Hardcover
FeedRecent activity by friends
Trending booksMost popular right now
New ReleasesMost anticipated
RecommendationsJust for you
Archive & Labs
2023 Year in Books2024 Year in Books
PromptsVote for your favorites
ListsCurated by our readers
GenresBrowse by Genre
MoodsBrowse by Mood
Last Year in BooksOur community highlights
Muhammad07

Muhammad

500 Reads
@Muhammad07BooksStatsReviewsListsPromptsGoalsNetworkActivity
The Miracle Worker: A Play

The Miracle Worker

By
William  Gibson
William Gibson
The Miracle Worker: A Play

হেলেন কেলারের নাম আজ আমরা কে না জানি? মাত্র ১৯ মাস বয়সে শ্রবণ, ও দৃষ্টিশক্তি হারানো হেলেনই পরবর্তীতে পৃথিবীর সবচেয়ে অনুপ্রেরণাদায়ী মানুষদের একজন হয়েছেন। যে মানুষ একইসাথে অন্ধ এবং বধির, তাঁর জীবনটিকে আমরা অর্থহীন বলেই ধরে নেই, অথচ ৮৭ বছরের ভীষণ অর্থবহ পূর্ণ এক জীবন কাটিয়ে হেলেন আজ বহু মানুষের কাছেই এক আলোকবর্তিকা-স্বরূপ। আরো অনেকদিনই সম্ভবত তিনি প্রাসঙ্গিক থাকবেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে ব্যাচেলর অফ আর্টস ডিগ্রী অর্জন করা আমেরিকার প্রথম ডেফব্লাইন্ড (অন্ধ ও বধির) ব্যক্তি হিসেবে হেলেন আজ স্বীকৃত। দীর্ঘ জীবনে তিনি ১৪টি বই আর শতাধিক প্রবন্ধ ও বক্তব্য লিখেছেন। বিশ্ব শান্তি, প্রাণী-অধিকার, মহাত্না গান্ধী, নারীদের যাতনা...কী নিয়ে লিখতে বাকি রেখেছেন তিনি? হেলেনের জন্ম আজ থেকে প্রায় দেড়শ বছর আগে, ১৮৮০ সালে, এর মাত্রই দেড় দশক আগে যুক্তরাষ্ট্র তার দীর্ঘ গৃহযুদ্ধ সামলে উঠেছে। অতো আগে জন্ম নেয়া একজন মানুষ এতগুলো প্রতিবন্ধকতা সামলে কী করে অমন অনুপ্রেরণাদায়ী একজন হয়ে উঠলেন? কোনো অলৌকিক ক্ষমতা কি রয়েছে এর পেছনে? কোন্‌ জাদুমন্ত্রবলে হেলেন অমন একজন সুপারহিরো হয়ে উঠলেন?

মার্ভেল কমিক্স-এর অন্ধ সুপারহিরো ডেয়ারডেভিলের কথা তো আমরা অনেকেই জানি। দৃষ্টিশক্তি না থাকলেও মারপিটে কোথাও পিছিয়ে নেই তিনি; দারুণ সংবেদনশীল ইন্দ্রিয়শক্তিকে কাজে লাগিয়ে নিত্যই তিনি দুষ্টের দমন করে চলেছেন। তবে মুখোশের আড়ালের ম্যাট মারডক অমন দোর্দণ্ড প্রতাপশালী মারকুটে ভিজিল্যান্টি হয়ে উঠতে পারতেন না যদি না স্টিকের কাছ থেকে তিনি মারপিট, ও ইন্দ্রিয়শক্তিগুলো নিয়ন্ত্রণ করা শিখতেন। স্টিকের প্রশিক্ষণেই ম্যাট হয়ে ওঠেন অজেয় ডেয়ারডেভিল।



হেলেন কেলারের ব্যাপারটিও কিছুটা অমনই! তাঁর জীবনেও স্টিকের মতো একজন শিক্ষক ছিলেন, যাঁর জীয়নকাঠির স্পর্শে রাতারাতি পাল্টে যায় হেলেনের জীবন। এই মানুষটির নাম অ্যান সালিভান। হেলেনের জীবনে অ্যান না এলে কী হতো বলা মুশকিল, হয়তো আর দশজন সাধারণ হতভাগ্য প্রতিবন্ধীর মতোই অন্ধকারে ঢাকা দুঃসহ এক জীবন কাটাতে হতো তাঁকে, পৃথিবী পেতো না হেলেন কেলারকে। দ্যা মিরাক্‌ল্‌ ওয়ার্কার নাটকটি এই অ্যান সালিভানকে নিয়েই, যিনি হেলেনের জীবনে সত্যিকার এক মিরাক্‌ল্‌ হয়ে আসেন। তবে শুধু অ্যান সালিভান-ই নন, হেলেনের জীবনে বড় ভূমিকা রেখেছেন আরো কয়েকজন সুপারহিরো। বাস্তবের সেই সুপারহিরোদের বন্দনাই এ লেখার মূল উদ্দেশ্য!

হেলেন কেলারের ৬ বছর বয়সের সময় অ্যান সালিভান তাঁর জীবনে আসেন, পরবর্তী ৪৯ বছর অ্যান হেলেনের হাতে হাত রেখে তাঁকে আগলে গেছেন। অ্যালাবামার প্রত্যন্ত এক গ্রামে হেলেনের জন্ম, যেখানে এমন অন্ধ ও বধির শিশুর পরিচর্যার কোন ব্যবস্থা ছিলো না, ছিলো না হেলেনকে নতুন কিছু শেখাবার উপায়ও। বহির্বিশ্বের সাথে যোগাযোগে সম্পূর্ণ অপারগ হেলেন বড় হয়ে উঠছিলেন ভীষণ একগুঁয়ে, জেদী, এবং মারকুটে স্বভাব নিয়ে। উইলিয়াম গিবসনের এ নাটকে হেলেনের বুনো স্বভাবটি বারবার উঠে আসে; কোন কিছু পছন্দ না হলেই হেলেন অন্ধ আক্রোশে হাত পা ছোঁড়াছুড়ি করে, চারপাশের সবাইকে কিল-লাথি-ঘুষি-খামচি মেরে জেরবার করে তোলে। কন্যার চিন্তায় পাগলপারা আর্থার এবং কেটি কেলার দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে চিঠি পাঠাতে থাকেন, এমন কোন উপায় কি কেউ বাতলে দিতে পারেন যাতে হেলেনকে একটু সামলে রাখা যায়? ন্যূনতম প্রাথমিক পর্যায়ের একটি যোগাযোগের মাধ্যম স্থাপন করা যায়? “হোপলেস” এই শিশুটির কোন একটা গতি করে দেবেন এমন কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কি আদৌ আছে কোথাও?

১৮২৯ সালে ম্যাসাচুসেটস-এ প্রতিষ্ঠিত হয় পার্কিন্স ইন্সটিটিউশন ফর দ্যা ব্লাইন্ড, যা দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করে লরা ব্রিজম্যান পড়তে ও লিখতে শেখেন, এবং উচ্চ শিক্ষাও অর্জন করেন। হেলেন কেলারের প্রায় অর্ধ শতাব্দী আগেই সে যুগের হেলেন কেলার হয়ে ওঠেন লরা। পৃথিবীবাসী লরা ব্রিজম্যানের কথা জানতে পায় চার্লস ডিকেন্সের বরাতে; আমেরিকা ঘুরে এসে বিশেষতঃ পার্কিন্স ইন্সটিটিউশন এবং লরাকে নিয়ে ভীষণ উচ্ছ্বসিত ডিকেন্স ১৮৪২ সালে প্রকাশ করেন তাঁর অ্যামেরিকান নোটস। হেলেনের মা কেটি এ বইটি পড়ে লরার কথা জানতে পারেন, এবং আশায় বুক বেঁধে যোগাযোগ করেন টেলিফোনের জনক হিসেবে খ্যাত বিজ্ঞানী আলেকজাণ্ডার গ্রাহাম বেলের সাথে। বেল সে সময়টায় বধির শিশুদের নিয়ে গবেষণা করছিলেন; তিনি কেটির সঙ্গে পার্কিন্স থেকে সদ্য পাশ করা অ্যান সালিভানের পরিচয় করিয়ে দেন। বেল পরবর্তীতে নিজ গরজে ব্রেইল শিখে নিয়েছিলেন, হেলেনের সাথে চিঠি চালাচালি করবার জন্য।


ছবিঃ লরা ব্রিজম্যান। সূত্রঃ উইকিপিডিয়া

১৮৮৭-এর মার্চের ৫ তারিখ ২০ বছর বয়েসি অ্যান এসে উপস্থিত হন হেলেনের অ্যালাবামার বাড়িতে। দু পক্ষের প্রথম মোলাকাতটা খুব মসৃণ হয়নি। হেলেনের বাবা আর্থার আমেরিকান গৃহযুদ্ধে কনফেডারেসির হয়ে লড়াই করেছিলেন, তাঁদের বাড়িতে কৃষ্ণাঙ্গ কৃতদাসও ছিলো বেশ কয়েকজন। বিপরীতে, অ্যান সালিভান বড় হয়েছেন উত্তরে, ম্যাসাচুসেটস-এ, কৃতদাসদের মুক্তির পক্ষে লড়াই করা ইউনিয়ন-এর কেন্দ্রস্থল হিসেবে খ্যাত এ অঞ্চলটি। সম্পূর্ন বিপরীতমুখী রাজনৈতিক দর্শন লালন করা এই মানুষগুলো কিন্তু শেষমেষ ঠিকই আক্ষরিক অর্থে এক ছাদের নিচে এসেছেন, হেলেনের জন্যই। অ্যান প্রথমেই লক্ষ্য করেন হেলেনের পরিবার হেলেনকে অতি আদরের এক ঘেরাটোপে আবদ্ধ রেখেছে, ছোট্ট হেলেন যা চায় তাই-ই পায়। নিজের প্লেট থেকে সে খায় না, টেবিলের চারপাশে হেঁটে বেড়ায়, আর হাতড়ে হাতড়ে সবার প্লেট থেকে খাবার তুলে নেয়। অ্যান নিজের প্লেট থেকে খাবার দিতে না চাইলে সে রাগ করে, মেঝেতে শুয়ে পা ঠোকে, বুনো চিৎকারে কানে তালা লাগিয়ে দেয়...। সব দেখেশুনে অ্যান রায় দেন, হেলেনকে তাঁর হাতে সম্পূর্ণভাবে তুলে দিতে হবে। পৃথিবীটা যে ফুলশয্যা নয়, ভীষণ কঠিন এক জায়গা, এখানে পদে পদে সংগ্রাম, ঠেকে ঠেকেই শিখে নিতে হয়-এই সত্যিটা হেলেনের মাথায় গেঁথে দেবার সঙ্কল্পে চোয়াল শক্ত করেন অ্যান।


ছবিঃ অ্যান, এবং হেলেন। আলেকজাণ্ডার গ্রাহাম বেলের তোলা (১৮৯৯)। সূত্রঃ উইকিপিডিয়া

হেলেনকে মনের ভাব প্রকাশ করতে শেখাবার জন্য অ্যান রীতিমতো মিলিটারী কায়দায় ট্রেনিং শুরু করেন। আমরা যারা চোখে দেখে, এবং কানে শুনে নতুন তথ্য আহরণ করি চারপাশ থেকে, আমরা হয়তো লক্ষ্যই করি না যে আমাদের আশেপাশের সবকিছুই আসলে বিশেষ্য, সবকিছুরই নাম রয়েছে (যেমনঃ পানি, টেবিল, প্লেট...ইত্যাদি)। অ্যান শুরুতেই হেলেনকে এই বিশেষ্য চেনাবার কাজে নামেন। কোন একটি বস্তু (যেমনঃ পুতুল) হাতে ছুঁইয়ে এরপর সেই বস্তুটির নাম হাতের স্পর্শে বানান করে করে (D-O-L-L) শেখানো শুরু করেন। যে কায়দায় বানানের এ শিক্ষাটি তিনি দেয়া শুরু করেন, এর নাম ম্যানিউয়াল অ্যালফাবেট (manual alphabet)। বিশেষতঃ বধিরদের শিক্ষাদানের মাধ্যম হিসেবে এই ম্যানিউয়াল অ্যালফাবেট, কিংবা ফিঙ্গার অ্যালফাবেট বর্তমানে বেশ জনপ্রিয়। প্রায় ৪০ ধরণের ম্যানিউয়াল অ্যালফাবেট-এর চল রয়েছে হালের সময়ে, তবে ইংরেজি ভাষা যেমন গোটা বিশ্বের লিঙ্গুয়া ফ্র্যাঙ্কা হয়ে উঠেছে, সাইন ল্যাঙ্গুয়েজের জগতে তেমনি লিঙ্গুয়া ফ্র্যাঙ্কা হয়ে উঠেছে ম্যানিউয়াল অ্যালফাবেটের আমেরিকান সংস্করণ অ্যামেরিকান সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ। আমেরিকার বহু বিশ্ববিদ্যালয়েই এ বিষয়টির ওপর পড়াশোনা করে স্নাতক, এবং স্নাতোকোত্তর পর্যায়ে ডিগ্রি নেয়া যায়।


ছবিঃ অ্যামেরিকান সাইন ল্যাঙ্গুয়েজে ব্যবহৃত বর্ণমালা ও সংখ্যা। সূত্রঃ উইকিপিডিয়া

আকার ইঙ্গিতের মাধ্যমে মানুষ তো আসলে হাজার হাজার বছর ধরেই মনের ভাব প্রকাশ করে আসছে, তবে এভাবে আঙ্গুলের ভাঁজে বর্ণমালা ফুটিয়ে একটি একটি করে শব্দ বানিয়ে আস্ত একটি বাক্য তৈরী করার ইতিহাস কিন্তু খুব পুরনো নয়। স্প্যানিশ শিক্ষাবিদ হুয়ান পাবলো বনেত ১৬২০ সালে একটি বই প্রকাশ করেন যেখানে তিনি ম্যানিউয়াল অ্যালফাবেট ব্যবহারের পদ্ধতি বিশদে আলোচনা করেন। ম্যানিউয়াল অ্যালফাবেট-এর ওপর এটিই প্রথম প্রকাশিত বই। পরবর্তীতে ১৮ শতকে ফরাসী শিক্ষাবিদ শাখলে মিশেল দ্যু লেপে বনেত-এর এই বর্ণমালাটি ব্যবহার করা শুরু করেন বধিরদের কাছে বাইবেলের বাণী প্রচার করার উদ্দেশ্যে। দ্যু লেপে বিশ্বাস করতেন বধিরদের কাছে ঈশ্বরের বাণী পৌঁছে দিলে তাদেরও আত্নার পরিত্রাণ ঘটানো সম্ভব, স্রেফ বধির বলেই কেউ স্বর্গে যেতে পারবে না তা কিছুতেই হতে পারে না! এই ভাবনা থেকেই ১৭৬০ সালে প্যারিসে তিনি পৃথিবীর প্রথম বধিরদের শিক্ষালয় স্থাপন করেন, যেখানে বিনামূল্যে শিক্ষাদান করা হতো। দ্যু লেপের দেখানো পথে লেখাপড়া শিখে বধিররা মানব ইতিহাসে প্রথম বারের মতো আদালতে নিজেদের বক্তব্য পেশ করা শুরু করেন। চোখে পানি এনে দেবার মতো ব্যাপার, তাই না?


ছবিঃ হুয়ান পাবলো বনেত-এর প্রস্তাবিত ম্যানিউয়াল অ্যালফাবেট (১৬২০)। সূত্রঃ উইকিপিডিয়া

অ্যান সালিভান তো ম্যানিউয়াল অ্যালফাবেট ও ব্রেইলের মাধ্যমে হেলেনকে লেখাপড়া শেখালেন, এবার হেলেনের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পালা। হেলেন পড়েছেন র‍্যাডক্লিফ কলেজে যা বর্তমানে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে। র‍্যাডক্লিফ কলেজে পড়বার সুযোগ পেলেও অর্থাভাবে ভর্তি হতে পারছিলেন না হেলেন। ঠিক এ সময়েই এগিয়ে আসেন আরেকজন মহান লেখকঃ স্যামুয়েল লংহর্ন ক্লেমেন্স, যাঁকে আমরা মার্ক টোয়েন নামে জানি। টোয়েনের নিজের তখন অর্থনৈতিক অবস্থা সঙ্গিন, কিন্তু হেলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারছেন না জেনে তিনি পত্রাঘাত করেন তাঁর ধনকুবের বন্ধু স্ট্যান্ডার্ড অয়েল-এর কর্ণধার হেনরি হাটলস্টন রজার্সকে। টোয়েনের অনুরোধেই হেনরি হেলেনের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সকল ব্যায়ভার বহন করেন। অ্যান সালিভানকে যে আজ আমরা মিরাক্‌ল্‌ ওয়ার্কার হিসেবে জানি, এই উপাধিটিও মার্ক টোয়েনেরই দেয়া। উইলিয়াম গিবসন এ নামে নাটক লিখে টোয়েনের দিকে চোখ টিপ মেরেছেন কার্যত।

অ্যান সালিভান যে হেলেনকে শুধু ব্রেইলের মাধ্যমে পড়তে, এবং ম্যানিউয়াল অ্যালফাবেট-এর মাধ্যমে কথা “বলতে” শিখিয়েছেন, তা নয়, কথা শুনতেও শিখিয়েছেন! সালিভান যে প্রতিষ্ঠান থেকে পড়ে এসেছেন, সেই পার্কিন্স ইন্সটিটিউশন-এর একজন শিক্ষক সোফি অ্যালকর্ন বধিরদের জন্য কথা শোনার একটি পদ্ধতি দাঁড় করিয়েছিলেন, যেটিকে ট্যাডোমা মেথড বলা হয়। এ পদ্ধতিতে বধির ব্যক্তি যিনি কথা বলছেন, তাঁর গলায়, ঠোঁটে, ও নাকে আঙুল রেখে শব্দের কম্পন থেকে কথা “শুনে” নিতে পারেন। অ্যান কীভাবে হেলেনকে কথা শুনতে শিখিয়েছেন তার একটি ভিডিও এখানে জুড়ে দিলাম। ১৯২৯ সালে ধারণকৃত এ ভিডিওটি সাদাকালো, কিন্তু অ্যানের কথা “শুনে” তা বুঝতে পেরে হেলেনের মুখে যে হাসি ফুটে ওঠে, তা যেন ভিডিওটিকে প্যালেটের সবগুলো রঙে রাঙিয়ে দেয়! শুধু তাই নয়, যে ধৈর্য, মমতা, আর একাগ্র নিষ্ঠার সাথে ৪৯ বছর ধরে অ্যান কাজ করে গেছেন হেলেনের জন্য, তার সামান্য একটু পরিচয়ও উঠে আসে মিনিট তিনেকের এই ভিডিওটিতে।

গিবসনের এ নাটক অবলম্বনে চলচ্চিত্র বানানো হয়েছে, অস্কারও জিতেছে তা। ১৯৫৭ সালে লেখা এ নাটক আজও নিয়মিতই মঞ্চস্থ হয়। মঞ্চে অভিনয় অত্যন্ত কঠিন একটি কাজ, এ নাটকে হেলেনের চরিত্রে অভিনয় করা সে চ্যালেঞ্জটিকে আরো বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। নাটকের মারকুটে, বুনো হেলেন কথায় কথায় তেড়ে আসে, মেঝেতে শুয়ে প্রচণ্ড ক্রোধে পা ঠোকে, আবার হাতে পানি স্পর্শ করে ম্যানিউয়াল অ্যালফাবেটের মাধ্যমে বানান করে W-A-T-E-R লিখতে শিখে বাঁধভাঙা খুশীতে আত্নহারা হয়ে ওঠে...এ চরিত্র মঞ্চে ঠিকঠাকভাবে ফুটিয়ে তোলা যেন আরেক মিরাক্‌ল্‌-এর দাবীদার। কানাডার বিশপ'স ইউনিভার্সিটির ড্রামা ডিপার্টমেন্ট ২০২০ সালে নাটকটি মঞ্চস্থ করে, দুর্দান্ত সে পার্ফর্ম্যান্সটি এখানে জুড়ে রাখলাম। কারো হাতে ঘন্টা দুয়েক সময় থাকলে দেখে নিতে পারেন।

অন্ধত্ব, বধিরতা, কিংবা বাকশক্তিহীনতা-এই প্রতিবন্ধকতাগুলোকে জয় করবার রাস্তা মানুষ বের করে নিয়েছে। শুধু এখানেই তো শেষ নয়, ম্যানিউয়াল অ্যালফাবেট, ব্রেইল, কিংবা ট্যাডোমা মেথডের সেই দিনগুলো ফেলে গত কয়েকশ বছরে বিজ্ঞান আরো বহু বহু দূর এগিয়ে গেছে। মানুষ এখন শ্রবণশক্তি ফিরে পাচ্ছে, পাচ্ছে চোখের দৃষ্টিও। যাঁদের চোখ একেবারেই ভালো হবার নয়, তাঁদের জন্যও আছে সুখবর। হাতের ছোঁয়ায় বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক তথ্য (গ্রাফ, চার্ট, ছবি ইত্যাদি) বুঝে নেয়া, চলচ্চিত্র দেখা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মনের ভাব প্রকাশ করা, জাদুঘরে ভার্চুয়ালি ঘুরে আসা...এই সবই এখন ধীরে ধীরে সত্যি হয়ে উঠছে!

এত এত এত সব বকবকবকবকানির কারণ নিজেকে এবং নিজের বন্ধুদের আশা যোগানো! আমরা যদি কেউ দৈবাৎ কোন দূর্ঘটনায় কখনো অন্ধ বা বধির হয়ে পড়ি, আমরা যেন হাল না ছাড়ি। আমরা যেন কিছুতেই ভুলে না যাই, আমাদের চারপাশেই আমাদের অলক্ষ্যে বাস্তবের সুপারহিরোরা কাজ করে যাচ্ছেন। আমরা যেন তাঁদের শক্তিতে বলীয়ান হয়ে উঠি। হয়তো একদিন আমরাও সুপারহিরো হয়ে উঠতে পারি, কে জানে!

2024-11-05T00:00:00.000Z
লাল নীল দীপাবলি বা বাঙলা সাহিত্যের জীবনী

লাল নীল দীপাবলি বা বাঙলা সাহিত্যের জীবনী

By
Humayun Azad
Humayun Azad
লাল নীল দীপাবলি বা বাঙলা সাহিত্যের জীবনী

লাল নীল দীপাবলি বা বাঙলা সাহিত্যের জীবনী হুমায়ুন আজাদের বিখ্যাত বই। মূলত কিশোর বা তরুণ বয়সী পাঠকদের উদ্দেশ্যে লেখা এ বইতে তিনি খুব ছোট পরিসরে বাঙলা ভাষার এক হাজার বছরের ইতিহাস তুলে ধরেছেন। যে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে বাঙলা ভাষা আজকের এই অবস্থানে এলো, সে পথের নানান বাঁকে আলো জ্বালিয়ে রেখেছে বাঙলা সাহিত্যের বিভিন্ন সময়ের সাহিত্যের বিভিন্ন নিদর্শন। আজাদ কল্পনা করেছেন যে কিশোর বা কিশোরীটি এ বইটি পড়বে, সে যেন বাঙলা সাহিত্যের এই নিদর্শনগুলোকে এক একটি লাল নীল দীপাবলি হিসেবে দেখবে, যেন সে আসরের মধ্যমণি হয়ে বসে রয়েছে, আর তার চারপাশ আলো করে রেখেছে এই দীপাবলি।

বাঙলা সাহিত্যের ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করতে গেলে প্রথমেই প্রশ্ন আসে, আমরা বাঙালিরা এলাম কোথা থেকে? নৃতাত্ত্বিকদের গবেষণার ভিত্তিতে আজাদ জানাচ্ছেন, আমাদের পূর্বপুরুষেরা মূলত সিংহলের ভেড্ডারা। আদিবাসী সাঁওতাল, মুণ্ডা, মালপাহাড়ি, ওরাঁও-এঁরা তো বটেই, ভেড্ডা উপাদান পাওয়া গেছে নিম্ন ও উচ্চবর্ণের হিন্দু, এবং মুসলমানের মাঝেও। মোটাদাগে আমরা ভেড্ডাদের উত্তরপুরুষ হলেও আমাদের রক্তে মিশে আছে আরো বহু জাতির রক্ত (যেমনঃ মঙ্গোলীয়, ইন্দো-আর্য, পারসিক শক ইত্যাদি)। বাঙালি মুসলমানেরা অনেকেই যদিও গর্ব করে বলেন তাঁরা নাকি আরবীয় বা পারসিক বংশোদ্ভূত, কিন্তু সত্যিটা হলো তাঁরা মূলত বাঙালি। মুসলমানেরা এই দেশে আসবার পর ত্রয়োদশ শতাব্দীর কিছু পরে উৎপীড়িত নিম্নবর্ণের হিন্দু এবং বৌদ্ধরা মুসলমান হওয়া শুরু করে।

বদলের প্রকৃতি অনুসারে বাঙলা ভাষাকে ৩টি স্তরে ভাগ করেছেন পণ্ডিতেরা। প্রথম স্তরটি প্রাচীন বাঙলা ভাষা যার প্রচলন ছিলো ৯৫০ থেকে ১২০০ খ্রিস্টাব্দ অব্দি। চর্যাপদ এ সময়েরই নিদর্শন। এরপরের ১৫০ বছর (১২০০-১৩৫০ খ্রিস্টাব্দ) বাঙলা ভাষার কোন নমুনা পাওয়া যায়নি, এ সময়টিকে বাঙলা সাহিত্যের অন্ধকার যুগ বলা হয়। ১৩৫০ থেকে ১৮০০ অব্দি যে ভাষাটির প্রচলন ছিলো সেটিকে বলা হয় মধ্যযুগের বাঙলা ভাষা, এ ভাষাও আজকের আধুনিক বাঙলা ভাষার মতো নয় পুরোপুরি। এ সময়ের মহৎ কবিদের মাঝে রয়েছেন বড়ু চণ্ডীদাস, মুকুন্দরাম চক্রবর্তী, বিজয়গুপ্ত, চণ্ডীদাস, বিদ্যাপতি, জ্ঞানদাস, গোবিন্দদাস, ভারতচন্দ্র, আলাওল, কাজী দৌলত প্রমুখ। মধ্যযুগের অন্যতম নিদর্শন মঙ্গলকাব্য; দীর্ঘ এ কাব্যগুলোতে কবিরা মূলত দেবতাদের মর্ত্যলোকে প্রতিষ্ঠার গল্প বলতেন। এ সময়ের সকল কাব্যই দেবতাকেন্দ্রিক, মানুষ তাতে প্রাধান্য পায়নি।

বাঙলা সাহিত্যের প্রথম প্রদীপ চর্যাপদ। এ বইটির বেশ কয়েকটি নাম রয়েছে; কেউ একে চর্য্যাচর্য্যবিনি-য় বলেন, কেউ বলেন এর নাম চর্য্যা-র্য্যবিনি-য়। এই বইটির কথা প্রথম জানতে পাওয়া যায় মাত্রই এই সেদিন ১৯০৭ সালে। পণ্ডিত মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপালের রাজদরবারের গ্রন্থাগার থেকে এটি উদ্ধার করেন। চর্যাপদ-এর সাথে তিনি আরো দুটি বইও সেখানে আবিষ্কার করেনঃ ডাকার্ণব, এবং দোহাকোষ। এই ৩টি বইকে একত্র করে তিনি ১৯১৬ সালে হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধ গান ও দোহা নামে একটি বই প্রকাশ করেন। চর্যাপদে সব মিলিয়ে ৪৬টি পূর্ণ, ও ১টি খণ্ডিত কবিতা সংকলিত হয়েছে। এ কবিতা বা গানগুলো রচনা করেছেন ২৪ জন বৌদ্ধ বাউল। চালচুলোহীন সমাজের নিচুতলার মানুষেরা ছিলেন আমাদের ভাষার প্রথম কবিকুল। এই কবিদের মাঝে অন্যতম কাহ্নপাদ, লুইপাদ, সরহপাদ, চাটিল্লপাদ, ডোম্বিপাদ, ঢেন্টপাদন, শবরপাদ। এঁদের মাঝে কাহ্নপাদ বা কৃষ্ণাচার্য সবচেয়ে বেশি ১২টি কবিতা লিখেছেন। এরপর ভুসুকপাদ, তিনি লিখেছেন ৬টি কবিতা। সরহপাদ লিখেছেন ৪টি, কুক্কুরিপাদ ৩টি, লুইপাদ, শান্তিপাদ, ও শবরপাদ লিখেছেন ২টি করে কবিতা। বাকি সবাই ১টি করে লিখেছেন।

চর্যাপদের কবিতার বিষয় নিয়ে কয়েকটি কথা না বললেই নয়। এ কবিতাগুলোতে প্রায়ই উঠে এসেছে দরিদ্র কবির জীবন সংগ্রামের কথা। আছে সমাজের উঁচুতলার ধনী লোকেদের অত্যাচারের বর্ণনাও। আজাদ মন্তব্য করেছেন বাঙলা সাহিত্যে শ্রেণীসংগ্রামের সূচনা হয়েছিলো এই কবিতাগুচ্ছেই। চর্যাপদের কবিরা কী নিদারুণ কষ্টে দিন কাটিয়েছেন তার একটি ছবি দেখা যাকঃ

টালত মোর ঘর নাহি পড়বেষী।
হাড়ীত ভাত নাহি নীতি আবেশী।।
বেঙ্গ সংসার বড্‌হিল জাঅ।
দুহিল দুধ কি বেন্টে ষামায়।।






সোণে ভরিতী করুণা নাবী।
রুপা থুই নাহিক ঠাবী।


সোনার তরী



শ্রীকৃষ্ণকীর্তন













পদসমুদ্র

পদামৃতসমুদ্র

পদকল্পতরু

পদকল্পলতিকা

গীতিচিন্তামণি

পদচিন্তামণিমালা



পুরুষপরীক্ষা

কীর্তিলতা

গঙ্গাবাক্যাবলী

বিভাসাগর







শবেমিরাজ

নবীবংশ

রসুলবিজয়, ওফাতে রসুল, ইবলিশনামা, জ্ঞানচৌতিশা, জ্ঞানপ্রদীপ, জয়কুম রাজার লড়াই



সতীময়না

লোরচন্দ্রাণী

সতীময়না

পদ্মাবতী

পদুমাবত

সয়ফলমূলক-বদিউজ্জামাল





ডিসগাইস

ভদ্রার্জুন

ফায়েড্রা

কীর্তিবিলাস

মার্চেন্ট অফ ভেনিস

ভানুমতী-চিত্তবিলাসনাটক

রোমিও-জুলিয়েট

চারুমুখচিত্থরা

কৌরব বিয়োগ

রজতগিরীনন্দিনী



বেনীসংহার, রত্নাবলী, অভিজ্ঞানশকুন্তল, মালতীমাধব, রুক্মিণীহরণ, কংসবধ, ধর্মবিজয়, বুঝলে কিনা, যেমন কর্ম তেমন ফল

কুলীনকুলসর্বস্ব

কুলীনকুলসর্বস্ব

নবনাটক

বিধবাবিবাহনাটক

সাবিত্রী-সত্যবান

মালতীমাধব



কিঞ্চিৎ জলযোগ

অলীক বাবু

পুরুবিক্রম, সরোজিনী, অশ্রুমতি, স্বপ্নময়ী

রজতগিরি, হঠাৎ নবাব, দায়ে পড়ে দারগ্রহ

অভিজ্ঞানশকুন্তল, উত্তরচরিত, মালতীমাধব, মুদ্রারাক্ষস, মৃচ্ছকটিক



কতো নদী সরোবর



2024-10-25T00:00:00.000Z
রেনেসন্স বাংলার রেনেসন্স

রেনেসন্স বাংলার রেনেসন্স

By
Ghulam Murshid
Ghulam Murshid
রেনেসন্স বাংলার রেনেসন্স

ইওরোপের রেনেসাঁন্স-এর কথা তো আজ আমরা সব্বাই-ই জানি। দানবীয় সব পরিবর্তন ও সংস্কারের ভেতর দিয়ে নতুন এক ইওরোপের জন্ম হয়েছিলো মধ্যযুগে। কুসংস্কারাচ্ছন্ন অন্ধকারে ঘেরা সে সমাজের খোলনলচেই পুরো পাল্টে দিয়েছিলো বুদ্ধিবৃত্তিক পুণর্জাগরণের এই আন্দোলনটি। ১৯ শতকে বঙ্গীয় সমাজেও এমন একটি সংস্কারমূলক আন্দোলন ঘটেছিলো, যাকে কেউ কেউ রেনেসাঁন্স হিসেবে অভিহিত করেন। গোলাম মুরশিদের এ বইটি লেখার মূল উদ্দেশ্য বাঙালি পাঠকের সঙ্গে সেই “বঙ্গীয় রেনেসাঁন্স”-এর পরিচয় করিয়ে দেয়া। বাঙলায় রেনেসান্স সত্যিই এসেছে কি না তা নিয়ে অনেকেরই হয়তো প্রশ্ন থাকবে মনে। অনেকটা সে প্রশ্নের উত্তর দেবার জন্যই বইয়ের প্রায় ৬৩% তিনি ব্যয় করেছেন ইতালীয় রেনেসাঁন্স-এর ইতিহাস বর্ণনায়। পাঠককে ১৫/১৬ শতকের সে রেনেসাঁন্স-এর একটি সম্যক ধারণা দিয়ে এরপর তিনি ১৯ শতকে বঙ্গীয় সমাজে ঘটে যাওয়া বড় বড় সামাজিক পরিবর্তনগুলোর দিকে চোখ ফিরিয়েছেন। দুই সমাজের সংস্কারকে সমান্তরালভাবে দেখতে এবং দেখাতে চেয়েছেন মুরশিদ।

সত্যিই কি বাঙলায় রেনেসাঁন্স ঘটেছিলো? সে প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে আগে চোখ ফেরাতে হবে সে সময়ের বঙ্গীয় সমাজ কী কী পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে গিয়েছে সেসবের ওপর। কফির কাপটা নামিয়ে শক্ত হয়ে বসুন, ইতিহাসের রোলার কোস্টারে বসতে চলেছি এক্ষুনি!

ইওরোপে প্রোটো-রেনেসাঁন্স ১২-১৩ শতকের দিকে শুরু হয়েছিলো, যা পরিপূর্ণ রূপ পায় ১৫ শতকে এসে। যে সমাজ-সংস্কারকে মুরশিদ বঙ্গীয় রেনেসাঁন্স অভিহিত করেছেন, তার সূচনা ১৯ শতকের শুরুতে। দুই “রেনেসাঁন্স”-এর মাঝে প্রায় ৫০০ বছরের পার্থক্য। তবে এই বঙ্গীয় রেনেসাঁন্স নাকি প্রথমে শুরু হয়েছিলো এশিয়াটিক সোসাইটির কয়েকজন ইংরেজ পণ্ডিতের হাতে, ১৮ শতকের শেষে। ১৭৮৪ সালের জানুয়ারী মাসে ইস্ট ইণ্ডিয়া কম্পানির কয়েকজন কর্মকর্তা মিলে এশিয়াটিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন; ভারতবর্ষের ভাষা, ধর্ম, সংস্কৃতি, সাহিত্য, ভূগোল ইত্যাদি নিয়ে গবেষণা করা ছিলো এদের লক্ষ্য। এই সোসাইটির একজন পণ্ডিত উইলিয়াম জোনস একদিন অতর্কিতে ঘোষণা করেন সংস্কৃত (এবং, বাঙলা সমেত উত্তর ভারতের ভাষাসমূহ) এবং ইওরোপীয় ভাষাগুলো আসলে একে অপরের আত্নীয়; এরা ইন্দো-ইওরোপিয়ান পরিবারের অন্তর্গত। এর অব্যবহিত পরেই ১৮৩৬-৩৮ সালের দিকে জেমস প্রিন্সেপ প্রায় ২০০০ বছর পর সম্রাট অশোকের সময়ের ব্রাহ্মীলিপি পাঠোদ্ধার করেন। অশোক এবং তাঁর সময়কাল নিয়ে পুরোদমে গবেষণা শুরু হয় এরপরই।

গোলাম মুরশিদ রাজা রামমোহন রায়কে (তাঁর) বাঙলার রেনেসাঁন্সের অন্যতম পথিকৃৎ হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন। ইওরোপের রেনেসাঁন্সে বহুভাষাবিদ পণ্ডিতেরা বিভিন্ন ভাষার গুরুত্বপূর্ণ কাজ অনুবাদ করে বড় ভূমিকা রেখেছিলেন। রামমোহন রায়কেও তেমনি একটি ভুমিকাতেই দেখেছেন মুরশিদ। তিনি বাঙলা, এবং ইংরেজির পাশাপাশি আরবী, ফার্সি, হিন্দী, সংস্কৃত-এই ভাষাগুলো শিখেছিলেন, এমনকি, বাইবেলের আদি গ্রন্থ (ওল্ড টেস্টামেন্ট) পড়বার জন্য তিনি হিব্রিউও নাকি রপ্ত করেছিলেন। আমার মতো অনেকেরই হয়তো ভীষণ অবাক লাগবে জেনে, ১৮০৩ সালে রামমোহন রায় তাঁর প্রথম যে বইটি প্রকাশ করেন, সেটি তিনি লিখেছিলেন ফার্সি ভাষায় (তুহফাতুল মুয়াহেদিন)। তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের এই বইটির ভূমিকা আবার লিখেছিলেন আরবী ভাষায়।

তুহফাতুল-এর এক যুগ পর ১৮১৫ সালে রামমোহন বেদান্ত গ্রন্থ নামে একটি বই প্রকাশ করেন, যেখানে বেদের সংস্কৃত শ্লোকগুলোর আলোকে হিন্দুধর্মকে একেশ্বরবাদী একটি জীবন বিধান হিসেবে দাঁড় করাতে চেয়েছেন তিনি। বেদ-উপনিষদের বাঙলা অনুবাদ এর আগে খুব একটা প্রচলিত ছিলো না সম্ভবত, ফলে বেদের দর্শন ও শিক্ষাও সাধারণ্যের অবোধ্য ছিলো। রামমোহন রায় নিজের ব্যাখ্যা সহ সহজ ভাষায় এই অনুবাদকর্মটি সম্পন্ন করেন। একেশ্বরবাদ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তিনি এরপর একে একে কেনোপনিষৎ (১৮১৬), ঈশোপনিষৎ (১৮১৬), কঠোপনিষৎ (১৮১৭), মাণ্ডূক্যোপনিষৎ (১৮১৭), গায়ত্রীর অর্থ (১৮১৮), মুণ্ডকোপনিষৎ (১৮১৯) ইত্যাদি সংস্কৃত গ্রন্থগুলো বাঙলায় অনুবাদ করে প্রকাশ করেন। রক্ষণশীল হিন্দু পণ্ডিতদের সঙ্গেও তিনি নিয়মিত বিতর্কে নামতেন। এসবের বাইরে তিনি বাঙলা ভাষার ব্যাকরণ নিয়েও গ্রন্থ প্রকাশ করেন গৌড়ীয় ব্যাকরণ নামে। রামমোহন রায়ের এই কীর্তিগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে গোলাম মুরশিদ তাঁকে ইটালীয় হিউম্যানিস্টদের সমান্তরালে রেখেছেন, যাঁরা কী না “মানুষ” পরিচয়টিকে ধর্মীয় ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে রেখেছিলেন।

ইটালীয় হিউম্যানিস্টদের সাথে এই সাদৃশ্য মুরশিদ টেনেছেন আরো দুজন বাঙালি সমাজ সংস্কারকের ক্ষেত্রেওঃ রাধাকান্ত দেব, এবং কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়। দুজনই সংস্কৃত ভাষার চর্চা করেছেন, এবং ভারতীয় প্রাচীন জ্ঞান পুণোরোদ্ধারে ভূমিকা রেখেছেন। রাধাকান্ত দেবের শব্দকল্পদ্রুম, এবং কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিদ্যাকল্পদ্রুম তাঁদের অন্যতম অবদান। এছাড়া অক্ষয়কুমার দত্ত ভারতবর্ষের বিভিন্ন উপাসক সম্প্রদায়কে নিয়ে গবেষণামূলক কাজ করে গেছেন। বাঙালি সংস্কৃত পণ্ডিতদের মাঝে সবচেয়ে বড় নাম সম্ভবত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তিনি প্রাচীন শাস্ত্র ও সাহিত্যের পাঠোদ্ধারে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন, বিশেষত একই গ্রন্থের কয়েকটি করে পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ করে সেগুলোর চুলচেরা বিশ্লেষণ করেন। তাঁর বিশ্লেষণী ক্ষমতার একটি উদাহরণ মুরশিদ দিয়েছেনঃ কালিদাস রচিত মেঘদূত সম্পাদনার সময় বিদ্যাসাগর ৩৭টি শ্লোক চিহ্নিত করেন যেগুলোকে তিনি কালিদাসের রচিত নয় বলে সিদ্ধান্ত দেন। পরবর্তীতে কাশ্মীরে মেঘদূত-এর একটি প্রাচীনতর পাণ্ডুলিপি উদ্ধার হলে আবিষ্কৃত হয় সেখানে সে ৩৭টি শ্লোক ছিলো না।

ব্রিটিশদের গড়া এশিয়াটিক সোসাইটিতে অনেক বাঙালি পণ্ডিতেরাও কাজ করেছেন। মাইকেল মধূসুদন দত্তের বন্ধু রাজেন্দ্রলাল মিত্র তাঁদের একজন। লুপ্ত বৌদ্ধশাস্ত্র এবং সাহিত্য পুণোরোদ্ধারে তিনি বড় ভূমিকা রেখেছেন। রাজেন্দ্রলাল ১৮৫৩ সালে বিবিধার্থ সংগ্রহ নামে একটি পত্রিকা চালু করেন যেখানে তাঁর গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করতেন। মাইকেল তাঁর প্রথম কাব্য তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য এই পত্রি��াতেই বেনামে প্রকাশ করেন। এই কীর্তিমান মানুষদের প্রচেষ্টায় ১৮৩০ থেকে ১৮৫০ সালের ভেতর প্রাচীন ভারতবর্ষ সম্পর্কে জানবার ব্যাপারে একটি আগ্রহ গণমানুষের ভেতর জন্ম নেয় বলে মুরশিদ মন্তব্য করেছেন।

সমাজ সংস্কারের অন্যতম প্রধান শর্ত ধর্মের সংস্কার। কার্যত ধর্ম-সংস্কার না করে সমাজের সংস্কার সম্ভব নয়। বঙ্গদেশে ধর্ম-সংস্কারের আন্দোলনটি শুরু হয় রামমোহন রায়ের হাত ধরে। তিনি পৌত্তলিকতা বর্জিত একেশ্বরবাদী একটি সমাজ গঠন করতে চেয়েছিলেন, যেটিকে আমরা আজ ব্রাহ্মসমাজ নামে জানি। এ সমাজের ব্রহ্মসভাতে শুদ্রদের বেদ শোনার অধিকার ছিলো, যদিও প্রচলিত লোকাচার অনুযায়ী শুদ্ররা বেদ শুনতে পারতেন না, তা নিষিদ্ধ ছিলো। তবে এ সমাজ পুরোপুরি বিকাশ লাভ করবার আগেই রামমোহন রায় বিলেতে মৃত্যুবরণ করেন। এরপর এ সমাজের হাল ধরেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। রামমোহন চেয়েছিলেন আচার বিবর্জিত একটি একেশ্বরবাদী সমাজ গড়তে, দেবেন্দ্রনাথ একে আচার-অনুষ্ঠানে বাঁধা একটি ধর্মীয় রূপ দেন। এই ধর্মটির নাম তিনি দেন ব্রাহ্মধর্ম। প্রচলিত হিন্দুধর্মকে তিনি এতটাই সংস্কার করেন, সে সময়ে কেউ ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করলে হিন্দুসমাজে তার জাত চলে যেতো। ১৮৪৩ সালে দেবেন্দ্রনাথ রাজনারায়ণ বসুকে সাথে নিয়ে বিস্কিট খেয়ে, আর মদ্য পান করে হিন্দুধর্ম চিরতরে ত্যাগ করেন।

