ্রিস্টান ছিল এটা আমি আগে জানতাম না! প্রকৃত নাম সুধীন্দ্র, কিন্তু বেছে নিয়েছিলেন সাদামাটা ডাকনাম “বাদল”। শিবপুর কলেজের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র ছিলেন, পেশায় ছিলেন টাউন প্ল্যানার, কিন্তু বৃদ্ধ বয়সে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব নিয়ে পড়াশুনা করবেন বলে। সারা পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষা থেকে উপাদান নিয়ে তৈরি হয়েছিল একটি খিচুড়ি ভাষা, নাম “এসপেরান্তো” (Esperanto)। এই অভিনব ভাষাটির বিশেষজ্ঞ ছিলেন তিনি। সুতরাং দেখতে পাচ্ছি, শুধু থিয়েটারি ক্ষেত্রে নয়, গোটা জীবনটাই যেন ব্যয় করেছিলেন বিকল্প পথের সন্ধানে।
আত্মজীবনীতে একই সঙ্গে পাই চল্লিশ-পঞ্চাশ-ষাটের দশকের কলকাতার সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক পরিমন্ডলের এক বিচিত্র বর্ণনা। একদিকে সুকুমারী ভট্টাচার্যকে নিজের লেখা নাটক পড়তে দিচ্ছেন, আরেকদিকে জুতোর সুকতলা খুইয়ে কমিউনিস্ট পার্টির ট্রেড ইউনিয়ন শাখায় কাজ করছেন। পরবর্তীকালে স্রেফ জেদের বশে লন্ডনে গেলেন টাউন প্ল্যানিং নিয়ে ডিগ্রি অর্জনের জন্য। পাশ করার পরে চাকরি করতে গেলেন নাইজেরিয়াতে! সরাসরি স্বীকার করেছেন, জাঁ পল সার্ত্র-এর প্রবন্ধ পড়ে অস্তিত্ববাদের কিছুই বোঝেননি, যা বোঝার বুঝেছেন সার্ত্রের নাটক পড়ে। কিংবা “মিথ অভ সিসিফাস পড়তে শুরু করেছিলাম, কিন্তু শেষ করতে পারিনি। পরে প্লেগ উপন্যাসটা পড়ে মনে হয় আর সিসিফাস পড়ার প্রয়োজন নেই”। সার্ত্রের মতোই তাঁরও অভিমত : কমিউনিস্ট পার্টিই সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সবচেয়ে বড়ো শত্রু।
আত্মজীবনীর শেষ পর্যায়ে বাংলাদেশ ভ্রমণের বৃত্তান্ত আছে। ঢাকা, রাজশাহী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, ময়মনসিং, খুলনায় নাটকের ওয়ার্কশপ করিয়েছেন। বাংলাদেশ ঘুরে তাঁর মনে হয়েছিল সারা দেশের মধ্যে রাজশাহী ইউনিভার্সিটির ছাত্র-অধ্যাপকরা সবচেয়ে প্রগতিশীল। এত যে নির্ভিক মানুষ, সেই তিনিই ঢাকা শহরে পরিচিত এক মহিলার সঙ্গে রিকশায় বসে যেতে অস্বস্তি বোধ করেছেন (কারণ তিনি শুনে এসেছেন ঢাকায় নাকি নারী-পুরুষ একসঙ্গে রিকশায় বসেনা)। পরে সেই মহিলার ধমক খেয়েছেন : “কেউ কিছু মনে করবে না!” যাই হোক, সবশেষে বলতে হয়, বাদল সরকারের কোনো সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারী নেই। বিংশ শতাব্দীর বহুমুখী-প্রতিভাসম্পন্ন ক্ষণজন্মা বাঙালি প্রজন্মের অন্যতম শেষ উদাহরণ তিনি। প্রসেনিয়াম থিয়েটারের পোক্ত দেওয়াল ভেঙে থিয়েটারকে নিয়ে যাবেন মাঠে ঘাটে পথে প্রান্তরে হাটে বাজারে চৌরাস্তার মোড়ে (কেবল কথার কথা নয়, একদম আক্ষরিক অর্থে)— এমন বুকের পাটা এখন আর কার আছে? নাট্যমঞ্চের শীতল অন্ধকার প্রকোষ্ঠ থেকে বের করে এনে নাটককে তিনি ঝলমলে দিনের আলোর মাঝে মুক্ত করে দিয়েছিলেন! প্রকৃত “পাগলা ঘোড়া” তো আসলে তিনি নিজেই!
“পরে যখন একটু নামডাক হয়েছে, অনেকে প্রশ্ন করেছেন— সিনেমায় কিছু করবার ইচ্ছে বা চেষ্টা আছে কি না। সোজা বলে দিয়েছি— না, নেই। আরো কথা বাড়ালে বলেছি, কিছু লোকের তো থিয়েটারে থাকা দরকার!”
শুরুতেই আপনি আমাকে পাগল ভাববেন না।শুরুতে পাগল ভাবলে আমার গল্পটা আপনি মন দিয়ে শুনবেন না।
একজন স্কিৎজোফ্রেনিক সাইকোপ্যাথের মনোলগের ভঙ্গিতে এমন একটা উপন্যাস যে লিখেছিলেন হুমায়ূন আহমেদ, অবশেষে এটা জেনে বেশ আশ্চর্য হয়েছি।
এই জটিল মানসিক ব্যাধির প্রায় নিখুঁত বর্ণনা দিয়েছেন তিনি। গল্পে কিছু নাটকীয়তা আছে; তবে এটাও ঠিক যে সাইকোপ্যাথদের মনের ভিতরে নাটকের তো সত্যিই অভাব নেই!
