Ratings1
Average rating4
We don't have a description for this book yet. You can help out the author by adding a description.
Reviews with the most likes.
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের নন-ফিকশন গদ্য বাংলা সাহিত্যের সম্পদ। এমন চমৎকার সুস্বাদু প্রবন্ধ লিখতেন তিনি, মনে হয় প্রবন্ধ পড়ছি না, জয়নগরের মোয়া খাচ্ছি। সংবাদ-প্রতিবেদনের মতো তাৎক্ষণিকতার দোষে দুষ্ট নয়, আবার কবিরা সচরাচর যেমন গদ্য লেখেন, সেই ললিত-লবঙ্গ-লতার প্রাদুর্ভাব নেই তাঁর গদ্যভাষায়। টানটান, ছিমছাম, নির্মেদ। শুনলে বিশ্বাসই হয় না, সুনীল নাকি গদ্যরচনা শুরু করেছিলেন নেহাতই বাধ্য হয়ে, গ্রাসাচ্ছাদনের উদ্দেশ্যে দুটো পয়সা অতিরিক্ত রোজগারের আশায়।
তিন চারটে ছদ্মনাম পকেটে ঢুকিয়ে এই মর্ত্যধাম ভ্রমণ করেছিলেন তিনি। বিখ্যাত সেই ছদ্মনামগুলির মধ্যে “সনাতন পাঠক” সম্ভবত সবচেয়ে প্রাচীন। মনেপ্রাণে তিনি ছিলেন কবি, কিন্তু স্রেফ কবিতা লিখে সংসার চালানো যায় না। তার জন্যে প্রচুর গদ্য লিখতে হয়। দু-হাত খুলে লেখালেখি করার উদ্দেশ্যে, পিতৃদত্ত নামের পাশাপাশি পত্রপত্রিকায় গদ্য লেখার জন্যে আরেকটি অতিরিক্ত নাম সৃষ্টি করে নিতে হয়েছিল তাঁকে। সনাতন পাঠক ছদ্মনামে তিনি দেশ বিদেশের সাহিত্য-সংক্রান্ত খবরাখবর সরবরাহ করতেন পাঠকদের। বলতে দ্বিধা নেই— পঞ্চাশ, ষাট কিংবা সত্তরের দশকে কলকাতা শহরে বসে সমসাময়িক বিশ্বসাহিত্যের যে-বিপুল তথ্য তিনি বাঙালি পাঠকের হাতে তুলে দিয়েছেন, আজকের এই “ইনফরমেশন ওভারলোড”-আক্রান্ত সাইবার-যুগেও, অন্তত বাংলা সাহিত্য-অঙ্গনে, ধারাবাহিকভাবে এই কাজ করতে আমি কাউকে দেখিনি, দেখছি না। সবাই কেবল সুললিত “ব্যক্তিগত গদ্য” লেখায় ব্যস্ত আজকাল। আর নয়তো দেশ-দুনিয়া-সমাজ-সময়-ধর্ম-অধর্মের মুণ্ডপাত!
অথচ সনাতন পাঠকের লেখা এই প্রবন্ধগুলি সুদীর্ঘকাল অপ্রকাশিত অবস্থায় আজকের অর্বাচীন পাঠকের চোখের আড়ালে পড়ে ছিল। ভাবতে অবাক লাগে! কতো হাবিজাবি সংকলন, সংগ্রহ, অমনিবাস কিংবা রচনাসমগ্র বেরোচ্ছে প্রায় প্রত্যেকদিন, কিন্তু বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্বের সামগ্রিক একটি প্রবন্ধ-সংকলন আজও বেরোয়নি, তিনি লোকান্তরিত হওয়ার এক যুগ পরেও! এই কাজ কেবল বাঙালির মতো কর্মনিষ্ঠ তৎপর জাতির পক্ষেই সম্ভব।
তবুও ভাগ্যের কথা, এবারের কলকাতা বইমেলায় অবশেষে পুনরাবির্ভাব ঘটেছে সনাতন পাঠকের। আমার বহুদিনের একটা আশা পূরণ হয়েছে। যে-সুনীলের গদ্যের এত ভক্ত আমি, তাঁর শুরুর দিকের গদ্যের স্বাদ বহু চেষ্টাতেও নিতে পারিনি এতদিন। কেমন ছিল সেই সুনীলের লেখা, যখন তিনি কবিতার গণ্ডি পেরিয়ে সদ্য পা ফেলছেন গদ্যের নিঃসীম জগতে? শুরুর দিকের একটি রচনায় তিনি লিখেছেন : “আমি জীবনে কখনো গল্প লিখিনি, কখনো লেখার ক্ষীণতম ইচ্ছা বা দুঃসাহসও আমার নেই।” কী আশ্চর্য কথা! গল্প রচনায় নিতান্ত অনিচ্ছুক সেই যুবকের বিপুল পরিমাণ গদ্যের প্রতি কটাক্ষ করে পরবর্তীকালে কবীর সুমন গান লিখেছেন : “সুনীল গাঙ্গুলীর দিস্তে দিস্তে লেখা...” (গানের নাম “আমাদের জন্য”)। বাকি গদ্যের কথা বাদ দিলাম, তাঁর শুধু উপন্যাস-সমগ্রই এখনও পর্যন্ত বেরিয়েছে ১৫টা খণ্ড (এবং এখনও শেষ হয়নি, আরো বেরোবে)!