যে সময়টায় দেবেন্দ্রনাথ এই ধর্ম সংস্কারে নেমেছেন, সে সময়ে ধর্মবাদীরা বিভিন্ন ছেলেমানুষী ছদ্ম-বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিয়ে তাঁদের ধর্মটির শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করতে চেয়েছেন। উদাহরণস্বরূপ মুরশিদ উল্লেখ করেছেন এক নেতার কথা যিনি প্রচার করতেন ইংরেজি গডকে উল্টো করে লিখলে তা ডগ হয়, কিন্তু হিন্দুদের অবতার নন্দনন্দনকে উল্টো করে লিখলে নন্দনন্দনই থাকে (অতএব, আর কোন অনুগ্রহকে অস্বীকার করবেন... )। মুরশিদ উল্লেখ করেছেন, এই ধার্মিকেরা নাকি দাবী করতেন “বেদে সব আছে”, অর্থাৎ কী না, আধুনিক যুগে বিজ্ঞানের অবদান যা কিছু আমরা আমাদের চারপাশে দেখতে পাই, তার সবই হাজার হাজার বছর আগে বেদে বলা হয়ে গেছে, পশ্চিমারা এখন এই বেদ পড়েই এই সব কিছুর সন্ধান পেয়েছেন। বাঙলাদেশের মুসলমানেরা এমন একটি বয়ানের সাথে খুব ভালোভাবে পরিচিত; মসজিদে মসজিদে এমন একটি খুৎবা-ই তাঁরা ঈমাম সাহেবের কাছ থেকে শুনে আসেনঃ এ জগতের সমস্ত বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবনের কথা ১৪০০ বছর আগেই কোরানে এসেছে।। আমেরিকায় খ্রীষ্টানেরা ঠিক একই কথাটি চার্চে শুনে আসেন ফাদারদের কাছ থেকে, বাইবেলকে ঘিরে।

গোঁড়া ধর্মবাদীদের নানান ছদ্ম-বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যায় আস্থা হারিয়ে বাঙলার তরুণ সমাজের কেউ কেউ সে সময়ে খ্রীষ্টধর্ম গ্রহণ করেন। তাঁদের ধারণা হয়েছিলো খ্রীষ্টধর্মই আধুনিকতার প্রথম ধাপ। কুলীন ব্রাহ্মণ কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় ১৮৩২ সালে খ্রীষ্টধর্মের দীক্ষা নিয়ে বেশ সাড়া ফেলে দেন। প্রায় একই সময়ে মধুসূদন দত্ত, লালবিহারী দে, কৃষ্ণদাস পাল, হিন্দু কলেজের ছাত্র মহেশচন্দ্র ঘোষ, এবং আনন্দচন্দ্র মজুমদার প্রমুখ ধর্ম পাল্টে খ্রীষ্টান হন। তবে হিন্দু ধর্ম ছেড়ে আসায় সমাজ, এবং সম্পত্তিচ্যুত হতে হতো বলে ধর্মান্তরের ব্যাপারটি সম্ভবত খুব আকর্ষণীয় হয়ে ওঠেনি। ধর্মান্তর ছাড়াও সমাজ সংস্কারের অন্যান্য যে দিকগুলো ছিলো সেদিকে বাঙলার মুসলমানেরা আগ্রহী হননি মোটেই। রেনেসাঁন্স-এর আলোতে আগ্রহী হবার জন্য যে শিক্ষার প্রয়োজন সেটিই তাঁদের ছিলো না বলে মুরশিদ মন্তব্য করেছেন।

রামমোহন রায় যে তাঁর লেখালেখির মাধ্যমে ধর্ম এবং সমাজের সংস্কার করতে চেয়েছেন সে তো কিছুটা একটু আগেই জানতে পেলাম। মুরশিদ জানাচ্ছেন তাঁর ধর্ম সংস্কার শুধু হিন্দুধর্মের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, তিনি দেশী খ্রীষ্টানদের পৌত্তলিকতার বিপক্ষেও নাকি লড়াই চালিয়েছেন; পত্রিকা এবং পুস্তিকায় বিভিন্ন লেখার মাধ্যমে খ্রীষ্টান মিশনারিদের সঙ্গে ধর্মীয় নানান কুসংস্কার নিয়ে বিতর্কে নেমেছেন। শুধু ধর্ম সংস্কারই নয়, বাঙলার নারীদের অবস্থানের উন্নতির জন্যও কাজ করে গেছেন রামমোহন; সতীদাহ প্রথা রদ করবার উদ্দেশ্যে লণ্ডনের আইনসভায় বিতর্ক করতে যাওয়াটাই তাঁর বিলেতে যাবার অন্যতম কারণ ছিলো বলে মুরশিদ রায় দিয়েছেন।

নারীকল্যাণ প্রসঙ্গে অক্ষয়কুমার দত্তের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন মুরশিদ; তিনি ১৮৪২ সালে বিদ্যাদর্শন নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন, যেটিকে মুরশিদ সমসাময়িক অন্য যেকোন পত্রিকার চেয়ে অনেক বেশি নারীবান্ধব হিসেবে দেখেছেন। বাল্যবিবাহের দোষ, বালবিধবাদের বিবাহের ঔচিত্য, স্ত্রীশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা, নারীদের “কিঞ্চিৎ” স্বাধীনতা-ইত্যাদি বিষয়ে এই পত্রিকায় নিয়মিত লেখা প্রকাশ হতো। “স্ত্রীলোকের স্বাধীনতা” কথাটিও নাকি অক্ষয়কুমার দত্তই প্রথম ব্যবহার করেন সবার আগে। তিনি তত্ত্ববোধিনী নামে একটি ধর্মীয় পত্রিকা পরিচালনা করতেন, কিন্তু প্রার্থনার ফল যে শূণ্য, তা চমৎকার একটি গাণিতিক সমীকরণ দিয়ে প্রকাশ করেছিলেন। তাঁর সমীকরণটি ছিলোঃ

পরিশ্রম = শস্য। পরিশ্রম + প্রার্থনা = শস্য। তাই, প্রার্থনা = ০




তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য



মেঘনাদবধ কাব্য

রামায়ণ



শর্মিষ্ঠা

রাজস্থান ইতিবৃত্ত

কৃষ্ণকুমারী

ইফেজেনিয়া অ্যাট আউলিস



বৃত্রসংহার কাব্য

রৈবতক

কুরুক্ষেত্র

প্রভাস



সমাচারদর্পণ

সমাচারচন্দ্রিকা







নবনারী

কুমুদিনীচরিত

জীবানালেখ্য

মুক্তকেশীর জীবনচরিত



ইতিবৃত্ত

আমার কথা

ইংলণ্ডে বঙ্গমহিলা







2024-10-01T00:00:00.000Z
বাংলা ভাষার উদ্ভব ও অন্যান্য

বাংলা ভাষার উদ্ভব ও অন্যান্য

By
Ghulam Murshid
Ghulam Murshid
বাংলা ভাষার উদ্ভব ও অন্যান্য

বাঙলা ভাষার অতীত, বর্তমান, ও ভবিষ্যৎ নিয়ে লেখা ছোট-বড় নানান দৈর্ঘ্যের ১৭টি প্রবন্ধ নিয়ে সংকলিত বই বাংলা ভাষার উদ্ভব ও অন্যান্য। নিজস্ব বিভিন্ন এজেন্ডা বাঙলা ভাষার আগ্রহী পাঠকের কাছে পৌঁছে দেবার জন্য সময়ে সময়ে কলম ধরেছেন গোলাম মুরশিদ; সে কারণেই, বাঙলা ভাষার ইতিহাস, সাহিত্য, ও বাঙালির ধর্ম নিয়ে আলোচনা করা এ বই প্রায়শয়ই একটি ‘সোশ্যাল কমেন্টারি' হয়ে উঠেছে। বেশ কিছু আগ্রহোদ্দীপক ব্যাপার জানলাম বইটি পড়ে, সেগুলোর একাংশই এখানে টুকে রাখছি।

বাঙলা ভাষার উৎস প্রসঙ্গে জনপ্রিয় একটি ধারণা রয়েছে যে এ ভাষার শতকরা ৯০টি শব্দই এসেছে আর্যদের মৌখিক ভাষা-প্রাকৃত-এবং লিখিত ভাষা-সংস্কৃত থেকে। গোলাম মুরশিদ এ ধারণাটির কিছুটা বিরোধীতা করেই তাঁর বই শুরু করেছেন। এর ব্যখ্যায় তিনি দেখিয়েছেন আর্যরা কোন পথে কীভাবে এ বাঙলায় এলো, এবং কীভাবে মানুষের মুখে মুখে ভাষার পরিবর্তন ঘটে আজকের আধুনিক বাঙলায় পরিণত হলো। ধারণা করা হয় আজ থেকে প্রায় ২৮০০ বছর আগে আর্যরা উত্তর ভারত থেকে গঙ্গা নদীর তীর ধরে এসে আধুনিক পশ্চিমবঙ্গের গৌড় অঞ্চলে বসতি স্থাপন করে। এরপর তাদের একটি অংশ দক্ষিণ দিকে, এবং অপর অংশ পুব দিকে ছড়িয়ে পড়ে।


ছবিঃ প্রাচীন বঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলের মানচিত্র

আর্যদের মুখের ভাষাকে ‘প্রাকৃত' বলা হয়, সে আমরা মাত্রই জেনেছি। পূর্ব ভারতে যে প্রাকৃত ভাষাটি ব্যবহৃত হতো, সেটির নাম ‘মাগধী প্রাকৃত'। এই প্রাকৃত ভাষাটি বঙ্গ, আসাম, এবং ওড়িষায় এসে কয়েক শতাব্দী ব্যাপী পারস্পারিক আদান-প্রদানের মাধ্যমে নতুন একটি ভাষায় পরিণত হয়, যাকে অপভ্রংশ বলা হয়। অপভ্রংশের পর নতুন যে ভাষা তৈরী হয়, তাকে বলা হয় ‘অবহট্ট'। এই অবহট্টের আধুনিক বিবর্তিত রূপই হলো বাঙলা, ওড়িয়া, এবং অহমিয়া।

আর্যরা তো ভারতবর্ষে এলো ২৮০০ বছর আগে, কিন্তু এর আগে তারা কোথায় থাকতো? আজ থেকে প্রায় ৬ হাজার বছর আগে আর্যরা সম্ভবত দক্ষিণ-পূর্ব ইওরোপের তৃণভূমিতে বাস করতো। এদের একটি দল পরবর্তীতে ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে, এবং অপর একটি দল কৃষ্ণ সাগর ও ক্যাস্পিয়ান সাগরের মাঝ দিয়ে ইরান, আফগানিস্তান হয়ে ভারতবর্ষে চলে আসে। এই সব ক'টা অঞ্চলে তারা নিয়ে যায় তাদের ভাষা, যেটিকে পণ্ডিতেরা আজ ‘ইন্দো-ইউরোপি���়ান' ভাষা বলে অভিহিত করেন। ল্যাটিন, গ্রীক, সংস্কৃত-এই ভাষাগুলোর উৎপত্তি এই ইন্দো ইউরোপিয়ান ভাষা থেকেই।


ছবিঃ ইন্দো ইউরোপিয়ান ভাষা ছড়িয়ে পড়ার মানচিত্র।

বাঙলা ভাষা যে স্রেফ সংস্কৃতের একটি বিবর্তিত রূপ নয়, এর যে নিজস্ব একটি কাঠামো আছে, তার চমৎকার একটি আলোচনা এ বইতে আছে, যার চুম্বক অংশ এখানে টুকে রাখার লোভ সামলাতে পারছি না! বাঙলা ভাষায় অতীত কাল বোঝাতে ক্রিয়াপদের শেষে আমরা কিছু অর্থবিহীন ধ্বনি যোগ করি (যেমনঃ লাম, লো, লে-ছিলাম, ছিলো, ছিলে ইত্যাদি অর্থে)। এই ধ্বনিসমষ্টিকে ব্যাকরণের ভাষায় ক্রিয়া বিভক্তি বা কৃৎ প্রত্যয় বলা হয়। হিন্দীতে অতীত কাল বোঝাতে ক্রিয়ার শেষে “থা” যোগ করতে হয় (পড়া থা), ওড়িয়াতে যোগ করতে হয় “থিলা” (খাইথিলা)। উত্তর ভারতের আর কোন ভাষায় এই লাম, লে, লো প্রত্যয় যোগ করা হয় না। এটি বাঙলার একান্ত নিজস্ব বৈশিষ্ট্য। একইভাবে, ভবিষ্যৎকাল বোঝাতেও বাঙলায় আমরা “বো”, “বে”-এই প্রত্যয়গুলো ক্রিয়াপদের শেষে যোগ করি (করবো, করবে-ইত্যাদি অর্থে)। এছাড়া, “পাগলে কী না বলে”, “ছাগলে কী না খায়”-এসব বাক্যে কর্তার সাথে “এ” ধ্বনিটি যোগ করাও বাঙলার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। আরো রয়েছে নির্দেশক প্রত্যয়, যেমন -টা, -টি, -খানা ইত্যাদি (চিঠিটি, বইটা, এক খান ইত্যাদি অর্থে)। হিন্দীতে “এক চিঠ্‌টি” বাঙলায় এসে “একটা চিঠি” হয়ে যায়। এই নির্দেশক প্রত্যয়ও বাঙলার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য।

বাঙলায় শব্দের শেষে যেমন অর্থবিহীন প্রত্যয় যোগ করে নতুন শব্দ তৈরী করা হয়, তেমনি শব্দের শুরুতেও প্রত্যয় যোগ করার রীতি রয়েছে, যাদের উপসর্গ বলা হয়। “উপ” শব্দটি নিজেই একটি উপসর্গ, যার যোগে তৈরী হয়েছে “উপহার”, “উপদ্বীপ”, “উপগ্রহ”, “উপপরিচালক”, “উপভাষা” ইত্যাদি শব্দগুলো। সংস্কৃত ভাষায় -অপ, -অধি, -অপি,-প্র-ইত্যাদি একুশটি উপসর্গ রয়েছে সত্যিই, তবে বাঙলারও প্রচুর নিজস্ব উপসর্গ রয়েছে, যেমনঃ অ+বেলা, আ+ধোয়া, কু+কথা, নি+খোঁজ, হা+ভাতে ইত্যাদি। ধারণা করা হয় এই প্রত্যয়গুলো সবই স্থানীয় অনার্য আদিবাসীদের ভাষা থেকে বাঙলায় এসেছে। বাঙলা ভাষার আরো দুটি বৈশিষ্ট্য হলো ধ্বন্যাত্নক শব্দ এবং জোড়া শব্দ-ব্যাকরণের ভাষায় যাদের বলা হয় শব্দদ্বৈত। ধ্বন্যাত্নক শব্দ দিয়ে ধ্বনির অনুকরণ করা হয়, যেমনঃ ঢংঢং, কুলকুল, ঘ্যান ঘ্যান, চুক চুক, খচ খচ ইত্যাদি। অপরদিকে, জোড়াশব্দের উদাহরণ হিসেবে আমরা আঁকাবাঁকা, এলোমেলো, রাজাবাদশা, ছোটবড়-ইত্যাদি শব্দগুলোর দিকে তাকাতে পারি। বাঙলা শব্দদ্বৈতের সঙ্গে সংস্কৃতের কোন যোগাযোগ নেই। বাঙলার নিজস্ব এই বৈশিষ্ট্যগুলোর কথা উল্লেখ করে গোলাম মুরশিদ দাবী করেছেন বাঙলাকে কেবল সংস্কৃতের সরাসরি দুহিতা বলা ঠিক নয়।

বাঙলা ভাষার আরেকটি অন্যতম বিশেষত্ব এর পদক্রম। কেউ যদি বলে, “north side-এর right corner-এর tube lightটা on করো”-তাহলে অতোগুলো ইংরেজি শব্দ থাকার পরও ভাষাটাকে বাঙলাই বলতে হয় “এর”, এবং “টা” প্রত্যয়গুলোর জন্য। এছাড়াও, “lightটা” এখানে কর্ম (object), আর on করো হলো ক্রিয়া, এদের পদক্রম বলে দেয় এই ভাষাটা বাঙলা। অপরদিকে, কেউ যদি বলে, “it was raining, তাই ঠিক করলাম, going out won't be right”, তাহলে ভাষাটা পদক্রমের জন্য ইংরেজিই হবে। বাঙলায় বলতে হলে বলতে হতো, “going outটা right হবে না”। কোন পদটা কখন কোথায় বসছে তা-ই মূলত নির্ধারণ করে দেয় ভাষাটা আসলে কী। এ প্রসঙ্গে আরেকটি বিখ্যাত উদাহরণ দেয়া যায়; সংস্কৃত ভাষার “নরো ব্যাঘ্রং হন্তি” বাক্যটির মানে দাঁড়ায় “মানুষ বাঘ মারে”। এই তিনটি শব্দকে আগে পরে যেভাবেই সাজানো হোক না কেন (নরো হন্তি ব্যাঘ্রং, হন্তি ব্যাঘ্রং নরো, ব্যাঘ্রং নরো হন্তি...ইত্যাদি), তাতে বাক্যের অর্থ পরিবর্তিত হয় না। কিন্তু বাঙলায় “মানুষ বাঘ মারে”, আর “বাঘ মানুষ মারে”-এই দুটি বাক্য সম্পূর্ণ উল্টো অর্থ প্রকাশ করে। বাঙলা ভাষা চেনার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য এর এই পদক্রম (কর্তা+কর্ম+ক্রিয়া)। প্রায় হাজারখানেক বছর আগে লেখা চর্যাপদের ভাষা যে মূলত বাঙলা তা এই সকল সূত্র মিলিয়েই নির্ধারণ করা।

চর্যাপদ যে খাঁটি বাঙলা ভাষায় লেখা-এ দাবী করাটাও পুরোপুরি ঠিক নয় সত্যি বলতে, কারণ, চর্যায় প্রাচীন ওড়িয়া, ও প্রাচীন অহমিয়া ভাষার নিদর্শনও পাওয়া যায়। যে সময়ে চর্যা রচিত হয়, তখনও বাঙলা, অহমিয়া, ও ওড়িয়া নিজস্ব রূপ পুরোপুরি পায়নি। খাঁটি বাঙলা ভাষার সবচেয়ে পুরনো নমুনা হিসেবে বর্তমানে বড়ু চণ্ডীদাসের “শ্রীকৃষ্ণকীর্তন”কে শনাক্ত করা হয়। এর রচনাকাল নিয়ে তর্ক রয়েছে; সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়-এর মতে এর রচনাকাল ১৪ শতকের শেষ দিকে, আর সুকুমার সেন রায় দিয়েছেন এই পুঁথির রচনাকাল কোনমতেই ১৭ শতকের আগে নয়। চর্যাপদের সাথে শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের ভাষার বেশ কিছু পার্থক্য রয়েছে, সর্বনামের ভিন্নতা তার মাঝে অন্যতম। চর্যাপদ, ও শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে ব্যবহৃত উত্তম পুরুষ, ও মধ্যম পুরুষের সর্বনামগুলোর তালিকা বানালে তা দেখতে কতকটা এমন হয়ঃ



এই সর্বনামগুলোর প্রায় সবই আজ বিলুপ্ত; আধুনিক বাঙলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সর্বনাম ‘আমি' তখনো জন্ম নেয়নি। এ সর্বনামটির প্রথম আবির্ভাব ১৫ শতকের শেষের দিকে, মালাধর বসুর ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়”-এ। এরপর ষোল শতকের মধ্যভাগ অব্দি আরো বেশ অনেকের লেখাতেই ‘আমি' এসেছে, তবে সে সময়ে ‘আমি', এবং ‘আমিসব' দিয়ে ‘আমরা' বোঝানো হতো। অহমিয়া ভাষায় এখনো ‘আমি' বহুবচন হিসেবে ব্যবহৃত হয়। অপরদিকে ওড়িয়াতে বহুবচনে ব্যবহৃত হয় ‘আম্ভে', যার আদিরূপ ‘আহ্মে'।

মালাধর বসুর শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের বছর চল্লিশেক পর চৈতন্যদেব তাঁর বৈষ্ণব ধর্ম প্রচার শুরু করেন আধুনিক পশ্চিমবঙ্গের নদিয়ায়। ১৫৩৩ সালে চৈতন্যদেব মারা যাবার পর তাঁর চ্যালাচামুণ্ডারা সম্ভবত বৈষ্ণবধর্মকে বিধিবিধানে পূর্ণ একটি প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মে পরিণত করেন (অরগ্যানাইজড রিলিজিয়ন)। মুরশিদের মতে এই চ্যালারা প্রায় সবাই-ই সংস্কৃত-পণ্ডিত ছিলেন, যাঁরা নাকি ফতোয়া জারি করেন, বাঙলায় লেখা পুরাণ (রামায়ন/ মহাভারত) চর্চা করলে রৌরব নরকবাস নিশ্চিত। এ ধরণের ফতোয়ার কারণে চর্যাপদ এবং শ্রীকৃষ্ণকীর্তনকে ঘিরে যে লৌকিক বাঙলা সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিলো তা বেশ অনেকটাই স্তিমিত হয়ে পড়ে এবং অতি-সংস্কৃতায়ণের দরুন একধরণের কৃত্রিমতা গেঁড়ে বসে বলে গোলাম মুরশিদ মন্তব্য করেছেন।

বাঙলা গদ্যে পুরোদমে বই লেখা শুরু হয় ১৮০০ সালে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠিত হবার পর। এ কলেজের পণ্ডিতেরা প্রায় সবাই-ই ছিলেন সংস্কৃত বিশেষজ্ঞ। মুরশিদের মতে এঁরা দেশী, এবং আরবী-ফার্সি শব্দ যতখানি সম্ভব পরিহার করে সংস্কৃত শব্দের আধিক্যে বেশ কিছু বই লেখেন, এবং এই সংস্কৃতায়ণ করতে গিয়ে নিজেদের বানানো কিছু ছদ্ম-সংস্কৃত শব্দ ব্যবহার করেন। এমনই একজন পণ্ডিত রামরাম বসুর বানোয়াট সংস্কৃত শব্দের একটি তালিকা মুরশিদ দিয়েছেনঃ



রামরাম বসুর অতি-সংস্কৃতায়ণের একটি উদাহরণ মুরশিদ দিয়েছেন; বসু ‘গাত্রমোচন' শব্দটি লিখেছেন তাঁর রচনায় ‘গা মোছা' অর্থে। মুরশিদের মতে গা না লিখে গাত্র লেখাটা সংস্কৃতের প্রভাব বটে, কিন্তু আসল মুশকিলটা হলো ‘মোচন' শব্দটির অর্থ ‘মোছা' নয়, বরং ‘মুক্তি দান'। এভাবে গা মোছাকে বসু জাতে তুলতে চেয়েছেন বলে মুরশিদ মন্তব্য করেছেন। রামরাম বসুর পাশাপাশি মুরশিদ উল্লেখ করেছেন গোলোকনাথ শর্ম্মার কথা; তিনি ‘অবিদ্বান' কে অবিদ্যান, ‘কর্ত্তব্য'কে কর্ত্তব্ব, ‘মিত্রতা'কে মৈত্রতা ইত্যাদি বানানে লিখে এমন সংস্কৃতায়ণের চেষ্টা করেছেন। মুরশিদের মতে সংস্কৃতায়ণের বিষয়ে এই পণ্ডিতদের পথপ্রদর্শক ছিলেন মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার।

১৮৫৪ সালে প্যারীচাঁদ মিত্র প্রথম বাঙলা উপন্যাস আলালের ঘরে দুলাল লেখা শুরু করেন। সমাজ-সংস্কারের উদ্দেশ্যে লেখা কিছুটা উপদেশমূলক এ উপন্যাসে দেখা যায় ধনী পরিবারের বড় ছেলেটি আদরে বখে গেছে, এবং ছোট ছেলেটি লেখাপড়া শিখে আদর্শ চরিত্রের এক তরুণে পরিণত হয়েছে। মুরশিদের মতে, এ উপন্যাসে লেখক ভাষা নিয়ে একটি সূক্ষ্ম খেলা খেলেছেন; যে চরিত্রগুলো অনুকরণযোগ্য, তাদের মুখে বসিয়েছেন সাধু ভাষা, কিন্তু আড়ষ্ট সে ভাষা সে চরিত্রগুলোকে বেশ অনেকটাই নাকি প্রাণহীণ করে তুলেছে। অপরদিকে উপন্যাসের মন্দ চরিত্রগুলো কথা বলে কথ্য অশিষ্ট ভাষায়, যাতে প্রচুর আরবী-ফার্সি শব্দের ব্যবহার রয়েছে। এ চরিত্রগুলো নাকি তুলনামূলক বেশ অনেকটাই জীবন্ত ও বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। কথ্য ভাষার প্রয়োগে কোন গল্প লেখার প্রথম প্রয়াসও বোধহয় এটিই। খাঁটি মৌখিক ভাষার প্রথম সত্যিকার প্রয়োগ লক্ষ করা যায় কালীপ্রসন্ন সিংহের লেখা (সম্ভবত) হুতোম প্যাঁচার নকশায় (১৮৬১-৬৩)। মুরশিদ উল্লেখ করেছেন এ বইতে বানানরীতি বেশ আধুনিক, অনেকটা যেন উচ্চারণকে অনুসরণ করেই লেখা (যেমনঃ গেলো থেকে গ্যালো)। শ্রেণীভেদে ভাষার এমন ভিন্নতা বঙ্কিমচন্দ্রের লেখাতেও দেখা যায়। তাঁর উপন্যাসে সংলাপ সাধু ও চলিতের মিশ্রণে গঠিত; মুরশিদের মতে, বিশেষতঃ নিম্নশ্রেণীর এবং অশিক্ষিত নারী চরিত্ররা বেশীরভাগ সময়ে কথ্য ভাষায় কথা বলে। তিনি উল্লেখ করেছেন, বঙ্কিমের উপন্যাসে স্বামী-স্ত্রীর কথোপকথনের দৃশ্যে দেখা যায় স্বামী কথা বলছেন সাধু ভাষায় আর স্ত্রী চলিত ভাষায়।

হিন্দু পুরোহিতরা যেমন বাঙলাকে ধর্মচর্চার অনুপযোগী মনে করেছেন, তেমনি মুসলমান মোল্লারাও বাঙলাকে ‘কুফরি জবান' বলে অভিহিত করে সাম্প্রদায়িকতাকে উস্কে দিতে চেয়েছেন বারেবারে। মুরশিদ আলোচনা করেছেন বাঙালি মুসলমান আদৌ বাঙালি কি না, সে নিয়ে কীভাবে ১৯২০-এর দশক অব্দি পত্রিকায় লেখালেখি হয়েছে। মুরশিদের আলোচনায় উঠে আসে কয়েকজন প্রগতিশীল মুসলমান চিন্তাবিদের নাম (হামেদ আলী, এবং সৈয়দ এমদাদ আলী), যাঁরা নূর-অল-ইমান, নবনূর, বাসনা ইত্যাদি পত্রিকায় কড়া ভাষায় প্রবন্ধ লিখে বাঙালি মুসলমানদের একটি দলকে বেশ কড়কে দিয়েছেন। তাঁদের মতে এই দলটির অন্তর্গত বাঙালি মুসলমানেরা সাতশ বছরের বেশি সময় ধরে এ বাঙলায় বাস করেও ইরাক-ইরান-কোহেকাফের স্বপ্নে বিভোর থাকেন।

মুরশিদ তাঁর বয়ানে প্রগতিশীল এই মুসলমান লেখকদের বিপরীত দাঁড় করিয়েছেন শেরে বাঙলা খ্যাত এ কে ফজলুল হককে। মুরশিদ উল্লেখ করেছেন হক বাঙলাভাষী হয়েও উর্দু শেখানোর পক্ষে ছিলেন, এবং বাঙলাকে শিক্ষার মাধ্যম করার বিরুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন। এছাড়াও, '৭১ সালে স্বাধীন হবার আগ পর্যন্ত পূর্ব বাঙলায় যে সত্যিকার অর্থে স্থায়ী কোন সরকার আসেনি, এর জন্যও ফজলুল হককে বেশ অনেকটাই দায়ী করেছেন মুরশিদ। তাঁর মতে, ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলীম লীগকে বিপুল ব্যবধানে হারাবার পর যুক্তফ্রন্ট (আওয়ামী মুসলিম লীগ, কৃষক-শ্রমিক পার্টি, নেজাম-ই-ইসলামী, এবং গণতন্ত্রী দলের সমন্বয়ে গঠিত মহাদল) যখন ফজলুল হককে মুখ্যমন্ত্রী বানাবার সিদ্ধান্ত নেয়, তিনি তখন সবচেয়ে বড় দল আওয়ামী লীগকে ন্যায্য আসন দিতে অসম্মতি দান করেন। পরে আওয়ামী লীগের সাথে সমঝোতায় এলেও শপথ গ্রহণের মাত্র ২ সপ্তাহ পরেই ফজলুল হকের সে মন্ত্রীসভা বাতিল করতে হয়। মুরশিদ মন্তব্য করেছেন এর পর কৃষক-শ্রমিক পার্টি, আওয়ামী লীগ, ও ফজলুল হক শুধু প্রতিযোগীতা করে গেছেন কে পাকিস্তান-গভর্নরের মন বেশি যুগিয়ে চলতে পারেন। প্রথম ১১ বছরে পূর্ব পাকিস্তানে ৯টি মন্ত্রীসভা শপথ নিয়েছে; এই অস্থিরতার দায় মুরশিদ শেরে বাঙলাকেই দিয়েছেন।

দেশভাগের বেশ কয়েক দশক আগে থেকেই বাঙালি হিন্দু, এবং বাঙালি মুসলমান বারবার দাঙ্গায় জড়ালেও '৫২-এর ভাষা আন্দোলনের ফলে হিন্দু-মুসলমান দলাদলিটা বেশ খানিকটা কমে আসে-এমন একটি ইঙ্গিত মুরশিদের এ বইতে পাওয়া যায়। মুরশিদের দাবী, সাহিত্য, এবং সংস্কৃতির ক্ষেত্রে আংশিকভাবে হলেও অসাম্প্রদায়িক মনোভাব গড়ে উঠতে শুরু করে। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করেছেন মৈত্রেয়ী দেবী এবং গৌরী আইয়ুবের মতো প্রগতিশীল মানুষদের কথা যাঁরা দাঙ্গা বিরোধী সংস্থা গড়ে তুলেছিলেন; সাম্প্রদায়িক মৈত্রী বাড়াবার উদ্দেশ্যে এই সংস্থা থেকে তাঁরা নবজাতক, এবং ব্রাদার্স ফেইস নামে দুটি পত্রিকাও চালু করেছিলেন। দুই বাঙলার এই মৈত্রী '৭১-এ বাঙলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় আরো সম্ভবত দৃঢ় হয়। মুরশিদ বলেছেন '৬৪-এর দাঙ্গার সময় আনন্দবাজার পত্রিকা-গোষ্ঠী সাম্প্রদায়িকতাকে উস্কে হলুদ সাংবাদিকতা করেছে বটে, কিন্তু '৭১ সালে তার ভূমিকা আমূল বদলে যায়, বাঙলাদেশের আন্দোলনে নানাভাবে তারা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ও বহু শরনার্থী অধ্যাপককে চাকরিতে নিয়োগ দেয় সে সময়। মুরশিদের বয়ানে জানতে পাই '৭১ সালে নাকি কলকাতার দূর্গাপূজার মণ্ডপে দেবদেবীর মূর্তির পাশে শেখ মুজিবের ছবিও টাঙানো হয়েছিলো!

এ বইয়ের একটি প্রবন্ধে '৫২'র ভাষা আন্দোলনের পটভূমিকা, এবং ২১শে ফেব্রুয়ারির ঘটনাবলীর একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণী আছে। এ লেখাটি পড়লে দুটো ব্যাপার চোখে পড়ে। প্রথমত, ভাষা-আন্দোলনকারীদের দমাবার জন্য আইয়ুব খানের সরকার যে পন্থা অবলম্বন করে, তার সাথে '২৪-এর জুলাই-আন্দোলন দমাবার জন্য হাসিনা-সরকারের পন্থার আশ্চর্য মিল; অনেকটা যেন আইয়ুব খান এবং শেখ হাসিনা একই মায়ের সন্তান, একই তাদের জিনগত বৈশিষ্ট্য, একই তাঁদের চরিত্র, এবং একই তাঁদের শিক্ষার্থী খুন এবং লাশ গুম করবার তরিকা। মুনীর চৌধুরীর কবর নাটকটি '৫২, এবং '২৪-দুইয়েরই প্রেক্ষিতে ভীষণ প্রাসঙ্গিক। দ্বিতীয়ত, নিজের রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের ব্যাপারে পূর্ববাঙলার মানুষের সচেতনতা। '৫২, এবং '২৪-এ ছাত্র-জনতার এক হবার patternটা একই রকম, আবেগটা একই জায়গায় গাঁথা। আমার ধারণা, পূর্ব বাঙলার বাঙলাভাষী এই মানুষদের ওপর জোর করে কোন সিদ্ধান্ত সহজে চাপিয়ে দেয়া যাবে না, দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে তারা বারবারই রুখে দাঁড়াবে।

ঐতিহাসিক বিভিন্ন তথ্য বাদে এ বইতে গোলাম মুরশিদের নিজস্ব যে বিশ্লেষণ ও মতামত রয়েছে, তার বেশিরভাগের সাথেই আমি একমত নই। নতুন কোন পরিবর্তনকে খুব ভালোভাবে গ্রহণ করতে মুরশিদ সম্ভবত আগ্রহী নন। বাঙলাদেশের টিভি নাটকের সংলাপে, এবং রেডিওর বয়ানে আপাতঃ অশিষ্ট কথ্য ভাষার ব্যবহার নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করেছেন বারবার। অথচ নিজেই তিনি প্রচুর যুক্তি দেখিয়েছেন কীভাবে বিভিন্ন সময়ে মানুষের মুখে মুখেই ভাষার বড় পরিবর্তনগুলো এসেছে। আগের সময়ের পরিবর্তন ভালো, বর্তমানেরটা নয়-এমন একটি পক্ষপাতমূলক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় তিনি দিয়ে গেছেন বইয়ের শেষার্ধ জুড়ে। বাঙলাদেশের মানুষ বিভিন্ন আঞ্চলিক টানে কথা বলে যাঁদের অনেকেই উন্নত জীবন যাত্রার উদ্দেশ্যে রাজধানীতে চলে যাবার পর ঢাকা শহরের চলিত কথ্যরীতিটি গ্রহণ করেন। বিশেষত তরুণসমাজের মুখে প্রচলিত এই কথ্য ভাষাটি মুরশিদ পছন্দ করেন না। মাত্র ২ সপ্তাহ আগেই মুরশিদ পরলোকগমন করেছেন; মৃত্যুর আগে তিনি বাঙলাদেশের জুলাই-আন্দোলন দেখে গেছেন। এ আন্দোলনে বারুদ যুগিয়েছে আওয়াজ উডা, কিংবা কথা ক গানগুলো। তরুণসমাজের অশিষ্ট এ ভাষাও কীভাবে প্রতিবাদের দুরন্ত হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে সেটি মুরশিদ দেখে গেছেন কি না জানি না। এ গান শোনার রূচি হয়তো তাঁর হতো না, কিন্তু কথ্য ভাষার শক্তির এ বাস্তবতাকে অস্বীকার করার কোন উপায় নেই।

এই প্রবন্ধগুলোর বেশিরভাগই আওয়ামীলীগের শাসনামলে লেখা (২০০৮-২০১৯), তাই শাসক গোষ্ঠীকে তুষ্ট করার একটা প্রচ্ছন্ন প্রবণতাও যেন লক্ষ করা যায়। জামাত সহ বাঙলাদেশের ইসলামী দলগুলো বাঙলা ভাষার মুসলমানী করাবার ষড়যন্ত্রে রত-এই অভিযোগ তুলে মুরশিদ অসংখ্যবার আওয়ামীলীগের শত্রু এই দলগুলোকে গালমন্দ করেছেন, কিন্তু স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থায় কেন এমন ইসলামী দলগুলো মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে সে আলোচনায় কখনোই যাননি। গোটা বইতে প্রচুর স্ববিরোধও চোখে পড়ে; জীবন-সায়াহ্নে এসে লেখা এই প্রবন্ধগুলোতে মুরশিদকে প্রায়ই খেই হারাতে দেখা গেছে।

সবশেষে, বইটির সম্পাদনা অত্যন্ত নিচু মানের। একই ধাঁচের বক্তব্য সংবলিত একাধিক প্রবন্ধ বিনা সম্পাদনায় বইতে যোগ করা হয়েছে, তাতে বইটির ওজনই বেড়েছে অনর্থক। অন্তত ৫০-৬০ পাতা কমিয়ে আনা যেতো অনায়াসেই। গোলাম মুরশিদ প্রথম আলো'র ভাষাগত গুণ্ডামি নিয়ে কথা বলেছেন; প্রথম আলোতে লেখা ছাপাতে হলে তাদের নিজস্ব বানান-রীতি শিখে আসতে হয় এমন মন্তব্য করেছেন। বইটি প্রথম আলো'র মালিকানাধীন সংস্থা থেকেই বেরিয়েছে। গুণ্ডামির সীমারেখাটা আরেকটু বাড়িয়ে মুরশিদের পুণরাবৃত্তিমূলক লেখাগুলোর ওপর কলম চালালেই পারতেন তাঁরা। এছাড়া, প্রচুর মুদ্রণ-প্রমাদ ও ভুল বানানও রয়েছে। বইটির নামকরণ নিয়েও আমার আপত্তি আছে; বাঙলা ভাষার উদ্ভব ও অন্যান্য-নামটি আমার দৃষ্টিতে বেশ lazy। বিভিন্ন সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে লেখা বিভিন্ন রকম বক্তব্যের এই লেখাগুলোকে এক মলাটে ধরতে গিয়ে লেখক-প্রকাশকের কেউই নামকরণের ব্যাপারে সৃষ্টিশীলতা দেখাতে পারেননি। প্রকাশ প্রকাশক প্রথমা হার্ডকাভারে সজ্জিত চমৎকার বাঁধাইয়ের এ বইয়ের দাম হাঁকিয়েছে ৫০০ টাকা; রুচিশীল পাঠকের কাছে এর অর্ধেকটাই ফালতু খরচ হিসেবে ঠেকবে।

2024-09-15T00:00:00.000Z
The Siege of Mecca: The Forgotten Uprising in Islam's Holiest Shrine and the Birth of al-Qaeda

The Siege of Mecca: The Forgotten Uprising in Islam's Holiest Shrine and the Birth of al-Qaeda

By
Yaroslav Trofimov
Yaroslav Trofimov
The Siege of Mecca: The Forgotten Uprising in Islam's Holiest Shrine and the Birth of al-Qaeda

কাবাঃ মুসলমানদের কাছে সবচেয়ে পবিত্র বলে গণ্য মক্কার এ স্থাপনাটি মুসলিম মানসের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থিত। প্রত্যেক মুসলমানই জীবনের কোন এক পর্যায়ে কাবা ঘর দর্শনের ইচ্ছে গভীরভাবে লালন করেন। এই স্থাপনাটিকে ঘিরে সত্যমিথ্যে মিলিয়ে নানানরকম গল্প প্রচলিত রয়েছে মুসলিম বিশ্বের দেশগুলোতে। মুসলমানদের ভেতর বেশ বড় একটি অংশই বিশ্বাস করেন কাবা ঘরটি পৃথিবীর কেন্দ্রে অবস্থিত (যদিও গোলক আকৃতির কোন বস্তুর পৃষ্ঠতলে ‘কেন্দ্র' বলে কোন কিছু হয় না)। এছাড়াও, ইসলামের প্রতি সম্মানের নিদর্শন হিসেবে কাবাঘরের ওপর দিয়ে কোন পাখি কখনো উড়ে যায় না-এমন একটি অবৈজ্ঞানিক, ভ্রান্ত, এবং কুসংস্কারাচ্ছন্ন বিশ্বাসও বহু মুসলমান অন্তরে ধারণ করেন। এই কাবা ঘরকে চতুর্পাশ থেকে ঘিরে তৈরী করা হয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মসজিদ দ্যা গ্র্যান্ড মস্ক। ইসলাম ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা নবী মুহম্মদের জন্মভূমি মক্কায় অবস্থিত এ মসজিদটিকে আরবীতে মসজিদ-আল-হারাম বলা হয়, কারণ পবিত্র এ নগরী এবং মসজিদ প্রাঙ্গণে বেশ কিছু কাজকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে, যার মাঝে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রক্তপাত; “হারাম শরীফ”-এর সীমানায় মারপিট, ঝগড়া বিবাদ, যুদ্ধ—বিগ্রহ, এসবের কিছুই চলবে না। এছাড়াও, মুসলমান নন-এমন মানুষদেরও এ সীমানায় প্রবেশ নিষিদ্ধ। ইসলাম ধর্মের অনুসারীরা যেহেতু বিশ্বাস করেন ইসলামের সবচেয়ে বড় শত্রু মূলত অমুসলিমরা, তাই তাঁদের প্রবেশ এখানে নিষিদ্ধ করে দিলেই রক্তপাতের ল্যাঠা চুকে যায়। আফটার অল, মুসলমান তো মুসলমানের সাথে ঝগড়া বিবাদ-রক্তপাতে জড়াতে পারেন না!