স্বভাবসিদ্ধ গতিময় ভাষায় এমন অভিনব একটি বিষয় নিয়ে লেখা চমৎকার উপন্যাসটি হুমায়ূন আহমেদের অন্যতম স্মরণীয় সৃষ্টি হয়ে থাকবে আমার কাছে। খুবই চমকপ্রদ!
আমি তিনদিন আগেও তর্ক করেছি বন্ধুদের সঙ্গে। অমুক রাজনৈতিক নেত্রীকে যদি সরিয়ে দেওয়া হয় তাহলে তমুক রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসার সুযোগ পেয়ে যাবে। অমুকের চেয়ে তমুক তো আরো বেশি ক্ষতিকর! রাত দখলের মিছিল করার কি আদৌ কোনো প্রয়োজন ছিল? বাজারে এতো গুজব ছড়াচ্ছে কারা? কী উদ্দেশ্যে? মেয়েটির হাত নাকি চেপে ধরে রেখেছিল আরেকটি মেয়ে (অর্থাৎ আরেকবার প্রমাণিত হলো যে মেয়েরাই মেয়েদের শত্রু)। তথ্যপ্রমাণ ছাড়া কোনোকিছু মেনে নিতে রাজি নই আমি। আমি তো মূলত একটি অরাজনৈতিক প্রাণী, তাই আমার চিন্তাভাবনা নির্মোহ। ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি।
কিন্তু এটা মেনে নিতে দ্বিধা নেই যে বুকের ভিতরে কেউ একজন হাতুড়ি পিটিয়ে যাচ্ছিল ক্রমাগত। সমস্ত রাজনৈতিক তরজা আর লাভ-ক্ষতির হিসেবের বাইরে সেই হাতুড়ির দুম দুম দুম শব্দ শয়নে স্বপনে জাগরণে শুনতে পারছিলাম আমি। ধর্ষণের যেটুকু বর্ণনা, অত্যাচারিতার প্রাণহীন শরীরের যেটুকু বিবরণ, পোস্ট-মর্টেম ঘরের পিচ্ছিল দেয়াল ভেদ করে বাইরে এসেছে, নীতি-আদর্শের ছাল-বাকলা ছাড়িয়ে আমার তর্ক আর যুক্তিগুলো ক্রমশ অর্থহীন হয়ে যাচ্ছিল। ঘরে বাইরে অফিসে বাজারে সদরে অন্দরে আমি শুধু কল্পনা করার চেষ্টা করে গেছি, ওই জায়গায় আমি নিজে থাকলে ঠিক কেমন লাগতো? তার জায়গায় আমি শুয়ে থাকলে? ধরা যাক আমার পা দুটোকে কেউ...
আমার পক্ষে সম্ভব নয় যদিও, এই চিন্তাকে পূর্ণতা দেওয়া। আমার পৌরাণিক যৌনাঙ্গটি বাধা সৃষ্টি করে নিজেকে একজন নারীরূপে কল্পনা করতে। আমি কিছুতেই নিজেকে নিচে-শুয়ে-থাকা-অবস্থায় কল্পনা করতে পারিনা। আমি তো পুরুষ। আমি ভালোবাসতে পারি, কিংবা ধর্ষণ করতে পারি, কিন্তু কখনোই নিচে শুয়ে থাকতে পারিনা। আমি তো পুরুষ। প্রেম কিংবা প্রয়োজন কিংবা পৌরুষপ্রদর্শন— আমি সবসময়ই উপরে থাকি।
তাই নিচে শুয়ে থাকার, শারীরিক কিংবা মানসিকভাবে ছিন্নভিন্ন হওয়ার, বাসে ট্রেনে ভিড়ের মাঝে অশ্লীল স্পর্শলাভ করার, পথে ঘাটে ইভ-টিজড হওয়ার, কর্মক্ষেত্রে উপরওয়ালার অবাঞ্ছিত অস্বস্তিকর “অ্যাটেনশন” সামলানোর, নিজের স্বাভাবিক জৈবিক শরীরী আকাঙ্ক্ষার উন্মোচনে “বেশ্যা” খেতাব লাভ করার, স্বামীর দ্বারা যথেচ্ছ ব্যবহৃত হওয়ার জন্য “বিবাহ” নামক লাইসেন্স প্রদান করার, পারিবারিক সদস্যের দ্বারা যৌনলাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনাকে লোকলজ্জার ভয়ে সারাজীবন গোপন রাখতে বাধ্য হওয়া, সমাজের তুলাদণ্ডে নিজেকে প্রতিনিয়ত পুরুষের বাটখারায় মাপতে বাধ্য হওয়া— এই সবকিছু সবকিছু সবকিছু জানতে হলে আমাকে তাকিয়ে থাকতে হয় একজন সুচিত্রা ভট্টাচার্যের দিকে, একজন আশাপূর্ণা দেবীর দিকে, একজন মহাশ্বেতা দেবীর দিকে, একজন ইসমাত চুঘতাইয়ের দিকে, একজন সিলভিয়া প্লাথের দিকে, একজন জেন অস্টেনের দিকে। কোনো পুরুষ লেখক (যতোই শক্তিশালী হোক না তাঁর কলম) নিজের পুরুষাঙ্গের বিপুল ওজন উপেক্ষা করে কিছুতেই বিশ্বাসযোগ্যভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারেন না মেয়েদের যাপনচিত্রের যাবতীয় বে-দাগ বে-রং বে-জুবান কালার-কম্বিনেশনগুলোকে। একজনও না!
