Ratings1
Average rating4
We don't have a description for this book yet. You can help out the author by adding a description.
Reviews with the most likes.
নিখাদ বিনোদনের উদ্দেশ্যে হোক কিংবা প্রতিবাদের উদ্দেশ্যে, উজ্জীবিত করার উদ্দেশ্যে হোক কিংবা প্ররোচিত করার উদ্দেশ্যে, শিল্প হিসেবে নাটক পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন একটি মাধ্যম। কিন্তু নাটকের একটা মৌল প্রতিবন্ধকতা আছে। পৃথিবীর সর্বত্র থিয়েটারের ঐতিহ্য মোটাদাগে দুই ভাগে বিভক্ত। লোকনাট্য (বা গ্রামীণ থিয়েটার) আঙ্গিক হিসেবে খুবই আকর্ষণীয়। এতে গ্রামের মানুষের সুখ-দুঃখের বর্ণনা কিছু-কিছু থাকে বটে, কিন্তু তার চেয়েও বেশি প্রাধান্য পায় রাজা-রানি, দেব-দেবী কিংবা পৌরাণিক বৃত্তান্ত। এসবের সঙ্গে গ্রামের সাধারণ মানুষের ব্যক্তিজীবনের খুব বেশি সম্পর্ক নেই। অন্যদিকে শহুরে থিয়েটার অনেক বেশি সফিস্টিকেটেড এবং কৃত্রিম।
ধরা যাক শহরের শীতাতপনিয়ন্ত্রিত প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শিত হচ্ছে চমৎকার একটি নাটক যার বিষয়বস্তু হলো : রাজনৈতিক পেশীশক্তির বিরুদ্ধে সর্বহারা কৃষকদের জাগরণ। এখন প্রশ্ন হচ্ছে... বুঝতেই পারছেন প্রশ্নটা কী। যারা নাটকটি দেখছেন তাদের মধ্যে “সর্বহারা কৃষক” আছেন কয়জন? গণজাগরণের নাটকের দর্শকাসনে “গণ”-দের বদলে বসে থাকেন শৌখিন মজদুরেরা। সুতরাং লোকনাট্য হোক কিংবা শহুরে থিয়েটার, যবনিকা নেমে যাওয়ার পরে আদপে বেশিরভাগ নাটকই, শুনতে খারাপ লাগলেও বলতে হয়, অশ্বডিম্ব প্রসব করে। আর নাটকের ক্ষেত্রে “art for art's sake” বাহানাটা খাটেনা। কারণ অ্যাজেন্ডা-বিহীন নাটক আর গুলিবিহীন বন্দুক একই জিনিস।
গ্রামের নাটক এবং শহরের নাটক ছাড়া তৃতীয় কোনো বিকল্প নাটক কি নির্মাণ করা সম্ভব? যার মধ্যে একইসঙ্গে থাকবে লোকনাট্যের মেঠো আবেদন এবং শহুরে থিয়েটারের কারিগরি সফিস্টিকেশন? যেখানে গণদের নাটক দেখার সুযোগ পাবে স্বয়ং গণরাই? সারা পৃথিবীর নাট্যকর্মীরা নাটকের এই সমস্যা সমাধানের কথা ভেবেছেন। ভারতীয় নাট্যকারদের মধ্যে বাদল সরকার শুধু চিন্তাভাবনার মধ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি, তৃতীয় বিকল্পটিকে সফলভাবে প্রয়োগ করে দেখিয়েছিলেন। বিকল্প নাট্যধারাটির নাম দিয়েছিলেন— কোনো ধানাইপানাই ছাড়াই—“থার্ড থিয়েটার”। যেখানে মঞ্চ নেই, প্রপস্ নেই, পশ্চাৎপট নেই, স্পটলাইট নেই, সাজ-সরঞ্জাম নেই, মেকআপ নেই। আছে শুধু অভিনেতারা, আর আছে দর্শকরা (সেই প্রকৃত “গণ” দর্শকরা যাদের জন্য নাটকটি লেখা হয়েছে)। যেখানে দর্শককে টিকিট কেটে নাটকের কাছে যেতে হয় না, নাটকই পৌঁছে যায় দর্শকের দোরগোড়ায়। তাঁর আত্মজীবনীমূলক বই “পুরোনো কাসুন্দি”তেও বারবার দেখতে পাই তাঁর এই সোজাসাপ্টা ভঙ্গিটি। বাদল সরকারের নাম শুনলে যে-তিনটি শব্দ সবার আগে মাথায় আসে : অকপট, জেদি এবং সুরসিক!