১৯৭৯ সালের ২০ নভেম্বরঃ ইতিহাসের পাতায় অবিস্মরণীয় এক দিন। ইসলামী নানাবিধ আন্দোলনের সাথে যাঁরা জড়িত, তাঁদের অনেকের কাছেই অমুসলিমীয় কায়দার ইংরেজী সাল মাসের এ তারিখটি হয়তো কোন গুরুত্ব বহন করবে না, কিন্তু আরবী তারিখটি এক নিমিষে আস্ত একটি দরজা খুলে দিতে পারে তাঁদের জন্য। এ দিনটি ছিলো হিজরী ১৪০০ সালের ১ম দিন (মুহাররম মাসের ১ তারিখ)। ইতিহাসের খাতায় এ দিনটি এত গুরুত্বপূর্ণ, এর কারণ এ দিনেই ঘটে যায় অকল্পনীয় এক ঘটনাঃ মুসলমানদের উগ্র একটি দল দখল করে নেয় মসজিদ-আল-হারাম, মসজিদ প্রাঙ্গণে ঘটে বিপুল রক্তপাত। মুসলমানের হাতেই মুসলমান খুন হয় পাইকারী হারে। কারণ? দখলকারী মুসলমানেরা ধারণা করতেন পৃথিবীব্যাপী ইসলামের ভুল একটি সংস্করণ চালু রয়েছে; সঠিক ইসলামের দিশা জানা আছে একমাত্র তাঁদেরই! বিশ্বব্যাপী ভ্রান্ত পথে থাকা কোটি মুসলমানদের সঠিক পথ দেখাবার জন্য, এবং ইসলামের জন্মভূমি সৌদী আরবের শাসকদের শায়েস্তা করবার জন্য এই ভয়ানক কাণ্ডটি ঘটান তারা। অনেকের কাছেই শুনতে অবাক লাগতে পারে, কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে প্রায় ৪৪ বছর আগে ঘটে যাওয়া এই ঘটনার হাত ধরেই আধুনিক সময়ের আল কায়েদা, ও আইসিস এই দু'টি ইসলামী জঙ্গি গোষ্ঠীর উত্থান।

মাত্র পাঁচ দশকেরও কম সময় আগে ইসলাম ধর্মের পবিত্রতম তীর্থভূমির দখল নিয়ে ঘটে যাওয়া এই ভীষণ অপ্রীতিকর ঘটনাটি সম্পর্কে পৃথিবীর বেশীরভাগ মুসলমানই সম্পূর্ণ অজ্ঞ। সৌদী সরকারের বিপুল প্রচেষ্টায় ধামাচাপা পড়ে গেছে ভয়াবহ এই ঘটনাটি। ইউক্রেনিয়ান-ইটালিয়ান সাংবাদিক ইয়ারোস্লাভ ট্রফিমভ তাঁর দ্যা সিজ অফ মেক্কা বইতে তুলে এনেছেন বিস্মৃতির অতলে চলে যাওয়া সেই কাহিনী। দারুণ সত্যান্বেষী এই প্রচেষ্টায় তিনি তুলে ধরেছেন মক্কা দখলের খুঁটিনাটি সকল বিবরণী। '৭৯ সালের এ ঘটনায় বাঙলাদেশ সমেত মুসলিম বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশেই অকারণ বিক্ষোভের আয়োজন করেন মুসলমানেরা; হামলা ও ভাঙচুর চালান আমেরিকান দূতাবাসগুলোতে। এই দূতাবাসগুলোর নিরাপত্তায় কোথায় কোন অফিসার প্রহরায় নিয়োজিত ছিলেন, হামলা চলাকালীন সময়ে কীভাবে তাঁদের সময় কেটেছে ইত্যাদি তথ্য থেকে শুরু করে বিশ্ব রাজনীতির মঞ্চে কী চলছিলো তখন-তার পুঙানুপুঙ্খ বয়ান উঠে এসেছে ট্রফিমভের এই বইতে।

শুরুতেই বলে নেয়া ভালো, কাবা দখলের ঘটনা ১৯৭৯ সালেই কিন্তু প্রথম ঘটেনি; বিভিন্ন শতকেই বিভিন্ন মতাদর্শের অনুসারীরা কাবায় হামলা চালিয়েছে, নিজেদের পকেটে পুরতে চেয়েছে স্থাপনাটিকে। ইসলামের ইতিহাসে কাবার ওপর চালানো সবচেয়ে বিখ্যাত হামলাটির কথা সূরা ফিল-এ এসেছে। ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দে ইয়েমেনের আবিসিনিয় খ্রিষ্টান শাসক আব্রাহা তাঁর বিশাল হস্তিবাহিনী নিয়ে কাবায় আক্রমণ চালান; তাঁর উদ্দেশ্য ছিলো কাবার স্থলে একটি গীর্জা স্থাপন করা। সূরা ফিল-এর সূত্রানুসারে আমরা জানতে পাই, আল্লাহ'র আদেশে শত শত আবাবিল পাখি মুখে ছোট ছোট নুড়ি পাথর বয়ে এনে আব্রাহার হস্তিবাহিনীর ওপর ছুঁড়ে মেরে তাদের ধ্বংস করে দেয়। আব্রাহা'র প্রায় ৬০০ বছর পর গীর্জা স্থাপনের একই উদ্দেশ্য নিয়ে ১১৮২ সালে ফরাসী ক্রুসেডার রেইনাড দে শাতিলিঁও কাবায় হামলা চালান। তাঁর উদ্দেশ্য ছিলো কাবা'র দখল নিয়ে মদিনায় গিয়ে নবী মুহম্মদের কবরটিকে গুঁড়িয়ে দিয়ে আসা। শাতিলিঁও'র এই উদ্দেশ্যও সফল হয়নি আব্রাহার মতই।

কাবাঘরের সত্যিকার ক্ষতিসাধন প্রকৃতপক্ষে মুসলমানরাই করতে পারেন; ৯২৯ সালে শিয়া মতাবলম্বী কার্মাশিয়ানরা কাবাঘর লুট করে হাজরে আসওয়াদ নামক পাথরটি চুরি করে নিয়ে আসেন। হজ্বযাত্রীদের কাছে এই পাথরটির মূল্য সবিশেষ; হজ্ব পালনের যে শাস্ত্রীয় আচারগুলো রয়েছে তার মাঝে অন্যতম এই হাজরে আসওয়াদে চুমু খাওয়া। কার্মাশিয়ানদের ধারণা ছিলো নিজেদের এলাকায় (খাতিফ) হাজরে আসওয়াদ স্থাপন করলে তা দেখতে তীর্থযাত্রীরা ভিড় জমাবেন, পর্যটন শিল্পের বরাতে ফুলে উঠবে তাদের পকেট, কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি। বাধ্য হয়ে ২০ বছর পর কার্মাশিয়ানরা বেশ অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্ত অবস্থায় পাথরটি মক্কায় ফেরত দিয়ে যায়। এরপর গুনে গুনে ১০৫০ বছর পর ১৯৭৯ সালেই মুসলমানেরা দ্বিতীয়বার আক্রমণ করেন কাবা; ২ সপ্তাহ কাবা অবরুদ্ধ রেখে বিপুল পরিমাণ জানমালের ক্ষতিসাধন করেন তাঁরা।

ধর্মবিশ্বাস মাত্রেই বিভাজন সৃষ্টিকারী; পৃথিবীর এমন কোন একটি ধর্ম নেই যেটির মূল বক্তব্য কী তা নিয়ে ধর্মটির অনুসারীদের নিজেদের ভেতর মতবিরোধ নেই। নিজেদের ধর্মকে সর্বশ্রেষ্ঠ দাবী করে আসা মুসলমানদের ভেতর এই বিভাজন এবং দলাদলিটি আরো প্রকট। তবে, ১৯৭৯ সালের এই মসজিদ-দখল কাণ্ড কারা এবং কেন ঘটিয়েছে তা জানতে হলে আমাদের সৌদী আরবের ইতিহাস কিছুটা জেনে আসতে হবে। সেই সাথে ইসলামের প্রচলিত নানান সংস্করণ সম্পর্কেও আমাদের একটি সম্যক ধারণা থাকা প্রয়োজন। ১৭৫০-এর দিকে আরবে মোহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওয়াহাব নামে একজন ধর্মপ্রচারক তাঁর গোঁড়া মতবাদের জন্য বেশ জনপ্রিয় হয়ে পড়েন; কট্টর ইসলামপন্থীদের কাছে তিনি আজও বড় একজন নায়ক। তাঁর প্রচারিত ইসলামের সংস্করণটিকে আমরা আজ ওয়াহাবী ইসলাম নামে জানি। এই মতটির অনুসারীরা অবশ্য নিজেদের “ওহায়াবী” বলে পরিচয় দেন না, এবং এই নামটিকে ভীষণ অপছন্দ করেন। কারণ, তাঁরা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন নবী মুহম্মদ ১৪০০ বছর আগে যে ইসলাম প্রচার করে গেছেন তাঁরা ঠিক সেটিকেই সঠিকভাবে পালন করে আসছেন, তাই এটিই প্রকৃত ইসলাম (তৌহিদ), একে বর্ণনা করতে “ওয়াহাবী” বা এমন বাড়তি কোন তকমার প্রয়োজন নেই। তাঁদের মতের বাইরে বাকী সব মুসলমানকেই তাঁরা ভ্রান্ত, এবং দুর্বল গণ্য করেন যারা কী না পশ্চিমা আনুকূল্য পেতে ইসলামের সত্যিকার আচারগুলোকে পাল্টে নরম করে নিয়েছে।

আব্দুল ওয়াহাবের একনিষ্ঠ সমর্থকদের একজন ছিলেন মোহাম্মদ আল সাউদ, যিনি মূলত আরবের নেজদ অঞ্চলের একজন শেখ। ওয়াহাবের মতাদর্শে ভীষণ উজ্জিবীত আল সাউদ ১৮০২ সালে গোটা আরব অঞ্চলের তৎকালীন শাসক অটোমানদের হঠাৎ প্রচণ্ড আক্রমণ করে ইরাকের কারবালার দখল নিয়ে নেন। ওয়াহাবী দৃষ্টিতে শিয়া মতবাদটি সর্বাপেক্ষা ঘৃণ্য; কারবালা আক্রমণের পর শিয়া অধ্যুষিত অঞ্চলটির মসজিদ এবং গ্রন্থাগারগুলোকে পুড়িয়ে দেন ওয়াহাবীরা। প্রায় ৪ হাজার মানুষও প্রাণ হারান তাঁদের হাতে। বিধর্মী শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ওয়াহাবীদের একটি অলিখিত নিয়ম রয়েছেঃ প্রতিপক্ষ শিবিরের গর্ভবতী নারীদের পেট চিরে ভ্রুণটিকে বের করে মায়ের লাশের ওপর ছড়িয়ে রেখে আসা। এই নিয়মটি আজও এঁরা অনেকেই পালন করেন; ২০১৬ সালে ঢাকার হলি আর্টিজানের ঘটনার পর বিধর্মীদের হত্যার পক্ষে বেশ কিছু পুস্তিকার প্রচলন বাড়ে অনলাইন জগতে যেখানে এ আচারটির ওপর বিশেষ জোরারোপ করা হয়।

আল সাউদের একজন বংশধর আব্দুলআজিজ আল সাউদ ১৯০২ সালে জর্দানের হাশেমাইট সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে আরবের বিভিন্ন অঞ্চল ছিনিয়ে নেন; একের পর এক বেদুইন গোত্র তাঁর দলে নাম লেখানো শুরু করে, বাড়তে থাকে সাউদ বংশের শাসনাধীন এলাকার সীমানা। এভাবেই ধীরে ধীরে আধুনিক সৌদি আরব গঠিত হয় সাউদদের হাতে। কড়া ওয়াহাবী ধর্মব্যবস্থার নতুন সে রাজ্যে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া বাধ্যতামূলক করা হয়, কিন্তু মরুর বুকে বেদুইনরা যে যাযাবর জীবন কাটায়-আজ এখানে তো কাল ওখানে-তাতে দিনে ৫ বার পানি দিয়ে ওযু করা সম্ভব নয় (সৌদী আরব পৃথিবীর দীর্ঘতম নদীবিহীন দেশ; ৮৩০,০০০ বর্গমাইলের দেশটিতে একটিও নদী নেই)। আল সাউদ এবং ওয়াহাবীরা মিলে তখন একটি ‘সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং' করেন; বেদুইন গোত্রগুলোকে এক জায়গায় বসত-বাড়ী বানিয়ে থিতু হতে বাধ্য করেন তাঁরা। দলের সকলের ভেতর একটি তীব্র ভ্রাতৃত্ববোধও সৃষ্টি করেন তাঁরা যেখানে সবাই সবার ভাই বা “ইখওয়ান”। ইখওয়ানদের ভেতর এমন একটি সামাজিক কাঠামো তৈরী হয় যে তারা নিজেদের দলের বাইরের অন্য মুসলমানদের সালামেরও জবাব দিতো না (কিছুটা আমাদের দেশের ছাত্রলীগ-ছাত্রদল গোছের ব্যাপার আর কী...)

১৯২০ এর শেষের দিক নাগাদ সৌদী আরব নামের দেশটির গোড়াপত্তন হয়ে যায়, যার একচ্ছত্র অধিপতি হন আব্দুলআজিজ আল সাউদ। খনিজ তেল আবিষ্কৃত হবার দরুন বিপুল পরিমাণ পশ্চিমা অর্থও সে সাথে আসা শুরু করে দেশটিতে। রাতারাতি মরুর যাযাবর জীবন থেকে বিলাসী নতুন এক জীবনে পা ফেলেন আল সাউদ এবং তাঁর প্রিয় পাত্রমিত্ররা। যে ইখওয়ানদের কাঁধে ভর করে তিনি সৌদীর বাদশাহ হয়েছেন, তাঁরা অবশ্য অতটা খুশী নন, কারণ তাঁদের লক্ষ্য তাঁদের ওয়াহাবী মতবাদের বাইরে ইসলামের বাকী সব সংস্করণকে (বিশেষত শিয়াদের) পিষে ফেলা। কিন্তু প্রতিবেশী দেশ ইরাক, জর্দান, কুয়েত ইত্যাদি সবই তখন বৃটিশদের মিত্র, ফলে আব্দুলআজিজ চাইলেই ইখওয়ানদের খুশী করবার জন্য এদের সাথে যুদ্ধে জড়াতে পারছেন না (বৃটিশ রাজ্যের সূর্য তখনও অস্তগামী হয়নি)। এছাড়াও, অটোমান সুলতানের হাত হয়ে হজ্ব-বাণিজ্যের ব্যাটনটি এখন আব্দুলআজিজের হাতে, যিনি অটোমান সুলতানদের মতোই নিজেকে মুসলিম বিশ্বের মালিক, এবং মক্কা-মদিনার রক্ষক হিসেবে ঘোষণা করেছেন। হজ্ব পালনের আকাঙ্ক্ষায় আগত অ-ওয়াহাবী মুসলমানদের যদি ইখওয়ানরা অত্যাচার করা শুরু করে, তাহলে মক্কা-মদিনার রক্ষক হিসেবে তাঁর দাবীটি আর টিকবে না মুসলিম বিশ্বের কাছে, হজ্ব সংক্রান্ত ব্যবসা-বাণিজ্যের বিপুল পরিমান অর্থও হাত ফস্কে যাবে। এসব বিবেচনা করে বাদশাহ ইখওয়ানদের ধর্মীয় আবেগকে সংযত করতে বলেন যা তাদের মোটেই পছন্দ হয় না। শুরু হয়ে যায় বাদশাহের সাথে ওয়াহাবী ইখওয়ানদের দ্বন্দ্ব।

ইখওয়ানরা এক পর্যায়ে বাদশাহের হুকুম অমান্য করেই ব্রিটিশ-শাসিত ইরাক এবং কুয়েতে হামলা চালায়। রাজনৈতিক স্বার্থ ধরে রাখার নিমিত্তে বাধ্য হয়ে বাদশাহকে ইখওয়ানদের বিরুদ্ধে এবার যুদ্ধে নামতে হয়। ১৯২৯-এর মার্চের এ যুদ্ধে বাদশাহ নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করেন। ইখওয়ানরা যুদ্ধে হেরে যায়, কিন্তু খোদ বাদশাহের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামার এ সাহসিকতা তাদের মনোভাবকে আরো কঠোর করে তোলে। এ যুদ্ধে ইখওয়ানদের নেতা ছিলেন দুই বিখ্যাত বেদুইন গোত্রপতি ফায়সাল আল দুয়াইশ, এবং সুলতান আল বিজাদ। আল বিজাদের দলে একজন সৈনিক ছিলেন উতায়বি গোত্রের মোহাম্মেদ বিন সাইফ, যিনি আজীবন তাঁর সেনাপতি আল বিজাদকে চূড়ান্ত সম্মানের আসনে বসিয়ে গেছেন। সৌদী বাদশাহের বিরুদ্ধে এ যুদ্ধের ৭ বছর পর বিন সাইফের একটি পুত্রসন্তান হয়। জন্মের পর থেকেই এই শিশুটির চোখেমুখে ভীষণ ক্রোধের একটি অভিব্যাক্তি দেখা যায়। সন্তানের ভীতিকর নাম রাখবার বেদুইন নিয়ম মেনে বিন সাইফ তাঁর পুত্রের নাম দেন জুহাইমান-“রাগী চেহারা”।

৪৩ বছর পর রাগী চেহারার এই বালকটিই সশস্ত্র হামলার মাধ্যমে কাবা'র দখল নিয়ে নেবে; গোটা ২ সপ্তাহের জন্য সৌদী বাদশাহ মসজিদ-আল-হারামের ওপর তাঁর কর্তৃত্ব হারাবেন। সুন্নী মতাবলম্বী সৌদী রাজপরিবারকে ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ করতে বদ্ধপরিকর ইরানী শিয়ারা সৌদী বাদশাহ আব্দুলআজিজকে এমন কোণঠাসা অবস্থায় পেয়ে মরণ কামড় দিতে তোড়জোড় শুরু করে দেবে। শুরু হয়ে যাবে বিশ্বব্যাপী এক নোংরা এবং ভীষণ বিষাক্ত রাজনীতির দাবা খেলা...


ছবিঃ জুহাইমান আল উতায়বি।

১৯৩০-এর দশকে সৌদী আরবে তেল আবিষ্কৃত হবার পর দেশটি আমেরিকার সহায়তায় গঠন করে রাষ্ট্রীয় তেল উত্তোলন প্রতিষ্ঠান “আরব-আমেরিকান অয়েল কম্পানি” (আরামকো) যার বরাতে প্রতি মাসেই বিপুল পরিমাণ পশ্চিমা বিদেশীদের আনাগোনা বাড়তে থাকে। বিদেশী এই অতিথিদের আপ্যায়নে সৌদী সরকার চেষ্টার কোন ত্রুটি রাখে না, ফলে ওয়াহাবী মতের কট্টর ইসলামপন্থী দেশটিতে মদ, নাইটক্লাব ইত্যাদির প্রচলন শুরু হয়ে যায়। ইখওয়ানদের ভাবগুরু আব্দুলআজিজ বিন বাজ পশ্চিমা সংস্কৃতির এই আগ্রাসনকে আক্রমণ করে একের পর এক আগুনে ফতোয়া জারি করতে থাকেনঃ আরামকো'র সকল বিধর্মী এবং নারী কর্মকর্তাদের বহিষ্কার করতে হবে, ইসলাম ধর্মের জন্মস্থানে একজনও বিধর্মী থাকা যাবেনা, নারীদের ঘর থেকে বেরোতে দেয়া যাবেনা...ইত্যাদি। ভীষণ প্রভাবশালী অন্ধ এই ধর্মগুরুকে বাদশাহ আব্দুলআজিজ কারাগারে পাঠান বাধ্য হয়ে। সাউদ বংশের সাথে ধর্মবাদীদের দূরত্ব আরো বেড়ে চলে।

১৯৬০-এর দশকে বাদশাহ আব্দুলআজিজ-এর পুত্র ফায়সাল সিংহাসনে বসেন, এবং বেশ কিছু বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনেন সৌদী সমাজে। তিনি নারীশিক্ষা চালু করেন, দাসপ্রথা উঠিয়ে দেন, এবং সৌদী টেলিভিশন স্থাপন করেন (যা পরবর্তীতে তাঁর মৃত্যু ডেকে আনে)। ফায়সাল পশ্চিমা দেশগুলোর বিরুদ্ধে তেল বিক্রির নিষেধাজ্ঞা জারী করলে সৌদী আরবের অর্থনীতি ফুলে ফেঁপে ওঠে, হুহু করে বাড়তে থাকে তেলের দাম। ১৯৭০-এর শুরুর দিকে যেখানে সৌদী আরবের তেল বিক্রয় থেকে আয় ছিলো বছরে ১.২ বিলিয়ন ডলার, নিষেধাজ্ঞার কারণে দশক শেষে এই আয় বেড়ে দাঁড়ায় ১০০ বিলিয়ন ডলারে। এই একই সময়টাতে মিশরের শাসক গামাল আব্দেল নাসের একটি ধর্মনিরপেক্ষ সর্ব-আরব জাতি প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখাতে শুরু করেন, যেখানে দেশ, ধর্ম, সংস্কৃতি, ইত্যাদি সবকিছু ছাপিয়ে সবার একটি পরিচয়ই থাকবেঃ আরব। সৌদী বাদশাহ ফায়সাল এই প্যান-অ্যারাবিক ধারণাটির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান; নাসেরের সর্ব-আরব আন্দোলনের বিপক্ষে দাঁড় করান তাঁর প্যান-ইসলামিক বা সর্ব-ইসলামীয় আন্দোলন। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে সবাই আরবী বললেও সবাই তো আর মুসলমান নয়; সেখানে খ্রিষ্টান, দ্রুজ, ইহুদী এমন বহু ধর্মের লোকই আছে, তাদের সবার সাথে বন্ধুত্ব চলে না। শুধু আরব মুসলমানদের মাঝেই সখ্যতা চলবে-ফায়সাল সাফ সাফ জানিয়ে দিলেন।

তেল উত্তোলন সংক্রান্ত প্রযুক্তিগত কাজে যেহেতু দক্ষ, এবং শিক্ষিত সৌদী জনবলের অভাব খুব প্রকট ছিলো, তাই বাধ্য হয়ে ফায়সালকে বিদেশী ইঞ্জিনিয়ার এবং কর্মকর্তাদের ওপরই ভরসা করতে হতো। দেশের অর্থনীতির শক্ত একটি ভিত্তি দাঁড় করালেও বিপুল পরিমাণ বিধর্মী বিদেশীদের সৌদীর পবিত্র ভূমিতে আসতে দেয়ায় কট্টর ধর্মবাদী ইখওয়ানদের চোখে তিনি খলনায়কই থেকে যান; ১৯৭৫-এর মার্চে তাঁরই এক নিকটাত্নীয় মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে তাঁকে হত্যা করেন। সৌদী রাজাদের নিরাপত্তায় যে বিশেষ প্রহরীরা নিয়োজিত থাকতো ৭০-এর দশকের সে সময়টায়, তাদের কার্যত বিশেষ কোন কাজ ছিলো না। কালেভদ্রে হঠাৎ কুচকাওয়াজ, শরীরচর্চা ইত্যাদির আয়োজন করা হতো, যাতে কারোই তেমন একটা অংশগ্রহণ ছিলো না। একরকম বিনে খাটুনিতেই মাসের পর মাস এই প্রহরীরা বেতনের টাকা পকেটে ভরে যেতো। আমাদের রাগী চেহারার সেই জুহাইমান আল উতাইবি ১৯ বছর বয়েসে এই প্রহরী দলে নাম লেখান।

১৮ বছরের চাকরীজীবনে জুহাইমান সবচেয়ে দায়িত্বশীল যে কাজটি করেছেন সেটি হলো পানিবাহী একটি ট্রাক চালানো; সেনাবাহিনীর সবচেয়ে নিচের দিকের কর্পোরাল পদেরও ওপরে কখনো উঠতে পারেননি তিনি। প্রহরীর আরামের চাকরীটিতে যেহেতু দায়িত্ব বিশেষ ছিলো না, জুহাইমানের সময় কাটতো বিভিন্ন ইসলামিক বক্তার ওয়াজ মাহফিলে ফতোয়া শুনে। এই সমাবেশগুলোতে সবচেয়ে বেশী প্রচারিত হতো সেই অন্ধ ধর্মগুরু আব্দুল্আজিজ বিন বাজের ফতোয়া, যাঁকে বাদশাহ আব্দুলআজিজ জেলে পুরেছিলেন। বিন বাজের বজ্রকঠোর কন্ঠে ঘোষিত হতে থাকে একের পর এক দাবীঃ দাঁড়ি-চুল কাটা যাবে না, নরসুন্দর পেশাটি উঠিয়ে দিতে হবে, ছেলেদের বিদ্যালয়ে নারী শিক্ষকদের নিয়োগ দেয়া যাবে না, টিভিতে নারীরা খবর পড়তে পারবে না, পৃথিবী গোল-এই ‘মিথ্যে তথ্য' শিক্ষার্থীদের শেখানো যাবে না...সৌদী বাদশাহেরা যে রাষ্ট্রীয় অর্থেই আমেরিকা সুইটজারল্যান্ডে মদ্যপান করে বেড়াচ্ছেন, বেশ্যা নিয়ে ফূর্তি করছেন, তা নিয়ে এই উলেমা সমাজ কোন নিন্দেমন্দ করেনি, কারণ, “দেশের শাসকের বিরুদ্ধাচারণ করা গুরুতর একটি গুনাহের কাজ”!

কোমল পানীয়, জিনস-টিশার্ট, টিভি ইত্যাদি পশ্চিমা ‘অপসং��্কৃতি' থেকে আরব তরুণ-যুবাদের বাঁচাবার জন্য বিন বাজ এবং তাঁর সহচরেরা একটি বিশেষ কর্মসূচী চালু করেন, যাতে অংশগ্রহনকারী অল্পবয়েসী কিশোর-যুবাদের মরুভূমিতে নিয়ে যাওয়া হতো সপ্তাহান্তে। গোটা দু'দিন তাদের কাটতো প্রার্থনা এবং কোরান তিলাওয়াত করে। এই সময়টাতে তাদের একমাত্র খাবার ছিলো ভিনেগারের স্বাদযুক্ত শুকনো রুটি। বারবার করে তাদের মনে করিয়ে দেয়া হতো তিলাওয়াতে পূর্ণ মনোযোগ দিতে, তাহলেই সর্বশক্তিমান আল্লাহ অলৌকিক এক উপহার দেবেন। দু'দিনের প্রার্থনা শেষে দেখা যেতো সত্যিই এক অলৌকিক কাণ্ড ঘটে গেছে! মরুভূমির মাঝেই জাফরানি চালের শাহী পোলাও, গরম ধোঁয়া ওড়া ভেড়ার মাংস, কাবাব, কালিয়া, এবং বরফজুড়ানো ঠাণ্ডা পেপসিকোলা চলে এসেছে তাদের ভোগে (কোকাকোলা যেহেতু ইজরায়েলে ব্যবসা করছিলো, তাই বেশীরভাগ আরব দেশগুলোতেই শুধু পেপসি পাওয়া যেতো। প্রার্থনায় সন্তুষ্ট হয়ে যে ‘সর্বশক্তিমান' এই খাবার মিলিয়ে দিতেন, পেপসি-কোকাকোলার এই সূক্ষ্ম রাজনৈতিক বিষয়টিও তিনি আমলে নিতেন স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে!)।

আব্রাহামিক ধর্মের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি ধারণা হলো ‘মসীয়াহ'; কেয়ামতের আগে পৃথিবীর মানুষ যখন সৃষ্টিকর্তাকে ভুলে যাবে, শয়তানের অবাধ বিচরণ চলবে, ঠিক তখনি মানবজাতির উদ্ধারে সর্বশক্তিমান এই মসীয়াহ বা উদ্ধারকর্তাকে পাঠাবেন। খ্রীষ্টানরা যীশুকে মসীয়াহ মনে করেন; মুসলমানেরা বিশ্বাস করেন এই মসীয়াহ-এর সাথে আরো একজন সহকারী আসবেন, যাঁকে তাঁরা ইমাম মাহদী বলে জানেন। আহমাদিয়া মুসলমানেরা মনে করেন মসীয়াহ এবং মাহদী একই ব্যক্তি এবং তিনি ইতোমধ্যে চলে এসেছেন (হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন, তিনি এই ধর্মমতটির স্থপতি মির্জা গোলাম আহমেদ কাদিয়ানী নিজেই)। পৃথিবীর ইতিহাসে প্রায় প্রতি দশকেই আসলে কেউ না কেউ নিজেকে ইমাম মাহদী বা মসীয়াহ দাবী করে আসছেন। গোলাম আহমদ সাহেব যখন নিজেকে মসীয়াহ দাবী করেন, ঠিক একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয়ে জন আলেকজাণ্ডার ডাওয়ি নাম্নী আরেকজন ভদ্রলোকও একই দাবী করেন। কয়েক হাজার মাইল দূরত্বের ব্যবধানে দু'জন ভিন্ন ব্যক্তি একই সময়ে একই ব্যক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবার চেষ্টা করেছেন। ধর্মীয় বিশ্বাসের আফিমটি বেশ কার্যকর; গল্পের গরুকে গাছে ওঠাতে বিশেষ বেগ পেতে হয় না।

কী করে ঈমাম মাহদীকে চেনা যাবে, তাঁর হুলিয়ার বর্ণনা দিয়ে বেশ কিছু হাদিস রয়েছে, যার সূত্রমতে মাহদীর কপাল চওড়া হবে, গালে দাগ থাকবে, ইসলামের নবীর মতোই তাঁর নামও হবে মুহাম্মদ, এবং পিতার নাম হবে আব্দুল্লাহ (নবী মুহম্মদের পিতার নাম)। ‘রাগী অভিব্যক্তির' জুহাইমান অবাক হয়ে লক্ষ্য করেন তাঁর প্রিয়তম কবি বন্ধু মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ-এর সাথে এই সবগুলো লক্ষণই মিলে যায়! পরিসংখ্যানের কোন জ্ঞান না থাকা কার্যত অশিক্ষিত জুহাইমানের মনে কখনো এই ভাবনাটির উদয় হয়নি যে পৃথিবীতে ইতোমধ্যে প্রায় ১০ কোটি মানুষ মুহম্মদ নামটি ধারণ করেন, যাঁদের অনেকেরই পিতার নাম আব্দুল্লাহ। ইসলামের ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্ব্বপূর্ণ এই নাম দু'টি ইসলামিক বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় দু'টি নামও বটে। ধর্মাবেগের আতিশয্যে দুইয়ে দুইয়ে বাইশ মিলিয়ে প্রিয় বন্ধুকে (এবং সম্বন্ধীও বটে; জুহাইমান তাঁর স্ত্রীকে তালাক দিয়ে তাঁর এই ‘মাহদী' বন্ধুটির বোনকে বিয়ে করেন) ইমাম মাহদী সাজিয়ে মসজিদ-আল-হারাম দখল করে নেন জুহাইমান। ২ সপ্তাহের এ নাটকে অনর্থক প্রাণ হারায় হাজারের ওপর মানুষ।

মুসলমান বিশ্বে একটি ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ভীষণ জনপ্রিয় যা কার্যত একটি বড় অংশের মুসলমানেরাই মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন, বিধর্মী কাফেররা ইসলামকে কলুষিত করবার জন্য দিনরাত ২৪ ঘন্টা নীলনকশা কষে যাচ্ছে। জুহাইমানদের কাবা দখল করে নেবার ঘটনা সম্পর্কে যখন মুসলিম বিশ্বের বাকী দেশগুলো অবগত হয়, তারা কোন প্রমাণ ছাড়াই অন্ধভাবে প্রচার করতে থাকে এই কাজটি আসলে আমেরিকা এবং ইজরায়েল-এর খ্রীষ্টান ও ইহুদীরা একত্র হয়ে ঘটিয়েছে, মুসলমানদের নিশ্চিহ্ন করে দেবার জন্য! এর প্রতিবাদে পাকিস্তানের কায়েদে আজম বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজার হাজার শিক্ষার্থী ক্লাসরুম ছেড়ে পড়ালেখা ফেলে পাকিস্তানের আমেরিকান দূতাবাসে হামলা চালায়। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ছোটখাটো একটি দাঙ্গা ঘটে যায়; মুসলমানেরা বাস গাড়ী এবং দোকানে আগুন দেন, বিদেশীদের ওপর হামলা চালান। কেরালায় সে সময়ে কোন বিদেশী ছিলো না, তাই সেখানে মুসলমানেরা চড়াও হন হিন্দুদের ওপর। হায়দ্রাবাদে হিন্দুদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো পুড়িয়ে দেয়া হয়, কয়েক দিন ব্যাপী চলে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। ঢাকায় হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে বিশাল জটলা পাকান, জনজীবনকে করে তোলেন দুর্বিষহ।

কাবার দখলের পর জুহাইমানদের দমন করতে গিয়ে সৌদী সরকার বারবার ভুল করেছে, হাস্যকর সব পদক্ষেপে নিজেদের বিপর্যস্ত করে তুলেছে, তাতে প্রাণক্ষয়ই শুধু বেড়েছে। দখলকৃত মসজিদের ভেতর একদিকে জুহাইমান তাঁর অনুগত চরদের বলছেন ভণ্ড সৌদী সরকারের বিরুদ্ধে এ যুদ্ধে কেউ মারা গেলে বেহেশত সুনিশ্চিত, অপরদিকে মসজিদের বাইরে যে সৌদী সেনাবাহিনী জুহাইমানদের বিরুদ্ধে গুলি ছুঁড়ছে, তারাও ওপর মহল থেকে আশ্বাসবাণী কানে নিয়ে এসেছেঃ ভ্রান্ত মুসলমান ‘খারেজী' এই জুহাইমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে মারা পড়লে বেহেশত সুনি...

বেহেশত-দোযখ ঠিক করবার মালিক যিনি, তিনি কার পক্ষে রায় দেবেন শেষতক? এর উত্তরে আমার কোন আগ্রহ নেই। আমার শুধু প্রচণ্ড ক্রোধে ফেটে পড়ি যখন শিক্ষাহীনদের নিম্নরুচির ফ্যান্টাসি গল্প বাস্তবায়নের বলি হতে হয় নিরীহ মানুষকে। বুড়োদের রূপকথার এই নির্বোধ নিরেট দেয়ালে আমার সমস্ত অসহায় আক্রোশ সজোরে আছড়ে পড়ে। তারপর আমি চারপাশে শুধুই অন্ধকার দেখি।

2023-10-17T00:00:00.000Z
Stuff Matters

Stuff Matters

By
Mark Miodownik
Mark Miodownik
Stuff Matters

ব্রিটিশ ম্যাটেরিয়াল সায়েন্টিস্ট মার্ক মিদোভনিক-এর বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণ বই স্টাফ ম্যাটারস। আমাদের আজকের দিনের পৃথিবীতে চারপাশে যেসব বস্তু নিয়ে প্রতিনিয়ত আমরা কাজ করি, কীভাবে সেগুলো এলো, ইতিহাসের কতটা দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে তবে আজ আমাদের নিত্য সঙ্গী হলো তারা তারই আখ্যান এ বই। ১০টি অধ্যায়ে উঠে এসেছে ধাতু, কাগজ, চকলেট, জেল, কাঁচ, গ্রাফাইট ইত্যাদির বৃত্তান্ত। সদ্য লব্ধ জ্ঞানের চুম্বক অংশ এখানে উগড়ে দিচ্ছি:

ধাতু কেন অত শক্ত হয়? এর কারণ, ধাতু মূলত ক্রিস্টাল বা স্ফটিকের সমন্বয়ে গঠিত; বিলিয়ন বিলিয়ন ধাতব ক্রিস্টাল একে অপরের সাথে গায়ে গা লাগিয়ে ভীষণ শক্তিশালী একটি বন্ধন তৈরী করে, এই ক্রিস্টালগুলোর ভেতর পরমাণুরা বিশেষ সজ্জায় নিজেদের গুছিয়ে নিয়ে গঠন করে একটি ত্রিমাত্রিক বূহ্য, যার দরুন ধাতুর কাঠামোটি অমন ‘ধাতব' হয়ে ওঠে। দাঁড়ি কামাবার রেজর যে কিছুদিন পরপর ভোঁতা হয়ে যায় তার কারণ, দাঁড়ির সাথে ক্রমাগত ঘর্ষণের ফলে রেজরের ধাতব ক্রিস্টালগুলোর আকৃতি বিকৃত হয়ে পড়ে, এলোমেলো হয়ে যায় তাদের সাজানো গোছানো সংসার। ধাতব পরমাণুগুলোকে যদি কোনভাবে জোর করে ফের আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে আসা যায়, তাহলেই রেজর বা ক্ষুরের ধার ফিরে আসে। ইলেক্ট্রন মাইক্রোস্কোপ দিয়ে ধাতব ক্রিস্টালে নজর ফেললে দেখা যাবে ক্রিস্টালের গায়ে কিছু আঁকাবাঁকা দাগ রয়েছে, যাদের ডিজলোকেশন বলে। এই ডিজলোকেশনগুলো আসলে একরকম ডিফেক্ট বা খুঁত; পরমাণুগুলোর অবস্থানের কোন উল্টোপাল্টা ঘটলেই এই ডিজলোকেশন ঘটে। ধাতুকে পিটিয়ে, তাপ/ চাপ ইত্যাদি প্রয়োগ করে ইচ্ছেমতো আকার দেয়া সম্ভব, যে কারণে ধাতু গত কয়েক হাজার বছর ধরেই পৃথিবীর সবচেয়ে প্রয়োজনীয় বস্তুগুলোর একটি। ধাতুর এই অনন্য গুণটির পেছনে হাত রয়েছে আসলে এই ডিজলোকেশনের।

আপনি যখন একটি পেপার ক্লিপকে বাঁকান, সেটি ভেঙে না গিয়ে দিব্যি বেঁকে যায় এর কারণ ক্লিপের ধাতব ক্রিস্টালের ডিজলোকেশনগুলো এক ক্রিস্টাল থেকে আরেক ক্রিস্টালে সরে পড়ে। নিজেরা সরে পড়ার সময়ে এই ডিজলোকেশনগুলো খুব ক্ষুদ্র পরিমাণে ধাতব পদার্থ ক্রিস্টালের এ মাথা থেকে ও মাথায় পাচার করে দেয়। এই পাচার করার কাজটি তারা করে শব্দের গতিতে। পেপার ক্লিপটিকে বাঁকালে প্রায় ১০০ ট্রিলিয়ন (১০০, ০০০, ০০০, ০০০, ০০০) ডিজলোকেশনের অবস্থানের পরিবর্তন ঘটে। এই বিপুল পরিমাণ ডিজলোকেশনগুলোর প্রত্যেকেই যখন খুব অল্প পরিমাণে ধাতব পদার্থ কয়েক লাখ মিটার/ সেকেন্ড গতিতে পাচার করে, তখনই ধাতু বেঁকে যায়, আর আমরা আমাদের চাহিদামতো আকার বানিয়ে নিতে পারি, হোক সেটা তলোয়ার কি সেতু কি আলমারী কি চামচ। কোন একটি ধাতুর গলনাঙ্ক থেকে সে ধাতুটির পরমাণুগুলো কতটা শক্তভাবে একে অপরের সাথে জড়িয়ে আছে, আর ধাতুটির ডিজলোকেশনগুলো কতটা তাড়াতাড়ি সটকে পড়তে পারে তার একটা আন্দাজ আমরা করে নিতে পারি। সীসার গলনাঙ্ক বেশ কম, এর ডিজলোকেশনগুলো খুব সহজে ক্রিস্টাল থেকে ক্রিস্টালে সরে যেতে পারে, তাই সীসা অত্যন্ত নরম একটি ধাতু। বিপরীতে, তামার ডিজলোকেশনগুলোকে সরাতে বেশ শক্তি প্রয়োগ করতে হয়, কারণ এর গলনাঙ্ক অনেক বেশী সীসার চেয়ে, তাই তামা অত শক্ত।

ডিজলোকেশনের নড়াচড়া, গতিবিধি ইত্যাদির ওপরই যে ধাতুর শক্তি নির্ভর করে সে তো জানলাম। তাহলে ডিজলোকেশনের নড়াচড়া করাটা কঠিন করে দিলেই শক্ত ধাতু তৈরী করা সম্ভব-এ তো বোঝাই যাচ্ছে! মেটাল অ্যালয় বা সঙ্কর ধাতু প্রস্তুত করা হয় ঠিক এ ধারণাটিকে কাজে লাগিয়েই। মূল host যে ধাতুটি, সেটির ক্রিস্টালের একটি পরমাণুকে সরিয়ে সেখানে অপর একটি ধাতুর পরমাণু যোগ করে সঙ্কর ধাতু বানানো হয়। পরমাণুর এমন অপসারণ প্রকৃতিতে আকছারই ঘটছে। বিশুদ্ধ অ্যালুমিনাম অক্সাইডের ক্রিস্টাল বর্ণহীন হয়, কিন্তু যদি এতে অল্প পরিমাণে লোহা ইম্পিওরিটি বা ভেজাল আকারে মিশে যায়, তাহলেই এর বর্ণ হয়ে যায় নীল, যাকে আমরা নীলকান্তমণি বলে জানি। লোহার জায়গায় যদি ভেজাল ধাতুটি ক্রোমিয়াম হয়, তাহলে তা লাল বর্ণ ধারণ করে। এই পাথরটিকে আমরা রুবি বা চুনী নামে চিনি।

সঙ্কর ধাতুর অন্যতম উদাহরণ স্টিল বা ইস্পাত-লোহা এবং কার্বনের সমন্বয়ে যা তৈরী হয়। ইস্পাতের ওপর ভর করে আধুনিক সভ্যতা বেশ অনেকটাই দাঁড়িয়ে আছে। শুধু আধুনিক সভ্যতা কেন, রোমান সাম্রাজ্যের অন্যতম সব বড় কীর্তিগুলোর পেছনেও আছে ইস্পাতের বিশাল ভূমিকা। বহু কাঠ খড় পুড়িয়ে, বহু ব্যর্থ প্রচেষ্টার পরই ইস্পাতের আধুনিক রূপটি আমরা পেয়েছি। অনেকেই হয়তো ধারণা করবেন লোহার সাথে কার্বন মেশালেই যেহেতু অত শক্ত ইস্পাত তৈরী হয়, তাহলে যথেচ্ছ কার্বন মেশালেই হয়! বাস্তবতা কিন্তু ভিন্ন; মাত্র ১ শতাংশ কার্বন যোগ করলেই ইস্পাত পাওয়া যায়, এর বেশী হয়ে গেলে সে ইস্পাত আর ব্যবহার উপযোগী থাকেনা, তা একেবারেই ঝুরঝুরে নরম হয়ে পড়ে।

প্রাচীন রোমানরা ছাড়াও আরেকটি সভ্যতা ইস্পাতের দারুণ ব্যবহার পৃথিবীকে শিখিয়েছে-জাপান। সামুরাইদের যে কাতানা তলোয়ার, সেটি আজও বিশ্ববাসীর কাছে একটি মহাবিস্ময়কর বস্তু। সামুরাইরা এই তলোয়ারটি বানাতো তামাহাগানে নামক এক ধরণের ইস্পাত থেকে। এই তামাহাগানের মূল উপকরণ ম্যাগনেটাইট নামক এক বিশেষ ধরণের লৌহ আকর; কম্পাসের কাঁটা তৈরী করা হয় এই ম্যাগনেটাইট থেকেই। কাতানা'র মাঝের অংশটুকুতে তারা কম কার্বন ব্যবহার করতো যাতে সে অংশটুকু দৃঢ় হয় এবং ঠোকাঠুকিতে ভেঙে না যায়, আর ধারালো অংশটুকুকে বেশী কার্বন দিয়ে তুলনামূলক নরম করে বানাতো যাতে ইচ্ছেমতো ঘষে এর ধার বাড়ানো যায় বহুগুণে।