তাহলে আমার মতো কল্পনাশক্তির অ্যানিমিয়ায় ভোগা মানুষের পক্ষে কীভাবে সম্ভব সেই মেয়েটির জায়গায় নিজেকে চিন্তা করা? কীভাবে চিন্তা করবো একজন মেয়েকে যখন টালিগঞ্জ মেট্রো স্টেশনের সামনে ভরসন্ধ্যেবেলায় শত শত মানুষের চলমান দৃষ্টির সামনে শারীরিকভাবে লাঞ্ছনা করা হয়? কী চলে তখন সেই নারীটির মনে? ঝড়? সাইক্লোন? বন্যা? নাকি ধ্বস? নাকি শূন্যতা? এই অপমানের সমতুল্য কিছুই তো খুঁজে পাইনা নিজের জীবনে। পাশাপাশি রেখে বিচার করার মতো কিছুই খুঁজে পাইনা! সুচিত্রা ভট্টাচার্য লিখে না গেলে এই পাহাড়প্রমাণ অপমানের অস্তিত্বই থাকতো না আমার চেতনায়।
আজ যখন ঘটে গেছে আরেকটা পাহাড়প্রমাণ অপমানের ঘটনা (যেটা আবারও আমার কাছে দুর্বোধ্য মনে হচ্ছে, কারণ আমি কিছুতেই নিজেকে তার জায়গায় কল্পনা করতে পারছি না), কলেজজীবনে হোস্টেলে বন্ধুদের সঙ্গে মধ্যরাত্রে বসে বিস্ফারিত চোখে দেখা পর্নোগ্রাফিগুলো আমাকে ধিক্কার জানাচ্ছে। রাস্তা ঘাটে উপভোগের দৃষ্টিতে কতোই তো দেখেছি নারীশরীরের সৌন্দর্য, আজ তারা বুমেরাংয়ের মতো আমাকে প্রত্যাঘাত করে যাচ্ছে। কতোই তো নারীইঙ্গিতবাহী গালি দিয়েছি জীবনে (কারণ নারীর অনুষঙ্গ জড়িয়ে না-থাকলে খিস্তি মেরে সুখ পাওয়া যায় না)— মাদারচোদ, বাঞ্চোত, খানকিমাগী, চুতমারানি, গুদমারানি— কিংবা আরো “পরিশীলিত” (কারণ ভাষা ইংরিজি)— মাদারফাকার, সান অভ আ বিচ।
সেই যাবতীয় গালিগালাজ আজ আমার দিকে ধেয়ে আসছে দশগুণ তীব্রতায়। আমার যাবতীয় রাজনৈতিক আর সামাজিক তর্ক আর যুক্তি আর বিচার আর প্রজ্ঞাকে ন্যাতানো বিস্কুটের মতো মনে হচ্ছে। কারণ পুরুষ হিসেবে আমি নাকি অনেক কিছু করতে পারি, যেহেতু আমার আছে অসীম ক্ষমতাবান একটি পুংলিঙ্গ। এই পৃথিবী নাকি পুরুষের। বীরভোগ্যা বসুন্ধরা! (“বসুন্ধরা” একটি স্ত্রীলিঙ্গবাচক শব্দ, সুতরাং বীর মানেই পুরুষ— “বীরপুরুষ”! আর ভীতুরা সবাই “pussy”!) আমি নাকি সব পারি কিন্তু কিছুতেই একটা নারীর জায়গায় রেখে নিজেকে কল্পনা করতে পারিনা। গত পাঁচ দিন ধরে চেষ্টা করেও পারছি না। কোনোদিন পারবো না। আজকে সকালে দৈনিক পত্রিকার পৃষ্ঠায় দেখলাম আমার এই আজন্মলালিত পৌরুষের প্রতি লিখেছেন গায়ক-সাংবাদিক অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায় : যদি একজন্ম-দুইজন্ম বলে কিছু থাকে, তবে যেন পরজন্মে কুকুর হয়ে জন্মাই। যেন চেরা কামুক জিভ হয় আমার, যেন নির্বীর্য, পঙ্গু হয় শিশ্নদণ্ডটি। নারীজন্মের অপমান যেন গিলে খায় পুরীষ পুরুষজন্মকে। যে-অহংকার পুরুষাঙ্গ দিয়েছে আমাকে, সে যেন মাথা তুলে আর দেখতে না পায় এই তপ্ত তমসার ভুবনকে।
যদি বলি পুরুষ হিসেবে আজকে আমার লজ্জা লাগছে— আমার এই ঢঙের লজ্জা ধুয়ে কি জল খাবে সেই মেয়েটি! সেই মেয়েরা! সব মেয়েরা!
“দিনদুপুরে নিলামডাকে বিকিয়ে গেছে পাড়া
আমিও শুধু একলা বসে মনোহরপুকুরে
ছিপ করেছি নিজের হাতে নিজেরই শিরদাঁড়া!”