এই সংকলনে রয়েছে মোট ১২৪টি রচনা। বেশিরভাগই আকারে ছোট। যেগুলোর আকার বড়, সেগুলোও আড়াই পৃষ্ঠায় এঁটে গেছে। সাময়িক পত্রিকায় এর চেয়ে বেশি জায়গা পাওয়া মুশকিল। মূলত সমসাময়িক সাহিত্য জগৎ নিয়ে আলোচনা করেছেন। প্রসঙ্গক্রমে মাঝে মাঝে চলে এসেছে সমাজের কথা, রাজনীতির কথা, ব্যক্তিগত আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা। পঞ্চাশের দশকে তিনি আমাদের জানাচ্ছেন এস্কিমোদের সাহিত্যের ব্যাপারে। ওড়িয়া সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ লেখকদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন। জেমস জয়েসের স্ত্রী কিংবা ফ্রাঞ্জ কাফকার প্রেমিকার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিচ্ছেন। সদ্য প্রয়াত জীবনানন্দের মৃত্যুর “প্রকৃত” কারণ খোঁজার চেষ্টা করছেন। রবীন্দ্রনাথের নোবেল প্রাপ্তির পরে নোবেল সংগঠনের সভাপতির ভাষণের উল্লেখ করেছেন, যেখানে সভাপতি মহাশয় লিখেছেন : “প্রফেট রবীন্দ্রনাথ কিছুদিনের জন্যে লেখা-টেখা ছেড়ে প্রাচীন ভারতীয় পদ্ধতিতে পবিত্র গঙ্গা নদীর বুকে একটা নৌকায় ধ্যানী তপস্বীর জীবন কাটিয়েছেন” (আসলে, পদ্মা নদীতে বজরা-ভ্রমণের ব্যাপারে লিখতে চেয়েছিলেন উনি। সভাপতি মশাই যদি জানতেন, সবচে সেরা প্রেমের গানগুলো নদীতে ভাসতে ভাসতেই লিখেছিলেন সেই ধ্যানী তপস্বী!)
তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে অতি কষ্টে জোগাড় করা “কালবেলা” নামক সাহিত্যপত্রিকায় (যেখানে “একটিও ছাপার ভুল নেই, ভাষার ভুল নেই”) শামসুর রাহমান নামের একজন অপরিচিত কবির কবিতা পাঠ করে মুগ্ধ হচ্ছেন। হাসান আজিজুল হক নামের একজন নবাগত গল্পকারের “আত্মজা ও একটি করবী গাছ” গল্পটির “ডায়ালেক্ট ও তেজী সাহিত্যের ভাষার” নিপুণতা দেখে বিস্ময় প্রকাশ করে মন্তব্য করছেন: “কালবেলা নয়, ওঁদের সাহিত্য এখন সন্ধিক্ষণের”। থিয়েটার প্রসঙ্গে জাঁ পল সার্ত্রে-র জরুরি মতামত অনুবাদ করছেন। ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের একুশ তারিখে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের আপামর বাংলাভাষী মানুষের জীবনে ঘটে যাওয়া একটি মর্মন্তুদ ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছেন। সৈয়দ মুজতবা আলীর মৃত্যুসংবাদ জানিয়ে একটি রচনায় সুনীল লিখছেন, “সাধু ভাষা থেকে চলতি ভাষায় উত্তরণ যেমন একটি বিরাট ঘটনা— তেমনভাবেই সৈয়দ মুজতবা আলী ভাষাকে আর এক ধাপ এগিয়ে দিলেন। তিনি দেখালেন যে, বিশ্বের যে-কোনো ভাষা থেকেই শব্দ নিয়ে আসায় কোনো ক্ষতি নেই— যদি ঠিক মতন ব্যবহার করা যায়”। আজকের ভাষা-নাৎসি এবং “কেবলমাত্র খাঁটি বাংলা ভাষা”-প্রেমী এবং অহেতুক উৎকট বাংলা প্রতিশব্দ/ পরিভাষা/ বিকল্প উদ্ভট বঙ্গশব্দ উৎপাদনকারীদের শ্রীচরণে এই উদ্ধৃতিটি বিনীত নিবেদন করলাম আমি। এরকম আরো কতো যে বিচিত্র ও কৌতূহলোদ্দীপক সাহিত্য-বিষয়ক সংবাদের রামধনু ছড়িয়ে আছে এই বইটির পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায়!
বইটির শুরুর দিকে গদ্যের বাঁধুনি ছিল কিছুটা যেন আলগা। বিষয়বস্তুর বিশ্লেষণে আবেগের পরিমাণ কিছুটা যেন অতিরিক্ত। ধীরে ধীরে পারদর্শিতা অর্জন করেছেন লেখক। ধীরে ধীরে চোখের সামনে নির্মিত হচ্ছে একজন অসামান্য গদ্যকারের শক্তিশালী কলম। যে-কলম পরবর্তী অর্ধ শতাব্দীরও বেশি সময় মাতিয়ে রাখবে বাঙালি পাঠকের রসনাকে। প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর, বৈচিত্র্যে বিচ্ছুরিত, অথচ বৈদগ্ধ্যের নিয়ন্ত্রিত প্রকাশে পারদর্শী— সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় নামক একজন অনবদ্য গদ্যশিল্পীর প্রারম্ভিক সাহিত্যভাবনার উপভোগ্য দলিল হয়ে থাকবে এই চমৎকার সংকলনটি। সুবিনয় দাস-এর আঁকা প্রচ্ছদটি বেশ সুচারু।
“পাকে-চক্রে লেখক হয়ে যাওয়ার পর এখন একটা অন্য স্বপ্ন প্রায়ই দেখি। আমরা ভাবি যে এই সময় বা এই যুগকে বদলে দেবার ক্ষমতা আছে আমাদেরই হাতে। এটা যে একেবারেই ভুল স্বপ্ন, তা মনেই পড়ে না!”