কার্বন আর লোহার সমন্বয়ে দৃঢ় কাঠামোর ইস্পাত তো তৈরী হলো, কিন্তু মরিচা ধরে যাওয়া থেকে একে বাঁচাবার উপায় কি? বাতাসের অক্সিজেন ইস্পাতের সাথে বিক্রিয়া করে আয়রন (III) অক্সাইড গঠন করে, যাকে আমরা জং ধরা বা মরিচা পড়ে যাওয়া বলে জানি। ইস্পাতের এক একটি স্তর অক্সিজেন দ্বারা ক্রমাগত আক্রান্ত হতে থাকে এবং মরিচা পড়ে গোটা কাঠামোটিই ঝুরঝুরে হয়ে পড়ে। মরিচা ঠেকাবার জন্য তাই ইস্পাতের সাথে অল্প পরিমাণে ক্রোমিয়াম যোগ করা হয়; ক্রোমিয়াম ইস্পাতের আগেই অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া করে ক্রোমিয়াম অক্সাইডের একটি স্বচ্ছ আস্তরণ তৈরী করে ফেলে; ইস্পাত বেঁচে যায় অক্সিজেনের আক্রমণ থেকে। ক্রোমিয়াম সংবলিত এই ইস্পাতকে আমরা স্টেইনলেস স্টিল বলে চিনি। মজার ব্যাপার হলো ক্রোমিয়ামের এই আস্তরণটি কোন কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হলে বা কিছু অংশ উঠে গেলে তা নিজে নিজেই সেরে যায়! ক্রোমিয়ামের আরো একটি দুর্দান্ত কেরামতি আছে; আধুনিক সময়ের আমরা স্টেইনলেস স্টিলের চামচ দিয়ে খেতে অভ্যস্ত। চামচের ক্রোমিয়াম আমাদের থুতুর সাথে কোন বিক্রিয়া করেনা, ফলে আমাদের মুখে চামচের বাড়তি কোন স্বাদ আমরা টের পাইনা। আমাদের পূর্ববর্তী প্রজন্মের মানুষেরা অতটা সৌভাগ্যবান ছিলেন না! তাঁরা রূপার তৈরী তৈজসপত্র ব্যবহার করতেন, যা থুতুর সাথে বিক্রিয়া করে, ফলে খাবারের পাশাপাশি জিভে রূপার একটি তেতো স্বাদও যুক্ত হতো।

ইস্পাত ছাড়া আধুনিক কোন সভ্যতা যেমন কল্পনা করা যায় না, তেমনি কাগজ ছাড়াও আমরা আজ এক মুহুর্তও ভাবতে পারিনা। গাছ থেকে কাগজ আসে এ তো আমরা সবাই জানি। গাছের কাঠামোটি গঠন করে সেলুলোজ নামক অসংখ্য ছোট ছোট আঁশ যারা কী না লিগনিন নামক এক ধরণের জৈব আঠার সহায়তায় একে অপরের সাথে জুড়ে থাকে। এই লিগনিনের এতটাই শক্তি যে শত শত বছর ধরে সেলুলোজের এই কাঠামোটি অক্ষত থাকে। লিগনিনের এই বন্ধন ভাঙা চুল থেকে চুইং গাম সরাবার মতোই দুঃসাধ্য একটি কাজ। কাগজ প্রস্তুত করবার জন্য প্রথমে উচ্চ তাপ ও চাপ প্রয়োগ করে বিশেষ প্রক্রিয়ায় লিগনিন সরিয়ে সেলুলোজের মণ্ড তৈরী করা হয়, যা কার্যত তরলীকৃত গাছ। এই তরলটিকে সমতল কোন পৃষ্ঠে লেপে শুকালে কাগজ পাওয়া যায়। এই ধরণের প্রাথমিক পর্যায়ের কাগজ বাদামী বর্ণের হয়। আমরা যে অভিজাত সাদা কাগজের সাথে পরিচিত, সেটি প্রস্তুত করতে হলে ক্যালসিয়াম কার্বনেটের সাদা গুঁড়ো মেশাতে হয়।

কাগজ পুরনো হয়ে গেলে হলুদ বর্ণ ধারণ করে এটি আমরা অসংখ্যবারই লক্ষ্য করেছি। মূলত দু'টি কারণে কাগজ হলদেটে হয়ে যায়। প্রথমত, লিগনিন পৃথকীকরণের ধাপটি যদি ভালোভাবে সম্পন্ন করা না হয়, মণ্ডে যদি যথেষ্ঠ পরিমাণে লিগনিন রয়ে যায়, তাহলে তা আলোর উপস্থিতিতে বাতাসের অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া করে ক্রমে হলদেটে হয়ে ওঠে। সময় বাড়বার সাথে সাথে এই হলদেটে ভাবও বাড়তে থাকে। নিউজপ্রিন্ট জাতীয় সস্তা কাগজ এভাবেই প্রস্তুত করা হয়। দ্বিতীয় যে কারণে কাগজ হলদেটে বর্ণ ধারণ করে সেটির কারণ অ্যালুমিনাম সালফেট (Al2(SO4)3); এ রাসায়নিক দ্রব্যটি মূলত পানি পরিশুদ্ধ করবার কাজে ব্যবহৃত হতো, তবে কাগজের খসখসে ভাবটিকে কমিয়ে আনবার জন্য ১৮ এবং ১৯ শতকে মণ্ডের সাথে Al2(SO4)3 মেশানো শুরু হয়, যার ফলে কাগজটি অ্যাসিডিক বা অম্লীয় হয়ে পড়ে। অম্লীয় এই কাগজের সেলুলোজগুলো হাইড্রোজেন আয়নের সাথে বিক্রিয়া করে কাগজের বর্ণ হলদেটে বানিয়ে দেয়, সেই সাথে কাগজের স্থায়ীত্বও কমে যায়। এ ধরণের কাগজকে আমরা অ্যাসিড পেপার নামে জানি আজ।

জীবন যাপনের সুবিধার্থে হরেক কিছিমের কাগজ-ই তো আমরা এখন নিত্য ব্যবহার করছি। এতসব রকম কাগজের মাঝে বিশেষ এক রকম কাগজ হলো থার্মাল পেপার যা আধুনিক মুদি দোকানগুলোর ক্যাশ রেজিস্টারে আমরা দেখতে পাই। ক্যাশ রেজিস্টারে কালি শেষ হয়ে গেছে বলে রসিদ ছাপাতে পারছেনা-এমন কথা আমরা কখনো শুনিনি, এর কারণ, ক্যাশ রেজিস্টারে আদৌ কোন কালি থাকেনা! থার্মাল পেপারে আগে থেকেই কালি মেশানো থাকে, লিউকো ডাই এবং অ্যাসিড রূপে। রসিদ ছাপাবার সময় সামান্য একটু তাপ প্রয়োগ করে কাগজের অ্যাসিড এবং লিউকো ডাই-এর বিক্রিয়া ঘটানো হয়, যার দরুন স্বচ্ছ ডাইটি কালো কালিতে পরিণত হয়। যেহেতু বাইরে থেকে শক্তি প্রয়োগ করে (তাপ) সাময়িকভাবে কালির রং বদলাতে হয়, কিছুদিন পর তাই সেই লিউকো ডাইটি ফের তার আগের স্বচ্ছ বর্ণে ফিরে যায়, ফলে রসিদের লেখাগুলোও মুছে যেতে দেখি আমরা।

কাগজের সবচেয়ে বড় ব্যবহারটি আমাদের সবারই ভীষণ প্রিয়ঃ টাকা! কাগজ তো এই মুহুর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে সহজলভ্য বস্তুগুলোর একটি, তাহলে কেন সবাই ঘরে ঘরে কাগজে টাকা ছাপিয়ে নিতে পারছেনা? এর কারণ, আমরা মূলত গাছ থেকে প্রাপ্ত সেলুলোজ ভিত্তিক কাগজ ব্যবহার করি, আর টাকা বানানো হয় সচরাচর তুলা দিয়ে (ডলারের ৭৫% তুলা, বাকী ২৫% লিনেন)। সেলুলোজ-এর কাগজ দিয়ে তুলা থেকে তৈরী সত্যিকার টাকার নকল বানানো ভীষণ কঠিন। এছাড়াও, টাকার যে জগত ভোলানো কড়কড়ে আওয়াজ, সেটিও তুলা ছাড়া অসম্ভব। নকল টাকা শনাক্ত করবার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় আয়োডিনের কলম ব্যবহার করা হয়। সেলুলোজের তৈরী নকল টাকায় স্টার্চ (শ্বেতসার) রয়ে যায়, যা আয়োডিনের সাথে বিক্রিয়া করে কালো বর্ণ ধারণ করে। বিপরীতে, তুলায় যেহেতু কোন স্টার্চ নেই, আয়োডিনের কলম দিয়ে দাগ দিলেও তাতে কোন কিছু ফুটে ওঠে না।

প্রযুক্তি-নির্ভর আজকের দিনে কাগজের বই অনেকের কাছেই একটি বাড়তি বোঝা; সে জায়গায় চলে এসেছে কিন্ডল, আইপ্যাড, কোবো ই-রিডার ইত্যাদি যন্ত্রগুলো। শুনতে অবাক লাগবে, কিন্তু এই যন্ত্রগুলোর যে পর্দা, যেটিকে ইলেক্ট্রনিক পেপার বলা হয়, সেখানেও সত্যিকার কালি ব্যবহৃত হয়! এই কালি ই-বই রিডারের পর্দায় জ্যানাস পার্টিকেল নামক এক বিশেষ রকম কণার আকারে লেপে দেয়া হয়। এই কণাগুলোর এক পাশ থাকে কালো-যা ঋণাত্নক চার্জ যুক্ত, আর অপর পাশ সাদা (ধনাত্নক চার্জযুক্ত)। ই-রিডারের বুদ্ধিমান চিপটি প্রয়োজন মাফিক ভোল্টেজ প্রয়োগ করে চার্জের কম বেশী ঘটিয়ে কণাগুলোকে উল্টিয়ে পাল্টিয়ে পর্দার এক একটি পিক্সেলে গোটা পৃষ্ঠার লেখাগুলো আমাদের সামনে এনে দেয়। জ্যানাস পার্টিকেলের নামকরণ করা হয়েছে দুই মাথা সংবলিত প্রাচীন রোমান দেবতা জ্যানাস-এর নামে। ল্যাপটপ বা কম্পিউটারের পর্দার লিকুইড ক্রিস্টাল ডিসপ্লেতে পিক্সেলগুলো খুব তাড়াতাড়ি বদলে যেতে পারে যে কারণে চলচ্চিত্র বা ভিডিও দেখা সম্ভব হয়; কিন্তু জ্যানাস পার্টিকেলকে চলচ্চিত্রের দৃশ্যগুলোর গতি অনুযায়ী অত জলদি উল্টেপাল্টে ফেলা যায়না, তাই জ্যানাস পার্টিকেল সংবলিত ই-বই রিডারে চলচ্চিত্র বা ভিডিও দেখা যায় না।

সভ্যতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য সুদৃঢ় দালানকোঠা যা কিনা প্রকৃতি ও সময়ের সাথে যুঝে শতকের পর শতক টিকে থাকতে পারে। এ ধরণের দালান নির্মানে আজ আমাদের প্রথম পছন্দ কংক্রিট। কংক্রিটের মূল উপাদান লাইমস্টোন বা চুনাপাথর থেকে প্রাপ্ত ক্যালসিয়াম কার্বনেট, যার সাথে মেশানো হয় সিলিকন ও অক্সিজেনের সমন্বয়ে তৈরী সিলিকেট। চুনাপাথর তৈরী হয় ভূত্বকে, যখন জৈবিক প্রাণীদেহ পৃথিবীর অভ্যন্তরে প্রচণ্ড চাপ ও তাপে মিলিয়ন মিলিয়ন বছর ধরে চিঁড়েচ্যাপটা হতে থাকে। আর সিলিকেট মূলত কাদামাটি; ভূত্বকের ৯০ শতাংশই গঠিত এই সিলিকেট দিয়ে। এই দুইয়ের মিশ্রণে তৈরী কংক্রিট সেই রোমান আমল থেকে আজও আমাদের নিত্যসঙ্গী। রোমানদের তৈরী বহু কংক্রিটের দালান আজ কয়েক হাজার বছর পরও দিব্যি টিকে আছে, তবে কংক্রিটের কিছু দুর্বলতাও আছে। কংক্রিটের রাস্তায় বা বাড়ীঘরের দেয়ালে আমরা প্রায়ই ফাটল দেখতে পাই; এই ফাটলগুলো ধরে মূলত সূর্যের তাপে কংক্রিটের ক্রমাগত সংকোচন প্রসারণের কারণে। বর্তমানে আমরা কংক্রিটের ঢালাইতে ইস্পাতের একটি কাঠামো যোগ করে দৃঢ়তা বহুগুণে বৃদ্ধি করতে পারি। আমাদের ভীষণ সৌভাগ্য যে কংক্রিট ও ইস্পাতের এক্সপ্যানশন কোএফিশিয়েন্ট (সম্প্রসারণ সহগ) খুব কাছাকাছি, তাই এই দুইয়ের মিশ্রণে রিইনফোর্সড কংক্রিট বানানো সম্ভব হয়েছে।

ইস্পাত দিয়ে কংক্রিটের দৃঢ়তা বাড়ানো গেলেও বড় একটি সমস্যা রয়েই যায়ঃ ইস্পাতে মরিচা পড়ে যাওয়া। ইস্পাত ও কংক্রিটের মিশ্রণে একটি ক্ষারীয় অবস্থার সৃষ্টি হয় যার ফলে ইস্পাতের ওপর আয়রন হাইড্রোঅক্সাইডের একটি আস্তরণ তৈরি হয়। আদর্শিকভাবে, এ আস্তরণটি ইস্পাতকে মরিচা পড়ে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচাবার কথা, কিন্তু ক্রমাগত সংকোচন প্রসারণের ফলে কংক্রিটের গায়ে যে ফাটল দেখা দেয়, তা দিয়ে বিন্দু বিন্দু পানি ঢুকে পড়ে। ঠাণ্ডায় এই পানি জমে যায়, সংকোচিত হয়, ফের গরমে প্রসারিত হয়... এভাবে বিশেষত ঠাণ্ডার দেশে সামুদ্রিক পরিবেশে লবণাক্ত পানি কংক্রিটের ভেতরের ইস্পাতকে আক্রমণ করে পুরো কাঠামোটিকেই ধ্বসিয়ে দিতে পারে। বড় বড় পাহাড়ের প্রাকৃতিকভাবে যে ক্ষয় হয় (ইরোশন), সেটিও হয় ঠিক এই একই কারণেই। তাহলে কি পানির হাত থেকে কংক্রিটের কাঠামোকে বাঁচাবার কোনই উপায় নেই?

সাম্প্রতিক সময়ে একধরণের ‘সেলফ হিলিং' কংক্রিট তৈরী করা সম্ভব হয়েছে, যা ফাটল ধরা পড়লে নিজে নিজেই মেরামত করে নেয়! এই স্ব-নিরাময়টি সম্ভব হয়েছে বিশেষ এক জাতের ব্যাকটেরিয়ার কল্যানে; B. pasteurii নামক এই ব্যাকটেরিয়ার বাস আগ্নেয় ছাইয়ে ঘেরা ভীষণ ক্ষারীয় এক পরিবেশে, যেখানে pH-এর মাত্রা ৯ থেকে ১১ অব্দি। এমন ক্ষারীয় পরিবেশের মুখোমুখি হলে মানবশরীরের চামড়া তৎক্ষণাৎ পুড়ে যাবে, কিন্তু এই ব্যাক্টেরিয়ার জন্য এটি স্বর্গ বিশেষ! B. pasteurii-এর মলে বিপুল পরিমাণে ক্যালসাইট থাকে (ক্যালসিয়াম কার্বনেটের একটি বিশেষ রূপ), যা কংক্রিটের মূল উপাদান। এই ক্যালসাইট ফাটলগুলোকে বন্ধ করে দেয় আর কাঠামোটিকে আগের মতোই শক্তিশালী করে তোলে। কংক্রিটের ভেতর দশকের পর দশক ধরে জমে থাকতেও এই ব্যাক্টেরিয়াদের মোটেই কোন আপত্তি নেই। এ ধরণের সেলফ হিলিং কংক্রিটের ভেতরে ব্যাক্টেরিয়ার খাদ্য হিসেবে স্টার্চ বা শ্বেতসারের একটি প্রলেপ লেপে দেয়া হয়; ব্যাক্টেরিয়ারা আটকে থাকে ক্যালসিয়াম সিলিকেট হাইড্রেইট-এর একটি বন্ধনে। যখনি কংক্রিটে ফাটল ধরা পড়ে ও পানি ঢোকা শুরু হয়, তখনি সে বন্ধনটি কেটে যায় আর ব্যাক্টেরিয়ারা আড়মোড়া ভেঙে জেগে ওঠে। এরপর শ্বেতসারের সেই প্রলেপ খেয়ে যাওয়া আর মলত্যাগ করে যাওয়া...

সেলফ হিলিং কংক্রিটের মতো সেলফ ক্লিনিং কংক্রিটও তৈরী করা সম্ভব হয়েছে! এ ধরণের কংক্রিটে টাইটেনিয়াম ডাই অক্সাইডের (TiO2) ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণা থাকে যারা সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি শোষণ করে ফ্রি র‍্যাডিক্যাল আয়ন তৈরী করে। যে কোন জৈবিক ধূলিকণাকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে দিতে পারে এই আয়নগুলো। বাকী ধ্বংসাবশেষ বৃষ্টির পানিতে কিংবা বাতাসে ভেসে যায়। রোমের একটি গীর্জা (দিভেস ইন মিসেরিকরদিয়া) বানানো হয়েছে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে, যা নিজেই নিজেকে পরিষ্কার করে নিতে পারে। TiO2-এর আরেকটি বড় গুণ হলো এটি বাতাসের নাইট্রোজেন অক্সাইডের পরিমাণ কমিয়ে দিতে পারে, ঠিক গাড়ীর ক্যাটালাইটিক কনভার্টার-এর মতো। অদূর ভবিষ্যতে হয়তো পরিবেশ রক্ষায় TiO2-এর আরো বহু ব্যবহারই আমরা দেখবো।

কাগজ, ইস্পাত, কংক্রিট-এগুলো তো সবই আমাদের বেশ চেনাজানা উপকরণ। এবার একটু অচেনা একটি বস্তুর দিকে নজর ফেলা যাকঃ সিলিকা অ্যারোজেল। পৃথিবীর সবচেয়ে হালকা এ বস্তুটির ব্যাপারে জানতে গেলে আগে ‘জেলী' কী সেটা একটু জেনে আসা প্রয়োজন। জেলী মূলত এমন একটি তরল যা একটি কঠিন পদার্থের কারাগারে ভেতর আটকা পড়ে আছে। এই কারাগারটিকে আমরা মেশ বলতে পারি। খাওয়ার যে জেলী, সেটিতে এই কারাগারের কাঠামোটি তৈরী করে জেলাটিন। আমাদের চামড়া তৈরী করে যে প্রোটিনটি, সেটির নাম কোলাজেন; জেলাটিন উৎপন্ন করা হয় এই কোলাজেন থেকেই। পানির সংস্পর্শে জেলাটিনের অণুগুলো একে অপরের সাথে জোড়া লেগে মেশ বা কারাগার তৈরী করে যার ভেতরে জেলীর তরলটি আটক থাকে। তরলের পৃষ্ঠটান বা সারফেইস টেনশনের কারণে মেশের ভেতরের তরলটি বেরোতে পারেনা। আমাদের মুখের ভেতর ৩৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপে জেলাটিনের মেশের কারাগারটি ভেঙে যায়, ফলে আমরা ভেতরের তরলের স্বাদটি গ্রহণ করতে পারি।

জেলের ভেতর যে তরলটি আটক থাকে, সেটিকে যদি বিশেষ একটি মাত্রার তাপ প্রয়োগ করে এমনভাবে বাষ্পীভূত করে ফেলা যায় যাতে মেশের কাঠামোটির পক্ষে আর ‘বোঝা সম্ভব না হয়' যে ভেতরে গ্যাস রয়েছে না তরল রয়েছে, তাহলেই কেল্লাফতে! খুব ধীরে ধীরে এরপর এই গ্যাসটিকে অত্যন্ত সন্তর্পনে বের করে আনলে দেখা যাবে মেশের কাঠামোটি অবিকৃত রয়েছে, যদিও এর ভেতরে এখন শুধুই বাতাস। কাঁচ তৈরী করা হয় যে সিলিকন ডাইঅক্সাইড দিয়ে, সেটির মেশের কাঠামোটির ভেতরে তরল পুরে সেটিকে বাষ্পীভূত করেই সিলিকা অ্যারোজেল তৈরী করা হয়। কাঁচের ভেতর দিয়ে যখন আলো প্রবাহিত হয়, তার কিছু অংশ বেঁকে যায়, যাকে প্রতিসরণ বলে জানি আমরা। একই উপকরণ দিয়ে তৈরী সিলিকা অ্যারোজেলের ভেতরটা যেহেতু পুরোটাই ফাঁপা, আলো তাই সরাসরি প্রবাহিত হয়, কোন প্রতিসরণ ঘটেনা। ঠিক এ কারণে হালকা রঙয়ের আলোর পরিবেশে সিলিকা অ্যারোজেলকে সম্পূর্ণ অদৃশ্য মনে হয়। কিন্তু চমকটা হলো, গাঢ় রঙের পরিবেশের সাপেক্ষে অ্যারোজেলের বর্ণ নীল মনে হয়, যদিও এটি তৈরী বর্ণহীন কাঁচ থেকে। এ ব্যাপারটি কেন হয় সেটি নিয়ে বিজ্ঞানীরা বহুদিন মাথা ঘামিয়েছেন। অবশেষে সে উত্তরটি পাওয়া গেছে!

আমরা জানি, সূর্য থেকে বিভিন্ন বর্ণের, বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো ক্রমাগত ঠিকরে আমাদের চোখে এসে পড়ছে। সব তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো সমানভাবে বিচ্ছুরিত হয় না। আকাশের রং লাল না হয়ে নীল, এর কারণ ছোট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের নীল আলো বিচ্ছুরিত হয় বেশী; লাল আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য বেশ বড়, এর বিচ্ছুরণও তাই অনেক কম। এ ব্যাপারটিকে র‍্যালে স্ক্যাটারিং বলে আমরা জানি। কোন স্বচ্ছ পদার্থের ভেতর যদি অল্প পরিমাণে বাতাস আবদ্ধ থাকে, যেখানে ঐ পদার্থের বিলিয়ন বিলিয়ন ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পৃষ্ঠতলে আলো বিচ্ছুরিত হতে পারে, তাহলেই র‍্যালে স্ক্যাটারিং ঘটা সম্ভব। গাঢ় বর্ণের পরিবেশে অ্যারোজেলের ভেতর ঠিক এ ব্যাপারটিই ঘটে, ফলে আমরা নীল বর্ণ দেখতে পাই। অ্যারোজেলের আরেকটি দুর্দান্ত কেরামতি হলো এর অসম্ভব তাপ প্রতিরোধ ক্ষমতা। একটি পাতলা অ্যারোজেলের পর্দার একপাশে একটি বুনসেন বার্নার জ্বালিয়ে (১০০০-১৫০০ ডিগ্রী সেলসিয়াস) অপর পাশে একটি ফুল রাখলে কয়েক মিনিট অব্দি সে ফুলটির গন্ধ দিব্যি শোঁকা যাবে!

অ্যারোজেলের সবচেয়ে দুর্ধর্ষ ফায়দাটি নিচ্ছে নাসা। মহাকাশে তো অগণন মহাকাশীয় ধূলিকণা ও নুড়ি বিপুল বেগে প্রতিনিয়ত ঘুরে বেড়াচ্ছে, যাদের উৎপত্তি পৃথিবী সৃষ্টিরও ঢের ঢের আগে। এই space dust গবেষণাগারে নিয়ে পরীক্ষা করতে পারলে সৃষ্টিরহস্যের অনেক অজানা প্রশ্নের উত্তর যে পাওয়া যেতে পারে এ তো বোঝাই যাচ্ছে! কিন্তু ঘন্টায় ১৮ হাজার মাইল বেগে ছুটে বেড়ানো এই ফেরারী আসামীদের ধরতে গেলেই তো কামানের গোলার মতো সব ফুটো করে তারা বেরিয়ে যাবে; ভয়ানক সেই সংঘর্ষে এই space dust গুলো নিজেরাও ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে, ফলে তাদের আদি অবস্থায় পরীক্ষা করা তো সম্ভব নয়। সমাধান সিলিকা অ্যারোজেল। অত্যন্ত কম ঘনত্বের এই বস্তুটি space dust-এর জন্য নরম তুলোর বালিশের মতো কাজ করে। ১৯৯৭ সাল থেকেই নাসা অ্যারোজেলের জাল বানিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে মহাকাশীয় নুড়িপাথর আটক করে বেড়াচ্ছে।

চুম্বক অংশ টুকে রাখার নোটটা যাচ্ছেতাই রকম লম্বা হয়ে গেছে, তাই এখানেই যবনিকা টানছি। মিদোভনিকের এই বইটি তো শুধু কঠিন পদার্থ নিয়ে; তরল পদার্থ নিয়েও তাঁর একটি বই রয়েছে, ‘লিকুইড ম্যাটারস'। সে বইটিও লিস্টিতে উঠিয়ে রাখলাম...

2023-09-04T00:00:00.000Z
Greek Fire, Poison Arrows & Scorpion Bombs: Biological and Chemical Warfare in the Ancient World

Greek Fire, Poison Arrows & Scorpion Bombs: Biological and Chemical Warfare in the Ancient World

By
Adrienne Mayor
Adrienne Mayor
Greek Fire, Poison Arrows & Scorpion Bombs: Biological and Chemical Warfare in the Ancient World

যুদ্ধক্ষেত্রে রাসায়নিক কিংবা জৈব অস্ত্রের ব্যবহার যে রাতারাতি সমীকরণ পাল্টে দিতে পারে তার বহু নজির ইতিহাসে আমরা দেখেছি। ১ম বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত মাস্টার্ড গ্যাস-এর কথা তো আমরা সবাই-ই জানি; রসুন, মুলা, আর সরিষার গন্ধযুক্ত এ গ্যাসটিতে সালফার, ক্লোরিন, ব্রোমিন, নাইট্রোজেন-এর মতো ভয়ানক বিপজ্জনক সব উপাদান রয়েছে। ত্বকের সংস্পর্শে এলে কিছুক্ষণ পরই ভয়ানক জ্বালা ধরায় এ গ্যাস। চামড়া তো পুড়িয়ে দেয় বটেই, সেই সাথে ডিএনএকেও ছিন্নভিন্ন করে দেয় মাস্টার্ড গ্যাস, ফলে পুড়ে যাওয়ার অংশটিতে আর কোষ বিভাজন ঘটতে পারে না, ক্ষতও তাই পুরোপুরি সারে না। ভয়ানক এ গ্যাসটি ১ম বিশ্বযুদ্ধের সময় বহু সৈনিকের চোখ পুড়িয়ে তাদের অন্ধ করে দিয়েছে, নিঃশ্বাসের সাথে শরীরের ভেতরে প্রবেশ করে জ্বালিয়ে দিয়েছে তাদের শ্বাসনালী। এ গ্যাসের কবলে যারা পড়েছে তাদের বেশীরভাগই প্রাণে হয়তো বেঁচে ফিরেছে, কিন্তু বাকীটা জীবন তাদের পরিণত হয়েছে দুর্বিষহ এক দুঃস্বপ্নে।

শুধুমাত্র মাস্টার্ড গ্যাসেই মানুষের উদ্ভাবনী ক্ষমতা থেমে থাকেনি নিশ্চয়ই! ১০০ বছরেরও বেশী আগে উদ্ভাবিত এই গ্যাসের পর মানুষ আরো ভয়ানক সব জৈবিক অস্ত্রে নিজেদের সজ্জিত করেছে বিগত দশকগুলোতে। সারিন গ্যাসের কথাও আমরা অনেকেই জানি; ফসফরাসের যৌগ এ গ্যাসটি ভয়াবহতার দিক দিয়ে মাস্টার্ড গ্যাসকে রীতিমতো বালখিল্য বানিয়ে দিয়েছে। কোরান শরীফ হাতে নিয়ে ফাঁসিকাষ্ঠে দাঁড়িয়ে পড়া সাদ্দাম হোসেন আজ লাখো বাঙালি মুসলমানের কাছে আদর্শ বীর মুসলমানের প্রতীক, এবং খলিফা-স্বরূপ। এই সাদ্দাম হোসেনই ১৯৮০ সালের মার্চে তাঁর নিজ দেশের কুর্দিশ মুসলমানদের ওপর সারিন গ্যাস প্রয়োগ করে ভয়ানক এক গণহত্যা চালিয়েছিলেন। সারিন গ্যাস উদ্ভাবিত হয়েছিলো হিটলারের জার্মানীতে, কিন্তু মিত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে এই অস্ত্রটি ব্যবহার করতে খোদ হিটলারেরও রুচিতে বেধেছিলো! নাজি বাহিনীকে হিটলার নির্দেশ দিয়ে রেখেছিলেন কিছুতেই যেন সারিন গ্যাস ব্যবহৃত না হয়। সাম্প্রতিক সময়ে আরো ভয়ানক একটি গ্যাস ভিএক্স নার্ভ এজেন্ট প্রয়োগ করে জনসম্মুখেই উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন-এর সৎ ভাই কিম জং নামকে হত্যা করা হয়।

এই রাসায়নিক এবং জৈবিক অস্ত্রগুলো সবই তো হাল আমলের। কিন্তু কেউ যদি দাবী করে বসে মানুষ আসলে কয়েক হাজার বছর আগে থেকেই এমন জৈব রাসায়নিক সব অস্ত্র বানিয়ে আসছে, কেমন হবে? স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক এইড্রিয়েন মেয়র সে দাবীটিই করেছেন, এবং নানান প্রমাণ হাজির করে দারুণ আগ্রহোদ্দীপক একটি বই লিখেছেন। দুরন্ত গতির এ বইয়ে মেয়র পাঠককে পরিচিত করিয়েছেন প্রাচীন গ্রীস, রোম, এবং ভারতে প্রচলিত বিভিন্ন রাসায়নিক রণকৌশলের সাথে। মনের ভেতর এখন নিশ্চয়ই কিছু প্রশ্ন আঁকুপাঁকু করছেঃ প্রাচীন সে যুগেও কি তাহলে মানুষ বিষাক্ত গ্যাস ব্যবহার করতে জানতো? ভয়ানক কোন জীবাণু ছড়িয়ে শত্রুকে নিকেশ করে দিতো? তিষ্ঠ পাঠক, ক্রমশ প্রকাশ্য!

ইতিহাসের মূল আলোচনায় যাবার আগে মেয়র তাঁর বইয়ের প্রথম অধ্যায়টি ব্যয় করেছেন গ্রীক নানা পৌরাণিক কাহিনী বর্ণনা করে, যে গল্পগুলোতে রাসায়নিক অস্ত্রের প্রয়োগের কথা এসেছে। গ্রীক ডেমিগড হারকিউলিস যে খুব কঠিন ১২টি কাজ সম্পন্ন করেছিলেন, এ গল্প আমরা অনেকেই পড়েছি (সুকুমার রায় হারকিউলিসের এই বীরত্বের গল্পগুলো খুব সংক্ষিপ্ত আকারে লিখে গেছেন বাঙালি শিশু-কিশোরদের জন্য; এ গল্পগুলো কারো জানা না থাকলে এখান থেকে সহজেই পড়ে নিতে পারেন)। হারকিউলিসের দ্বিতীয় যে কীর্তি, সেটি ছিলো সাত মুণ্ডু ওয়ালা ভয়ানক বিষাক্ত সাপ হাইড্রাকে নিকেশ করা। গ্রীক পুরাণমতে হাইড্রার বিষ পৃথিবীর সবচেয়ে বিষাক্ত দ্রব্যগুলোর মাঝে অন্যতম। হারকিউলিস হাইড্রাকে মেরে তার বিষে নিজের তীরগুলোর মাথা চুবিয়ে নিয়ে তৈরী করে নেন পৃথিবীর প্রথম জৈবিক অস্ত্র।

সাপের বিষে চুবিয়ে তীরের ফলা বিষাক্ত করবার যে রাস্তা হারকিউলিস পৌরাণিক গল্পে দেখিয়ে গেছেন, বাস্তবে এর প্রয়োগ সত্যিই ঘটেছে বহুবার। খ্রীষ্টপূর্ব ১৩০ সালে এশিয়া মাইনরের ক্লারোস মন্দিরের পুরোহিত নিকাণ্ডার-এর লিখে যাওয়া বিষবিদ্যার একটি বই সাম্প্রতিক সময়ে গবেষকেরা আবিষ্কার করেছেন, যাতে নিকাণ্ডারের সে সময়টাতে গ্রেকো-রোমান সাম্রাজ্যের সবচেয়ে বিষধর ২০ রকম ভাইপার ও কোবরা গোত্রের সাপের বিস্তারিত তালিকা মেলে। কাছাকাছি সময়ের এমন আরো বেশ কিছু প্রাচীন চিকিৎসা-বিদ্যা সংক্রান্ত নথিতে বিভিন্ন প্রজাতির সাপের কামড়ের প্রকৃতি, বিষক্রিয়ার ধরণ, চিকিৎসা-ইত্যাদির বিশদ বিবরণ পাওয়া যায়। প্রায় আড়াই হাজার বছর আগের সে সময়টাতেই মানুষ যে যুদ্ধাস্ত্রে সাপের বিষের ব্যবহার নিয়ে বিস্তর মাথা ঘামিয়েছে তার প্রমাণ বারবারই উঠে আসে বিভিন্ন ঐতিহাসিক নমুনায়। এমন কয়েকটি উদাহরণের দিকেই এবার চোখ ফেরানো যাকঃ

খ্রীষ্টপূর্ব ৫ম শতকে মধ্য এশিয়ায় (মূলত বর্তমান উজবেকিস্তানে) সিথিয়ান (Scythian) নামক একটি যাযাবর বাহিনী'র ভীষণ দাপট ছিলো, যাদের কথা হেরোডটাসও বেশ সমীহের সাথে উল্লেখ করে গেছেন। এই সিথিয়ানরা খ্রীষ্টপূর্ব ৫ম শতকে ১ম দারিয়াসের বিশাল পারসিক বাহিনীকে থামিয়ে দিয়েছিলো; এর শ'খানেক বছর পর খ্রীষ্টপূর্ব ৩৩১ সনে দিগ্বিজয়ী আলেকজান্ডার দ্যা গ্রেটকেও তারা হারিয়ে দেয়। সিথিয়ানদের এই দুর্দণ্ড প্রতাপের পেছনে মূল রহস্য তাদের অসাধারণ তীরন্দাজ বাহিনী, এবং তাদের বিষাক্ত তীর। সিথিয়ানদের আগে পরে চৈনিক, গ্রীক, পারসিক, স্লাভ, আফ্রিকান, আরমেনিয়ান-এমন বহু সভ্যতাই বিষাক্ত তীর ব্যবহার করেছে, কিন্তু সিথিয়ানদের মতো অমন ভয়ানক আর কেউ হয়ে উঠতে পারেনি। অ্যারিস্টটল, থিওফ্রাস্টাস এবং অলিয়ান-প্রাচীন এই গ্রীক পণ্ডিত ত্রয়ীর বরাতে সিথিয়ানদের বিষ বানাবার কৌশলটি আজ আমরা জানিঃ প্রথমে তারা ভাইপার প্রজাতির সাপের বিষ সংগ্রহ করে সাপটিকে মেরে মৃতদেহটিকে পঁচাতো। এরপর মানুষের রক্তের প্লাজমাকে আলাদা করে তার সাথে মেশাতো বিভিন্ন বন্য প্রাণীর মল। মল ও প্লাজমা'র এ মিশ্রনটিকে মাটির নিচে বেশ কিছুদিন পঁচিয়ে এবার তার সাথে সেই বিষ এবং সাপের পঁচা গলা মরদেহটি মিশিয়ে তৈরী করতো ভয়ানক দুর্গন্ধযুক্ত অব্যার্থ মারণবিষ। আধুনিক বিজ্ঞানের সাথে পরিচিত আমরা সকলেই বুঝতে পারছি সিথিয়ানদের এই বিষ মূলত ক্ষতিকর সব ব্যাক্টেরিয়ার নিদারুণ এক বাম্পার ফলন মাত্র। বিষের দুর্গন্ধটিও শত্রুপক্ষকে মানসিকভাবে কতটা কাবু করে দিতে পারতো তার একটা আন্দাজ বোধহয় করতেই পারছি!

শুধু বিষ উদ্ভাবন করেই সিথিয়ানরা থেমে থাকেনি, ধনুর্বিদ্যাতেও তারা অসামান্য দক্ষতা অর্জন করে। সিথিয়ানদের ধনুকটিকে প্রাচীন সে যুগের সবচেয়ে আধুনিক বলে গণ্য করা হতো; গ্রীক ধনুকের প্রায় দ্বিগুণ দূরত্বে তীর ছুঁড়ে দিতে পারতো এই ধনুক। এছাড়াও, সর্বোচ্চ বিষক্রিয়া নিশ্চিত করবার জন্য তারা তাদের তীরের ফলাটির গায়ে কাঁটা বসাতো যাতে শরীরে বিঁধলে তা খুব সহজে বের করে আনা না যায়। কিলবিলে ব্যাক্টেরিয়াময় তীরের আঘাতে বিষক্রিয়া শুরু হতে ঘন্টাখানেকের বেশী লাগতো না; গ্যাংগ্রিন ও টিটেনাসের যুগপৎ আক্রমণে প্রচণ্ড যন্ত্রণাময় এক মৃত্যুই ছিলো একমাত্র পরিণতি। সিথিয়ানদের বিষের সাথে পাল্লা দেবার মতো একটি বিষই প্রাচীন পৃথিবী প্রত্যক্ষ্য করেছে, সেটির উদ্ভাবক ভারতীয়রা। খ্রীষ্টপূর্ব ৩২৬ সনে আলেকজান্ডার দি গ্রেট যখন ভারত অভিযানে আসেন তখন হার্মাটেলিয়াতে (খুব সম্ভব বর্তমান পাকিস্তানের মানসূরা) এই বিষের ভয়াবহতা তিনি হাতেনাতে টের পান। সে সময়ের ইতিহাসবিদ অলিয়ান এবং কুইন্টাস কার্টিয়াসের বয়ানে এ বিষটির কথা বিশদে জানা যায়ঃ

প্রাচীন ভারতীয়রা তাদের বিষ সংগ্রহ করতো এক বিশেষ প্রজাতির আদিম ভাইপার সাপ থেকে, যার বৈজ্ঞানিক নাম Azemiops feae। প্রথমে তারা একটি ব্রঞ্জের পাত্রের ভেতর সাপের মুখ রেখে জ্যান্ত সাপটিকে উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখতো দিনের পর দিন। সাপের মুখ থেকে বিষ গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ে হলদেটে কমলা রঙের তরল দিয়ে পাত্রটি পূর্ণ হয়ে গেলে সেটি সরিয়ে নতুন একটি পাত্র এনে রাখা হতো আগের জায়গায়। সাপের গলিত পঁচা মৃতদেহটি যে তরলে পরিণত হতো সেটিই এই নতুন পাত্রে সংগ্রহ করা হতো, ৩ দিন পর যা ঘন কৃষ্ণ বর্ণে রূপ নিতো। ভাইপারের পেটের ভেতর মাসের পর মাস ধরে বিপুল পরিমাণ মল জমা থাকে, যা গলিত সাপটির ব্যাক্টেরিয়ার স্বর্গটিকে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক মাত্রা দেয়। এই দু'ধরণের বিষের দু'রকম প্রভাব; কালো বর্ণের বিষটি আঘাতের জায়গার মাংস পঁচিয়ে বছরের পর বছর কষ্ট দিয়ে তিলে তিলে মৃত্যু ডেকে আনতো, অপরদিকে হলদেটে বর্ণের বিশুদ্ধ বিষটি শরীরে প্রচন্ড খিঁচুনি তৈরী করে কয়েক ঘন্টা এক নরক যন্ত্রণায় ভুগিয়ে তবেই ভবলীলা সাঙ্গ করাতো। অলিয়ান লিখে গেছেন এ বিষটির প্রভাবে নাকি আঘাতপ্রাপ্ত'র মগজ গলে নাক দিয়ে বেরিয়ে আসতো। কিছুটা হয়তো অতিরঞ্জিত, তবে একেবারে উড়িয়ে দেয়াও যাচ্ছে না; ভাইপারের বিষের যে প্রকৃতি (হিমোটক্সিন), তা রক্তকে জমাট বাঁধতে দেয়না, ফলে বিপুল রক্তক্ষরণ হয়, এবং টিস্যু ধ্বংস হয়ে যায়।

হার্মাটেলিয়ায় যে ভারতীয় বিষাক্ত তীরন্দাজদের দেখা পায় গ্রীকরা, তাদের ব্রাহ্মণ বলে চিহ্নিত করেছে তারা। যুদ্ধক্ষেত্রে ব্রাহ্মণের কী কী কর্তব্য সে ব্যাপারে মনুসংহিতায় অনেক ভালো ভালো কথা এসেছে, বিশেষতঃ ছল-চাতুরী কিংবা বিষ প্রয়োগের ব্যাপারে কড়া নিষেধাজ্ঞা রয়েছে সেখানে। তবে প্রেমে এবং যুদ্ধে সবকিছুই ‘ফেয়ার'। আলেকজাণ্ডার ভারতে আসার কয়েক দশক আগেই রাজা চন্দ্রগুপ্ত'র সামরিক কৌশলবিদ কৌটিল্য যুদ্ধজয়ের এক মহাস্ত্র রচনা করে গেছেন। ‘অর্থশাস্ত্র' নামক এ বইটি ২৩০০ বছর পর আজও দর্শন, ইতিহাস, অর্থনীতির শিক্ষার্থীদের পাঠ্য। নিজেকে বাঁচিয়ে চলার জন্য মিথ্যাচার, বেইমানী, বিশ্বাসঘাতকতা, অনৈতিকতা, ইত্যাদির আশ্রয় নিয়ে প্রয়োজন মোতাবেক বাকী সবাইকে গোল্লায় পাঠিয়ে স্বার্থপর পদক্ষেপ নেবার কায়দাটিকে আজ আমরা মাকিয়াভেল্লিয়ান বলে জানি, তবে মাকিয়াভেল্লি'র দেড় হাজার বছর আগেই কৌটিল্য তাঁর অর্থশাস্ত্রে মাকিয়াভেল্লিয়ান এই রাস্তাগুলো দেখিয়ে দিয়ে গেছেন। কোন সিদ্ধান্ত নেবার আগে রাজামশাই'র মনে যেন নৈতিকতা-অনৈতিকতা'র প্রশ্নটি একেবারেই না আসে, সে ব্যাপারে বিস্তর উপদেশ তো রয়েছেই, সাথে বোনাস হিসেবে আছে বিবিধ প্রজাতির সাপ ও বিচ্ছু'র বিষ এবং অন্যান্য বিষাক্ত পদার্থ দিয়ে ভয়ানক সব রাসায়নিক অস্ত্র তৈরী করবার পুঙ্খানুপুঙ্খ রেসিপি।

কৌটিল্য'র আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে ভারতীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে ২০০২ সালে পুনে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা প্রাচীন সেই সব রেসিপি অনুসরণ করে রাসায়নিক অস্ত্র তৈরী করতে নামেন। সে সময়ে প্রচলিত কিছু ধারণা যেমন, বুনো শুকরের চোখ এবং জোনাকী পোকার মিশ্রণে তৈরি পোশন খেলে ঘুটঘুটে অন্ধকারে দেখতে পাওয়া যাবে, কিংবা গর্ভবতী ঊট পুড়িয়ে রোস্ট বানিয়ে তা থেকে প্রাপ্ত স্নেহ দিয়ে এমন জুতো বানানো যাবে যা পায়ে দিলে সৈনিকেরা শত শত মাইল ক্লান্তিহীনভাবে হাঁটতে পারবে (ঊট যদি হাতের কাছে পাওয়া না যায়, তাহলে বিকল্প রেসিপি হিসেবে পাখির বীর্য ও ভস্মীকৃত শিশুর দেহাবশেষ-এর মিশ্রণও ব্যবহার করা যেতে পারে)-ইত্যাদির বাস্তব প্রয়োগে সত্যিই কোন মারণঘাতী রাসায়নিক অস্ত্র প্রস্তুত করা যায় কি না পুনে'র বিজ্ঞানীরা তা পরীক্ষা করে দেখছেন।

রোগ প্রতিরোধে বর্তমান পৃথিবীর আমরা যে কাজটি করি, প্রাচীন সে পৃথিবীর মানুষেরাও ঠিক তাই-ই করতো; অল্প পরিমাণে বিষ, এবং সে বিষটির প্রতিষেধক খাবারের সাথে মিশিয়ে ধীরে ধীরে শরীরে একটি প্রতিরোধ ব্যবস্থা তৈরি করতো। খাবারের সাথে বিষের প্রতিষেধক মেশাবার এ উপদেশটি মনুসংহিতাতেও আছে। কৃষ্ণ সাগরের উপকূলে আনাতোলিয়া'র (বর্তমান তুরস্ক) শাসক ষষ্ঠ মিথ্রিডেইটিসও এ কাজটি করতেন। মিথ্রিডেইটিসের বাবাকে বিষ প্রয়োগ করে হত্যা করা হয়েছিলো; আজীবন বিষের জুজু তাঁকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে বলে তিনি তাঁর খাবারের সাথে প্রতিদিন অল্প পরিমাণে বিষ গ্রহণ করা শুরু করেন। বিষবিদ্যার ওপর তাঁর দারুণ দখলও ছিলো; বিভিন্ন বিষের ওপর বিশদে তিনি লিখে গেছেন, বিষবিদ্যার ওপর তাঁর বইয়ের সংগ্রহও নাকি ছিলো দেখার মতোই। এই মিথ্রিডেইটিসের ৫ম সন্তান যখন তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এবং তাঁকে প্রায় কোণঠাসা করে ফেলে, তিনি তখন বিষপানে আত্নহত্যার পথ বেছে নেন। কিন্তু বহু বছর ধরে একটু একটু করে বিষ গ্রহণ করে করে তদ্দিনে তাঁর শরীরে দারুণ প্রতিরোধ তৈরি হয়ে গেছে, বিষ তাঁর কাঙ্খিত সে মৃত্যু ডেকে নিয়ে আসতে পারছিলো না! মরিয়া মিথ্রিডেইটিস তখন তাঁর এক সৈনিককে তলোয়ার চালিয়ে তাঁর জাগতিক সব কষ্ট চিরতরে লাঘব করে দেবার জন্য অনুরোধ করেন।

শুধু যুদ্ধ করবার হাতিয়ারেই নয়, খাওয়ার পানিতে বিষ মিশিয়ে আস্ত একটি জনগোষ্ঠীকেই নিকেশ করে দেয়ার নজিরও আছে প্রাচীন পৃথিবীতে। বিষাক্ত পানি দিয়ে গণহত্যা ঘটাবার প্রথম ঘটনাটি খুব সম্ভবত ঘটে খ্রীষ্টপূর্ব ৫৯০ সালে, ধর্মরক্ষার যুদ্ধ First Sacred War-এ। গ্রীসের রাজধানী এথেন্সের ডেলফিতে অ্যাপোলো'র যে মন্দির রয়েছে যেখানে কী না দেবতা মশাই আকাশ থেকে নেমে এসে তাঁর দৈববাণী শোনাতেন, সে মন্দির দর্শনে এবং হত্যে দিতে প্রাচীন গ্রীকরা তীর্থযাত্রায় বেরোতো। করিন্থিয়ান সাগর থেকে ডেলফি'র মন্দির অব্দি যে রাস্তা, সেটি'র নিয়ন্ত্রণ ছিলো তখন কিরা (Kirrha)-নগরের অধিবাসীদের হাতে। এই কিরাবাসীরা তীর্থযাত্রীদের নানানরকম হয়রানিতে ফেলে তাদের কাছ থেকে উচ্চহারে ট্যাকশো আদায় করে নিতো।

তীর্থযাত্রীদের হয়রানির গল্প শুনে শুনে বিরক্ত হয়ে এথেন্স ও সিসিওন (Sicyon)-এ দু'টি নগর একসাথে হয়ে অ্যাম্ফিক্টিওনিক লীগ নামে একটি দল গঠন করে; কিরাবাসীদের একচেটিয়া ধর্মব্যবসা থামাবার জন্য তারা বদ্ধপরিকর। সময় এবং সুযোগ-উভয়ই অনুকূলে দেখে অ্যাপোলো দেব তাঁর মন্দিরে নেমে এসে অ্যাম্ফিক্টিওনিক লীগের হর্তাকর্তাদের কানে দৈববাণী শোনানঃ কিরাবাসীদের সমূলে উৎপাটন করতে হবে, একজনও যেন বেঁচে না ফিরে। হেলেবোর (Hellebore) নামক বিষাক্ত একটি গাছের নির্যাস সরবরাহের পানিতে মিশিয়ে দেবতার ইচ্ছে পূর্ণ করে অ্যাম্ফিক্টিওনিক লীগ। ধর্মের পতাকা সুউচ্চে ওড়ে, আরো একবার। আগ্রোদ্দীপক ব্যাপার হলো, যে মনুসংহিতায় যুদ্ধে বিষের ব্যবহার নিয়ে অত নিষেধাজ্ঞা এসেছে, সেখানেই আবার ধর্মবিরোধী শত্রুপক্ষে'র পানিতে বিষ মিশিয়ে দেবার উপদেশ রয়েছে। ধর্মরক্ষার ব্যাপারটাই বোধহয় অমন...