“পাহাড়ের মানুষ মানেই সরল (পড়ুন : বুদ্ধিহীন), আবেগপ্রবণ (পড়ুন : রগচটা), সাধাসিধে (পড়ুন : অল্পে খুশি) ও অনুগত (পড়ুন : প্রশ্ন করে না, সহজে বশ্য, গৃহপালিত পশুর মতো) — সমতলের বাঙালির এই ধারণাগুলো শাসকের মতো, প্রতিবেশীর মতো নয়। এই ধারণার চাষ হতে দেখেছি প্রশাসন থেকে শুরু করে সমাজের সর্বস্তরে। এই চাষ থেকে উঠে এসেছে যে ফসল তার নাম : ক্ষোভ।”
আমার মতো সমতলের মানুষদের কাছে দার্জিলিং স্রেফ একটি শৈলশহরের নাম। দার্জিলিং তো যেকোনো হেঁজিপেজি শৈলশহর নয়, ইংরেজরা একে আদর করে ডাকতো “The Queen of Hill-stations” নামে। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের কাছে আরো গর্বের ব্যাপার হলো দার্জিলিং আমাদেরই রাজ্যে অবস্থিত। হাতে যদি দিন-তিনেকের ছুটি পাওয়া যায়, ছাপোষা বাঙালি তিনটে জায়গায় দৌড়ে যায়। দীঘার সমুদ্রসৈকত, শান্তিনিকেতন, অথবা দার্জিলিং। কিন্তু একদা যে-শৈলশহরটি ছিল পাহাড়ের রানি, সেই রানি আজ কাঙাল হয়ে গেছে। রাজনৈতিক কিংবা আর্থ-সামাজিক, যে দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই দেখা হোক না ক্যানো, অধুনা একটি দীর্ঘশ্বাসের নাম দার্জিলিং।
লেখক প্রথম দার্জিলিঙে যান কর্মসূত্রে। নিবিড় কুয়াশাঘেরা এবং স্মৃতির মলিন জলরঙে আঁকা এই শহরটিকে আপন করে নেন ধীরে ধীরে। সাধারণ বাঙালি ট্যুরিস্টের আদিখ্যেতা-মার্কা নজরের বাইরে একটা আলাদা নজরে এই শহরকে দেখতে শুরু করেন। যে শহরকে আমরা ভালোবাসি সেই শহরের সমস্যাগুলো আমরা এড়িয়ে যাই না। সেই শহরের মানুষদের আমরা “ইউজ অ্যান্ড থ্রো” হিসেবে ব্যবহার করি না। তাদের সঙ্গে মেলামেশা করি, তাদের সুখ-দুঃখ-স্বপ্ন-স্বপ্নভঙ্গের দিনলিপির সঙ্গে পরিচিত হই। এক অনবদ্য মুনশিয়ানায়, আন্তরিকতায়, অভিনিবেশে, লেখক এই বিরল কাজটি করেছেন। শুধু নস্টালজিয়ার রঙিন চশমাটি নাকে ঝুলিয়ে রাখেননি, হাতে রেখেছেন আরো দুটো জিনিস। একটা আয়না আর একটা আতসকাচ।
কীভাবে একটি শহর হয়ে যায় মানুষের অন্ধ ফুর্তিবাজির শিকার। কীভাবে একটি শহর হয়ে যায় ভোট-রাজনীতির ক্রমিক ক্রীড়নক। কীভাবে একটি গোটা শহরের মানুষ হয়ে যান বহিরাগত ফুর্তিবাজদের একনিষ্ঠ চাকরবাকর। কীভাবে একটি শহরের রমণীয় সৌন্দর্যের আড়ালে লুকিয়ে থাকে আত্মপরিচয়হীন অস্তিত্বের তীব্র যন্ত্রণা। কীভাবে একটি প্রজাপতির অতীত ইতিহাসজুড়ে লেখা থাকে কেবল শুঁয়োপোকার কুৎসিত দংশন। আমরা যারা একবারের জন্যেও দার্জিলিঙে গেছি, পরিমল ভট্টাচার্যের এই হতশ্রী দার্জিলিংকে কিন্তু কমবেশি আমরা সবাই চিনি। কিন্তু ফুর্তির নেশায় অন্যদিকে চোখ ঘুরিয়ে ছিলাম। সূর্যোদয়ের মনভোলানো কাঞ্চনজঙ্ঘার রূপ দেখে হুল্লোড়ে মেতে ছিলাম, তাই আপামর শহরটার ক্ষীণ কান্নার শব্দ আমাদের কানে এসে পৌঁছায়নি। লেখক আমাদের চোখ আর কান দুটোই খুলে দিয়েছেন। কিছু কিছু বই অতর্কিতে হানা দ্যায় পাঠকের সুসজ্জিত চেতনায়। এটি তেমনই একটি বই।
মধ্যযুগে রাজস্থানের রাজপুতদের ইতিহাস এমন কিছু গৌরবের ছিল না। ভারতীয়রা মোটের উপর যুদ্ধপ্রবণ মানুষ নয়, কিন্তু রাজপুতরা ছিলেন ব্যতিক্রম। যোদ্ধা বলেই হয়তো সাধারণ ছাপোষা ভীরু ভারতীয়দের মনে তারা রেখাপাত করতে পেরেছিলেন। যদিও তাদের প্রতিশোধস্পৃহা, নৃশংসতা, উগ্র জাত্যভিমান—এইসব গুণকে কিছুতেই প্রশংসার যোগ্য হিসেবে বিবেচনা করা যায় না।
অবনীন্দ্রনাথের এই বইটিকে ক্যানো যে “কিশোরপাঠ্য” হিসেবে গণ্য করা হয় সেটা ভেবে অবাক লাগে। অবনীন্দ্রনাথের ভাষায় এবং গল্প বলার কায়দায় কিছু সহজিয়া বিশেষত্ব আছে ঠিকই; কিন্তু এইরকম হিংসা, হানাহানি, নরহত্যার গ্র্যাফিক বর্ণনা পড়ে কিশোর-কিশোরীরা কীভাবে উপকৃত হতে পারে তা আমি বুঝিনা। তাছাড়া, রাজস্থানের ‘ভিল' কিংবা ‘মিনা' জনজাতিদের উপরে অত্যাচারের ঘটনাকে যেরকম “স্বাভাবিক” হিসেবে দেখানো হয়েছে, সেটাও কাঙ্ক্ষিত নয়।
সহিংসতাকে শৌর্য হিসেবে কিংবা প্রতিশোধ নেওয়াকে আত্মমর্যাদা হিসেবে বিবেচনা করা, স্বার্থসিদ্ধির কারণে যেনতেন উপায়ে শত্রুর নিধন (এমনকি নিজের ভাইকেও), প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে ‘জংলী' হিসেবে চিহ্নিত করা—নিজের ছেলেমেয়েদের যারা এইসব জরুরি বিষয়ে শিক্ষা দিতে আগ্রহী, তাদের জন্য বইটি অবশ্যপাঠ্য। বুড়োরাও যদি এইসব “বীরত্বব্যঞ্জক উপাখ্যান” উপভোগ করেন, তারাও মিস করবেন না।
মোবাইলে একটা ছবি এডিট করার ক্ষমতা নেই যার (করলেও সেই ছবির অবস্থা হয় একইসঙ্গে ভৌতিক এবং হাস্যকর), সেই আমি যদি AI-এর মতো আধুনিক সফিস্টিকেটেড তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে চিন্তাভাবনা করি, তাহলে কি মানায়? কিন্তু কী আর করা যাবে, জমানা যেদিকে এগোচ্ছে, একটু আধটু খবর না-রাখলে তো চলে না। ইউভাল নোয়াহ হারারির বইটা যদিও এতকিছু ভেবেচিন্তে কিনিনি। বরাবর এই লেখকের বই পড়তে ভালো লাগে, জানতে পারলাম তাঁর নতুন বই বেরিয়েছে, তাই কিনেছি। তো এই দফায় হারারির আলোচনার বিষয়বস্তু : A brief history of information networks from the stone age to AI.