বইটি একটানা লেখেননি তিনি। পাঁচটি পর্যায়ে বিভক্ত এই বইটির প্রতিটি পর্যায় লেখার মাঝে ছিল অনেকদিনের বিরতি। ফলে কিছু পুনরাবৃত্তি আছে। কিন্তু লেখকের অসামান্য রসবোধ এবং চাঁছাছোলা এক্সপ্রেশনের কারণে কখনোই লেখাটা ঝুলে যায়নি। উত্তর কলকাতার বনেদি পরিবারের সন্তান ছিলেন, কিন্তু তাঁদের পরিবার যে খ্রিস্টান ছিল এটা আমি আগে জানতাম না! প্রকৃত নাম সুধীন্দ্র, কিন্তু বেছে নিয়েছিলেন সাদামাটা ডাকনাম “বাদল”। শিবপুর কলেজের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র ছিলেন, পেশায় ছিলেন টাউন প্ল্যানার, কিন্তু বৃদ্ধ বয়সে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব নিয়ে পড়াশুনা করবেন বলে। সারা পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষা থেকে উপাদান নিয়ে তৈরি হয়েছিল একটি খিচুড়ি ভাষা, নাম “এসপেরান্তো” (Esperanto)। এই অভিনব ভাষাটির বিশেষজ্ঞ ছিলেন তিনি। সুতরাং দেখতে পাচ্ছি, শুধু থিয়েটারি ক্ষেত্রে নয়, গোটা জীবনটাই যেন ব্যয় করেছিলেন বিকল্প পথের সন্ধানে।
আত্মজীবনীতে একই সঙ্গে পাই চল্লিশ-পঞ্চাশ-ষাটের দশকের কলকাতার সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক পরিমন্ডলের এক বিচিত্র বর্ণনা। একদিকে সুকুমারী ভট্টাচার্যকে নিজের লেখা নাটক পড়তে দিচ্ছেন, আরেকদিকে জুতোর সুকতলা খুইয়ে কমিউনিস্ট পার্টির ট্রেড ইউনিয়ন শাখায় কাজ করছেন। পরবর্তীকালে স্রেফ জেদের বশে লন্ডনে গেলেন টাউন প্ল্যানিং নিয়ে ডিগ্রি অর্জনের জন্য। পাশ করার পরে চাকরি করতে গেলেন নাইজেরিয়াতে! সরাসরি স্বীকার করেছেন, জাঁ পল সার্ত্র-এর প্রবন্ধ পড়ে অস্তিত্ববাদের কিছুই বোঝেননি, যা বোঝার বুঝেছেন সার্ত্রের নাটক পড়ে। কিংবা “মিথ অভ সিসিফাস পড়তে শুরু করেছিলাম, কিন্তু শেষ করতে পারিনি। পরে প্লেগ উপন্যাসটা পড়ে মনে হয় আর সিসিফাস পড়ার প্রয়োজন নেই”। সার্ত্রের মতোই তাঁরও অভিমত : কমিউনিস্ট পার্টিই সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সবচেয়ে বড়ো শত্রু।
আত্মজীবনীর শেষ পর্যায়ে বাংলাদেশ ভ্রমণের বৃত্তান্ত আছে। ঢাকা, রাজশাহী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, ময়মনসিং, খুলনায় নাটকের ওয়ার্কশপ করিয়েছেন। বাংলাদেশ ঘুরে তাঁর মনে হয়েছিল সারা দেশের মধ্যে রাজশাহী ইউনিভার্সিটির ছাত্র-অধ্যাপকরা সবচেয়ে প্রগতিশীল। এত যে নির্ভিক মানুষ, সেই তিনিই ঢাকা শহরে পরিচিত এক মহিলার সঙ্গে রিকশায় বসে যেতে অস্বস্তি বোধ করেছেন (কারণ তিনি শুনে এসেছেন ঢাকায় নাকি নারী-পুরুষ একসঙ্গে রিকশায় বসেনা)। পরে সেই মহিলার ধমক খেয়েছেন : “কেউ কিছু মনে করবে না!” যাই হোক, সবশেষে বলতে হয়, বাদল সরকারের কোনো সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারী নেই। বিংশ শতাব্দীর বহুমুখী-প্রতিভাসম্পন্ন ক্ষণজন্মা বাঙালি প্রজন্মের অন্যতম শেষ উদাহরণ তিনি। প্রসেনিয়াম থিয়েটারের পোক্ত দেওয়াল ভেঙে থিয়েটারকে নিয়ে যাবেন মাঠে ঘাটে পথে প্রান্তরে হাটে বাজারে চৌরাস্তার মোড়ে (কেবল কথার কথা নয়, একদম আক্ষরিক অর্থে)— এমন বুকের পাটা এখন আর কার আছে? নাট্যমঞ্চের শীতল অন্ধকার প্রকোষ্ঠ থেকে বের করে এনে নাটককে তিনি ঝলমলে দিনের আলোর মাঝে মুক্ত করে দিয়েছিলেন! প্রকৃত “পাগলা ঘোড়া” তো আসলে তিনি নিজেই!
“পরে যখন একটু নামডাক হয়েছে, অনেকে প্রশ্ন করেছেন— সিনেমায় কিছু করবার ইচ্ছে বা চেষ্টা আছে কি না। সোজা বলে দিয়েছি— না, নেই। আরো কথা বাড়ালে বলেছি, কিছু লোকের তো থিয়েটারে থাকা দরকার!”