কৌটিল্য'র অর্থশাস্ত্রের ১৪ নাম্বার খণ্ডের ১ম অধ্যায়ে বিভিন্ন বিষের প্রস্তুতপ্রণালী'র পাশাপাশি বিষাক্ত গ্যাসের ব্যবহারের কথাও এসেছে, এসেছে নদীর পানিতে বিষ ঢেলে জলজ সকল প্রাণী'র প্রাণহরণের কায়দাও। ভুলক্রমে যদি কেউ নিজ দলের লোকেদেরই আক্রান্ত করে বসে তার জন্য নিদানও দিয়ে গেছেন। কাছাকাছি সময়ের আরেক ভারতীয় চিকিৎসা শাস্ত্রীয় পণ্ডিত সুশ্রুত তাঁর বই সুশ্রুত সংহিতায় কয়লা, খনিজ পাথর, অ্যালকোহল ইত্যাদি ব্যবহার করে বিষাক্ত পানি পরিশোধনের উপায় বাতলে দিয়ে গেছেন, সাথে অবশ্য যথোপযুক্ত মন্ত্রোচ্চারণ চাই, তা না হলে এর সবই বৃথা।

গত কয়েক হাজার বছর ধরেই যুদ্ধক্ষেত্রে সবচেয়ে ব্যবহৃত প্রানীটি নিঃসন্দেহে ঘোড়া। দেশ-কাল-জাত ভেদে ঘোড়সওয়ার বাহিনীর সামনে পদাতিক বাহিনী বারবারই অসহায় আত্নসমর্পণ করেছে। প্রতিপক্ষ দলের ক্যাভালরি বাহিনী যদি ভীষণ শক্তিশালী হয়, আর আপনার হাতে যদি কোন্ ঘোড়াই না থাকে, তাহলে সে যুদ্ধে আপনার জেতার কোন সুযোগ আছে কি? এর উত্তরঃ “আছে”! ঘোড়া ঊটের গন্ধ সইতে পারে না, এবং কার্যত প্রাণীটিকে এড়িয়ে চলতে ভালোবাসে। খ্রীষ্টপূর্ব ৫৪৬ সালে পারস্যের রাজা সাইরাস লিডিয়ার রাজা ক্রোসাস-এর বিখ্যাত ঘোড়সওয়ার বাহিনীকে সম্পূর্ণই অচল বানিয়ে দেন তাঁর পোষা ঊটদের যুদ্ধক্ষেত্রে ছেড়ে দিয়ে। গন্ধ থেকে বাঁচতে এলোমেলো ছুটতে থাকা ঘোড়ারা নিজেদের সওয়ারদেরই পিষ্ট করে মারে। এরপর থেকে প্রাচীন বহু যুদ্ধেই ঘোড়সওয়ার বাহিনীর বিরুদ্ধে ঊটের ব্যবহার বেড়ে যায়।

ঘোড়ার পর যুদ্ধক্ষেত্রে জনপ্রিয়তার দিক থেকে দ্বিতীয় প্রাণীটি খুব সম্ভবত হাতি। গ্রীকরা ভারত অভিযানে এসে প্রথমবার হাতির দেখা পায়, এবং এর দানবিক ক্ষমতায় প্রাথমিকভাবে হতচকিত হয়ে পড়ে। পাঞ্জাবের রাজা পুরুকে হারিয়ে আলেকজাণ্ডার ভারতে তাঁর ঘাঁটি শক্তিশালী করেন। পুরু তাঁর দলে যোগ দিয়ে অন্য ভারতীয় রাজাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সহায়তা করা শুরু করেন। ভারতের রাজাদের অন্যতম বড় ভরসা ছিলো তাদের বিশাল হস্তিবাহিনী। পুরু'র উপদেশে আলেকজাণ্ডার এই হস্তিবাহিনীর মুখোমুখি হন পালে পালে শুকর সাথে নিয়ে। অত্যন্ত সূক্ষ্ম রুচির ভীষণ বুদ্ধিমান প্রাণী হিসেবে হাতি'র সুখ্যাতি রয়েছে; হাতি সুরেলা গান পছন্দ করে, রং নিয়ে খেলতে ভালোবাসে, সুন্দরী নারীদের প্রতিও আকর্ষণ তার কম নয়। অত সূক্ষ্ম রুচির প্রাণীটি'র নোংরা জিনিসে রাজ্যের আপ���্তি। শুকরের গন্ধ, এবং আওয়াজ হাতির মোটেই পছন্দ নয়। হাতিকে এভাবে শুকর দিয়ে বিরক্ত করে মেরে বহু যুদ্ধ জয় করা সম্ভব হয়েছে।

ব্যাক্টেরিয়া, সাপ, বিচ্ছু, হাতি, ঘোড়া, শুকর, ঊট...যুদ্ধে আর কী কী প্রাণী'র ব্যবহার দেখেছে পৃথিবী? কৌটিল্য তাঁর অর্থশাস্ত্রে শকুন, কাক, কবুতর, বেড়াল, বেজি, এবং বাঁদরের মাধ্যমে শত্রুশিবিরে আগ্নেয় পদার্থ ফেলে আসার উপদেশ দিয়েছেন। এই প্রাণীগুলোকে প্রশিক্ষণ দেয়া সম্ভব, তাই তাদের এমন বোমারু ভূমিকায় নামানোটা মোটেই অসম্ভব কিছু নয়। ১৬১০ সালেই চৈনিক জেনারেল তেশ-কি-কোয়াং নাকি কয়েকশ বাঁদরকে দিয়ে বন্দুক চালানো শিখিয়ে সি-চু পাহাড়ের ওপর থেকে জাপানী আক্রমণকারী বাহিনীর ওপর গুলি চালিয়েছিলেন! ২০০৩ সালে যখন আমেরিকা ইরাক আক্রমণ করে তখন মরোক্কো আমেরিকান বাহিনীকে দু'হাজার প্রশিক্ষিত বাঁদরের একটি বাহিনী দিয়ে সাহায্য করবার প্রস্তাব দিয়েছিলো যারা কী না ল্যান্ড মাইন অকেজো করতে কিংবা বিস্ফোরণ ঘটাতে জানে!

আগুনের ব্যবহার ছাড়া কোন যুদ্ধের কথা আজ আমরা ভাবতে পারি না। বোমা-বারুদ, কামান, গোলা-ইত্যাদির সবই আসলে আগুনের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ব্যবহার। আগুন ব্যবহার করে দুর্গের পাথরের দেয়াল পুড়িয়ে ফেলার অদ্ভুত নজিরও আছে প্রাচীনকালের যুদ্ধে। পাইন গাছের নির্যাস থেকে পিচ নামের একধরণের দাহ্য রাসায়নিক পদার্থ প্রস্তুত করা হতো যা তীরের ফলায় মেখে তাতে আগুন জ্বালিয়ে ছুঁড়ে মারলে ভয়ানক এক বিস্ফোরণ ঘটাতো। এই পিচ এবং সালফার একসাথে মিশিয়ে আদিম বোমা'র ব্যবহার করেছে গ্রীকরা পেলোপনেজিয়ান যুদ্ধের সময়। সালফার পোড়ালে বিষাক্ত সালফার ডাই অক্সাইড উৎপন্ন হয়, যা কয়েক মিনিটের ভেতর খুব কষ্টদায়ক মৃত্যু ডেকে আনতে পারে।

রোমানদের সবচেয়ে বড় শত্রু হ্যানিবাল ভিনেগার ব্যবহার করে পাথরের দেয়াল ধসিয়ে দিতে পারতেন। পাথরকে খুব উচ্চ তাপমাত্রায় গরম করে তাতে বিশুদ্ধ ভিনেগার (মূলত রেড ওয়াইন; সে যুগে ভিনেগারের সবচেয়ে বড় উৎস) ঢাললেই ভীষণ বিক্রিয়া করে পাথর ফেটে চৌচির হয়ে যায়। লাইমস্টোন এবং মার্বেল-এ দু'ধরণের পাথরের জন্য এটি বেশী কার্যকর ছিলো, আর হ্যানিবালের সময় বেশীরভাগ দূর্গ বানানোও হতো এই দু'টি পাথর দিয়েই। যে ভিনেগার দিয়ে পাথর ভেঙে ফেলা যায়, সেই ভিনেগারই দুর্দান্ত অগ্নিনির্বাপক হিসেবে কাজ করে। গ্রীক এবং রোমান ইতিহাসবিদেরা বারবার ভিনেগারের আগুন নেভাবার ক্ষমতার কথা উল্লেখ করেছেন। আগুন সংক্রান্ত ব্যবহার ছাড়াও ভিনেগারের স্বাস্থ্যগত প্রয়োগও রয়েছে; প্লিনি উল্লেখ করেছেন হাঁচি কাশি কিংবা শ্বাসকষ্টের সময় ভিনেগার বেশ উপকার দেয়। মজার ব্যাপার হলো, বর্তমানের এই দিনে বিভিন্ন মিছিল বা আন্দোলন ছত্রভঙ্গ করে দেবার জন্য পুলিশ যখন কাঁদানে গ্যাস কী মরিচের গুঁড়ো ছিটিয়ে দেয়, আন্দোলনকারীরারা প্রতিরক্ষায় নাক মুখ ঢাকে ভিনেগারে ভেজানো রুমাল দিয়ে!

পৃথিবী'র মরু অঞ্চলগুলোতে, বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যের ইরান ও ইরাকে সেই আড়াই হাজার বছর আগেই মানুষ ন্যাফথা'র সন্ধান পায়; মরুভূমি'র বালুর নিচে প্রচণ্ড তাপে প্রাকৃতিক গ্যাস এবং তেল জমে জমে ন্যাফথা নামক ভীষণ দাহ্য একটি পদার্থে পরিণত হয়। অগ্নি সংযোগ করাবার ক্ষমতার দিক দিকে ন্যাফথা হাল আমলের উদ্ভাবন নেইপাম-এর কাছাকাছিই প্রায়। ইরাকের উত্তরাঞ্চলে বাবা গুরগুর নামক স্থানে ন্যাফথা'র একটি ঝর্ণা আছে যেটি খ্রীষ্টপূর্ব ৬০০ সাল থেকে জ্বলে আসছিলো। ১৯২৭ সালে এসে এটিকে নেভানো হয়। এ ধরণের আরো অনেক ঝর্ণাই রয়েছে, যেগুলোকে দৈবিক নিদর্শন হিসেবে দেখিয়ে ইলাইজাহ এবং নেহেমিয়াহ ইত্যাদি চরিত্রকে কেন্দ্র করে বাইবেলে কিছু গল্প ফাঁদা হয়েছে।

ন্যাফথা'র সাথে কয়লা, পাইন গাছ থেকে প্রাপ্ত পিচ, দস্তা, রিয়ালগার নামক খনিজ থেকে প্রাপ্ত আর্সেনিক-ইত্যাদি মিশিয়ে ভারতীয় এবং আরবরা ভয়ানক সব বোমা বানিয়েছে। ইসলামের নবী মুহম্মদ ৬৩০ সালে তায়েফে তাঁর শেষ যুদ্ধে ন্যাফথা ব্যবহার করেছেন বলে প্রমাণ মিলেছে। মুহম্মদের মৃত্যু'র পর ইসলামের মসনদ নিয়ে পরবর্তী খলিফারা যে গৃহযুদ্ধ চালিয়েছেন তাতেও এই ন্যাফথা-বোমার বিস্তর ব্যবহার হয়েছে। আগুন দিয়ে মানুষ মারবার শিল্পটিকে মুসলমানরা যেমন উন্নত করেছে, তেমনি অগ্নি নিরোধক অ্যাসবেস্টস-এর আবিষ্কারও তাদের হাতেই। ৮০০ শতকের দিকে তাজিকিস্তানের মুসলমানেরা এই রহস্যময় পদার্থটি'র সন্ধান পায় যাতে আগুন ধরে না। তারা এর নাম দেয় “হাজার আল-ফাতিলা”।

মেয়র তাঁর এ বইতে একটি ব্যাপার বারবার দেখিয়েছেন, সেটি হলো poisoner is poisoned-বিষ যে তৈয়ার করে, নিয়তির পরিহাসে তার নিজেকেই সে বিষে নীল হতে হয়। প্রাচীন গ্রীস, রোম, ভারত, ও আফ্রিকা থেকে শুরু করে হালের আমেরিকার উদাহরণ টেনে এ সতর্কতাবাণীটি তিনি ঘুরেফিরেই শুনিয়েছেন। প্রায় আড়াই হাজার বছর ব্যাপী জৈব-রাসায়নিক অস্ত্রের ইতিহাস দেখালেও মেয়র একাধিকবার উল্লেখ করেছেন এ ধরণের বিষাক্ত অস্ত্রের ব্যবহারের প্রতি মানুষের একধরণের অরূচি'র কথা; সচরাচর নাকি মানুষ এতটা ক্ষতিকর অস্ত্র ব্যবহার করতে চায় না! প্রতিদিন আগের দিনের চেয়ে অসহিষ্ণু হয়ে ওঠা আমাদের আধুনিক এই জীবনে মেয়রের এই দাবীটি কতদিন সত্যি থাকে তাই-ই এখন দেখবার বিষয়...

2023-07-19T00:00:00.000Z
Hassan: The Story of Hassan of Baghdad and How He Came to Make The Golden Journey to Samarkand

Hassan: The Story of Hassan of Baghdad and How He Came to Make The Golden Journey to Samarkand

By
James Elroy Flecker
James Elroy Flecker
Hassan: The Story of Hassan of Baghdad and How He Came to Make The Golden Journey to Samarkand


ব্রিটিশ কবি ও নাট্যকার জেইমস এলরয় ফ্লেকার-এর নাটক ‘হাসান'। ১৯২৫ সালে লেখা এ নাটক মূলত বাগদাদের হাসানের ঠিকানা কিভাবে শেষতক সামারকান্দে গিয়ে ঠেকলো তার-ই আখ্যান (এটিই নাটকের উপশিরোনাম)। ইসলামিক বিশ্বের আব্বাসীয় খিলাফতের পঞ্চম খলিফা হারুন-উর-রশীদ-এর শাসনকাল (৭৮৬-৮০৯) এ নাটকের পটভূমি। ‘আরব্য রজনী''র বদৌলতে খলিফা হারুনের এ সময়টির সত্যমিথ্যে অনেক গল্পই আমাদের জানা। ফ্লেকার যে সময়ের মানুষ, পশ্চিমা বিশ্বে তখন-মধ্যপ্রাচ্য থেকে ভারত-গোটা পূর্বাঞ্চলটি নিয়েই ভীষণ আগ্রহ, যার বরাতে প্রচুর পশ্চিমা লেখকের বই আজ আমাদের হাতে এসে পৌঁছেছে। তাঁদের গবেষণার ফল এই বইগুলো সবসময় যে প্রাচ্যের সত্যিকার চিত্রটি তুলে ধরে তেমন নয়। বহু পশ্চিমাই প্রাচ্যকে রহস্যে ঘেরা জাদুকরী এক জায়গা হিসেবে দেখেছেন, যেখানে কি না মানুষ রাস্তাঘাটে হাত সাফাই করার খেলা দেখায়, পশু পাখির সাথে কথা বলে, জাদুর কার্পেটে উড়ে বেড়ায়...

পশ্চিমা দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে প্রাচ্যকে এঁদের অনেকেই গেঁয়ো, কুসংস্কারাচ্ছন্ন, পিছিয়ে পড়া এক জনপদ হিসেবে দেখেছেন, যেখানের মানুষের লোকাচার রীতিমতো বুনো ও আদিম। সত্তরের দশকে এডওয়ার্ড সাইদ পশ্চিমাদের এই মনোভাবটিকে টিটকারী মেরে ‘অরিয়েন্টালিজম' নাম দিয়েছিলেন। ফ্লেকারের এ নাটকটি লেখার সময়কাল, ও এর বিষয়বস্তু এমন যে আধুনিক অনেক পাঠক এতে সেই অরিয়েন্টালিজম-এর ভুত দেখতে পারেন। মূলত আপনার রুচিবোধই নির্ধারণ করে দেবে এ ভুতটি আপনি দেখতে পাবেন নাকি পাবেন না।
নাট্যকার নাটক লেখেন আসলে কোন একটি ‘বদ' উদ্দেশ্য নিয়ে। একটি পক্ষ অবলম্বন করে নানান ঘটনার ‘নাটক' সাজিয়ে নাট্যকার তাঁর নৈতিক অবস্থানের পক্ষে প্রপাগ্যান্ডা চালান মূলত। আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে এথেন্স ও স্পার্টা'র মাঝে যখন পেলোপনেজিয়ান যুদ্ধ শুরু হয়, সে যুদ্ধ বন্ধে গ্রীক কমেডি নাটকের অন্যতম শীর্ষ গুরু অ্যারিস্টোফেনিস একটি অভিনব পন্থা অবলম্বন করেছিলেন; ‘লিজিস্ট্রাটা' নাটকে তিনি দেখান যুদ্ধরত সৈনিকদের স্ত্রীরা একটি ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে-তাদের স্বামীদের সাথে তারা আর যৌনমিলনে অংশ নেবেনা, হোক না তাতে তাদের যতই কষ্ট! কামনার শরে বিদ্ধ হতে হতে দুর্বল হয়ে যাওয়া সৈনিকেরা বাধ্য হয়ে যুদ্ধ বন্ধ করে দেবে এটাই লিজিস্ট্রাটার আশা ছিলো।

বাস্তবের পেলোপনেজিয়ান যুদ্ধে এমন কিছু ঘটেনি, ঘটার কথাও নয়, কিন্তু যে বার্তাটি অ্যারিস্টোফেনিস দিয়ে গেছেন, সেটিই এখানে মুখ্য। প্রাচীন গ্রেকো-রোমান বহু নাট্যকারকেই আমরা এ ধরণের প্রপাগ্যান্ডা চালাতে দেখি; মেনান্দার, প্লাউতাস, টেরেন্স-এঁরা সবাই-ই দু হাজার বছরেরও ওপরের আগের মানুষ হয়েও ক্রীতদাস প্রথার বিরুদ্ধে সূক্ষ্মভাবে প্রচারণা চালিয়েছেন। দু'হাজার বছরের রুচির পার্থক্যে এঁদের কমেডি আজ আমাদের কাছে দিলদার কি হারুন কিসিঞ্জারের কমেডির মতোই সস্তা, গেঁয়ো ও খেলো ঠেকতে পারে, কিন্তু তাঁদের নাটকগুলো সাক্ষ্য দেয়, চিন্তায়-চেতনায় তাঁরা আমাদের অনেকের-প্রায় বেশীরভাগেরই বোধহয়-চেয়েই অনেক আধুনিক ছিলেন।

বিংশ শতকের ইংরেজ কবি হয়ে ফ্লেকার কেন অষ্টম শতকের ইসলামী খলিফাকে নিয়ে নাটক লিখতে গেলেন? এ নাটকের নাম হাসান, তবে কেন্দ্রীয় চরিত্রটি সে নয়; নাটকের ঘটনাপ্রবাহ যাকে ঘিরে তার নাম রাফি, ভিক্ষুকদের সর্দার সে। রাজ্যের ফকির মিসকীনদের নিয়ে খলিফা হারুন-উর-রশীদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ গড়ে তুলেছে রাফি। কারণ? রাফি'র বাগদত্তা পারভীনকে ক্রীতদাস বেচাকেনার হাটে নিয়ে যাওয়া হয় জোর করে। বহু কষ্টকর যাত্রার পর যখন অবশেষে পারভীনকে হাটে খুঁজে পায় রাফি, তখনও তাকে টাকা দিয়ে ছাড়িয়ে আনতে পারেনা সে, কারণ খলিফা হারুনের আদেশ-বাজারের সেরা সব ‘মাল' যাবে খলিফার হারেমে, তাঁর সওদা করা শেষ হলেই বাকী সব এঁটো ঝুটারা রাফিদের মতো ফকির ফাতরা গরীব গুর্বাদের ভাগে যাবে।

আব্বাসীয় খিলাফতকে ইসলামের ইতিহাসে সোনালী এক অধ্যায় হিসেবে দেখা হয়, যখন দিকে দিকে ইসলাম ছড়িয়ে পড়ছে, খলিফাদের বীরত্বের নানান গল্প পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে এসে পৌঁছাচ্ছে। ইসলাম ধর্মের অনুসারীরা এই সময়টিকে নিয়ে ভীষণ গর্ব বোধ করেন, এবং পশ্চিমারা যে কেবলই ভোগ পান ও অবাধ যৌনতায় মেতে থাকে তা নিয়ে ছিছিকারে মাতেন। তবে এই আব্বাসীয় খলিফেরা “ভোগ পান ও অবাধ যৌনতায়” কারো চেয়েই যে কম কিছু ছিলেন না-এ ইতিহাসটি অনেকটা ইচ্ছেকৃতভাবেই ভুলে যান তাঁরা। বিশেষত হারেম শব্দটি আজ আব্বাসীয় খলিফাদের সমার্থক শব্দই হয়ে উঠেছে। আব্বাসীয় হারেম-এর ব্যাপকতার ধারণা দেয়ার জন্য একটি তথ্য দেয়া যেতে পারে। অষ্টাদশ আব্বাসীয় খলিফা আবুল ফজল জাফর ইবনে আহমেদ আল মুক্তাদির-এর হারেমে সব মিলিয়ে ১৫ হাজার বন্দিনী/ দাসী/ বাঁদি ছিলো।

আব্বাসীয় হারেমের বাসিন্দা এই নারীদের মাঝে একধরণের hierarchy বা শ্রেণিবিন্যাসও ছিলো; মোটা দাগে ৫ ভাগে ভাগ করা যেতে পারে এই ছোট্ট রাজ্যের অধিবাসীদেরঃ স্ত্রী,উপস্ত্রী বা রক্ষিতা, খলিফার বিশেষ খেদমতে নিয়োজিত নর্তকী যাদের “জাওয়ারি” বলা হতো, বাচ্চাকাচ্চাদের দেখে রাখার দায়িত্বে নিয়োজিত “কাহরামানা”, এবং সবশেষে এই নারীদের পাহারার দায়িত্বে থাকা খোজা পুরুষেরা। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, প্রাক-ইসলামী আরবের সবকিছুকেই খারাপ ও বাতিল ঘোষণা করা এই খলিফারা প্রাক-ইসলামী যুগের গাইয়ে বন্দিনী “কিয়ান”দের ঠিকই সানন্দে গ্রহণ করেছিলেন, এবং এদের অনেককেই “জাওয়ারি”'র পদে তাঁরা অধিষ্ঠিত করেন। রাজকার্য, যুদ্ধবিগ্রহ নিয়ে ব্যস্ত থাকা খলিফাদের সময় থাকতোনা হারেমের ব্যবস্থাপনার দিকে নজর দেবার, তাই বিশাল এই সংগঠনটির দায়িত্বে থাকতেন খলিফাদের মায়েরা। খলিফাদের যে ৪ বা এরও বহু সংখ্যক স্ত্রী থাকতো, তাদের কাউকে এ দায়িত্ব দেয়া হতোনা, কারণ, ইসলামে এক স্ত্রীকে অপর স্ত্রীদের চেয়ে বেশী ক্ষমতাবান না বানাবার নির্দেশ এসেছে।

ছবিঃ খাজারদের (তুর্কী বংশোদ্ভূত স্লাভিক মুসলমান) কাছে রাশানরা ক্রীতদাস বিক্রী করছে। সের্গেই ইভানভ (১৯১৩)। সূত্রঃ উইকিপিডিয়া

ফ্লেকারের এ নাটকে ইসলামী আরব সংস্কৃতির টুকরো টুকরো অনেক ছবিই চমৎকারভাবে উঠে আসে। ইয়াসমিনের প্রেমে হাবুডুবু খেতে থাকা হাসান যখন বারবার ‘ইয়াল্লাহ, ইয়াল্লাহ' জপতে থাকে, তার বন্ধু সেলিম তাকে “O father of repetition” বলে সম্বোধন করে মনে করিয়ে দেয় বিগত কয়েক মিনিটে হাসান ৩৭ বার ‘ইয়াল্লাহ' বলা ছাড়া আর কিছুই বলেনি। কমবয়েসী সুন্দরী ইয়াসমিনের এক টুকরো হাসির প্রত্যাশায় থাকা প্রৌঢ় হাসান হতাশ হয়ে শেষতক বলেই বসে অবিশ্বাসীদের জন্য বেহেশতের দরজা যেমন চিরতরে বন্ধ, হাসানের জন্যও ইয়াসমিনের হাসির দেখা পাওয়া বোধহয় তেমনি অসম্ভব। আরবীভাষীদের নিজেদের মাঝে একে অপরকে নিয়ে হাসি-তামাশা'র ব্যাপারটি আমরা অনেকেই জানি, সামান্য পরিসরে তার কিছুটা এ নাটকেও উঠে আসে; হাসানের প্রেমরোগ সারাবার জন্য বন্ধু সেলিম যখন বিখ্যাত এক ইহুদী জাদুকরের গুণের বর্ণনায় দাবী করে কায়রোর সুলতানের সামনে সে জাদুকর উপস্থিত দর্শকদের আধ ঘন্টার জন্য বাঁদর বানিয়ে রেখেছিলো, জবাবে হাসান বলে “মিশরীয়দের ভাল করে চিনলে সহজেই বুঝে নিতে পারতে এটা মোটেই কোন তাক লাগানো খেল নয়!”।

রেগে গেলে এ নাটকের চরিত্ররা একে অপরকে কাফির বা অবিশ্বাসী বলে গালাগাল করে, “নালায় মরা কুত্তা টেনে আনা ছোটলোক”-বলে অপমান করে, শূলে চড়িয়ে সে লাশ বিষ্ঠার স্তূপে ছুঁড়ে ফেলার হুমকি দেয়, অপেক্ষা করিয়ে রাখলে দেরী করিয়ে দেবার জন্য “আমারে কি ইহুদী নাইলে খ্রীষ্টান মনে অয় তর?” বলে চিৎকার চেঁচামেচি লাগিয়ে দেয়, সামান্য তুচ্ছ একটি মেয়েকে হারেমে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে গোটা ইসলামের সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ ঘোষণা করে রাফি কি গর্হিত এক অপরাধ করেছে তা তাকে বারবার মনে করিয়ে দেয়...নাটকের পরতে পরতে নানান চোখা সংলাপ আর দৃশ্যের অবতারণা ঘটিয়ে ফ্লেকার তাঁর এজেন্ডা বাস্তবায়িত করেছেন, ব্যঙ্গের এক ‘নাটক' সাজিয়ে যা বোঝাবার বুঝিয়ে দিয়েছেন। একটি বিষয় বারবারই চোখে পড়ে, সেটি হলো খলিফার স্নেহধন্য চাটুকার চরিত্রগুলো এখানে খলিফাকে বিভিন্ন উপাধিতে ভূষিত করে সম্বোধন করে, কখনো খলিফা “আগ্নেয় থুতু নিক্ষেপক”, কখনো “অবিশ্বাসীদের হাড় ভঙ্গনকারী”, কখনো “ইসলামের বাগানের মালী”, কখনো “পৃথিবীর বুকে স্রষ্টার ছায়া”, আর কখনো তিনি স্রেফ “সর্বশক্তিমান”। একজন খেয়ালী খলিফাকে কেন্দ্রে রেখেই যে গোটা ইসলামিক বিশ্ব ঘোরে সেটি ঘুরেফিরে উঠে আসে এই খেতাবগুলোর ভেতর দিয়ে।

জেইমস ফ্লেকার আজ অনেকটাই বিস্মৃতপ্রায়, মাত্র ৩১ বছর বয়েসেই প্রাণ হারানো এ কবি খুব বেশী কাজ রেখে যেতে পারেন নি। কিন্তু এই অতি ছোট জীবনেই তিনি তাঁর সময়ের বাঘা বাঘা সব লেখক সাহিত্যিকদের নজর কেড়েছেন। হোর্হে লুই বোর্হেস, আগাথা ক্রিস্টি, বিক্রম শেঠ, নেভিল শ্যুট, সাকি, অ্যান্থনি পাওয়েল থেকে শুরু করে হালের সময়ের নেইল গাইম্যান-এঁরা সবাই-ই নিজেদের কাজে ফ্লেকারকে উদ্ধৃত করেছেন। এতগুলো নেইম ড্রপিং-এর পর আমার একার মন্তব্যে আর কি এসে যায়?

এ বইতে পাওয়া ফ্লেকারের একটি চুটকি দিয়ে শেষ করছি, যেটি তিনি খলিফার মুখে আমাদের শুনিয়েছেন। খলিফার দরবারে ডলফিন ও নগ্নবালক-সংবলিত দারুণ সুন্দর একটি ফোয়ারা দেখে হাসান যখন মুগ্ধ হয়, তখন খলিফা হারুন গর্বভরে এ ফোয়ারার ইতিহাসটি ব্যক্ত করেন (সম্মানিত পাঠক, লক্ষ্য করুন, ইসলামী বিধিতে ভাস্কর্য তৈয়ার করা হারেমে রক্ষিতা পোষার মতোই নিষিদ্ধ)। হারুন-উর রশীদের বাবা খলিফা আল মাহদী'র দরবারে একদিন এক গ্রীক ভাস্কর অনিন্দ্যসুন্দর এই ফোয়ারাটি নিয়ে হাজির হন। আল মাহদী তাকে জিজ্ঞেস করেন এমন ফোয়ারা সে আরো বানিয়ে দিতে পারবে কি না। “সানন্দে! চাইলে এমন আরো ১০০টা বানিয়ে দিতে পারবো”-উত্তর দেয় গ্রীক ভাস্কর। “এই কে আছিস, এই বিধর্মী কাফির শুয়োরটাকে শূলে চড়া এক্ষুণি”-হাঁক দিয়ে ওঠেন আল মাহদী। এর পর থেকে গোটা পৃথিবীতে এই ফোয়ারা এই এক খানাই আছে।

2023-07-04T00:00:00.000Z
Elemental: How the Periodic Table Can Now Explain (Nearly) Everything

Elemental: How the Periodic Table Can Now Explain (Nearly) Everything

By
Tim James
Tim James
Elemental: How the Periodic Table Can Now Explain (Nearly) Everything


ব্রিটিশ রসায়ন শিক্ষক টিম জেইমস-এর রসায়ন-বিষয়ক বিজ্ঞান-জনপ্রয়করণ বই ‘এলিমেন্টাল'। বিভিন্ন ট্রিভিয়া জেনে রাখার জন্য বেশ কাজের। গুরুত্বপূর্ণ যা যা জানলাম তার সিকিভাগ এখানে রইলোঃ

অক্সিজেন ছাড়া আগুন জ্বালানো সম্ভব নয় আমরা সবাই-ই জানি, কিন্তু অক্সিজেন নিজে নিজে আগুন জ্বালিয়ে দিতে পারে না, বাইরে থেকে শক্তি সরবরাহ করতে হয়, এ কারনেই আগুন জ্বালাতে তাপ বা ঘর্ষণের প্রয়োজন হয়। তবে পৃথিবীর সবচেয়ে দাহ্য পদার্থটিতে কিন্তু অক্সিজেন নেই। ১৯৩০ সালে বিজ্ঞানীরা পর্যায় সারণীর সবচেয়ে ‘খবিস' দু'টি মৌল ক্লোরিন (Cl) ও ফ্লোরিন (F)-এর সমন্বয়ে তৈরী করেন ক্লোরিন ট্রাইফ্লূওরাইড (ClF3); এ যৌগটি এতটাই আক্রমণাত্নক, যে তা যেকোন বস্তুর সংস্পর্শেই আগুন জ্বালিয়ে দিতে পারে, এমনকি অগ্নি প্রতিরোধকও ছাড় পায় না। কাঁচ, বালু ইত্যাদি তো বটেই, যে অ্যাসবেস্টস এবং কেভলারের তৈরী পোষাক পরে দমকল কর্মীরা কাজ করেন, তাও এই ClF3-এর সংস্পর্শে এলে দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে। পানি দিয়ে যে সে আগুন নেভাবেন, তারও উপায় নেই; ClF3 পানিকে জ্বালিয়ে হাইড্রোফ্লুওরিক অ্যাসিডের বিষাক্ত ধোঁয়া উৎপন্ন করে। আমেরিকার লুইজিয়ানাতে একবার ট্রাকে সিলিণ্ডার ভর্তি ১ টন হিমায়িত ClF3 নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো; অমন হীমশীতল তাপমাত্রায় সিলিণ্ডারটি ফেটে যায় আর ClF3কংক্রিটের রাস্তায় ছড়িয়ে পড়ে। আগুন নেভাবার পর দেখা যায় রাস্তার নিচে ১ মিটার গভীর পর্যন্ত পুড়িয়ে দিয়ে গেছে ClF3। F পর্যায় সারণীর সবচেয়ে সক্রিয় মৌল; Cl-এর অবস্থান তার ঠিক পরেই। এই দুটি মৌলই ভীষণ ইলেক্ট্রোনেগেটিভ, অর্থাৎ অন্য পদার্থের ইলেকট্রনকে এরা ছিনতাই করে নিয়ে আসে। এদের দু'জনের সংস্পর্শে পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ানক রাসায়নিক দ্রব্যটি তৈরী হবে সেটি আর বিচিত্র কি?

পর্যায় সারণীর এক একটি মৌলের আবিষ্কারের পেছনে অনেক অদ্ভুত সব ঘটনা লুকিয়ে আছে। ১৬৬৯ সালে জার্মান বিজ্ঞানী হেনিগ ব্র্যান্ডট নতুন একটি আবিষ্কারের আশায় মানুষের মূত্র জ্বাল দেয়া শুরু করেন। তাঁর আশা ছিলো, মূত্রের রং যেহেতু সোনালী-হলুদ, একে জ্বাল দিয়ে দিয়ে হয়তো স্বর্ণ উৎপাদন করা সম্ভব হবে। বহু ঘন্টা জ্বাল দেবার পর অবশেষে তিনি চটচটে একটি দ্রব্যের সন্ধান পান, যার গন্ধ রসুনের মতো, এবং রং কিছুটা নীলচে সবুজ। শুধু তাই নয়, এ বস্তুটি ভীষণ দাহ্য, এবং আগুন জ্বালালে তা ভীষণ উজ্জ্বল সাদা আলোর বিচ্ছুরণ ঘটায়। ‘আলোক বাহক'-এর গ্রীক থেকে ব্র্যান্ডট তাঁর নব্য আবিষ্কৃত এ বস্তুটির নাম দেন ফসফরাস। মানুষের দৈনিক ফসফরাসের চাহিদা মাত্র ০.৫-০.৮ গ্রাম; অতিরিক্ত ফসফরাস মূত্রের সাথে বেরিয়ে যায়। ফসফরাসের সন্ধান পাবার জন্য ব্র্যান্ডটকে তাই বিপুল পরিমাণ মূত্র নিয়ে কাজ করতে হয়েছে। সাড়ে ৫ টন মূত্র সিদ্ধ করলে ৬০ গ্রামের মতো ফসফরাস পাওয়া যায়!