উপরের ইংরিজি লাইনটা হলো বইয়ের উপ-শিরোনাম। প্রস্তর যুগ থেকে মানুষের দ্বারা উদ্ভাবিত এবং ব্যবহৃত বিভিন্ন information network (ভাষা, মিথোলজি, ব্যুরোক্রেসি, ধর্মগ্রন্থ, মুদ্রণযন্ত্র, বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র, সংবাদমাধ্যম, রেডিও, ইন্টারনেট, ইত্যাদি) নিয়ে আলোচনা করেছেন বটে, তবে শেষ অবধি এই বইয়ের মূল আলোচ্য বিষয় যে “আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স”, সেটা বোধহয় ইতিমধ্যে প্রায় সবাই জেনে ফেলেছেন। হারারি প্রথমে খুব ধীরেসুস্থে এবং বেশ বিশদে একদম প্রাচীনকাল থেকে শুরু করে হাল আমলের তথ্য-সম্প্রচার ব্যবস্থাগুলো নিয়ে আলোচনা করেছেন। সমাজের উপর, রাজনীতির উপর, অর্থনীতির উপর, ধর্মের উপর, সর্বোপরি ব্যক্তিমানুষের উপর ইনফরমেশনের প্রভাব নিয়েও বিশদ আলোচনা করেছেন (বইয়ের প্রায় অর্ধেক আলোচনা এইসব বিষয়ে)। কারণ পুরো ইতিবৃত্তটা খোলসা না-হলে বর্তমান সমাজ এবং সভ্যতায় AI-এর প্রভাব আমার মতো বিজ্ঞানচর্চাহীন সাদামাটা পাঠকের মস্তিষ্কে সহজে ঢুকতো না। যদিও এই বইয়ের আলোচনা যতটা না প্রযুক্তি-বিষয়ক, তার চেয়ে বেশি আর্থসামাজিক। রাজনৈতিক।
হারারির প্রতিটা বইয়ের বিশেষত্ব হলো তিনি প্রচলিত চিন্তাভাবনাকে ভেঙেচুরে একটা নতুন রূপে পাঠকের সামনে হাজির করেন। এছাড়াও, হারারির প্রথম বই (“সেপিয়েন্স”) থেকেই আরো একটা ব্যাপার খেয়াল করেছি, তিনি তীব্রগতিসম্পন্ন অনুভূতিহীন অত্যাধুনিক যন্ত্রসভ্যতাকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দ্যাখেন। তাই বলে পাঠককে পুনরায় সেই আদিম শিকারী জীবনে ফিরে যেতে উদ্বুদ্ধ করেন, এমনটা নয়। তিনি শুধু এইটা বোঝাতে চান : আধুনিক সভ্যতার ব্যাপক অগ্রগতি নিয়ে নাচন-কোদন করার আগে একটু স্থির হয়ে বসে চিন্তা করো, বৎস। যতটা আহ্লাদে ডগমগ হচ্ছ, আদৌ কি ততটাও “মানুষ” হয়ে উঠেছে হোমো সেপিয়েন্স নামক প্রজাতিটা? নাকি বহু ক্ষেত্রে নিজের পায়ে কুড়ুল মারছি আমরা? এই বইতে এমন একটি প্রযুক্তি নিয়ে আমাদের সাবধান করেছেন তিনি, যেটাকে ঠিক মতো ব্যবহার করতে না-পারলে, সম্ভবত এটাই হবে শেষবারের মতো পায়ে কুড়ুল মারা। এরপর কুড়ুলও থাকবে না, পা-ও না, পায়ের মালিকও না। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বিষয়ে হারারি ২০১৬ সালে প্রকাশিত তাঁর Homo Deus বইটিতে কিছু প্রাথমিক আলোচনা করেছিলেন বটে, কিন্তু গত আট বছরে তথ্যপ্রযুক্তির এই ক্ষেত্রটি বহু দিগন্ত অতিক্রম করে ফেলেছে।
২০২২ সালে চ্যাট-জিপিটি বাজারে আসার পর থেকে, দোকানে-বাজারে-মাঠে-ঘাটে-পথে-প্রান্তরে-ফেসবুকে-টুইটারে-ব্লগে-ভ্লগে-সংবাদপত্রের কলামে অসংখ্য মানুষ বাঁকা চোখে চাপা হেসে প্রতিনিয়ত মন্তব্য করে চলেছেন : আরে বাওয়া... মানুষের বুদ্ধি, মানুষের চেতনা, মানুষের অনুভূতি, মানুষের... ইয়ে কী যেন বলে... মৌলিক সৃজনশীলতা, এইসব আয়ত্ত করা কি অতোই সস্তা রে ভায়া? এই তো আজকে সকালেই চ্যাট-জিপিটি ব্যাটাকে দুটো সহজ প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলাম। এমন হাস্যকর উত্তর দিলো, হাসতে হাসতে কাশি পেয়ে গ্যালো। এই এলেবেলে জিনিসটা নাকি মানুষকে টেক্কা দেবে, হাহাঃ!