ধাতু পোড়ালে বিভিন্ন বর্ণের গুঁড়ো পাউডার তৈরী হয়, মধ্যযুগে একে বলা হতো ক্যালক্সেস (calxes)। আগুন নিভে যাবার পর এই ক্যালক্সেসকে ফের পোড়ানো বেশ কঠিন। ১৮ শতকে মানুষ তাই ধারণা করে দাহ্য বস্তুতে নিশ্চয়ই এমন কোন পদার্থ রয়েছে যা আগুন লাগবার পর বাতাসে উবে যায়, রেখে যায় ক্যালক্সেস। তারা এই অজানা পদার্থটির নাম দেয় ফ্লজিস্টন। ফ্লজিস্টনের উস্কানিতেই আগুন জ্বলে এই ধারণা বেশ পোক্ত হয়ে ওঠে জনসমাজে। ব্রিটিশ-ফরাসী বিজ্ঞানী হেনরি ক্যাভেন্ডিশ এই তত্ত্বটি পরীক্ষা করতে নামলেন। তিনি লক্ষ্য করলেন, ধাতু আর অ্যাসিড যখন বিক্রিয়া করে, তখন একটি অদৃশ্য গ্যাসের উদ্ভব ঘটে যেটি তিনি সংগ্রহ করেন। তাঁর প্রথমে ধারণা হয়েছিলো তিনি বোধহয় সেই ফ্লজিস্টনই ধরেছেন, কিন্তু অবাক করা ব্যাপার হলো, এই গ্যাসটি দাহ্য। ফ্লজিস্টন বাতাসে উবে যাবার কারণেই যদি আগুন জ্বলে, তাহলে ফ্লজিস্টন নিজেই কীভাবে জ্বলে? এর চেয়েও অবাক করা ব্যাপার হলো, এ গ্যাসটি বিস্ফোরিত হলে পানি উৎপন্ন হয়! ক্যাভেন্ডিশ নিশ্চিত হলেন, পানি মোটেই কোন মৌলিক পদার্থ নয়; অন্য কিছুর মিশ্রণে পানি তৈরী হয়। সে সময়ের মানুষ বিশ্বাস করতো প্রকৃতিতে ৪টিই মাত্র মৌলিক পদার্থ রয়েছেঃ বায়ু, পানি, মাটি, ও আগুন। ক্যাভেন্ডিশ সে বিশ্বাসের গোড়ায় প্রথম আঘাতটা হানেন।

ক্যাভেন্ডিশের অল্প কিছুদিন পর আঁতোয়া লাভঁয়শিয়ে একটি দারুণ পরীক্ষা করে বসেন। তিনি নয় ফুট লম্বা বিশাল একটি আতশ কাঁচে সূর্যের আলো কেন্দ্রীভূত করে এক প্লেট ভর্তি পারদে আগুন জ্বালান। পুরোটা পারদ জ্বলে শেষ হয়ে গেলে যে ক্যালক্সেস রয়ে যায়, সেটি ওজন করে দেখা গেলো আগুন জ্বালাবার আগে প্লেটে রাখা পারদের চেয়ে তা ভারী! অর্থাৎ, আগুন জ্বালাবার ফলে পারদ থেকে কিছু বেরিয়ে যায়নি, বরং, বাতাসে থাকা কিছু একটা পারদের ক্যালক্সেসের সাথে যুক্ত হয়ে এর ওজন বাড়িয়েছে। লাভঁয়শিয়ে এর নাম দেন অক্সিজেন। ধাতু আর অ্যাসিডের বিক্রিয়া ঘটিয়ে যে গ্যাসটি ক্যাভেন্ডিশ বন্দী করেছিলেন, লাভঁয়শিয়ে পরীক্ষার মাধ্যমে বোঝেন তা আসে অ্যাসিড থেকে, ধাতু থেকে নয়। উত্তপ্ত অবস্থায় অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া করে এ গ্যাসটি পানি উৎপন্ন করে, তাই তিনি এর নাম দেন হাইড্রোজেন (পানি প্রস্তুতকারক)।

প্রকৃতিতে পাওয়া খনিজগুলোর কে কতখানি শক্ত তা নির্ণয় করবার জন্য ১৮১২ সালে জার্মান বিজ্ঞানী ফ্রিডরিখ মোস ১ থেকে ১০ অব্দি দাগানো একটি স্কেল তৈরী করেন। লোহার অবস্থান এ স্কেলে ৪, দাঁতের এনামেলের ৫, আর সবচেয়ে উঁচু ১০ নাম্বার অবস্থানটি হীরার, অন্তত ২০০৩ সাল অব্দি। ২০০৩ সালে জাপানী একদল বিজ্ঞানী তৈরী করেন পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন পদার্থ-হাইপারডায়মন্ড। পৃথিবীর অভ্যন্তরে বিলিয়ন বিলিয়ন বছর ধরে প্রচণ্ড চাপ ও তাপে কার্বন ধীরে ধীরে হীরায় পরিণত হয়। হীরার স্ফটিকটি তৈরী হয়ে গেলে অগ্ন্যুৎপাতের মাধ্যমে পৃথিবী তা প্রায় বমি করে বের করে দেয়। হীরা আদতে বেশ অস্থিতিশীল একটি বস্তু, কয়েক হাজার বছর পর তা ক্রমশ ক্ষয়ে কয়লায় পরিণত হয়। তাই প্রশ্ন হলো, এর উল্টোটা কি তাহলে সম্ভব? কয়লা থেকে কি হীরা বানানো যায়? ২০০৩ সালে জাপানী বিজ্ঞানী তেতসুও ইরিফুনে আর তাঁর দল ঠিক এ কাজটাই করেন। তাঁরা বিশেষ একরকম ‘প্রেশার কুকার'-এ কয়লা নিয়ে প্রচণ্ড তাপ ও চাপ প্রয়োগ করে যে বস্তুটি প্রস্তুত করেন, তা প্রকৃতিতে এর আগে কখনো দেখা যায়নিঃ হাইপারডায়মন্ড। এমন প্রচণ্ড তাপ ও চাপ প্রয়োগ করে কৃত্রিমভাবে হীরা বানাবার আরো বহু নজির অবশ্য আছে। জার্মানীতে পিনাট বাটার বা বাদামের মাখন থেকে হীরা বানিয়েছেন ড্যান ফ্রস্ট। পুঁজিবাদের দেশ আমেরিকা কৃত্রিম হীরা বানাবার এই শিল্পকে আরো এক ধাপ ওপরে নিয়ে গেছে। ইলিনয়ের কম্পানি লাইফজেম আপনার প্রিয়জনের ছাইভস্ম থেকে এই বিশেষ প্রক্রিয়ায় হীরা বানিয়ে দেবে। ক্যারেটের ওপর ভিত্তি করে ৩,০০০ থেকে ১৯,০০০ ডলার অব্দি দাম পড়তে পারে লাইফজেম হীরার।

১৯৮৯ সালে আইবিএম মাত্র ৩৫টি জিনন পরমাণু দিয়ে তাদের কম্পানির লোগো বানিয়ে পুরো বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেয়। এরপর ২০১৩ সালেই তারা তামার পাতের ওপর কার্বন মনোঅক্সাইডের পরমাণু দিয়ে দেড় মিনিটের একটি আস্ত চলচ্চিত্র তৈরী করে ফেলে! আ বয় অ্যান্ড হিজ অ্যাটম-নামের এ চলচ্চিত্রটি বর্তমানে গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে ক্ষুদ্রতম চলচ্চিত্র হিসেবে স্থান করে নিয়েছে। আমরা জানি অনেকগুলো স্থির চিত্রকে একসাথে খুব তাড়াতাড়ি আগুপিছু করলে তা একটি চলচ্চিত্রে পরিণত হয়। আ বয় চলচ্চিত্রটি ঠিক সেভাবেই অনেকগুলো স্থির চিত্রের সমন্বয়ে তৈরী। যে যন্ত্রটি দিয়ে পরমাণুগুলোর ছবিগুলো তোলা হয় সেটির নাম স্ক্যানিং টানেলিং মাইক্রোস্কোপি (STM)। ধরুন, আপনি একটি অন্ধকার, গভীর গর্তের কিনারে দাঁড়িয়ে গর্তে পাথর ছুঁড়ে মারছেন। গর্তের তলায় পাথরটি যেতে কত সময় নিলো তা থেকে আপনি গর্তের গভীরতা নির্ণয় করতে পারবেন। STM যন্ত্রটি অনেকটা সেভাবেই কাজ করে। এটি ঠিক ছবি তোলার যন্ত্র নয়, তাই এতে কোন লেন্স নেই। এ যন্ত্রে মূলত একটি সরু নলের শেষ মাথায় খুব আলতোভাবে কিছু পরমাণু আটকে থাকে; যখনি এর ভেতর দিয়ে বিদ্যুৎপ্রবাহ চালানো হয়, তখন সেই পরমাণুগুলো ছুটে বেরিয়ে এসে নিচে নমুনার পৃষ্ঠে আঘাত করে। পরমাণুগুলোর নিচে পড়তে কতখানি শক্তি ক্ষয় হলো, তা হিসেব করে STM জানিয়ে দেয় নমুনাটি নল থেকে কতখানি দূরে। পরমাণুর ‘গুলিবর্ষণ' করা এ নলটি নমুনার পৃষ্ঠের অসমতার ওপর ভিত্তি করে ক্রমাগত ওপরে নিচে ওঠানামা করতে থাকে, ফলে পরমাণুগুলোর শক্তি ক্ষয়েরও তারতম্য ঘটে। এভাবে আস্তে আস্তে গোটা পৃষ্ঠটি স্ক্যান করা হয়ে গেলে সে পৃষ্ঠের একটি মানচিত্র আমরা পাই। আ বয় চলচ্চিত্রটি এমন অনেকগুলো ‘মানচিত্রের' স্মমন্বয়ে তৈরী।


ছবিঃ ৩৫টি জিনন পরমাণু দিয়ে IBM-এর লোগো। সূত্রঃ সায়েন্স ফটো লাইব্রেরী

তাপমাত্রার সাথে সাথে গ্যাসের আয়তন পরিবর্তন হয়, এটি আমরা পাঠ্যবইতে পড়েছি। তাপমাত্রা যতো কমানো হবে, গ্যাসের আয়তন ততো কমতে থাকবে। উল্টোটিও সত্যি; তাপমাত্রা বাড়ার সাথে সাথে গ্যাসের আয়তনও বাড়তে থাকে, বোমা বিস্ফোরণে গ্যাসের এই বৈশিষ্ট্যটিকেই কাজে লাগানো হয়। প্রচণ্ড তাপমাত্রায় গরম গ্যাসের আয়তন খুব দ্রুত বাড়িয়ে বিস্ফোরণের সীমা বাড়ানো হয়। তাপমাত্রার সাথে আয়তনের এ সম্পর্কটিকে আমরা চার্লসের সূত্র বলে জানি। জাক চার্লস ইঙ্গিত করেছিলেন, গ্যাসের তাপমাত্রা কমাতে কমাতে একটা সময় এমন একটি অবস্থার সৃষ্টি হবে যে গ্যাস আয়তনে আর ছোট হতে পারবেনা; অচিন্তনীয় এই ভীষণ ঠাণ্ডা তাপমাত্রাটির অস্তিত্ব বাস্তবে নেই, তাই এটিকে অ্যাবসোলিউট টেম্পারেচার বা পরম তাপমাত্রা বলা হয়, যার মান -২৭৩.১৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস। মহাকাশে নিঃসীম শূণ্যতায় যেখানে কোন নক্ষত্রের আলো পৌঁছায়না, সেখানের গড় তাপমাত্রা -২৭০ ডিগ্রী সেলসিয়াস। একমাত্র ব্যুমেরাং নেবুলায় -২৭২ ডিগ্রী সেলসিয়াসের সন্ধান পাওয়া গেছে, পরম তাপমাত্রার মাত্র এক ডিগ্রী ওপরে।

তবে গোটা মহাবিশ্বের সবচেয়ে ঠাণ্ডা অঞ্চলের রেকর্ডটি পৃথিবীর দখলে; ম্যাসাচুসেটসে মার্টিন জুইয়ারলেইন-এর গবেষণাগারে কৃত্রিমভাবে এ তাপমাত্রা তৈরী করা হয়েছে সোডিয়াম-পটাশিয়াম (NaK) নামক একটি নতুন ধাতু তৈরী করার জন্য। দুটি ধাতব পরমাণু সচরাচর বন্ধনে আবদ্ধ হয় না; বিশেষ এক অবস্থার সৃষ্টি করে অনেকটা প্রকৃতির বিরুদ্ধে গিয়েই এই ধাতুটি বানানো হয়। গ্যাসীয় Na ও K-এর পরমাণু দিয়ে প্রথমে একটি চেম্বার ভর্তি করে এরপর মিশ্রণটিকে ৭৩০০ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপে উত্তপ্ত করা হয়। চেম্বারের চারপাশে এরপর একটি চৌম্বকক্ষেত্র প্রয়োগ করা হয়, যার কারণে পরমাণুগুলো আর ছোটাছুটি করতে পারে না, তারা বাধ্য হয়ে একে অপরের সাথে বন্ধন তৈরী করে। এই প্রক্রিয়াটিকে ফেশবাখ রেজোনেন্স বলে। এই গ্যাসের মিশ্রণটিকে এরপর একটি উচ্চ শক্তির এবং একটি অপেক্ষাকৃত বেশ কম শক্তির লেজার দিয়ে আঘাত করা হয়। উচ্চ শক্তির লেজারের (অর্থাৎ উচ্চ কম্পাঙ্কের আলো) আঘাতে গ্যাস পরমাণুগুলো শক্তি হারিয়ে একই বর্ণের আলোর বিচ্ছুরণ ঘটাতে থাকে। ওদিকে নিম্ন শক্তির লেজার যখন আঘাত করে (অর্থাৎ অপেক্ষাকৃত কম কম্পাঙ্কের আলো) তখন পরমাণুগুলো ২য় সেই লেজারের কম্পাঙ্কের সাথে নিজেদের কম্পাঙ্ক মেলাবার চেষ্টা করতে থাকে। উচ্চ কম্পাঙ্ক থেকে নিম্ন কম্পাঙ্কে এমন দ্রুত পরিবর্তনের জন্যই তাপমাত্রা হু হু করে নেমে যায়। এই প্রক্রিয়ায় পরম তাপমাত্রার এক ডিগ্রী ওপরের তাপমাত্রার (-২৭২.১৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস) ৫ বিলিয়ন ভাগের এক ভাগ অব্দি শীতলতা অর্জন করা গেছে। ৫ বিলিয়ন ভাগের এক ভাগ, কিন্তু তবুও তা পরম তাপমাত্রা (-২৭৩.১৫ ডিগ্রী) নয়, কী আশ্চর্য, তাই না?

আমরা যারা ঝাল খাবার খেতে পছন্দ করি, তারা অনেকেই জানি, কোন খাবার কতখানি ঝাল তা নির্ণয় করবার জন্য স্কোভিল হিট ইউনিট (SHU) নামে একটি একক রয়েছে। আমেরিকান বিজ্ঞানী উইলবার স্কোভিল ১৯১২ সালে এ স্কেলটি প্রণয়ন করেন। কোন একটি ঝাল খাবারের ঝাল উপাদানটি পানিতে কতবার মেশালে ঝাল অনুভূতিটি আর টের পাওয়া যাবে না তার ওপর ভিত্তি করে এ স্কেলটি দাঁড় করানো। হ্যালাপিনিও মরিচের তেলটিকে ৮,০০০ বার পানি দিয়ে ঘোলা করলে ঝাল স্বাদটি আর থাকে না, তাই এর SHU ৮,০০০। তাবাস্কো সসের SHU ৫০,০০০, আর পৃথিবীর সবচেয়ে ঝাল মরিচ ড্র্যাগন'স ব্রেথ চিলি'র SHU ২.৪ মিলিয়ন! এরকম ঝাল শরীরে অ্যানাফিলেকটিক শক বা ভয়ানক এক অ্যালার্জির উদ্ভব ঘটায়; দ্রুত এপিনেফ্রিন প্রয়োগ না করলে মৃত্যু খুব অসম্ভব নয়।

তবে পৃথিবীর সবচেয়ে ঝাল পদার্থটির তুলনায় ড্র্যাগনস ব্রেথ নস্যি। রেজিনিফেরাটক্সিন নামক এই রাসায়নিক উপাদানটি পাওয়া যায় ইউফোরবিয়া রেজিনিফেরা নামক একধরণের গাছ থেকে। এর SHU যে ঠিক কত তা সরাসরি নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি (সঙ্গত কারণেই!), তাই ঘুরপথে SHU হিসেব করতে হয়েছে। আমাদের শরীরে তাপ অনুভব করার যে সেন্সরটি আছে, সেটির নাম TRPV1 রিসেপ্টর। খাবারের ঝাল উপাদানটি এই রিসেপ্টরটিকে গুঁতো দেয় বলেই আমরা ঝাল টের পাই। লাল মরিচের উপাদান ক্যাপ্সাইসিন এই TRPV1-এর সাথে যেভাবে বন্ধন তৈরী করে, রেজিনোফেরাটক্সিন তার এক থেকে দশ হাজার গুণ বেশী ভালোভাবে বন্ধন তৈরী করতে পারে। ক্যাপ্সাইসিনের SHU ১৬ মিলিয়ন, রেজিনোফেরাটক্সিনের তাহলে ১৬-১৬০ বিলিয়ন! পৃথিবীর সবচেয়ে ঝাল বস্তুটির ব্যাপারে যখন জানলামই, সবচেয়ে মিষ্টি বস্তুটি আর অজানা থাকবে কেন? এ রাসায়নিক উপাদানটির নাম লাগডানেইম, চিনির চেয়ে ২৩০,০০০ গুণ বেশী মিষ্টি এটি। ফাউ হিসেবে আরো কয়েকটি রাসায়নিক পদার্থের নাম জেনে রাখছি; সবচেয়ে কৃষ্ণাভ বস্তুটির নাম ভ্যান্টাব্ল্যাক; যে কোন আলোর ৯৯.৯৬৫%-ই তা শুষে নেয়। আর পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্গন্ধময় দুটি পদার্থ হলো প্রোপ্যান্থিওন, এবং মিথেনেথিওল। এই দুটি বস্তু এতই ভয়ানক গন্ধ ছড়ায় যে ২০১৪ সালে ডুপন্ট কেমিক্যালের ৪ জন কর্মী দূর থেকে গন্ধ শুঁকেই প্রাণ হারান।

উৎসব-পার্বনে আমরা যে রঙবেরঙের বাজি পোড়াই, তাতে বিভিন্ন ধাতুর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। বিশেষ বিশেষ বর্ণের জন্য বিশেষ বিশেষ ধাতু প্রয়োজন। হলুদ রঙয়ের জন্য চাই সোডিয়াম, সবুজের জন্য বেরিয়াম, নীলের জন্য তামা, আর লাল রঙয়ের জন্য স্ট্রন্টিয়াম। গোলাপী রঙের বাজি সবচেয়ে কঠিন; এ রঙটির জন্য সচরাচর তামা এবং স্ট্রন্টিয়ামের একটি মিশ্রণ ব্যবহার করা হয়। যে কোন বিস্ফোরণ ঘটাতে হলে একটি অস্থিতিশীল রাসায়নিক উপাদানের প্রয়োজন, যাকে অল্প একটু উস্কানী দিলেই চলে। বোমা-বাজির ক্ষেত্রে এমন অস্থিতিশীল বস্তুই ব্যবহার করা হয়। তবে পৃথিবীর সবচেয়ে অস্থিতিশীল পদার্থটি একটু বেশীই অস্থিরমতি! এর নাম অ্যাজাইডোঅ্যাজাইড অ্যাজাইড। একটি গোল চক্রকে ঘিরে ১৪টি N ও ২টি C পরমাণু রীতিমতো গায়ে গা লাগিয়ে ঘেঁষাঘেঁষি করে বসে এই রাসায়নিক পদার্থটি গঠন করে। অত ছোট জায়গায় এমন ভীষণ ভীড়বাট্টা বলেই এ পদার্থটি এত অসহিষ্ণু। এটি পানিতে রাখলে বিস্ফোরিত হয়, এর ওপর ফুঁ দিলে বিস্ফোরিত হয়, এমনকি টিভির রিমোটে যে ইনফ্রা রেড রশ্মি থাকে সেটির সংস্পর্শেও ক্ষেপে যায়।

পর্যায় সারণীর পরের দিকের মৌলগুলোর পরমাণুর আকার বড় হওয়ায়, আর নিউট্রন সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় এই পরমাণুগুলো বেশ অস্থিতিশীল থাকে। নিউট্রনের আকর্ষণ শক্তি বেশ কম-এটিও অন্যতম কারণ। এরা ক্রমশ তেজষ্ক্রীয় বিকিরণের মাধ্যমে ক্ষয় হয়ে যেতে থাকে। অ্যাক্টিনিয়ামের ৮৯টি প্রোটন; বছর ২০-এর মধ্যেই এটি ক্ষয়ে ক্ষয়ে মূল পরিমানের অর্ধেকে পরিণত হয় (হ্যাফ লাইফ)। অপরদিকে রুবিডিয়ামের মাত্র ৩৭টি প্রোটন, তাই এর হ্যাফ লাইফ ৪৯ বিলিয়ন বছর। এমন তেজস্ক্রিয় বিকিরণের মাধ্যমে ক্ষয়প্রাপ্ত মৌলগুলোর নিউট্রন সংখ্যা মৌলগুলো স্বাভাবিক অবস্থায় থাকলে যে নিউট্রন সংখ্যা থাকতো তার চেয়ে বেশ ভিন্ন; একমাত্র তেজস্ক্রীয় বিকিরণের মাধ্যমেই নিউট্রন সংখ্যার এ ওলট-পালটটি ঘটে। এ কারণে সহজেই বোঝা যায় কোন মৌলটি ক্ষয়ে ক্ষয়ে আজকের অবস্থায় এসেছে। মূল মৌল আর বিকিরিত মৌলটিকে যদি আমরা মা-মেয়ে হিসেবে কল্পনা করে নেই, তাহলে এই মা-মেয়ের প্রোটন ও নিউট্রনের অনুপাত থেকে আমরা হিসেব করে নিতে পারি মৌলটির বয়স কত, এবং কতদিন ধরে বিকিরিত হয়ে চলেছে। পৃথিবীর বয়স যে সাড়ে ৪ বিলিয়ন বছর তা আমেরিকান রসায়নবিদ ক্লেয়ার প্যাটারসন ঠিক এই পদ্ধতিতেই নির্ণয় করেছিলেন।

তেজস্ক্রীয় বিকিরণের মাঝে অন্যতম প্রধান ২টি হলো আলফা ও বেটা রেডিয়েশন। যখন একটি ভারী মৌল থেকে ২টি প্রোটন ও ২টি নিউট্রন বেরিয়ে যায় (অর্থাৎ হিলিয়াম), তখন তাকে আলফা রেডিয়েশন বলে। আলফা রেডিয়েশন সবসময় ২ ধাপ পেছনে নিয়ে যায়, (অর্থাৎ, ৯৪ নাম্বার মৌলটি ২টি প্রোটন ও ২টি নিউট্রন হারিয়ে ৯২ নাম্বারে পরিণত হয়)। অপরদিকে, যদি নিউক্লিয়াসের নিউট্রনটিকে কোনভাবে জোর করে প্রোটনে পরিণত করা যায় (এবং ১টি ইলেকট্রনকে লাথি দিয়ে বের করে দেয়া যায়), তখন সেটি ১ ধাপ সামনে এগিয়ে যায়, এটিকে বেটা রেডিয়েশন বলে। এভাবে ৯২ নাম্বার মৌল ৯৩ নাম্বার-এ পরিণত হয়। পর্যায় সারণীতে যে ২৪টি ‘মানবসৃষ্ট' মৌল রয়েছে, যেগুলো প্রকৃতিতে স্বাভাবিকভাবে নেই, সেগুলোর অনেকগুলোই এভাবে বেটা রেডিয়েশনের মাধ্যমে পাওয়া গেছে। ১৯৪০ সালে ঠিক এভাবেই নতুন মৌল নেপচুনিয়াম সংশ্লেষণ করেন বিজ্ঞানীরা; পৃথিবী তার সাড়ে ৪ বিলিয়ন বছরের ইতিহাসে এ বস্তুটি কখনো দেখেনি এর আগে!

আলফা রেডিয়েশনের ফলে যে আলফা পার্টিকেল নির্গত হয় (২টি প্রোটন ও ২টি নিউট্রন), তাদের গতি সেকেন্ডে ১৫ মিলিয়ন মিটার, এ কারণেই তেজস্ক্রীয় পদার্থের কাছাকাছি যাওয়া আমাদের জন্য বিপজ্জনক, প্রচণ্ড গতিতে DNAকে এরা ছিন্নভিন্ন করে দেয়। ৮১ নাম্বার মৌল থ্যালিয়ামকে উত্তপ্ত করে গ্যাস বানিয়ে প্রচণ্ড চাপে রেখে যদি এর দিকে আলফা পার্টিকেল ছুঁড়ে মারা হয়, তাহলে প্রতি কয়েক হাজার থ্যালিয়াম পরমাণুর মাঝে ১টি স্বর্ণে পরিণত হয়। মধ্যযুগে বিশেষত শীষা থেকে স্বর্ণ তৈরী করবার নেশায় বহু বহু আলকেমিস্ট যুগের পর যুগ ঘুম হারাম করে গেছেন। তাঁদের বহু আরাধ্য সে রেসিপিটা আজ হাতের এত কাছে!

আলফা রেডিয়েশন যেমন শুধু ভারী মৌলগুলোর ক্ষেত্রেই ঘটে, বেটা'র ক্ষেত্রে তা নয়। যে কোন মৌলই বেটা রেডিয়েশনে অংশ নেয়, বিশেষত যাদের নিউট্রন সংখ্যা বেশী। কিছু নির্দিষ্ট সংখ্যক নিউট্রনের জন্য বেটা রেডিয়েশন বেশী ঘটে, যেগুলোকে ম্যাজিক নাম্বার বলা যায়। প্রকৃতিতে যত পটাসিয়াম (K) আছে, তার প্রায় সবখানেই ১৯টি প্রোটন ও ২০টি নিউট্রন আছে, কিন্তু ০.০১২% K-তে ২১টি নিউট্রন থাকায় এরা বেটা রেডিয়েশনে ভীষণ আগ্রহী। এটিকে K-40 বলা হয়। আমাদের খাবারের মাঝে K সবচেয়ে বেশী আছে কলায়। আপনি যদি ১ বছর ধরে প্রতিদিন ১৪টি করে কলা খান, তাহলে শরীরের জন্য ক্ষতিকারক তেজস্ক্রীয়তার যে সীমা (১ সিভার্টের ১/৫০০ ভাগ) সেটি ছুঁয়ে যাবেন, এবং আপনার শরীরে একটি মিনি-চেরনোবিল ঘটিয়ে ফেলতে পারবেন!

অ্যাসিডের সংজ্ঞা কী হওয়া উচিৎ এ নিয়ে অনেক তর্কাতর্কি হয়েছে ইতিহাসে, তবে বর্তমানে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা হচ্ছে অ্যাসিড এমন একটি যৌগ যা পানিতে ভেঙে প্রোটন (H+ আয়ন) ছেড়ে দেয়। এমন লাগামছাড়া ১টি প্রোটন নিজের দিকে ইলেকট্রনকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে আসবার জন্য মুখিয়ে থাকে। কাঁচ বা প্লাস্টিকে পরমাণুগুলোর বন্ধন শক্ত বলে অ্যাসিড সেখানে বেশী জোর খাটাতে পারে না, কিন্তু দুর্বল বন্ধন পেলেই (যেমন আমাদের শরীর) অ্যাসিড তার মাস্তানী দেখিয়ে দেয়। অ্যাসিড তার এই প্রোটনটি ছেড়ে দেবার জন্য কতখানি উন্মুখ-এর ওপরই নির্ভর করে অ্যাসিডের শক্তি, যে স্কেল দিয়ে এটি মাপা হয়, সেটিকে বলে PKa স্কেল। রিখটার স্কেলে যেমন প্রতিটি সংখ্যা আগের সংখ্যার চেয়ে ১০গুণ বড়, PKa স্কেলেও ঠিক তাই, তবে এ স্কেলটি কাজ করে বিপরীত দিক থেকে। ভিনেগারের PKa ৫, পালং শাকে'র অক্সালিক অ্যাসিডের ৪, অর্থাৎ অক্সালিক অ্যাসিড ভিনেগারের চেয়ে ১০গুণ বেশী শক্তিশালী।ওদিকে ক্রোমিক অ্যাসিডের PKa ১, মানে অক্সালিক অ্যাসিডের চেয়ে তা ১,০০০ গুণ শক্তিশালী (ভুলেও খেতে যাবেন না!)।

যে সকল অ্যাসিডের প্রোটন ধরে রাখার কোন ইচ্ছেই নেই, যে কোন ছুতোতে প্রথমেই ছেড়ে দেয়, তাদের সুপারঅ্যাসিড বলে। সালফিউরিক অ্যাসিডকে আমরা অত্যন্ত শক্তিশালী অ্যাসিড বলে জানি, এর PKa -৩। পারক্লোরিক অ্যাসিড একটি সুপারঅ্যাসিড, যার PKa -১০, সালফিউরিক অ্যাসিডের চেয়ে ১০ মিলিয়ন গুণ শক্তিশালী। এখানেই শেষ নয়, ট্রিফ্লিক অ্যাসিডের PKa -১৪, সালফিউরিকে অ্যাসিডের চেয়ে তা ১০০ বিলিয়ন গুণ বেশী শক্তি ধরে। অন্তর্জালে সন্ধান করলে সচরাচর ফ্লুওরোঅ্যান্টিমনিক অ্যাসিডকে সবচেয়ে শক্তিশালী অ্যাসিড হিসেবে পাওয়া যায় (PKa -১৯), তবে একেও বালখিল্য বানিয়ে দিতে পারে এমন অ্যাসিডও মানুষ বানিয়েছে, কিন্তু সেটা এতটাই ভয়ঙ্কর যে এখন পর্যন্ত নাকি একবারই তা করা হয়েছে। সুপার অ্যাসিড যেহেতু H-কে প্রথম সুযোগেই বের করে দেয়, তাই সবচেয়ে শক্তিশালী অ্যাসিডটি এমন হওয়া চাই যেখানে H কারো সাথে বন্ধন-ই বানাতে চাইবে না। He পর্যায় সারণী'র সবচেয়ে অনাগ্রহী মৌল; কারো সাথেই তার বন্ধনে আগ্রহ নেই। ১৯২৫ সালে প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করে রীতিমতো গায়ের জোর খাটিয়ে হিলিয়াম হাইড্রাইড নামক সুপারঅ্যাসিডটি বানানো হয়, এর PKa -৬৯!

PKa-স্কেলটি কিভাবে কাজ করে তা নিয়ে অনেকের প্রশ্ন থাকতে পারে। এটি pH-এর মতোই। আমরা জানি ৮১-কে আমরা ৩^৪ হিসেবে লিখতে পারি। লগের হিসেবেঃ

Log ৮১= ৪।

যদি এক বোতল অ্যাসিডে ১০০,০০০টি H আয়ন থাকে, তাহলে তার লগ নিলে পাইঃ

Log (১০) ১০০,০০০ = ৫

বেশীর ভাগ অ্যাসিডেই আসলে H থাকে খুব কম পরিমাণে; H-এর ঘনত্ব ০.০০০০১ থেকে ১ এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ।। এই সংখ্যাগুলোকে আমরা যেহেতু ১০-৬, এভাবে লিখি, তাই সেই বিয়োগ চিহ্নটিকে লগের সামনে নিয়ে এসে নতুন ভাবে প্রকাশ করিঃ -Log ০.০০০০০১ = ৬; যদি অনেক বেশী ঘন অ্যাসিড হয় তাহলে হয় -Log ১ = ১। pH-এর p এসেছে potenz শব্দটি থেকে যার আক্ষরিক অর্থঃ “১০-এর ওপর যে ঘাতটি বসবে” (pH = -Log 10)। pH দিয়ে মাপা হয় অ্যাসিডে H-এর পরিমাণ, PKa দিয়ে মাপা হয় অ্যাসিডের শক্তি, অর্থাৎ প্রোটন ছেড়ে দিতে অ্যাসিডটি কতখানি উৎসাহী। যেহেতু খুব অল্প H-ই অ্যাসিড থেকে বেরিয়ে আসে, তাই Ka-এর মান হিসেবে আমরা অনেক বড় সব ঋণাত্নক নাম্বার পাই।

2023-04-27T00:00:00.000Z
R.U.R.

R.U.R.

By
Karel Čapek
Karel Čapek,
Claudia Novack-Jones
Claudia Novack-Jones(Translator)
R.U.R.

চেক লেখক কারেল চাপেক-এর বিজ্ঞান-কল্পকাহিনী নাটক রসাম'স ইউনিভার্সাল রোবট, বা সংক্ষেপে আর.ইউ.আর। বিজ্ঞান কল্পকাহিনী ও থিয়েটারকে এক বিন্দুতে মিলিয়েছেন এমন লেখক/ নাট্যকার পৃথিবীতে খুব বেশী নেই। অন্তর্জালে ঘাঁটাঘাঁটি করে জানলাম বিজ্ঞান কল্পকাহিনী ভিত্তিক থিয়েটার নাটক নিয়ে আদতে গবেষণাই হয়েছে ভীষণ কম। ১৯৯৩ সালে র‍্যালফ উইলিংহ্যাম বহু গবেষণার পর "সায়েন্স ফিকশন অ্যান্ড দ্যা থিয়েটার' নামে একটি বই বের করেছিলেন যাতে তিনি ৩২৮টি বিজ্ঞান কল্পকাহিনী ভিত্তিক নাটক তালিকাবদ্ধ করেন। এর অনেকগুলোই মূলত "অ্যাডাপ্টেশন" বা রূপান্তর। সচরাচর মেরি শেলী'র ফ্র্যাংকেন্সটাইন বা রবার্ট লুই স্টিভেন্সনের ড. জেকিল অ্যান্ড মিস্টার হাইড-ই ঘুরেফিরে বিভিন্ন রুপে সায়েন্স ফিকশন নাটক হিসেবে মঞ্চে অভিনীত হয়। সাম্প্রতিক সময়ে এর বাইরে অ্যান্থনি বার্জেসের "আ ক্লকওয়ার্ক অরেঞ্জ"-এর নাট্যরূপও বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তবে একটি বিজ্ঞান কল্পকাহিনীকে নাটক হিসেবেই লেখা-এমন কাজ সত্যিই বেশ দুর্লভ। চাপেকের আর.ইউ.আরকে এ ঘরানায় প্রথম বলা যাবে না, সে কৃতিত্বটির দাবীদার সার্বিয়ান নাট্যকার দ্রাগুতিন ইলিচ-এর ("অ্যাফটার মিলিয়ন অফ ইয়ারস", ১৮৮৯), তবে আর.ইউ.আর ভিন্ন একটি কারণে অনন্য। "রোবট" শব্দটি পৃথিবীতে প্রথম চাপেক-ই ব্যবহার করেন এই নাটকে। আজও রোবটিক্সের পাঠ্যবইয়ের প্রথম অধ্যায়ের প্রথম লাইনটি শুরু হয় চাপেকের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে।

চেক ভাষায় "রোবোতা" শব্দের অর্থ (ক্রীতদাসদের দিয়ে করানো) জোরপূর্বক শ্রম। ১৯২০ সালে লেখা এই নাটকে চাপেক নিকটবর্তী এক ভবিষ্যতের ছবি দেখান, যখন জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই রোবটের ব্যবহার শুরু হয়ে গেছে; বিজ্ঞানী রসাম-এর কারখানায় বিরাট দক্ষযজ্ঞ চলছে, একদিনেই ১৫ হাজার রোবট সরবরাহের ফরমায়েশ হরদম আসছে। এই রোবটেরা দেখতে হুবহু মানুষের মতো; সাধারণের চোখে কোন পার্থক্যই ধরা পড়ে না। রোবট কারখানায় যে মানুষেরা কাজ করে, তারা অবশ্য জড়বুদ্ধির এই রোবটদের যন্ত্রের চেয়ে বেশী কিছু মনে করে না। এদিকে রোবটদের "মর্যাদার" এই অবনমনে কিছু কিছু মানুষের ঘোর আপত্তি, তারা রোবটের জন্য মানবাধিকার সংঘ খুলে রোবটদের বেতন-ভাতা এবং অন্যান্য অধিকার আদায়ের আন্দোলন শুরু করেছে। নাটকের শুরু ঠিক এখানেই। রোবটের অধিকার নিয়ে কর্মরত হেলেনা রসাম-এর রোবট ফ্যাক্টরীতে এসে উচ্চকণ্ঠে তার দাবী জানায়ঃ রোবটদের সাথে সম্মানসূচক আচরণ করতে হবে, তাদের শ্রমের মূল্য দিতে হবে, রোবটেরও যে "আত্না" আছে, তার স্বীকৃতি দিতে হবে।

পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলোর রাজনীতিতে একটি শব্দ বিগত এক দশকে বেশ জনপ্রিয় হয়েছেঃ woke। ইংরেজী wake শব্দের past participle এই রুপটি ব্যবহৃত হয় মূলত রাজনীতি নিয়ে সচেতন তরুণ সমাজকে বোঝাতে, যাঁরা বিভিন্ন সামাজিক, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে জাগ্রত ভূমিকা পালন করেন। এ শব্দটির প্রচলন যখন প্রথম শুরু হয়, তখন এটি প্রশংসাসূচক অর্থেই ব্যবহৃত হতো; বিশ্বব্যপী যখন নানা অবিচার, বৈষম্য, বিভেদ, বর্ণবাদ চলছে, তখন চারপাশে ঘুমিয়ে থাকা শত কোটি মানুষের মাঝে মুষ্টিমেয় "জাগ্রত" কয়েকজনই যে প্রকৃত বীর সে তো সন্দেহাতীত। তবে এক দশকের পার্থক্যে এই শব্দটির অর্থ অনেকটাই বদলে গেছে; সম্পূর্ণ বিপরীত একটি অর্থে শব্দটির প্রয়োগ চলছে বর্তমানে। হালের সময়ে টিটকারী মেরে তাঁদেরই "ওক" বলা হয়, যাঁরা ভাসা ভাসা জ্ঞান নিয়ে বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা নিয়ে উচ্চকিত হন। একটি সামাজিক সমস্যার আগাগোড়া না জেনে, প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত যোগাড় না করে, সমস্যাটির ইতিহাস পর্যবেক্ষণ না করেই যাঁরা সমস্যাটি নিয়ে উচ্চবাচ্য করেন, এবং সেটি সমাধানের বিভিন্ন (আধাখেঁচড়া) উপায় বাতলে দেন, তাঁদের আজ মোটা দাগে এই "ওক" বলা হচ্ছে। এই শব্দটি দিয়ে আজ বোঝানো হয় এঁরা অনেকটা যেন এতদিন ঘুমিয়েই ছিলেন, এবং হঠাৎ ধড়ফড়িয়ে ঘুম ভেঙে উঠে ঝাপসা চোখ এবং মস্তিষ্ক দিয়ে চারপাশটা বিচার করছেন।

মাত্র বছর দশেকের ব্যবধানে অমন প্রশংসাসূচক একটি শব্দ মশকরার বিষয়ে কেন পরিণত হলো? এর কারণ প্রগতির সঠিক সংজ্ঞা কী তা নিয়ে প্রগতিশীলদের ভেতরে থাকা অনৈক্য, এবং অনেক ক্ষেত্রেই প্রগতির আন্দোলনটির প্রতি তাঁদের নৈতিক অসততা। যে আন্দোলনের সাথে তাঁরা যুক্ত, সেটির কারণ, লক্ষ্য, ও উদ্দেশ্য নিয়ে তাঁদের পড়াশোনার অভাবও অশ্লীলভাবে চোখে পড়ে সময়ে সময়ে। আহমদ ছফা প্রায় তিন দশক আগে এ বিষয়ে অমর একটি উক্তি রেখে গেছেন,

“

যারা মৌলবাদী তারা একশো ভাগ মৌলবাদী। কিন্তু যারা প্রগতিশীল বলে দাবী করে থাকেন তাদের কেউ কেউ দশ ভাগ প্রগতিশীল, পঞ্চাশ ভাগ সুবিধাবাদী, পনেরো ভাগ কাপুরুষ, পাঁচ ভাগ একেবারে জড়বুদ্ধিসম্পন্ন।”

রসামের রোবট কারখানায় রোবটদের মুক্তির দাবী নিয়ে আসা হেলেনকে এ দলে ফেলা যায়। পৃথিবীতে রোবটের অত চাহিদার কারণ মূলত মুনাফা; রোবটের ব্যবহার কারখানার মালিকের খরচ কয়েকগুণ কমিয়ে দিয়েছে। চাপেক তাঁর নাটকে যে পৃথিবী দেখিয়েছেন তা খাদ্য সরবরাহে বেশ অনেকটাই স্বয়ংসম্পন্ন; এর কারণ খাদ্য উৎপাদন, প্রস্তুতি, বাজারজাতকরণ-ইত্যাদি নানান ধাপগুলো এখন রোবটদের দিয়ে করানো হচ্ছে, ফলে উৎপাদনের হার বহুগুণ বেড়ে গেছে। “এক টুকরো রুটির দাম কত?”-রোবট বিজ্ঞানীদের এই সামান্য প্রশ্নটির উত্তর হেলেন জানেনা। যে অভিজাত কাপড়টি পরে হেলেন কারখানা পরিদর্শনে এসেছে, সে কাপড়ের গজ প্রতি দাম কত তার ব্যাপারেও বিন্দুমাত্র ধারণা নেই তার। উৎপাদন ব্যয় কমে যাওয়ায়, এবং উৎপাদনের হার বেড়ে যাওয়ায় পৃথিবীব্যাপী মানুষের যে খেতে পরতে সুবিধে হচ্ছে সে ব্যাপারেও হেলেন সম্পূর্ণই অজ্ঞ। আর্থিক বিষয়গুলোকে আমলে না নিয়ে, বৈশ্বিক একটি ছবি মনে ধারণ না করে কেবল আবেগের বশবর্তী হয়ে হেলেন তার দাবী নিয়ে এসেছে। আন্দোলনের নির্দিষ্ট কোন লক্ষ্য না থাকায় হেলেন ও তার রোবটাধিকার সংঘের কার্যত কোন অবদানই থাকেনা, এবং হেলেন রোবট কারখানার বিজ্ঞানীদের ক্রীড়নকেই পরিণত হয় ধীরে ধীরে।

তবে চাপেকের এ নাটকের মূল গল্প হেলেনের "feel good" আন্দোলন নয়; রোবটেরা একসময় সত্যিই নিজেদের "আত্না" এবং অধিকার নিয়ে সচেতন হয়, এবং মানুষের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসে। রোবট কারখানার এক প্রকৌশলীকে শুধু বাঁচিয়ে রেখে গোটা পৃথিবীর সব মানুষকে নিকেশ করে দেয় তারা। “টার্মিনেটর” ঘরানার অসংখ্য চলচ্চিত্রে এ গল্প আমরা বহু বহুবার দেখেছি, কিন্তু চাপেকই সম্ভবত প্রথম আমাদের সতর্ক করে গেছেন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিদ্রোহ প্রসঙ্গে। এ নাটকের প্রায় ১০০ বছর পর ইউভাল নোয়াহ হারারি আজ আশঙ্কা করছেন আগামী দিনগুলোতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই হয়তো আমাদের বলে দেবে কাকে বিয়ে করতে হবে, কাকে ভোট দিতে হবে, বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন বিষয়ে ভর্তি হতে হবে। ইতোমধ্যে অনেকেই অংকের হোমওয়ার্ক, বইয়ের রিভিউ ইত্যাদি চ্যাটজিপিটি'র মতো এআই দিয়ে করিয়ে নিচ্ছে। চাপেক বর্তমানে অন্য আর যেকোন সময়ের চেয়ে অনেক বেশী প্রাসঙ্গিক।

তবে চাপেকের এ নাটকের মূল গল্প হেলেনের "feel good" আন্দোলন নয়; রোবটেরা একসময় সত্যিই নিজেদের "আত্না" এবং অধিকার নিয়ে সচেতন হয়, এবং মানুষের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসে। রোবট কারখানার এক প্রকৌশলীকে শুধু বাঁচিয়ে রেখে গোটা পৃথিবীর সব মানুষকে নিকেশ করে দেয় তারা। “টার্মিনেটর” ঘরানার অসংখ্য চলচ্চিত্রে এ গল্প আমরা বহু বহুবার দেখেছি, কিন্তু চাপেকই সম্ভবত প্রথম আমাদের সতর্ক করে গেছেন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিদ্রোহ প্রসঙ্গে। এ নাটকের প্রায় ১০০ বছর পর ইউভাল নোয়াহ হারারি আজ আশঙ্কা করছেন আগামী দিনগুলোতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই হয়তো আমাদের বলে দেবে কাকে বিয়ে করতে হবে, কাকে ভোট দিতে হবে, বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন বিষয়ে ভর্তি হতে হবে। ইতোমধ্যে অনেকেই অংকের হোমওয়ার্ক, বইয়ের রিভিউ ইত্যাদি চ্যাটজিপিটি'র মতো এআই দিয়ে করিয়ে নিচ্ছে। চাপেক বর্তমানে অন্য আর যেকোন সময়ের চেয়ে অনেক বেশী প্রাসঙ্গিক।

ছবিঃ নাটকের ৩য় অঙ্কের দৃশ্য, বিদ্রোহী রোবটেরা কারখানার মানুষদের মেরে ফেলছে, ১৯২১। সূত্রঃ উইকিপিডিয়া

কেউ কেউ চাপেকের এ নাটকটিকে প্রযুক্তি-বিরোধী হিসেবে দেখতে পারেন, কিন্তু আদতে চাপেক প্রচ্ছন্নভাবে সমালোচনা করেছেন আগ্রাসী পুঁজিবাদী মনোভাবকে। অতি মুনাফার লোভে মানুষ বুদ্ধিমান রোবট বানিয়ে জীবন-যাপন একেবারেই সহজ করে ফেলেছিলো। সে জীবন একদিকে যেমন সংগ্রামহীন, অপরদিকে তেমনি রাজনৈতিক সচেতনতাহীনও বটে। হেলনদের জন্ম এখান থেকেই। হেলেনের এই চরিত্রটি দিয়ে চাপেক স্পষ্ট দেখিয়ে দিয়েছেন আধসেদ্ধ সচেতনতা, ও অন্ধ আবেগ দিয়ে সমাজ উদ্ধার করা যায় না। সমাজ উদ্ধারের জন্য যে গভীর চিন্তার প্রয়োজন, সেই চিন্তা করবার কষ্টটি স্বয়ংক্রিয় হয়ে যাওয়া এক জীবনে কেউ আর করতে চায় না।

চাপেক যেভাবে তাঁর নাটক শেষ করেছেন, তাতে ধারণা হয় “শোষক শ্রেণীকে উচ্ছেদ করে শাসিত শ্রেণী নতুন এক পৃথিবীর জন্ম দেবে”-এমন একটি বিষয়েরও দিকেও তিনি ইঙ্গিত করেছেন। নাটকের শেষ দৃশ্যে “নারী” ও “পুরুষ” দুটি রোবট একে অপরের প্রেমে পড়ে, এবং পৃথিবীর শেষ মানুষ অ্যালকুইস্ট-এর আশীর্বাদ নিয়ে “অ্যাডাম” ও “ইভ” নাম ধারণ করে। একপক্ষীয় শোষণ যে চিরদিন চলতে পারেনা, দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে যে শোষিতেরাও মরণ কামড় দিতে জানে এই সত্যটি শোষক-শোষিতের সংগ্রামে বারবারই ফিরে ফিরে আসে; মানুষ-রোবট, সাদা-কালো, পাকিস্তানী-বাঙালি, বাঙালি-পাহাড়ি...যে রূপেই হোক না কেন।

তবে শোষকেরা বরাবরই কানে ঠসা হন।

2023-02-03T00:00:00.000Z
Cyrano de Bergerac

Cyrano de Bergerac

By
Edmond Rostand
Edmond Rostand,
Brian Hooker
Brian Hooker(Translator),
+1 more
Cyrano de Bergerac

সিহানো দে ব্যেহজেহাচ (Cyrano de Bergerac) একাধারসে ছিলেন কবি, বিজ্ঞান-কল্পকাহিনীকার, দার্শনিক, চিকিৎসক, নাট্যকার, চিঠি-লেখিয়ে, সৈনিক, এবং তলোয়ারবাজ। যে সময়টায় সিহানো'র জন্ম, সেই ১৬১৯ সালে ইওরোপের মধ্যভাগ জুড়ে চলছে থার্টি ইয়ারস' ওয়ার। ১৬১৮ থেকে ১৬৪৮ সাল পর্যন্ত চলা এ যুদ্ধে প্রায় ৮০ লক্ষ মানুষ প্রাণ হারায়, জার্মানীর জনসংখ্যা নেমে আসে অর্ধেকে। এ যুদ্ধের হাত ধরে ইওরোপ খুব অল্প সময়ের ব্যবধানেই আরো বেশ কয়েকটি যুদ্ধ দেখে যার মাঝে উল্লেখ্যযোগ্য নেদারল্যান্ড ও স্পেনের ৮০ বছরের যুদ্ধ, ফ্রান্স-স্পেনের মাঞ্চুয়ান যুদ্ধ, পর্তুগাল-স্পেনের যুদ্ধ, এবং সবশেষে ফ্রান্স-স্পেনের যুদ্ধ। শেষের এই যুদ্ধে ফরাসী সিহানো নিজেও লড়াই করেন এবং যুদ্ধে আহত হবার পর সৈনিকের দায়িত্ব ছেড়ে পুরোপুরি লেখালেখিতে মনোনিবেশ করেন।

জনশ্রুতি আছে, সিহানো'র নাকটি নাকি (আক্ষরিক অর্থেই) ছিলো বিশাল বড়। টেনিদা'র বইয়ের প্রচ্ছদে যেমন সবার প্রথমে তাঁর নাকের দিকেই নজর যায়, সিহানো'র ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম কিছু ছিলো না নাকি। সিহানো'র মৃত্যুর প্রায় আড়াইশ বছর পর ১৮৯৭ সালে ফরাসী নাট্যকার এদমোঁ হোস্তাঁ (Edmond Rostund) সিহানোকে নিয়ে নাম শিরোনামে একটি নাটক লেখেন, যা আজ অব্দি তাঁর শ্রেষ্ঠতম কাজ হিসেবে টিকে আছে; বস্তুতঃ হোস্তাঁ এবং ‘সিহানো দে ব্যেহজেহাচ' আজ সমার্থক শব্দই হয়ে গেছে প্রায়।

হোস্তাঁ তাঁর এ নাটকে সিহানোকে নিয়ে যে গল্পটি ফেঁদেছেন, সে ধরণের গল্প আমরা ৮০-৯০-এর দশকের বাঙলা সিনেমায় অনেকই হয়তো দেখেছি। ট্র্যাজি-কমেডি ঘরানার এ নাটকে আমরা দেখতে পাই সিহানো তাঁর বিসদৃশ নাকের কারণে ভীষণ হীনমন্যতায় ভোগেন, এবং লজ্জায় ও শঙ্কায় তিনি কখনোই তাঁর ভালোবাসার নারী হক্সেইন (Roxanne)কে মনের কথা জানাতে পারেন না। হক্সেইন এদিকে মন দিয়েছেন সিহানো'র কম্পানি'র আরেক সৈনিক খ্রিস্তীয়ঁকে (Christian)। হক্সেইন দুর্দান্ত বুদ্ধিমতী, শিল্প-সাহিত্যে দারুণ আগ্রহ তার; ওদিকে, জীবনভর শুধুই তলোয়ার চালাতে শেখা খ্রিস্তীয়ঁ'র একেবারেই কাব্য আসে না! হক্সেইন খ্রীস্তীয়ঁ'র রূপে মজেছে, কিন্তু খ্রিস্তীয়ঁ নিজের থেকে বুদ্ধি খাটিয়ে কথা বলতে গেলেই হক্সেইন-এর হাঁপ ধরে যায়। আদতে একইরকম বোকা বোকা কথার বিরক্তিকর পুণরাবৃত্তি ছাড়া খ্রিস্তীয়ঁ'র ঝুলিতে আর কিছুই নেই। পাছে ভুল মানুষকে ভালোবাসার যাতনায় হক্সেইন আত্নদহনে ভোগে, সে ভয়ে সিহানো হাতে কলম তুলে নেন, আর বুকে চেপে নেন পাথর; খ্রিস্তীয়ঁ'র নাম দিয়ে হক্সেইনকে একের পর এক চিঠি লিখে দিতে থাকেন। মাতাল করা ভাষায় লেখা সে চিঠির কাব্যসুধা আকণ্ঠ পান করে হক্সেইন খ্রিস্তীয়ঁর প্রেমে আরো, আরো ডুবে যেতে থাকে, আর ‘কুৎসিত-দর্শন' সিহানো দূর থেকে দেখে যান। হক্সেইন সিহানো'র হয়নি, কিন্তু তাতে কী? খ্রিস্তীয়ঁকে বিয়ে করে হক্সেইন তো সুখে আছে, হক্সেইনের সুখেই সিহানো'র সুখ।

খ্রিস্তীয়ঁর সাথে হক্সেইন-এর বিয়েটা শেষমেশ দীর্ঘস্থায়ী হয় না; ফ্রান্স-স্পেনের যুদ্ধে খ্রিস্তীয়ঁ প্রাণ হারায়, এরপর ১৪ বছর কেটে যায়, কিন্তু সিহানো একবারও মনের কথাটা জানান না। এই ১৪টা বছর হক্সেইন জেনে এসেছে তাকে লেখা চিঠিগুলো সবই খ্রিস্তীয়ঁ'র লেখা; এমনকি যুদ্ধের ময়দান থেকেও নিয়ম করে প্রতিদিন সিহানো খ্রিস্তীয়ঁ'র সই দিয়ে চিঠি লিখে গেছেন, প্রাণ হাতের মুঠোয় নিয়ে শত্রু শিবিরের চোখ এড়িয়ে সে চিঠি প্রতিদিন পাচার করেছেন, কারণ যুদ্ধে যাবার আগে হক্সেইনকে সিহানো কথা দিয়েছিলেন খ্রিস্তীয়ঁ যেন নিয়মিত চিঠি লেখে তা তিনি দেখবেন। প্রায় পুরোটা নাটকে সিহানো তাঁর দারুণ চোখা চোখা সব সংলাপে পাঠক/ দর্শককে হাসিয়ে মেরে শেষের দৃশ্যে উদাস ও স্তম্ভিত করে দেন। হক্সেইন-এর কোলে মাথা রেখে ৩৬ বছর বয়েসী সিহানো যখন মারা যাচ্ছেন, সেই মুহুর্তেই কেবল হক্সেইন বুঝতে পারে কী নিদারুণ এক মিথ্যের সাথে গত ১৪টা বছর সে বাস করে এসেছে। মৃত্যুপথযাত্রী সিহানো'র একটিই আবদার, সিহানো'র জন্য হক্সেইনকে আলাদা সময় ব্যয় করতে হবেনা, শুধু খ্রিস্তীয়ঁর জন্য যখন হক্সেইন-এর খুব মন খারাপ হবে, প্রাণ কাঁদবে, তখন যেন সিহানোকেও একটু সে মনে করে, তাঁর জন্য এক ফোঁটা চোখের পানি ফেলে...

১৮৯৭ সালে লেখার পর থেকে হস্তোঁ'র এ নাটকটি গত ১২৬ বছরে অসংখ্যবার মঞ্চে এবং পর্দায় অভিনীত হয়েছে। মার্কিন অভিনেতা হোসে ফেরার ১৯৪৭ সালে টনি ও ১৯৫০ সালে অস্কার জেতেন সিহানো'র চরিত্রে অভিনয় করে। এরপর থেকে সিহানো প্রায় প্রতি দশকেই ফিরে ফিরে এসেছে কোন না কোন রূপে। ২০২১-এই টিরিওন ল্যানিস্টার খ্যাত পিটার ডিংক্লেজ সিহানো হয়েছেন। একান্ত সাক্ষাৎকারে ডিংক্লেজ বলেছিলেন কিভাবে সিহানো'র সাথে তিনি নিজে মিশে একাকার হয়ে গেছেন। সিহানো'র মতোই তাঁরও যে নিজের শারীরিক গঠন ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে প্রবল আক্ষেপ, হতাশা, লজ্জা ও হীনমন্যতা ছিলো! গত বছর প্রফেসর এক্স-খ্যাত জেইমস ম্যাকঅ্যাভয়ও সিহানোর চরিত্রে মঞ্চে এসে ভীষণ প্রশংসা কুড়িয়েছেন, তবে এটি আধুনিক ‘অ্যাডাপ্টেশন', হস্তোঁর মূল নাটকটি নয়।

সিহানো আর হক্সেইনকে নিয়ে লেখা প্রেমের গপ্পোটি সম্পূর্ণ বানোয়াট, তবুও কেন সিহানোকে মানুষ অতো ভালোবাসে? কেন তাঁকে নিয়ে হস্তোঁ নাটক লিখতে গেলেন? এর কারণটি লুকিয়ে আছে সিহানো'র লেখালেখিতে এবং তাঁর ব্যক্তিত্বে। নাটকে যেমন দেখা যায়, সিহানো বাস্তব জীবনেও খুব সম্ভব তেমনি বাকচতুর ছিলেন, কথার ইয়র্কারে প্রতিপক্ষকে সম্ভবত একইভাবে তিনি ক্লিন বোল্ড করে দিতেন। ১৭ শতকের সেই অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়টাতেই সিহানো হাসির বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী লিখে ধর্মীয় কুসংস্কারে আক্রান্ত এক সমাজকে চাবকিয়েছেন, কর্তৃত্ববাদকে মুখ ভেঙিয়েছেন। যে ধরণের বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে সিহানো'র আস্থা ছিলো সেটিকে আজ ‘এপিকিউরান অ্যাটোমিজম' বলে। গ্রীক দার্শনিক ডেমোক্রিটাস প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে ধারণা করেছিলেন সকল বস্তুই বিভাজনের অযোগ্য ভীষণ ছোট ছোট সব কণা দিয়ে গঠিত (স্পয়লারঃ অ্যাটম/ পরমাণু)। তাঁর শিষ্য এপিকিউরান এ ধারণাটিকে আরো পোক্ত এবং প্রসারিত করেন। ১৭ শতকের ক্যাথলিক ফরাসী সমাজ এ ধারণাটিকে কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলো না। এর কারণঃ অ্যারিস্টটল!

ডেমোক্রিটাস পরমাণু'র যে ধারণা দিয়ে যান, তাতে দু'টি পরমাণু'র মাঝে একটি ফাঁকা জায়গা থাকে (void)। এই ভয়েড বা শূণ্যতা নিয়েই অ্যারিস্টটলের যতো আপত্তি ছিলো। “কোন একটি ঘুর্ণায়মান বস্তু যতোখানি জোরে ঘুরছে, এর চেয়েও বেশী জোরে কেন ঘুরতে পারছে না?”-এ প্রশ্নের উত্তর অ্যারিস্টটল ভেবে বের করেন, নিশ্চয়ই কোথাও কোন একটি প্রতিরোধী বল কাজ করছে যা এর ঘুর্ণনকে নিয়ন্ত্রণ করছে। পরমাণুগুলো'র মাঝে যদি নিঃসীম শূণ্যতাই থাকতো, তাহলে তো আর এ বল কাজ করতে পারতো না, কারণ, যেখানে কিছু নেই সেখানে তো কিছুই থাকতে পারে না! অতএব শূণ্যতার তত্ত্ব বাদ, পরমাণুর তত্ত্বটিকে গোল্লায় পাঠানো হোক। বাঙলাদেশের আজকের ধর্মীয় সমাজ যেভাবে শিশুদের পাঠ্যবইতে বিবর্তনবাদ পড়ানো নিয়ে প্রবল আপত্তি জানিয়ে চলেছে, বিবর্তনবাদের অংশটুকু ছিঁড়ে ফেলে দিয়ে বাকী বইটুকু পড়তে আহ্বান জানাচ্ছে, ১৭ শতকের ফরাসী ক্যাথলিক সমাজের পরমাণুবাদের বিরোধীতা এর চেয়ে ভিন্ন কিছু ছিলো না। ফ্রান্সের ধর্মবাদীরা তাঁদের ভীষণ ক্ষুদ্র জানাশোনার পরিধি, এবং তার চেয়েও ক্ষুদ্র মনকে সম্বল মেনে সিহানোকে ধর্মনিন্দা'র অভিযোগে ফাঁসিয়ে তাঁর জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছিলেন।

দারুণ আধুনিকমনস্ক সিহানো তাঁর গল্পে মানুষকে রকেটে চাপিয়ে চাঁদ এবং সূর্যে পাঠিয়েছেন, সেখানের অধিবাসীদের সাথে পৃথিবীর অধিবাসীদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন, দুই ভুবনের সামাজিক আচার-রীতির পার্থক্যের হিসেবও কষে দেখিয়েছেন নানা ব্যঙ্গাত্নক গল্পের অবতারণা করে। আজ আমরা জোনাথন সুইফটের গালিভার'স ট্র্যাভেলসকে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যাঙ্গাত্নক কাজ বলেই জানি, সুইফট-এর অনুপ্রেরণা হিসেবে সিহানো কাজ করেছেন, এটি নিশ্চয়ই এখন আর অবাক করা কোন তথ্য নয়! বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর অন্যতম শীর্ষ গুরু আর্থার সি ক্লার্কও সিহানোকে ওস্তাদ মেনেছেন। শুধু সুইফট বা ক্লার্ক-ই নন, মলিয়ের, যাঁকে দিয়ে মানুষ ফরাসী ভাষাটিকে চিনেছে (“ফরাসী মলিয়েরের ভাষা”-লোকমুখে প্রচলিত ছিলো), পর্যন্ত তাঁর Scapin the Schemer নাটকের দু'টি দৃশ্য সিহানো'র Le Pédant joué থেকে সরাসরি ছেপে দিয়েছেন! পৌনে ৪শ বছর আগের মানুষ সিহানো আজও আমাদের চারপাশের বহু বহু মানুষের চেয়ে ঢের আধুনিক।

সিহানোকে অমরত্ব দান করা ছাড়াও বিশ্বসাহিত্যে হস্তোঁ'র আরেকটি বড় অবদান রয়েছে; তাঁর বরাতে প্রথমে ফরাসী এবং পরে ইংরেজী অভিধানে 'panache' শব্দটি যুক্ত হয়। প্যানাশ শব্দের অর্থ আমরা আড়ম্বরপূর্ণ আচরণ, নিজস্ব একটি স্টাইল ইত্যাদিকে বুঝি। বাঙলা একাডেমি'র অভিধানে এ শব্দটির অর্থ লেখা হয়েছে "বড়াই ভাব"। নাটকে মৃত্যুপথযাত্রী সিহানো তাঁর টুপির পালকে হাত বুলিয়ে অনেকটা দম্ভ নিয়েই বলেন, তিনি রিক্ত, শূণ্য হাতে পৃথিবী ছাড়ছেন বটে, কিন্তু সাথে করে নিয়ে যাচ্ছেন তাঁর সেই প্যানাশ। প্যানাশ বিষয়টি আদৌ কী, এবং সিহানো'র প্যানাশটি কেমন ছিলো তার উত্তরে আত্নবিশ্বাস, হামবড়া ভাব, দৃঢ় প্রত্যয়, আপুন কা ইশটাইল...ইত্যাদি নানা শব্দের তাত্ত্বিক প্রয়োগ ঘটানো যায়, কিন্তু তাতেও কি পরিষ্কার হয়? নাটকটি পড়ে সিহানো'র প্যানাশ কেমন হতে পারে তার যে একটি ধারণা পেয়েছি সেটির একটি approximation সম্ভবত একমাত্র শিবাজিই হতে পারেনঃ



ইউটিউবে খুঁজলে হস্তোঁ'র নাটকটির অনেকগুলো মঞ্চায়ন-ই চোখে পড়বে, আমার সবচেয়ে দুর্দান্ত লেগেছে ২০১৪ সালে বব জোন্স ইউনিভার্সিটির এই পার্ফর্ম্যান্সটি। কারো হাতে ঘন্টা দু'য়েক সময় থাকলে বসে যেতে পারেন কিন্তু!

2023-01-23T00:00:00.000Z
We

We

By
Yevgeny Zamyatin
Yevgeny Zamyatin,
Bela Shayevich
Bela Shayevich(translator)
We

ডিস্টোপিয়া কাকে বলে-সে সংজ্ঞা ২০২৪ সালের দ্বিতীয় এই মাসে দাঁড়িয়ে নতুন করে আমাদের শেখার প্রয়োজন নেই আর। অসংখ্য বই, সিনেমা, নাটক, আর গল্পের বরাতে আমরা আজ দিব্যি জেনে গেছি, যে সমাজে আমরা শুনতে পাই “অতঃপর সকলেই সুখে শান্তিতে বসবাস করিতে থাকিলো”, সে সমাজেই অ-সুখটা সবচেয়ে বেশি। যে সমাজ বা রাষ্ট্রব্যবস্থা আমাদের বারবার নিশ্চিত করে সমাজের সক্কলেরই গোলাভরা ধান, পুকুরভরা মাছ, আর পেটভরা গু রয়েছে, সে সমাজ বা রাষ্ট্রব্যবস্থাটি নিয়েই আমরা আজ সবচেয়ে বেশি সন্দিহান হয়ে উঠি (যদি সন্দিহান হবার সে অবকাশ বা ক্ষমতাটুকু আমাদের অবশিষ্ট থাকে)।

গল্প-উপন্যাস, কিংবা সিনেমায় আমরা বর্তমানে যে ধরনের ডিস্টোপিয়ান সমাজ বেশি দেখি, তাতে কয়েকটি বিষয়ই সচরাচর উঠে আসেঃ প্রাকৃতিক বা মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগের দরুন পৃথিবীর আবহাওয়া, পরিবেশ ইত্যাদি বিষাক্ত হয়ে উঠেছে, সীমিত সম্পদের সে পৃথিবীতে বেঁচে থাকার সংগ্রামটা খুব তীব্র, মানুষ হয়তো মাটির নিচে কিংবা পৃথিবীর চারপাশে ঘূর্ণায়মান কোন উপগ্রহে এখন বাস করে...ইত্যাদি। তবে ডিস্টোপিয়া বলতে মোটাদাগে আমরা যা বুঝি তা হলো একজন সর্বগ্রাসী শাসকের অঙ্গুলিহেলনে চলা এমন একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা, যেখানে প্রতিটি নাগরিকের প্রতিটি পদক্ষেপই শাসকের কড়া নজরে থাকে (চেক)। দম বন্ধ করা এ ব্যবস্থায় কথা বলার স্বাধীনতা থাকে না (চেক), নিজের ইচ্ছেমতো কাজ করবার সুযোগ থাকে না (চেক), সমাজব্যবস্থাটির সমালোচনা করবার কোন উপায় নেই (চেক), সমাজটির গায়ে “ডিস্টোপিয়ান” তকমাটি লাগাবারও কোন রাস্তা নেই (চেক)। সবগুলো ঘরেই টিক চিহ্ন দিয়ে ‘চেক' করা হয়ে গেছে। কোথাও কি মিল পাচ্ছেন?

বাক এবং ব্যক্তিস্বাধীনতাহীন সমাজ বা রাষ্ট্রব্যবস্থার এ গল্পগুলো আজ আমাদের কাছে অনেকটাই ক্লিশে হয়ে উঠেছে; এর দায় কিছুটা ডিস্টোপিয়ান বই এবং সিনেমার, আর বাকি সবটার দায় আমাদের নিত্যদিনের বাস্তব অভিজ্ঞতার। আমরা ভালো করেই জানি, কীভাবে চুল রাখা উচিৎ সে বিষয়ে নির্দেশনা দিয়ে উত্তর কোরিয়ার সরকার রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে প্রচারনা চালিয়ে এসেছেন; সরকারের বেঁধে দেয়া নিয়মের বাইরে নিজের ইচ্ছেমতো ফ্যাশনে চুল রাখবার উপায় সেখানে নেই। আমরা জানি ৩ দশক ধরে শাসন করে যাওয়া তুর্কেমেনিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রপ্রধান সাপারমুরাত নিয়াজভ ১২ মিলিয়ন ডলার খর্চা করে রাজধানীতে নিজের একটি বিশালাকার স্বর্ণমূর্তি বসিয়েছিলেন, যেটি সবসময় সূর্যের দিকে মুখ ফিরিয়ে রাখে। নিয়াজভ তাঁর নিজের লেখা বই ‘রুহনামা' দেশটির স্কুল, কলেজ, ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাসেও অন্তর্ভুক্ত করেন। সরকারী চাকরীর ইন্টারভিউতে কিংবা ড্রাইভিং টেস্টে এই বইটি থেকেই প্রশ্ন করা হতো।

রাষ্ট্রপ্রধানের আত্নজীবনীমূলক বইয়ের ওপর চাকুরীপ্রার্থীদের পরীক্ষা দেবার ব্যাপারটি নিয়ে বছর কয়েক আগেও আমাদের দেশে হাসাহাসি করা হতো, এখন আর হয় না; কারণ, সময়ের পরিক্রমায় এ ধরনের আত্নজীবনী আমাদের দেশের চাকুরীপ্রার্থীদের পাঠ্যসূচীর তালিকাতেও ঢুকে গেছে। চিকিৎসক, প্রকৌশলী, প্রশাসন কর্মকর্তাভেদে সকলকেই এখন এ বই পড়ে পরীক্ষায় বসতে হয়। নিজ নিজ বিষয়ের দক্ষতা এ পরীক্ষায় মুখ্য নয়, এ আত্নজীবনীকে কেন্দ্র করে কে কতখানি প্রশস্তিমূলক রচনা লিখতে পারেন, তারই পরীক্ষা মূলত এটি। টিক চিহ্ন দিয়ে চেক করবার জন্য আর কোন ঘর বাকি আছে কি? দেখা যাক...

কী হয় আসলে যদি একটি সমাজের কেউ নিজের ইচ্ছেমতো তরিকায় চুল কাটতে না পারে? কিংবা নিজের কথাগুলো বলতে বা লিখতে না পারে? কিংবা সে সমাজটির সবচেয়ে বড় পাণ্ডাটির জীবনী তাকে মুখস্থ করতে বাধ্য করা হয়? তাঁর ভাস্কর্যের সামনে মাথা নুইয়ে চলতে শেখানো হয়? মানুষ স্বাধীনচেতা প্রাণী; এ ধরণের জোর জবরদস্তির মাধ্যমে মূলত মানুষের মানবিক দিকগুলো কেড়ে নেয়া হয়। একক কোন ব্যক্তি বা সংঘ বা প্রতিষ্ঠানকে ঘিরেই তখন যান্ত্রিক একটি সমাজ গড়ে ওঠে, যেখানে সবাইকে চোখ কান নাক বুজে কাজ করে যেতে হয় শুধু সেই ব্যক্তি বা সংঘ বা প্রতিষ্ঠানের স্বার্থসিদ্ধির জন্যই। এ ধরণের সমাজে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের কোন মূল্য থাকে না; একটি দলের বা মতের অনুসারীরাই শুধু সে সমাজ দাবড়ে বেড়ান, তাঁরাই নির্ধারণ করে দেন মানুষের মুখের বুলি। কী বলা যাবে, আর কী যাবে না, তার বিষয়ে নানান নির্দেশনা আসে এই দলটির কাছ থেকে। মানুষের কল্পনার ডানা ছেঁটে ফেলে তাকে সমাজপতির ক্রীড়নকে পরিণত করা এ শাসন ব্যবস্থাটির সারকথা, ফলে এখানে মানসম্পন্ন শিল্প-সাহিত্যও কখনো মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না; শিল্পের নামে যা হয় তা মূলত তোষামোদী। ব্যক্তিজীবনের নিয়ন্ত্রণ, গোপন বাহিনী কর্তৃক উঠিয়ে নিয়ে যাবার সার্বক্ষণিক ভীতি জারি রাখা, আর দাসত্বের শৃঙ্খল-ব্যাস, এই-ই তো আদর্শ ডিস্টোপিয়ান সমাজ তৈরীর রন্ধনপ্রণালী।

ইয়েভগেনি জামিয়াতিন তাঁর ‘উই' উপন্যাসটি লিখেছিলেন ১৯২২ সালে, এর ইংরেজি অনুবাদটি বেরোয় আজ থেকে গুনে গুনে ঠিক ১০০ বছর আগে, ১৯২৪ সালে। এই ১০০ বছরে জামিয়াতিন প্রতিদিনই আগের দিনের চেয়ে বেশী প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছেন, বিশ্বময় একের পর এক ডিস্টোপিয়ান সমাজের উত্থানে। গত ১০০ বছরে-জামিয়াতিনের নিজের জন্মভূমি রাশিয়া সমেত-অসংখ্য দেশে ডিস্টোপিয়া গেঁড়ে বসেছে, ঠিক যেমন ডিস্টোপিয়া জামিয়াতিন কল্পনা করে গেছেন “উই”তে। এ উপন্যাসের চরিত্রদের কারো নাম নেই, সবার পরিচয় এক একটি সংখ্যা মাত্র। এর কারণ, উপন্যাসে বর্ণিত যে “ওয়ান স্টেট”, তা এর নাগরিকদের ব্যক্তিস্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না; সমাজের সকলে মিলে “আমরা”, এখানে “আমি”'র কোন মূল্য নেই। প্রত্যেকের দায়িত্ব নির্দিষ্ট করে দেয়া রয়েছে ওপর মহল থেকে, সে মোতাবেকই কাজ করে চলে সবাই, যেন বৃহৎ কোন মেশিনের এক একটি ক্ষুদ্র অংশ আপন আপন নির্দেশ পালন করে চলেছে। কাজের ধরণের ওপর ভিত্তি করে প্রত্যেকের রয়েছে বিভিন্ন বর্ণের উর্দি। নাগরিকেরা সবাই এক তালে পা ফেলে নিজ নিজ বর্ণের উর্দি চাপিয়ে কাজে যায়, কাজ করে, দিনশেষে বাড়ি ফেরে।

এই যান্ত্রিক রুটিনের বাইরে কেউ যায় না, যাবার কথাও কারো মাথায় আসে না কখনো। সবাই শুধু জানে মাথার ওপরে একজন সর্বজ্ঞ পৃষ্ঠপোষক রয়েছেন- উপন্যাসে যাঁকে benefactor বলা হয়েছে-তিনি ওয়ান স্টেটের প্রতিটি নাগরিকের গতিবিধি লক্ষ্য করেন, তাঁর চোখ এড়াবার কোন উপায় নেই। থাকবেই বা কীভাবে? এ রাজ্যের প্রত্যেকেরই যে বাস কাঁচের তৈরী স্বচ্ছ দেয়ালের বাড়িতে! শুধু বিশেষ কয়েকটি দিনে বাইরে থেকে দেখতে পাওয়া সে দেয়ালে গোলাপী একটি পর্দা ঝোলানো হয় আধ ঘন্টার জন্য। সে দিনটি ভালোবাসাবাসির দিন। রাষ্ট্র তথা বেনিফ্যাক্টর নির্ধারণ করে দেন কোন দিনটিতে কে কার সাথে বিছানায় যাবে, কার দেয়ালে আধ ঘন্টার জন্য ঝুলবে গোলাপী পর্দা...

রাষ্ট্রকর্তৃক শয্যাসঙ্গী ঠিক করে দেবার ব্যাপারটি অনেকের কাছেই হাস্যকর এবং অবিশ্বাস্য ঠেকতে পারে, কিন্তু পৃথিবীর ইতিহাসে বাস্তবে এমন ঘটনা সত্যিই ঘটেছে। সত্তরের দশকে পল পট যখন কম্বোডিয়াতে তাঁর খেমার রুজের শাসন প্রতিষ্ঠান করেন, তিনি জামিয়াতিনের এ মডেলেই দেশ চালান। ৮ বছর বয়স হলেই শিশুদের বাবা মা'র কাছ থেকে সরিয়ে বিশেষ শিবিরে নিয়ে রাখার ব্যবস্থা করেন তিনি যেখানে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করিয়ে আর দিনভর সরকারী প্রচার প্রচারণামূলক গরম গরম বক্তৃতা শুনিয়ে এই শিশুদের “প্রকৃত দেশপ্রেমী” নাগরিকে পরিণত করতেন। একটি কথাই তাদের মনে দৃঢ়ভাবে গেঁথে দেয়া হতোঃ রাষ্ট্রই হলো প্রকৃত দেশপ্রেমী নাগরিকের সত্যিকার অভিভাবক, জন্মদাতা/ দাত্রী বাবা-মা নয়; যারা এ কথা মানে না, তারা রাষ্ট্রের শত্রু, তাদের খতম করা রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব । পল পটের তৈরী রাষ্ট্রীয় সে যন্ত্র নির্ধারণ করে দিতো কার সাথে কার বিয়ে হবে, নিজের ইচ্ছেয় নিজের পছন্দের মানুষকে বেছে নেবার কোন সুযোগ সেখানে ছিলো না। “উই” লেখার ৫ দশকের মাঝেই ভিন্ন একটি সংস্কৃতির দেশে জামিয়াতিনের কল্পনার সে ডিস্টোপিয়া বাস্তবায়িত হয়।

যাঁরা জর্জ অরওয়েল-এর ‘১৯৮৪' পড়েছেন, তাঁদের কাছে “উই”'র এ গল্প খুব নতুন কিছু শোনাবে না, এর কারণ, অরওয়েল তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত উপন্যাসটি লেখেন “উই”-এর আদলেই। জামিয়াতিনের উপন্যাসে নাগরিকেরা কেউ বেনিফ্যাক্টর-এর বিরুদ্ধে কথা বলতে পারে না, অরওয়েল সে ধারণাটিকে আরো এক ধাপ এগিয়ে নিয়েছেন, সেখানে “বিগ ব্রাদার”-এর বিপক্ষে কোন কিছু ভাবাও অপরাধ! বিশেষ এক পুলিশ বাহিনীর সাথে অরওয়েল আমাদের পরিচিত করিয়ে দেন যারা কী না নাগরিকদের বাড়ির আনাচে কানাচে নজরদারীর বিভিন্ন যন্ত্র বসিয়ে তাদের মনের খবর উদ্ধারে সদা তৎপর। “১৯৮৪” লেখার পর ৭০ বছর পেরিয়ে গেছে, কিন্তু আমাদের তবুও মনে হয় অরওয়েল স্রেফ যেন গেল সপ্তাহেই বইটি লিখলেন। অরওয়েলের সময় যা ছিলো কল্পবিজ্ঞান, আজ তা-ই ধ্রুব সত্য হয়ে উঠেছে। "উই"-এর বেনিফ্যাক্টর, এবং "১৯৮৪"-এর বিগ ব্রাদার-এ দুই শাসকের নাম নির্বাচনের ব্যাপারটিও লক্ষণীয়। এ ধরণের ডিস্টোপিয়ান সমাজে এমন সর্বগ্রাসী শাসকেরা আমাদের মনে খোদাই করে লিখে দেন, তাঁরাই রাষ্ট্রটির সবচেয়ে দয়ালু মানুষ, তাঁদের বিকল্প কেউ নেই। বিকল্পহীন কৃপাময় এই মানুষদের ছাঁচটি আজ আমাদের অনেকের কাছেই যেন কিছুটা অস্পষ্টভাবে চেনা চেনা ঠেকে, তবুও আমরা চিনে নিতে চাই না।

ডিস্টোপিয়ান সমাজ বলতে আমরা আজ যা বুঝি, তা আমাদের শিখিয়েছে মূলত ৩টি বইঃ “ব্রেইভ নিউ ওয়ার্ল্ড”, “১৯৮৪”, এবং “ফ্যারেনহাইট ৪৫১”। বিষয়গত দিক দিয়ে “উই”, “ব্রেইভ নিউ ওয়ার্ল্ড”, এবং “১৯৮৪” প্রায় একইরকম। “উই”তে যেমন দেখতে পাই নির্দিষ্ট বর্ণের উর্দি পরে নাগরিকেরা নির্দিষ্ট কাজ করে চলেছে, “ব্রেইভ নিউ ওয়ার্ল্ড”-এ আল্ডুস হাক্সলি সে ধারণাটির ওপরই আরেকটু রং চড়ান;হাক্সলির নতুন সে সাহসী পৃথিবীতে মানুষ আর স্বাভাবিক যৌন প্রক্রিয়ায় সন্তান জন্ম দেয় না, যে পেশায় যতজন প্রয়োজন তা হিসেব করে সে মোতাবেক কারখানায় ফরমায়েশ দেয়া হয়, পেশার চাহিদা অনুযায়ী বুদ্ধিমত্তার স্তর কম বেশ করে ফরমায়েশ মতো মানুষ বানিয়ে দেয় কারখানার কল। ছয় দশক পর “দ্যা মেইট্রিক্স” চলচ্চিত্রটি “ব্রেইভ নিউ ওয়ার্ল্ড”-এর এ গল্পটিই নতুন করে শুনিয়েছে, তবে আরো ঢের গম্ভীর স্বরে। জর্জ অরওয়েল দাবী করে গেছেন তাঁর নিজের মতোই আল্ডুস হাক্সলিও জামিয়াতিনের “উই” থেকে অনুপ্রেরণা নিয়েছেন। সে হিসেবে “উই” হলো আধুনিক সব ডিস্টোপিয়ান গল্পের গ্র্যাণ্ডফাদার।

এ তালিকার সর্বশেষ বই “ফ্যারেনহাইট ৪৫১”, যাতে রে ব্র্যাডবারি এমন এক পৃথিবীর ছবি আঁকেন, যেখানে কেউ বই পড়ে না, কারো বাড়িতে বই আছে এমন খবর পেলে বিশেষ দমকল বাহিনী এসে বই সমেত গোটা বাড়িটাই পুড়িয়ে দিয়ে যায়। রাষ্ট্রপ্রধানের বিরোধী মতটি তাই কখনো শোনা যায় না। ব্র্যাডবারির সে সমাজে মানুষ সস্তা বিনোদনে মেতে থাকে, ভাবনা-চিন্তার ঝামেলায় যায় না, প্রশ্ন করে না। দূর্ঘটনায় কেউ মারা গেলে সে মৃত্যুও তাদের স্পর্শ করে না। এ বইটি লিখে ব্র্যাডবারি ঘোষণা করেন, “একটি সভ্যতাকে ধ্বংস করে দিতে বই পোড়াতে হয় না, বই পড়ার অভ্যাসটা তুলে দিলেই হয়”। সম্মানিত বাঙলাদেশী পাঠক, ব্র্যাডবারির কল্পনার সে সমাজের সাথে কোথাও কি মিল দেখতে পাচ্ছেন?

প্রযুক্তির দানবিক অগ্রগতি, বই পড়া ও গঠনমূলক চিন্তার প্রতি মানুষের অনাগ্রহ, একের পর এক ছোটলোকদের ক্ষমতায় আরোহন...বিশ্বময় এই ব্যাপারগুলো লক্ষ্য করে সচেতন পাঠক-গবেষকদের অনেকেই এখন সিঁদুরে মেঘ দেখতে শুরু করেছেন। ডিস্টোপিয়ান সাহিত্যের তিন মহারথী যে যে ভয়ানক সমাজগুলো কল্পনা করে গেছেন, আমরা নাকি এখন তার সবগুলোর ভেতর দিয়েই যাচ্ছি। পর্যবেক্ষণটি সত্যি হয়ে থাকলে চিন্তার ব্যাপারই বটে; একই সঙ্গে ৩ রকম ডিস্টোপিয়ার মাইনকার চিপায় মানবসমাজ বোধহয় আগে পড়েনি!



বাঙলাদেশ পৃথিবীর বাইরের কোন দেশ নয়। গোটা পৃথিবীবাসীই যখন নিজেদের বিভিন্নরকম ডিস্টোপিয়ার অংশ বলে মনে করছে, বাঙলাদেশ এর ব্যক্তিক্রম কেন হবে? প্রশ্ন হলো কোন ধরণের ডিস্টোপিয়াটি বাঙলাদেশের জন্য প্রাসঙ্গিক? প্রযুক্তিগত দক্ষতার দিক দিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান তলানিতে; “উই”'র শিল্পোন্নত সমাজ, কিংবা “ব্রেইভ নিউ ওয়ার্ল্ড”-এর কারখানায় ফরমায়েশ মোতাবেক মানুষ বানাবার ব্যাপারগুলো তাই খাটে না দেশটির জন্য। এখানে মুক্তবাকের সুযোগ নেই, ওপর মহলের কুদৃষ্টিতে পড়লে বরং ফ্রাঞ্জ কাফকার “দ্যা ট্রায়াল” উপন্যাসের মতোই রহস্যজনক লোকেরা এসে দরজায় কড়া নাড়ে, ফ্রিজ খুলে আপেল বের করে খেয়ে ফেলে, অজানা এক মামলায় আদালত থেকে আদালতে ঘোরাতে থাকে জীবনের শেষ দিনটি অব্দি... কাফকা ট্রায়াল লিখেছিলেন ১৯১৪ সালে, কিন্তু বাঙলাদেশের কারো যদি এ বই পড়ে মনে হয় কাফকা আসলে গত ২ সপ্তাহের খবরের কাগজে দেশের সংবাদ পড়ে বইটি লিখেছেন, তাঁকে বোধহয় খুব বেশী দোষ দেয়া চলে না। “উই”-এর সাথে বড় একটি মিল অবশ্য রয়েছে বাঙলাদেশের; এখানেও একজন বেনিফ্যাক্টর রয়েছেন যাঁকে কেন্দ্র করে দেশটির সকল কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এ বেনিফ্যাক্টর-এর পৃষ্ঠপোষক যে বেনিফ্যাক্টর রয়েছেন, তাঁর নীতির সমালোচনা করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লেখালেখি করলে খুন হয়ে যেতে হয়। এখানেই “উই”-এর সাথে পার্থক্য। অতটা দূরদর্শী কল্পনাশক্তির পরিচয় খোদ জামিয়াতিন নিজেও দিয়ে যেতে পারেননি।

তবে, বাঙলাদেশের বাস্তবতায় সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক ডিস্টোপিয়ান উপন্যাস সম্ভবত “ফ্যারেনহাইট ৪৫১”; এখানে নির্দিষ্ট একটি মতের বিরোধীতা করে কোন বই ছাপানো যায় না, ৪৫১ ফ্যারেনহাইটে তা পুড়িয়ে ফেলা হয়। শুধু বই নয়, ৪৫১-এর লেলিহান সে শিখা গ্রাস করে নেয় বিরোধী মত ধারণ করা মানুষদেরও। ২০২৩ সালের এক গবেষণাতেই উঠে এসেছে বাংলাদেশের তরুণ সমাজের ৭১.৫% অংশ স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করাকে অনিরাপদ মনে করে। ভয়ের এ সংস্কৃতিতে কথা বলতে না পেরে জনগণ তাই ক্রমশ নির্ভরশীল হয়ে ওঠে বিনোদনের সবচেয়ে সস্তা রাস্তাগুলোর ওপর। জীবনে একটিও বই না পড়া, একটিও গঠনমূলক প্রশ্ন না করা শূণ্য মগজগুলোতে যখন নিম্নমানের বিনোদনের মাধ্যমগুলো সুড়সুড়ি দেয়া শুরু করে, মানবিক সম্পর্কগুলো ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে ভেঙে পড়তে থাকে। একের পর এক কিশোর গ্যাং-এর উত্থান ঘটতে থাকে, যাদের বিনোদনের অন্যতম উৎস সাধারণ পথচারীদের কব্জি কেটে সে কাটা হাত নিয়ে টিকটক ভিডিও বানানো। ঠিক এমনটিই তো দেখে গেছেন রে ব্র্যাডবারি, তাই না?

ডিস্টোপিয়ার এ ধারা বহমান; তার জোরালো স্রোতে ভেসে যায় পারিবারিক সম্পর্কের বন্ধনও। বন্ধুদের নিয়ে ঘুরতে যাবার টাকা যোগাড় করবার জন্য আপন নানাকে খুনের সাম্প্রতিক এক সংবাদে সংক্ষুব্ধ হয়ে ডিস্টোপিয়ান কবি আব্দুল্লাহেল হেলফায়ার তিতিবিরক্ত হয়ে একটি ডিস্টোপিয়ান পদ্য লিখে বসেনঃ

বুইড়া হালায় খবিসচোদা, টেগা চাইলেই “না না”
ইয়াং বয়েসের ধাড়কান কী বোঝে না আমার বালের নানা
দোস্তরা মিল্লা ফাঁস দিছি হালারে, টেগাও পাইছি নগদে নগদ
কিলিক কইরা লগেই থাকেন, আইতাছে এইবার ককশোবাজারে টিক্টক।

“উই” উপন্যাসে বেনিফ্যাক্টর-এর বিরুদ্ধে একসময় মানুষ বিদ্রোহ করে। বেয়াড়া এই নাগরিকদের বশে আনতে বেনিফ্যাক্টর নতুন একটি আইন বানানঃ অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে রাষ্ট্রের প্রত্যেকের মগজের সৃষ্টিশীল অংশটিকে নষ্ট করে দিতে হবে। মানুষের মানবিক দিকগুলোকে পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় করে দিয়ে তাকে স্রেফ আজ্ঞাবহ এক যন্ত্রমানবে পরিণত করাই বেনিফ্যাক্টর-এর মূল লক্ষ্য। বাঙলাদেশের শাসনের দায়িত্বে যাঁরা ছিলেন, যাঁরা আছেন, যাঁরা থাকবেন, তাঁদের কাউকেই নাগরিকদের “মস্তিষ্ক প্রক্ষালন”-এর জন্য আলাদা আইন বানানো নিয়ে কখনো মাথা ঘামাতে হয়নি, হবে না। কারণ, এখানে “ফ্যারেনহাইট ৪৫১” বহু আগেই বাস্তবায়িত হয়ে গেছে। এখন আর সরকার প্রধানকে আয়োজন করে বই পোড়াতে হয় না, বই পড়ার এবং প্রশ্ন করবার অভ্যাসটাই উঠে গেছে। এ দেশের মানুষ প্রক্ষালিত মস্তিষ্ক নিয়েই জন্মায়। ২০ কোটি প্রক্ষালিত মস্তিষ্কের একটি জাতি আমরা-“ উই ”।

2023-01-07T00:00:00.000Z
S.