হারারির বইটির মূল প্রতিপাদ্য বিষয় : এই বাঁকা-হাসিওয়ালা (এবং আমার মতো যারা বাঁকা হাসে না, কিন্তু এই বিষয়ে অজ্ঞ) মানুষদের প্রকৃত বিপদটা সম্পর্কে অবহিত করা। “আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স” প্রযুক্তিটি এখনও যে-পর্যায়ে রয়েছে, তাকে মানুষের জীবনচক্রের সঙ্গে তুলনা করলে বলতে হয়, এখনও সে হামাগুড়ি দিতেও শেখেনি। হাত পা ছুঁড়ে দোলনায় শুয়ে আঙুল চুষছে আর আবাবাবাবাবা গিগিগিগিগি এইসব দুর্বোধ্য কথা বলছে। কিন্তু এই দোলনা পর্যায়েই সে নিখুঁত ছন্দে কবিতা লিখছে (অসন্দিগ্ধ পাঠকের কাছে যেগুলোকে প্রতিষ্ঠিত কোনো কবির নামে সহজেই চালিয়ে দেওয়া যায়)। ওস্তাদের মতো ছবি আঁকছে (ধরিয়ে না দিলে অনেকসময় বোঝার উপায় থাকে না সেটা কোনো বিখ্যাত চিত্রকরের আঁকা নয়)। গানের সুর সৃষ্টি করছে (এটার ব্যাপারেও একই কথা)।
শেয়ার বাজার কিংবা ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার বিপুল পরিমাণ জটিল হিসাবপত্র চোখের নিমেষে হজম করে ফেলছে। সুযোগ পেলে গোটা-গোটা প্রবন্ধ নিবন্ধ লিখে ফেলছে। অসংখ্য ধারা-উপধারা-দফা-অনুচ্ছেদ-কার্যবিধি-সংশোধনী সম্বলিত দেশের সংবিধানের খোলনলচে মুখস্ত করে ফেলছে (যেটা কোনো একক মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়)। এত বেশি পরিমাণে ফেক-টুইট কিংবা ফেসবুকে ফেক-স্ট্যাটাস পোস্ট করছে যে, ২০২২ সালের হিসেব অনুযায়ী সেইসব নকল পোস্টের সংখ্যা— দুনিয়ার সমস্ত পোস্টের শতকরা ৩০ ভাগ! মানে প্রতি তিনটে পোস্টের মধ্যে অন্তত একটা পোস্ট কোনো মানুষ লিখছে না, লিখছে একটা AI chatbot. এমনকি এই রিভিউটা আমি নিজে লিখেছি নাকি কোনো AI ওয়েবসাইট থেকে জেনারেট করা হয়েছে (পুরোটা না হলেও কিছুটা অংশ), এই ব্যাপারে পাঠকদের ১০০% নিশ্চিত হওয়ার উপায় নেই!
ঔপনিবেশিক বঙ্গদেশে উচ্চবিত্ত বাঙালি পরিবারের সামাজিক লেক্সিকনে “পশ্চিম” নামে একটি শব্দ ছিল। এই পশ্চিম দিকনির্দেশক পশ্চিম নয়, স্থাননির্দেশক পশ্চিম। তৎকালীন রাজনৈতিক মানচিত্রে বৃহত্তর বাংলাপ্রদেশের সঙ্গে বিহার রাজ্যটি যুক্ত থাকলেও, বাঙালি নিজের জাতিগত সম্ভ্রান্ত-অবস্থানের সঙ্গে সেই রাজ্যের “লিট্টিখোর খোট্টা” বিহারি মানুষ এবং সংস্কৃতিকে একই আসনে স্থান দিতে ইচ্ছুক ছিল না। তাই “পূর্ববঙ্গ” নামের একটি আঞ্চলিক ধারণা প্রচলিত থাকলেও, স্বাধীনতাপূর্ব বাঙালির মননে “পশ্চিমবঙ্গ” বলে কিছু ছিল না। ছিল শুধু “পশ্চিম”। কেবলই পশ্চিম। এর চেয়ে বেশি সম্মান দেওয়ার প্রয়োজন ছিল না।
এবং সেই অঞ্চলটি ছিল “ড্যাঞ্চি”। অর্থাৎ “damn cheap”। মানে, নেহাতই সস্তা। জলের দর। বাঙালি বাবুরা পশ্চিমে যেতেন ছুটি কাটাতে, কিংবা “হাওয়া বদল” করতে, কিংবা আমাশয়, অগ্নিমান্দ্য (বর্তমানে “অম্বল”), ক্ষুধামান্দ্য (বর্তমানে “একদম ক্ষিধে হচ্ছে না, ডাক্তারবাবু”), বদহজম-পীড়িত বাঙালির চিরাচরিত উদরসমস্যার উন্নতিকল্পে (কারণ সেই অঞ্চলের খনিজসমৃদ্ধ জল-হাওয়া ছিল ক্ষুধা এবং সুস্বাস্থ্য উদ্রেককারী)। এবং শহর কলকাতার বনেদি বাজারহাটের অগ্নিমূল্যের তুলনায় সেই পশ্চিমের দেহাতি বাজারের জিনিসপত্রের অস্বাভাবিক সস্তা দর প্রত্যক্ষ করে বাবুদের মুখ থেকে ছিটকে বেরোতো এই কথাটি : Damn cheap! উচ্চারণের বিবর্তনে কথাটি রূপান্তরিত হয় “ড্যাঞ্চি”তে। পরিমল ভট্টাচার্যের বইটি বাঙালির সেই অতীত ড্যাঞ্চিভূমির একটি অভিনব আখ্যান।
শুধু জিনিসপত্র নয়, সেই অঞ্চলের মানুষও ছিল ড্যাঞ্চি। বিহারি বাদ দিলেও, ছোটনাগপুর মালভূমির বিস্তীর্ণ জঙ্গল-অধ্যুষিত অঞ্চলটির ভূমিসন্তান ছিলেন সাঁওতাল, হো, মুন্ডা, ওরাওঁ, কোল, ইত্যাদি অসংখ্য জনজাতিরা (যাঁরা ইদানিং মূলত ঝাড়খণ্ড রাজ্যের অধিবাসী)। কিন্তু সামাজিক অবস্থানের নিরিখে নিজেদের ভূমিতেই তাঁরা ছিলেন সবচেয়ে অবহেলিত, নিপীড়িত, নির্যাতিত। যে-অঞ্চলে খাদ্যবস্তুর অস্বাভাবিক সস্তা দর দেখে বাঙালি বাবুরা Damn cheap বলে উল্লসিত হয়ে উঠতেন, সেই একই অঞ্চলের স্থানীয় মানুষদের কাঁধে নিয়মিত চেপে থাকতো খাদ্যের অনটন, দুর্ভিক্ষের জোয়াল। শোষণের এক বিচিত্র সহাবস্থানে বহিরাগত বাঙালিদের তৈরি করা সুদৃশ্য রুচিশীল বাগানবাড়িতে ভৃত্যের কাজ করতো সেই অঞ্চলের বুভুক্ষু মানুষরা।
পরিমল ভট্টাচার্যের এই ড্যাঞ্চি-আখ্যানে শুধু ছোটনাগপুর মালভূমি অঞ্চল নয়, ক্রমশ উঠে এসেছে ব্রিটিশ আমলের খাদ্যসংকটে জর্জরিত আরো অনেক মানুষের কথা। সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কবিতায় আছে : “মন্বন্তরে মরিনি আমরা মারী নিয়ে ঘর করি”। কাজী নজরুল ইসলামের কবিতায় আছে : “বাঁচিতে বাঁচিতে প্রায় মরিয়াছি, এবার সব্যসাচী, যা হোক একটা দাও কিছু হাতে, একবার ম'রে বাঁচি!” কেমন ছিল সেই ঘর? কেমন ছিল সেই ম'রে বাঁচা? বাঙালিজাতির জাতিগত উৎকর্ষের সফেদ দেয়ালে কুৎসিত ঘুঁটের মতো লেপ্টে আছে মন্বন্তরের স্মৃতিদাগ। যে-দাগ জন্মদাগের মতোই চিরন্তন। ক্রনিক চুলকানির মতো নাছোড়বান্দা। কলকাতা শহরের সুরম্য পথঘাটের আনাচে কানাচে এখনও রয়ে গেছে গগনবিদারী “একটু ভাত দিন গো”... “একটু ফ্যান দিন গো” আর্তচিৎকারের যূথবদ্ধ প্রেতাত্মারা। শিল্পীর আঁকা উডকাট ছবিতে, ফটোগ্রাফারের তোলা সাদাকালো স্থিরচিত্রে, আজও রয়ে গেছে সেই কঙ্কালসদৃশ মানুষদের অশরীরী ছায়া, জ্বলজ্বলে ক্ষুধার্ত চোখের তীব্র চাহনি।
অর্থাৎ জিনিসপত্র নয়, আসলে মানুষই বড় সস্তা। সামাজিক পিরামিডের উঁচুনিচু সহাবস্থানের নকশায় একদল মানুষ আরেকদল মানুষকে বানিয়ে রেখেছে ড্যাঞ্চি। মানুষেরই তৈরি সভ্য সমাজে মানুষ পোকামাকড়ের মতো মারা যায়, কুকুরের মতো (এবং কুকুরেরই সঙ্গে) ডাস্টবিন থেকে খাবার খুঁটে খায়, গবাদি পশুর মতো নির্বিকারে ত্যাগ করতে বাধ্য হয় নিজের মানুষিক আত্মমর্যাদা। ব্যক্তিগত স্মৃতি এবং নৈর্ব্যক্তিক ইতিহাসের পঙ্কিল ঘোলাজলে ডুবসাঁতার দিয়ে পরিমল ভট্টাচার্য তুলে এনেছেন অস্বাভাবিক সস্তা মানুষদের কতিপয় প্রত্নচিহ্ন। কখনও কলকাতা শহরের বেওয়ারিশ লাশে-ঢাকা রাজপথে, কখনও ছোটনাগপুরের রুক্ষ প্রকৃতির মাঝে, কখনও দেশভাগের অবাঞ্ছিত জারজ সন্তান উদ্বাস্তুদের কলোনিতে, কখনও ভোরবেলায় গড়ের মাঠে নকশাল বিপ্লবীর পলাতক উদ্বায়ী জীবনে, তিনি খুঁজে খুঁজে ফিরেছেন ড্যাঞ্চি মানুষদের, অবিশ্বাস্য সস্তা মানুষদের।
বিষয়বস্তুর মতোই বইটির রচনাশৈলীও অভিনব। একটি নির্দিষ্ট পথরেখা ধরে চলেনা লেখকের বর্ণনা। এমনকি ভাষাতেও যেন জড়িয়ে রয়েছে স্মৃতিচারণের উচ্ছৃঙ্খল ঘোরগ্রস্ততা। বর্তমান বাংলা নন-ফিকশন সাহিত্যে পরিমল ভট্টাচার্যের গদ্য সম্ভবত সবচেয়ে মৌলিক, সবচেয়ে সুখপাঠ্য। সেই সুখপাঠ্য গদ্যের খাঁজে লেখক অবলীলায় গুঁজে দিয়েছেন বিষাদের বেহালাকান্না। প্রকৃতির শিশিরনিবিড় বর্ণনার মাঝে হঠাৎ ছুঁড়ে দিয়েছেন আনরোমান্টিক অস্তিত্বের নিঃশব্দ হাহাকার। ছড়ানো ছেটানো এলেমেলো ইতস্তত খাপছাড়া এই রচনাশৈলী যেন মানুষেরই খাপছাড়া জীবনের দ্যোতক। যে-জীবন অন্ধকার সঙ্ঘারামে জেগে থেকে জীবনের স্রোত ভালোবাসে। যে-জীবন সোনালি রোদের ঢেউয়ে উড়ন্ত কীটের মতো খেলা করে। যে-জীবন ফড়িঙের, দোয়েলের। যে-জীবন চাঁদ ডুবে গেলে পর প্রধান আঁধারে অশ্বত্থের কাছে এক গাছা দড়ি হাতে একা-একা হেঁটে যায়।
যে-জীবন ড্যাঞ্চি। হে প্রগাঢ় পিতামহী, আজো চমৎকার?
(কলকাতার রাজপথ, ১৯৪৩ সালের মন্বন্তর।
শিল্পী: জয়নুল আবেদিন)
তাঁর লেখা চিঠিপত্র পড়লে আমার সামনে একটা ভিন্ন রূপে আত্মপ্রকাশ করেন রবীন্দ্রনাথ। চিঠি তিনি লিখেছেন বিস্তর। নিজের গহন আন্তরিক সত্তাকে চিঠির পৃষ্ঠায় যতটা উন্মোচিত করেছেন, অন্য কোথাও এতটা করেননি মনে হয় (গান বাদ দিয়ে)। মনের মতো পত্রসঙ্গী পেলে তাঁর যেন আলাদা একটা দেখার চোখ খুলে যেত, একটা আলাদা ভাবার মন আবিষ্কৃত হতো, কলমের কালির রং পাল্টে যেত।
তাঁর লেখা চিঠিপত্রগুলো খণ্ডে খণ্ডে সংকলিত হয়েছে। প্রথম এই খণ্ডটিতে রয়েছে স্ত্রী মৃণালিনী দেবীকে লেখা চিঠির সম্ভার। জীবনে অনেক নারীর সঙ্গে বিভিন্ন মাত্রায় ঘনিষ্ঠতা হয়েছে তাঁর, কিন্তু যাকে বলে ‘জীবনসঙ্গিনী', তা একমাত্র মৃণালিনী ছাড়া আর কেউ ছিলেন না।
সাধারণ আলাপ-আলোচনা-আড্ডা-বিতর্কে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কাদম্বরী দেবী, লেডি রাণু মুখোপাধ্যায়, ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণী, নির্মলকুমারী মহলানবীশ, এমনকি বিদেশিনী ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর নাম উঠে আসে অহরহ। কিন্তু এই চিঠিগুলো পড়লে বোঝা যায়, স্ত্রীর সঙ্গেও তাঁর মানসিক যোগাযোগ ছিল যথেষ্ট অন্তরঙ্গ। স্ত্রীর কাছেও মনের কথা, প্রাণের কথা, হাসি ঠাট্টার কথা, নিতান্ত ঘরোয়া কথা, কিংবা গভীর জীবনদর্শনের কথা আদানপ্রদান করেছেন তিনি।
“ভাই ছুটি” সম্বোধন করে মৃণালিনীকে লেখা চিঠিগুলোতে রবীন্দ্রনাথের একটি দাম্পত্য প্রেমিক-রূপ দেখতে পাই। স্ত্রীর জীবনাবসানের পরে স্বাভাবিকভাবেই যেটা আর কখনও কোথাও দেখতে পাওয়া যায় না। অনেক নারীর কাছে অনেকরকম ভাষায়, অনেকরকম গভীরতায়, নিজেকে প্রকাশ করেছেন বটে, কিন্তু ইংল্যান্ড যাওয়ার পথে জাহাজ থেকে কল্পনায় জোড়াসাঁকোয় গিয়ে ঘুমন্ত স্ত্রীকে “একটু আধটু আদর” করার ইচ্ছের কথা, কিংবা “অনেক হামি” খাওয়ার কথা, আর কোনো নারীকে বলেছেন বলে জানা নেই আমার (রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় জানতে পারেন)।
ব্যক্তিগত কথাবার্তা ছাড়াও এই চিঠিগুলোতে রয়েছে প্রকৃতি ও পরিবেশের (মূলত পূর্ববঙ্গের গ্রামীণ অঞ্চলের) সেই অলৌকিক বর্ণনা, যা কিনা রবীন্দ্রনাথের চিঠিপত্রের অন্যতম ট্রেডমার্ক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে।
“চারিদিকের সবুজ ক্ষেতের উপরে স্নিগ্ধ তিমিরাচ্ছন্ন নবীন বর্ষা ভারী সুন্দর লাগচে। বসে বসে মেঘদূতের উপর একটা প্রবন্ধ লিখচি। এই প্রবন্ধের উপর আজকের এই নিবিড় বর্ষার দিনের বর্ষণমুখর ঘনান্ধকারটুকু যদি এঁকে রাখতে পারতুম, যদি আমার শিলাইদহের সবুজ ক্ষেতের উপরকার এই শ্যামল আবির্ভাবটিকে পাঠকদের কাছে চিরকালের জিনিস করে রাখতে পারতুম, তাহলে কেমন হত!”
.