S.

By
Slavenka Drakulić
Slavenka Drakulić,
Marko Ivic
Marko Ivic(Translator)
S.

যে কোন যুদ্ধে সবার প্রথমে যে “সত্য” খুন হয় এ জ্ঞান তো আমরা হেরোডটাস, থুসিদিদেস, জেনোফোনদের হাত ধরে কয়েক হাজার বছর আগেই পেয়ে গেছি। যুদ্ধে আধিপত্য বিস্তার করতে হলে আপনাকে উন্নত অস্ত্র বানাতে হবে, শক্তিশালী সামরিক বহর গড়তে হবে, নিশ্ছিদ্র বূহ্য সাজাতে হবে, সত্যকে খুন করতে জানতে হবে, আর...আর? আর একটি উপকরণ আছে, যেটি অনুচ্চারিত রয়ে যায়, যুদ্ধ জেতার কৌশলের কোন হ্যান্ডবুকে তার উল্লেখ থাকে না, কিন্তু প্রতিটি যুদ্ধেই প্রেজেন্ট ইন্ডেফিনিট টেন্সের চিরন্তন সত্যের উদাহরণের মতো অনিবার্যভাবে ব্যবহৃত হয়ঃ ধর্ষণ। যুদ্ধের মূল উদ্দেশ্য ক্ষমতার প্রদর্শন; যুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়া ব্যক্তিটির পেশীটি কতখানি মাংসল, শিশ্নটি কতখানি বড় তার সংবাদই যুদ্ধের বরাতে আমরা পাই। যুদ্ধ ব্যাপারটি যেহেতু পুরুষপ্রধান, যুদ্ধের সাথে ধর্ষণ তাই হাতে হাত ধরে আসে। যুদ্ধে সত্য খুন হয় সবার আগে বটে, তবে যুদ্ধের সবচেয়ে বড় শিকার আসলে নারী।

বাঙলাদেশের স্বাধীনতার মাহাত্ন্য বোঝাতে আমরা কথায় কথায় একটি মুখস্থ বুলি আউড়াই, “২ লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে এ দেশ স্বাধীন করেছি আমরা”। “সম্ভ্রম” কোথায় থাকে? কী হয় এই সম্ভ্রম হারালে? সম্ভ্রম হারাবার পর এই নারীরা কোথায় যায়? কেমন জীবন কাটাতে হয় তাঁদের? তাঁদের মানসিক অবস্থাটাই বা কেমন থাকে? এ প্রশ্নগুলো নিয়ে আমরা খুব একটা ভাবি না। আমাদের কাছে সংখ্যাটাই বড় হয়ে দেখা দেয়, সেটাকেই মোটা দাগে দাগিয়ে আমরা বিজ্ঞাপিত করি নিজেদের স্বাধীনতাকে। ২ লক্ষ না হয়ে যদি শুধু ১ জন নারী ধর্ষিত হতেন, তাহলে আমরা হয়তো সেই তথ্যটা আদৌ আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিজ্ঞাপনে আনতামই না। ২ লক্ষ হোক, কিংবা ১, সারাজীবনের জন্য মানসিকভাবে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়া এই নারীদের প্রত্যেককে ব্যক্তিগতভাবে যে যাতনা পোহাতে হয়েছে, তার মাত্রাটা বাইরের কারো পক্ষেই আন্দাজ করা সম্ভব নয়। ব্যাপকতার দিক দিয়ে ২ লক্ষ অনেক বড় একটি সংখ্যা, কিন্তু যন্ত্রণার প্রেক্ষিতে ১ আর ২ লক্ষ সমান সমান।

ইউগোস্লাভিয়ার পতনের পর ১৯৯১ সালে স্লোভেনিয়া এবং ক্রোয়েশিয়া যখন ইউগোস্লাভিয়া থেকে বেরিয়ে এসে নিজ নিজ স্বাধীনতা ঘোষণা করে, তখন বসনিয়া-হার্জেগোভিনার মুসলমানেরাও ভোটাভুটি করে নিজেদের জন্য একটি আলাদা দেশের প্রস্তাব উত্থাপন করে। বসনিয়ায় বাস করা খ্রীষ্টান সার্বরা এতে আতঙ্কিত হয়ে ভীষণভাবে প্রতিবাদ শুরু করে। তারাও নিজেদের একটি আলাদা সংবিধান রচনা করে। ঐতিহাসিকভাবেই মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ বসনিয়াতে মুসলমান-খ্রীষ্টানে ঠোকাঠুকি চলে আসছিলো প্রায় ৭০০ বছর ধরে। মার্শাল টিটো সমাজতান্ত্রিক ইউগোস্লাভিয়া গঠন করে বেশ শক্ত হাতে এই ঠোকাঠুকি অনেকটাই দমিয়ে এনেছিলেন, তাঁর মৃত্যুর পর ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকয়তার বোতল বন্দী দৈত্য আবারো বেরিয়ে আসে। ১৯৯২-এর ২৯ ফেব্রুয়ারি বসনিয়া স্বাধীনতা ঘোষণা করে; মাসখানেক পরেই ৬ এপ্রিল সার্বিয়ার রাষ্ট্রপতি স্লোবোদান মিলোসেভিচের আশীর্বাদ নিয়ে বসনিয়ান সার্বদের নেতা রাদোভান কারাদচিচ বসনিয়ান মুসলমানদের ওপর হামলা করে বসেন, শুরু হয়ে যায় ৩ বছর মেয়াদী বসনীয় যুদ্ধ।

বসনিয়ান মুসলমান বা বসনিয়াকদের মানসিকভাবে ভেঙে দিতে সার্বরা ধর্ষণের এক মহোৎসবে নামে। জায়গায় জায়গায় ধর্ষণের ক্যাম্প বানিয়ে বন্দী নারীদের ওপর চলে দিনরাত নির্যাতন। মাতাল সার্ব সৈনিকেরা ইচ্ছেমতো সময়ে এসে যাকে পছন্দ হয়েছে টেনে নিয়ে গেছে নিজেদের ঘরে। কিশোরী থেকে বৃদ্ধা-১২ থেকে ৭০-কেউই ছাড় পায়নি। গবেষকেরা আজ বসনিয়ায় ধর্ষিত নারীদের সংখ্যা ২০ হাজার থেকে ৫০ হাজার পর্যন্ত ধারণা করেন। সংখ্যার ব্যাপকতার বিহবলতায় আমরা জানতে পাই না বা চাই না কীভাবে সে নারীরা এই ক্যাম্পগুলোতে দিন কাটিয়েছেন। কী চলেছে তাঁদের মনে। ক্রোয়েশিয়ান সাংবাদিক স্লাভেঙ্কা দ্রাকুলিচ এই ক্যাম্প বন্দী হতভাগ্য নারীদের গল্পই আমাদের শুনিয়েছেন তাঁর এস. উপন্যাসে।

এস. উপন্যাসের নামচরিত্র “এস”। এস কে? সাফিয়া? সায়রা? সেলমা? আমরা জানতে পাই না। যেমন জানতে পাই না “এস”-এর বান্ধবী “এন”, “এল” দের নামও। তাদের একটাই পরিচিতিঃ ধর্ষণ ক্যাম্পের বন্দী তারা, ঘন্টায় ঘন্টায় যাদের ডাক পড়ে সৈনিকদের ঘরে। ক্যাম্পে আসবার আগে এরা কেউ নার্স ছিলো, কেউ ছিলো শিক্ষক, গৃহিণীও ছিলো অনেকেই। এখন আর কারো কোন আলাদা পদমর্যাদা নেই; সবাই সবার সামনে একইরকম নগ্ন। সবাই এরা জানে কার সাথে কী হয়েছে। প্রতি সকালেই সার্ব সৈনিকেরা এদের সবাইকে মাঠে একসাথে বসিয়ে প্রাতঃকৃত্য সারতে বাধ্য করে। পশুর মতো অবস্থায় থাকতে থাকতে কি “এস”দের সব মানবিকতাও লোপ পাবে? তারা কি কেবলই লালসা মেটাবার বোধ-বুদ্ধিহীন বস্তুতে পরিণত হবে? দিনের পর দিনের পর দিন ধর্ষণের ফলে যে অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণের ভেতর দিয়ে যেতে হয় এদের অনেককেই, তারা কি করবে এই সন্তানদের নিয়ে? সার্ব সৈনিকদের এই সন্তানদের কি জন্মের পরপরই মাটিতে আছড়ে মেরে কিংবা নাক টিপে শ্বাসরোধ করে ক্যাম্পের বন্দীরা তাদের অক্ষম প্রতিশোধস্পৃহা চরিতার্থ করবে? গোটা উপন্যাস জুড়ে দ্রাকুলিচ এই প্রশ্নগুলোরই উত্তর খুঁজে বেড়িয়েছেন।

দ্রাকুলিচ নিজে ক্রোয়েশিয়ান, প্রতিবেশী বসনিয়ান নারীদের দুর্ভোগ খুব কাছ থেকে দেখেছেন, সাংবাদিক হিসেবে বসনীয় যুদ্ধের ওপর প্রতিবেদন লিখেছেন, তাই তাঁর বয়ান প্রাসঙ্গিক। উপন্যাস হিসেবে এস. খুব সুখপাঠ্য নয়, বেশ অনেকটাই পত্রিকার রিপোর্টের ধাঁচে লেখা, তবুও এটি বসনীয় যুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল। দ্রাকুলিচ বসনীয় যুদ্ধের টুকরো টুকরো ভয়াবহতার কথা দেখিয়েছেন তাঁর উপন্যাসে; ধর্ষণ-শিবিরে জন্ম নেয়া বহু শিশুকে জন্মের পরপরই তাদের হতভাগ্য মায়েরা প্রবল ঘৃণায় হত্যা করেছে, সার্বরা বসনীয় পিতাদের বাধ্য করেছে সবার সামনে আপন আপন কিশোর বয়েসী পুত্রদের ধর্ষণ করতে। হয় নিজ পুত্রকে ধর্ষণ করতে হবে, নয় বন্দুকের গুলি-এমন বিকৃত বিকল্পের সম্মুখীন হয়ে বহু বহু পরিবার চিরদিনের জন্য মানসিকভাবে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে গেছে। এই ক্যাটাটোনিয়া থেকে মুক্তির উপায় কী কারোই জানা নেই। যুদ্ধ ও নারীর গল্পগুলো আসলে একই; দেশ কাল জাত ভেদে একই ঘটনাই ঘটে চলে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে। বসনীয় যুদ্ধের সার্ব, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নাৎজি, নানকিং-এর জাপানী বাহিনী, ১৯৭১-এর পাকিস্তানী হানাদার... এরা সবাই একে অপরের অবতার মাত্র। স্থান, কাল, আর চরিত্রগুলো ঢেকে দিলে কে যে কে তা আর ঠাহর করা যায় না।

যুদ্ধের বরাতে নতুন নতুন প্রযুক্তি আসে, মানুষের গতিবিধি জানবার আর পাইকারী হারে খুন করবার এক একটা অস্ত্র গবেষণাগারে বিপুল বেগে তৈরী হতে থাকে। যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলে সেই প্রযুক্তির নতুন অন্য কোন ব্যবহার সভ্যতাকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যায়। চিরবিষণ্ণ “এস”রা সেই সভ্যতার বুকে দগদগে এক ঘা।


2022-12-30T00:00:00.000Z
The Seven Daughters of Eve: The Science That Reveals Our Genetic Ancestry

The Seven Daughters of Eve: The Science That Reveals Our Genetic Ancestry

By
Bryan Sykes
Bryan Sykes
The Seven Daughters of Eve: The Science That Reveals Our Genetic Ancestry


ব্রিটিশ জিন বিজ্ঞানী ব্রায়ান সাইকসের বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণ বই দ্যা সেভেন ডটারস অফ ইভ। ২০ বছরেরও বেশী আগে প্রকাশিত এ বই আজকের দিনে বেশ অনেকটাই অচল। এই ২০ বছরে জিন প্রযুক্তি লাফিয়ে লাফিয়ে এত এগিয়ে গেছে যে এ বইয়ের অনেক আলোচনাই হয় বড্ড পুরনো, এবং “বালখিল্য” হয়ে গেছে, নয়তো আগাগোড়া ভুল প্রমাণিত হয়েছে। বইটির কথা প্রথম যখন জানতে পেরেছিলাম, এটি পড়বার এক অদম্য ইচ্ছে আমাকে গিলে খাচ্ছিলো, পড়ে ফেলবার পর এখন বেশ অনেকটাই আফসোস হচ্ছে! তবে বইটি ফেলনা নয় কোনভাবেই; ২০০১ সালে প্রকাশের পর যথেষ্ঠই সাড়া ফেলেছিলো সেভেন ডটারস। আমি বইটি পড়ে যা যা জানতে পেলাম তার চুম্বক অংশ এখানে নোট করে টুকে রাখছি স্রেফ।

সাইকস মূলত গবেষণা করছিলেন অস্টিওজেনেসিস ইম্পার্ফেক্টা নামক একটি ভীষণ দুরারোগ্য রোগ নিয়ে। কিছু কিছু নবজাতক শিশুদের মাঝে এ রোগটি দেখা যায়; তাদের হাড় এতই নরম থাকে যে যখন শিশুটি বুক ভরে তার প্রথম শ্বাসটি নেয়, তার বুকের পাঁজরের হাড়গুলো বাতাসের সে চাপে সঙ্গে সঙ্গে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়। এতেই শ্বাসরোধ হয়ে এই শিশুরা মৃত্যুবরণ করে। আমাদের হাড়ে কোলাজেন নামক এক ধরণের প্রোটিন আছে, হাড়ের শক্ত কাঠামোর জন্য এই প্রোটিনটিই দায়ী। কনক্রিটের স্থাপনায় স্টিলের রড যে কাজটি করে, হাড়ের ভেতর কোলাজেন ঠিক তা-ই করে। এই কোলাজেনের জিনের ছোট একটু ত্রুটি বিচ্যুতি থেকেই ভয়ানক এই রোগটির উদ্ভব। শত হাজার বছর ধরে মৃত প্রাণীর হাড় থেকে যে কার্বন ডেটিং করা যায় সেটিও সম্ভব হয় এই কোলাজেনের কার্বনের জন্যই। প্রোটিন তৈরী হয় বিভিন্ন রকম অ্যামাইনো অ্যাসিড দিয়ে; এই অ্যামাইনো অ্যাসিডের ক্রমটি কেমন হবে, কার পরে কে বসবে সেটি নির্ভর করে জিনের ভেতর ডিএনএ কিভাবে সজ্জিত আছে তার ওপর। যার যেখানে বসবার কথা, সে সে জায়গা থেকে নড়ে গেলেই ঘটে যায় মহা বিপত্তি।

১৯৯১ সালে অস্ট্রিয়া এবং ইটালীর সীমানায় অটজটাল আল্পস পাহাড়ী এলাকায় প্রায় সাড়ে ৫ হাজার বছর পুরনো এক মমি পাওয়া যায়, যার ডিএনএ অনুসন্ধানের দায়িত্ব এসে পড়ে সাইকসের ওপর। এই মমিটি আজ অব্দি সবচেয়ে পুরনো প্রাকৃতিকভাবে তৈরিকৃত মমি হিসেবে স্বীকৃত এবং এর নাম দেয়া হয়েছে অজি দ্যা আইসম্যান। যে সময়টাতে সাইকসরা তাঁদের গবেষণা করছিলেন, সেই নব্বইয়ের দশকে জিন প্রকৌশল সবে হাঁটি হাঁটি পা পা করছে; যে সব পরীক্ষা তখন তাঁরা চালাচ্ছেন, আজ সেগুলো খুবই সহজ এবং খেলো হয়ে গেছে। সে সময়ে বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিলো ডিএনএ সবসময় শূণ্যের ৭০ ডিগ্রী নিচে তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করতে হয়, ঘরোয়া তাপমাত্রায় আনলে কয়েক মিনিটের মধ্যেই ডিএনএ'র গুণাগুণ নষ্ট হয়ে যায়, তাই তা ফেলে দেয়া ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না। হাজার হাজার বছর ধরেও যে মমিতে ডিএনএ অবিকৃত থাকতে পারে, এটি একটি অসম্ভব চিন্তা ছিলো সে সময়ে। সাইকসরা তবুও একটি সুযোগ নেন। দাঁত বা হাড়ে ক্যালসিয়াম হাইড্রক্সিঅ্যাপেটাইট-এর রূপে থাকে। এই হাইড্রক্সিঅ্যাপেটাইট মিলিয়ন মিলিয়ন বছর ধরেও অবিকৃত থাকতে পারে, তাই সাইকস তাঁর অনুসন্ধান শুরু করেন আইসম্যানের হাড় থেকে।

আইসম্যানের হাড়ের ক্যালসিয়াম সরাবার পর যে প্রোটিন থাকে সেটিকে একটি এনজাইম দিয়ে দূর করা হয়। এনজাইম মূলত একধরনের অণুঘটক, যা জৈবিক বিক্রিয়াগুলোকে ত্বরান্বিত করে। এরপর ক্লরোফর্ম প্রয়োগ করে সরানো হয় চর্বি। সবশেষে ফেনল দিয়ে ধুয়ে পরিষ্কার করা হয় আইসম্যানের নমুনা। ক্লোরোফর্ম, এবং কার্বলিক সাবানের মূল ভিত্তি ফেনল-উভয়েরই ভয়ানক রাসায়নিক দ্রব্য হিসেবে (কু)খ্যাতি রয়েছে তবে আশার কথা হলো এরা কেউই ডিএনএ'র গুনাগুণ নষ্ট করতে পারে না। আইসম্যানের নমুনা টিউবে নিয়ে এবার মেশানো হয় পলিমেরাইজ নামক আরেকটি এনজাইম যা ডিএনএ'র নকল কপি বানানো শুরু করে। একে বলা হয় পলিমেরাইজ চেইন রিঅ্যাকশন বা সংক্ষেপে পিসিআর। কোভিড শনাক্তকরণে রোগীর নমুনা পরীক্ষা করা হয় আজ এই পিসিআর ব্যবহার করেই। সাইকসের দল আইসম্যানের মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ নিয়ে কাজ শুরু করেন। কেন নিউক্লিয়ার ডিএনএ না নিয়ে মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ? সে প্রশ্নের উত্তর আসছে শিগগীরই, তবে আপাতত এইটুকুই বলে রাখা যায় যে, এই বই প্রায় পুরোটাই মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ'র কেরামতি নিয়ে!

প্রায় সাড়ে ২৩০০ বছর আগে অ্যারিস্টটল ধারণা করেছিলেন, সন্তান কেমন হবে সেটি নির্ধারণ করে দেয় পিতা; মায়ের কাজ শুধুই সন্তানকে গর্ভের ৯ মাস যত্নে লালন করা, এবং জন্মের পর খাওয়ানো দাওয়ানো। যদি পিতার ছাঁচেই সন্তান হয়, তাহলে পুরুষ মানুষের কন্যাসন্তান কেন হয়-এ প্রশ্ন তখন অ্যারিস্টটলকে করা হয়। অ্যারিস্টটল উত্তর দেন সন্তানের সকল বৈশিষ্ট্য, লিঙ্গ সমেত, সম্পূর্ণভাবে পিতার ওপর নির্ভরশীল। সকল ভ্রুণই আসলে পুরুষ, কিন্তু গর্ভে থাকবার সময় কোন ত্রুটি বিচ্যুতির কারণেই সে ভ্রুণটি বিকৃত হয়ে কন্যার ভ্রুণে পরিণত হয়। আজ আমরা জানি, সন্তান মায়ের কাছ থেকে এক প্রস্ত, এবং বাবার কাছ থেকে আরেক প্রস্ত ক্রোমোজম পেয়ে দু'জনেরই বৈশিষ্ট্য একটু একটু করে ধারণ করে। ক্রোমোজমের ডিএনএতে ২০টি ভিন্ন অ্যামাইনো অ্যাসিড একের পর এক বিভিন্ন ক্রমে বসে। এই অ্যামাইনো অ্যাসিডগুলোর কিছু কিছু আমাদের নিত্য ব্যবহৃত বিভিন্ন পণ্যেই আছে, যেমন ফেনাইলঅ্যানাইনঃ ডায়েট সোডায় কৃত্রিম চিনি হিসেবে যে অ্যাসপার্টামি দেয়া হয় তার অন্যতম উপকরণ। বাবা-মা'র জিনে এই অ্যামাইনো অ্যাসিডেরা কি ক্রমে রয়েছে সেটিই নির্ধারণ করে দেয় কেমন হবে সন্তানের বৈশিষ্ট্যগুলো।

ডিএনএ'র যে চারটি মূল উপকরণ, অ্যাডেনিন (A), সাইটোসাইন (C), গুয়ানাইন (G), এবং থাইমাইন (T), এরা ATG TGA CGT TCA ইত্যাদি বিভিন্ন ত্রয়ী বানিয়ে এক একটি অ্যামাইনো অ্যাসিড তৈরী করে, যেমন, ATG তৈরী করে মেথায়োনাইন, ACC করে থেরোনাইন, TCC সেরাইন, TTC ফেনাইলঅ্যানাইন...ইত্যাদি। এমন এক একটি অ্যামাইনো অ্যাসিড একের পর এক বসার ফলে তৈরী হয় এক একটি প্রোটিন। মাথার চুল টেনে উপড়ে আনলে আমরা চুলের এক মাথায় যে সাদা গোল পুটুলিস্বরুপ ফলিকেল দেখতে পাই, তা মূলত কেরাটিন নামক একটি প্রোটিন যার ডিএনএ ক্রম হলো ATGACCTCCTTC; কেরাটিনে অ্যামাইনো অ্যাসিডগুলো সজ্জিত থাকে ATG-ACC-TCC-TTC-এমন একটি ক্রমে। এই A, C, G, Tরা কে কার সাথে বসবে তারও বাঁধা নিয়ম রয়েছে। A শুধু T-এর সাথেই বসে, আর কারো সাথে নয়। ঠিক একই ভাবে C এবং G শুধুমাত্র একে অপরের সাথেই বসে, A বা T-এর সাথে নয়। ডিএনএ'র যে ডাবল হেলিক্স গঠন, তার একটি তন্তুর কোড যদি হয় ATTCAG, তাহলে অপর তন্তুটি হবে TAAGTC। এভাবেই ছোট ছোট এক একটি অ্যামাইনো অ্যাসিডের ‘ইঁট' দিয়ে তৈরী হয় প্রাণীজগতের ইমারত।

ডিএনএ'র সাথে রক্তের গ্রুপের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক; আজ আমরা জানি এক গ্রুপের দাতা অপর গ্রুপের গ্রহীতাকে রক্ত দিতে পারে না, তবে এ জ্ঞানটি বহু প্রাণের বিনিময়ে কিনতে হয়েছে। ১৬২৮ সালে ইতালীতে প্রথম রক্তদানের প্রক্রিয়া শুরু হয়, কিন্তু ভুল রক্তের গ্রুপের মিশ্রণের ফলে এত মানুষ তখন মারা যায় যে রক্তদানের ব্যাপারটিই তখন আইন করে নিষিদ্ধ করা হয়। ১৮৭৫ সালে আবিষ্কৃত হয় বিভিন্ন প্রাণীর রক্ত একসাথে মেশালে কোষগুলো ছোট ছোট দল পাকিয়ে বিস্ফোরিত হওয়া শুরু করে। এই আবিষ্কারের হাত ধরে ১৯০০ সালে বিজ্ঞানীরা মানুষের রক্তকে ৪টি গ্রুপে ভাগ করেন: এ, বি, এবি, এবং ও। প্রাচীন ইনকারা বেশ সফলতার সাথে রক্তদানের প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করেছিলো বলে বেশ কিছু প্রমাণ পাওয়া যায়। কী করে তারা ইওরোপীয়দেরও ঢের আগে কাজটি করলো? দক্ষিণ আমেরিকার বড় অংশের মানুষেরই আসলে রক্তের গ্রুপ "ও", তাই দাতা ও গ্রহীতার রক্তের গ্রুপ “দৈবক্রমে” মিলে গেছে বেশীর ভাগ সময়েই।

উপর্যুক্ত ৪টি রক্তের গ্রুপকে পজিটিভ-নেগেটিভের ভিত্তিতে রেসাস গ্রুপ বলে আরেকটি গ্রুপে ভাগ করা যায়। ১৯৪০-এর দিকে বিজ্ঞানীরা মানুষের রক্তের সাথে খরগোশের রক্ত মেশান, যে খরগোশগুলোর শরীরে আগে রেসাস বাঁদরের কোষ ইঞ্জেকশন দিয়ে প্রবেশ করানো হয়। এভাবেই রেসাস গ্রুপটির সন্ধান পাওয়া যায়। এই রেসাস জিনের জন্যই নবজাতক শিশুদের মাঝে হিমোলাইটিক ডিজিজ বলে একটি রোগ হয়। মা যদি রেসাস নেগেটিভ হন, অর্থাৎ তাঁর রক্তে রেসাস অ্যান্টিজেন না থাকে (নেগেটিভ রক্তের গ্রুপ), এবং বাবা যদি রেসাস পজিটিভ হন, অর্থাৎ তাঁর রক্তে রেসাস অ্যান্টিজেন থাকে (পজিটিভ রক্তের গ্রুপ), তাহলে দ্বিতীয় সন্তানের রেসাস পজিটিভ হবার অনেক ঝুঁকি থাকে। প্রথম সন্তানের ক্ষেত্রে হয় না, কারণ, সন্তানের জন্মের সময় তার কিছু রক্ত কোষ মায়ের শরীরে চলে যায়; মা যেহেতু রেসাস নেগাটিভ, তাই তার শরীর এই রেসাসের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি বানানো শুরু করে দেয়। দ্বিতীয় সন্তান যখন গর্ভে আসে তখন মায়ের শরীরের সেই অ্যান্টিবডি এই রেসাস পজিটিভ ভ্রুনটিকে শত্রু জ্ঞান করে আক্রমণ করে বসে। এই শিশুরা অক্সিজেনের অভাবে জন্মের পর সচরাচর নীলাভ বর্ণের হয়।

মাইটোকন্ড্রিয়া যে কোষের শক্তি উৎপাদক সে তো আমরা ছোটবেলাতেই জেনেছি। কোষ যতো বেশী অক্সিজেন গ্রহণ করে, তত বেশী শক্তি উৎপাদন করতে পারে। মাইটোকন্ড্রিয়া এই বেশী করে অক্সিজেন গ্রহণ করবার কাজটিতেই সহায়তা করে। আমাদের শরীরের যে উত্তাপ, তার কিছুটার জন্য মাইটোকন্ড্রিয়া দায়ী। মাইটোকন্ড্রিয়ার মূল কাজ শরীরকে ATP সরবরাহ করা; হৃৎপিণ্ডের ওঠানামা, চোখের রেটিনা-যা এই লেখাটি পড়ছে, মস্তিষ্কের কোষ-যা এই লেখাটির অর্থ দাঁড় করাচ্ছে, এই সবগুলো কাজের শক্তি যোগায় ATP। এই মাইটোকন্ড্রিয়ার ঠিক কেন্দ্রে বাস করে একটি বিশেষ ডিএনএ, যাকে মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ বলে। নিউক্লিয়ার ডিএনএ থেকে বেশ অনেকটাই আলাদা মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ'র অস্তিত্ব আবিষ্কারটাই বিজ্ঞানীদের জন্য বেশ অবাক করা একটি ব্যাপার ছিলো। মাইটোকন্ড্রিয়াতে ডিএনএ কিভাবে এলো তার অন্যতম জনপ্রিয় একটি ব্যখ্যা হলো মিলিয়ন মিলিয়ন বছর আগে মাইটোকন্ড্রিয়া আসলে ছিলো স্বাধীনভাবে ঘোরাফেরা করে বেড়ানো ব্যাকটেরিয়া বিশেষ, যা অন্য কোষকে আক্রমণ করে ভেতরে জায়গা দখল করে বসে। মাইটোকন্ড্রিয়া পেলো আবাসস্থল, আর কোষ পেলো শক্তি উৎপাদক ATP। কোষ ও মাইটোকন্ড্রিয়া দু'জনই কিছুটা করে দু'জনের পিঠ চুলকে দিচ্ছে; এই সিম্বায়োটিক রিলেশনের জন্যই শেষতক এই ব্যবস্থাটি দাঁড়িয়ে গেলো।

নিউক্লিয়াসের ক্রোমোজমে যে ডিএনএ থাকে, তা মানুষ বাবা এবং মা, উভয়ের কাছ থেকেই পায়। কিন্তু মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ মানুষ পায় শুধুমাত্র মায়ের কাছ থেকে। ডিম্বাণুর যে বহির্স্তর, সাইটোপ্লাজম, তাতে প্রায় লাখ দশেক মাইটোকন্ড্রিয়া থাকে। বিপরীতে, শুক্রাণুতে থাকে হাতে গোণা অল্প কয়েকটি মাইটোকন্ড্রিয়া; জরায়ু অব্দি সাঁতার কেটে ডিম্বাণুর কাছে পৌঁছাবার জন্য যতটুকু শক্তি প্রয়োজন ঠিক ততটুকুই এই মাইটোকন্ড্রিয়াগুলো যোগান দেয়, এরপর এদের আর কোন কাজ থাকেনা, তাই তারা স্রেফ ঝরে পড়ে। ডিম্বাণুর ভেতর ঢুকতে পারা সফল শুক্রাণুটি নিউক্লিয়ার ডিএনএ নিয়ে আসে, কিন্তু মায়ের ডিম্বাণুর সাইটোপ্লাজমে তো মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ শুরু থেকেই বসে ছিলো। এ কারণেই মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ শুধুমাত্র মা'র কাছ থেকেই আসে। মা'র মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ'র একটি নকল কপি পায় মেয়ে, এরপর সেটিরও আরেকটি নকল কপি পায় নাতনি...এভাবে চলতেই থাকে। পুরুষেরাও মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ পায় তাদের মায়েদের কাছ থেকে, কিন্তু সেটি তারা তাদের সন্তানদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে পারে না।

মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ'র ভেতর মিউটেশন বা জিনেটিক পরিবর্তন হয় বটে, তবে এই ডিএনএ'র বিশেষ একটি অঞ্চলে এই মিউটেশন অনেক বেশী হয়, যাকে বলা হয় কন্ট্রোল রিজিয়ন। শরীরের গঠন কেমন হবে তার বিভিন্ন নির্দেশ মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ'র বিভিন্ন অংশে থাকলেও এই কন্ট্রোল রিজিয়নের এ ক্ষেত্রে তেমন কোন ভূমিকা নেই। কিছু কিছু স্নায়বিক রোগ রয়েছে যেগুলো মাইটোকন্ড্রিয়ার গুরুত্বপূর্ণ অংশের মিউটেশনের জন্য ঘটে। এ সকল ক্ষেত্রে মাইটোকন্ড্রিয়া এতটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয় যে তা প্রাকৃতিকভাবেই ঝরে পড়ে, পরবর্তী প্রজন্মের মাঝে আর সে পরিবর্তিত জিনগুলো সঞ্চারিত হয় না। অপরদিকে, কন্ট্রোল রিজিয়ন অংশটির যেহেতু সরাসরি কোন ভূমিকা নেই, তাই তাদের মিউটেশন অব্যাহত থাকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে। প্রতি দশ হাজার বছরে কন্ট্রোল রিজিয়ন-এর এক একটি মিউটেশন হয়, তাই, যদি দুজন ব্যক্তির কন্ট্রোল রিজিয়ন-এর ডিএনএ'র ক্রমটি হুবহু একই হয়, তাহলে ধরে নিতে হবে তাঁদের দুজনের যে ‘কমন' নারী পূর্বপুরুষ রয়েছেন, তিনি গত দশ হাজার বছরের ভেতরের মানুষ ছিলেন।

কিছু কিছু রোগ রয়েছে যা নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চলেই বেশী দেখা যায়, যেমন, আফ্রিকার দক্ষিণে সিকল সেল অ্যানিমিয়া (বক্র কোষ রক্তাল্পতা), এবং এশিয়া, ও ইওরোপে থ্যালাসেমিয়া। সিকল সেল অ্যানিমিয়াতে লোহিত রক্ত কণিকাগুলো বিকৃত আকার ধারণ করে কাস্তের মতো দেখতে হয়। এমন আকারের কারণে বিশেষতঃ সরু রক্তনালীগুলো দিয়ে তারা আর চলাচল করতে পারে না, ফলে শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অংশে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে ভয়ানক এক অবস্থার সৃষ্টি করে। অপরদিকে, থ্যালাসেমিয়ার ক্ষেত্রে লোহিত রক্ত কণিকার ভেতরের হিমোগ্লোবিন জমে পিণ্ড তৈরী করে, যা পরে প্লীহার ভেতরে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায়। নিয়মিত রক্ত স্থানান্তর করা ছাড়া এর স্থায়ী সমাধান নেই।

প্রশ্ন হলো, এই সিকল-সেল অ্যানিমিয়া বা থ্যালাসেমিয়া হয় কেন? এর উত্তরঃ ম্যালেরিয়া। প্রতিটি ম্যালেরিয়া-প্রবণ অঞ্চলেই এই দু'টি রোগের প্রাদুর্ভাব বেশী। বাবা এবং মা-উভয়ের কাছ থেকেই এক একটি করে পরিবর্তিত হিমোগ্লোবিন জিন পেলেই সন্তানের এ রোগগুলো হতে পারে। বহু জিনেটিক রোগই এভাবে ছড়ায়; ইওরোপীয়দের ভেতর সবচেয়ে বেশী যেমন সিস্টিক ফাইব্রোসিস। যে জীবাণুটি ম্যালেরিয়া ঘটায়, কোন একটি অজানা কারণে তা সিকল সেল অ্যানিমিয়া বা থ্যালাসেমিয়া'র বাহককে আক্রান্ত করতে পারে না, বরং বাহকের শরীরে এই দু'টি রোগের বিরুদ্ধে কিছুটা প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। অপরদিকে, বাহকের শরীরে এই প্রতিরোধের জন্যই পরবর্তী প্রজন্মগুলোর মাঝে এই রোগগুলো ছড়াবার সুযোগ থাকে। প্রকৃতি এভাবেই এক আশ্চর্য নিষ্ঠুর খেলা খেলে নতুন-পুরানের একটি সাম্যাবস্থা বজায় রাখে। ম্যালেরিয়ার কারণেই যেহেতু হিমোগ্লোবিনের জিনের এই মিউটেশনগুলো ঘটে, তাই কোন অঞ্চলকে ম্যালেরিয়া-মুক্ত করে ফেললেও থ্যালাসেমিয়া দূর করা সম্ভব হয় না। সার্ডিনিয়া, ইতালী, গ্রিস, সাইপ্রাস, তুরস্ক ইত্যাদি অঞ্চলে ঠিক তাই-ই হয়েছে। সেখানে ম্যালেরিয়ার জন্য দায়ী মশাটিকে সম্পূর্ণরূপে নিকেশ করে ফেলা হয়েছে, কিন্তু থ্যালাসেমিয়া রয়ে গেছে বহাল তবিয়তে।

বাইবেল-কোরানে আমরা যে আদম-ইভের গল্প পড়ি, তার একটি জিনগত ব্যখ্যা দেয়া সম্ভব! মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ যে আমরা শুধু মা'র কাছ থেকে পাই সে তো আগেই জেনেছি; আমাদের মা'রা পেয়েছেন তাঁদের মায়েদের কাছ থেকে, তাঁরা পেয়েছেন তাঁদের মায়েদের কাছ থেকে্‌...এভাবে পেছনের দিকে ক্রমাগত যেতে থাকলে শেষ পর্যন্ত ২ লাখ বছর আগে আফ্রিকার একজন মা'র কাছে গিয়েই ঠেকতে হয়, যাঁর হাত ধরে পৃথিবীর সমস্ত মানুষ এসেছে! এই নারীকে বলা হয় ‘মাইটোকন্ড্রিয়াল ইভ'। এই মাইটোকন্ড্রিয়াল ইভ যে পৃথিবীর প্রথম নারী ঠিক তা নয়, সে সময়ে মনুষ্য প্রজাতির আরো নারী নিশ্চয়ই ছিলেন, কিন্তু তাঁদের উত্তরসূরী কন্যারা বা নাতনীরা টিকে থাকতে পারেনি ডারউইনীয় ন্যাচারাল সিলেকশনের জন্যই। ইভের কন্যা, তস্য কন্যা, তস্য তস্য কন্যারা বেঁচে গেছেন বলেই আমরা আসতে পেরেছি-এটাই এখন সবচেয়ে গৃহীত বৈজ্ঞানিক ব্যখ্যা। কিভাবে বিজ্ঞানীরা এই ২ লাখ বছরের হিসেবে আসলেন? সেই যে মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ'র মিউটেশনের হার, প্রতি ৮ থেকে ১০ হাজার বছরে একটি করে মিউটেশন হয়, তার কথা মনে আছে তো? পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের ডিএনএ নমুনায় কতগুলো মিউটেশন আছে সেটি বের করে তার সাথে মিউটেশনের হার গুণ করে তাঁরা এই সময়টা পেয়েছেন। ব্যাপারটি যতো সহজে বলে ফেললাম, অমনও ঠিক নয়, তবে মোটামুটি ধারণাটি এমনই।

মাইটোকন্ড্রিয়াল ইভ-এর হাত ধরে পরবর্তীতে যে নারীরা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে গত ২ লাখ বছরে নতুন নতুন জনগোষ্ঠীর জন্ম দিয়েছেন, এদের বলা হয় হ্যাপলোগ্রুপ। সাইকস ধারণা করেছেন ইভ-এর পর ৭ জন নারীর হাত ধরে বাকী পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে মানুষ ছড়িয়েছে, যাদের তিনি ইভের কন্যা বলে অভিহিত করেছেন। এ বইয়ের প্রথমার্ধে জিন বিজ্ঞান নিয়ে যাবতীয় তথ্য প্রদানের পর সাইকস বাকী অর্ধেকে তাঁর সেই কল্পিত ৭ জন নারীর কল্পিত গল্প বলেছেন। সেটুকু পড়া নিতান্তই সময়ের অপচয়। এই শ'খানেক পাতা অতিরিক্ত যোগ করায় বইয়ের বাহ্যিক ওজন বেড়েছে বটে, কিন্তু বইটির গ্রহণযোগ্যতার যে ওজন, সেটি অনেকটাই কমে গেছে।

2022-12-30T00:00:00.000Z
Sofia Petrovna

Sofia Petrovna

By
Lydia Chukovskaya
Lydia Chukovskaya,
Aline Werth
Aline Werth(Translator)
Sofia Petrovna





গুলাগের শ্রমিক শিবিরে আসা নতুন এক বন্দীর সাথে পুরনো বন্দী কথা বলছেঃ
-“তো কী অপরাধে আপনাকে ১০ বছরের সাজা দেয়া হলো?”
“কিছুই না! আমি কিছুই করিনি!”
-“কেন শুধু শুধু মিথ্যা বলছেন? এখানে সবাই জানে, “কিছুই না”'র সাজা তো মাত্র ৩ বছর!”

ইংরেজী purge শব্দটির অর্থ তো আমরা সবাই-ই জানি। অবাঞ্চিত, অপ্রয়োজনীয় বস্তু সরিয়ে ফেলার প্রেক্ষিতে এ শব্দটির নানাবিধ ব্যবহার রয়েছে। পেটের পীড়ায় ভোগা রোগী জোলাপ জাতীয় laxative খেয়ে কিংবা গলায় আঙুল দিয়ে বমি করে পেটের ভেতরটা purge করিয়ে নেন। গবেষণাগারে কাজ করা বিজ্ঞানী ভ্যাকিউয়াম চুলার ভেতরে জমা হওয়া অবাঞ্চিত গ্যাস purge করে তাঁর sampleটিকে দূষণ থেকে বাঁচান...চাইলে এমন আরো কয়েক রকম উদাহরণই দেয়া সম্ভব; অভিধানটা হাতে নিয়ে একবার চোখ বোলালে এ শব্দটি এবং এর প্রয়োগগুলো বিনা ক্লেশেই শেখা হয়ে যায়। সোভিয়েতের জনগণ ১৯৩০-এর দশকে এ শব্দটি অবশ্য শিখেছিলো এর ব্যবহারিক প্রয়োগ থেকে, অভিধান ঘেঁটে নয়। রাষ্ট্রনায়ক জোসেফ স্টালিন তখন দেশজুড়ে সাঁড়াশি আক্রমণ চালিয়ে রাজনৈতিক শত্রু খুঁজে বেড়াচ্ছেন; যার ওপরই বিন্দুমাত্র সন্দেহ হচ্ছে, যাকেই বিরোধী মতের লোক বলে ঠাওর হচ্ছে, কোন যাচাই বাছাই ছাড়াই তাকে জেলে পুরে দিচ্ছেন, পাঠিয়ে দিচ্ছেন নিশ্চিত মৃত্যুর পথে। এভাবে ২ বছরে প্রায় ১২ লাখ মানুষকে খুন করে purge করে কন্টকমুক্ত নিশ্চিত একটি রাজনৈতিক অবস্থান তৈরী করেন স্টালিন। ইতিহাসের পাতায় গণহত্যার এই ঘটনাটি The Great Purge নামে স্বীকৃত।

১৯২৪ সালে যখন সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির সর্বেসর্বা নবী ভ্লাদিমির লেনিন পটল তোলেন, তখন একটি শূণ্যতা তৈরী হয়। “পার্টির হাল এবার কে ধরবেন?”-এই প্রশ্নে বিব্রত হতে হয় দলের নিবেদিতপ্রাণ কর্মীদের। ধর্মে কিংবা জিরাফে কমিউনিজমে একটি বিষয় সর্বজনীনঃ একজন পালের গোদাকে কেন্দ্র করে ধর্মের কিংবা কমিউনিজমের গোটা দুনিয়া ঘূর্ণায়মান থাকে। কেন্দ্রে থাকা এই পালের গোদা মশাইটির ভবলীলা সাঙ্গ হলেই গোটা কাঠামোটি কেঁপে ওঠে; ক্ষমতা এবার কার হাতে যাবে সে প্রশ্ন নিয়ে লেগে যায় হুটোপাটি। এই হুটোপাটিতে শেষতক কে জিতবেন সেটিরও একটি pattern রয়েছে। পালের গোদা'র ‘গোদাত্ব' জাহির করবার জন্য তাঁর জীবদ্দশাতেই তাঁর নামে অনুসারীদের পক্ষ থেকে সচরাচর কিছু রূপকথার গল্প চাউর করা হয় (তিনি আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন, কিংবা পশুপাখির সাথে কথা বলতে পারেন, কিংবা চাঁদ দু'ভাগ করে ফেলতে জানেন, কিংবা তাঁর কখনো ঘুমোবার/ বিশ্রাম নেবার প্রয়োজন পড়ে না...ইত্যাদি)। গোদা মশাইটি মারা যাবার পর তাঁর যে অনুসারী তাঁর নামে প্রচলিত এই গল্পগুলোকে দ্বিগুণ-চতুর্গুণ উৎসাহে জনগণের গলায় ঠেসে ঢোকাতে পারেন, তিনিই সেই ইঁদুর দৌড়ে জয়ী হন। “দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পালের গোদা”'র স্বীকৃতীস্বরূপ বরমাল্যটি তাঁর গলাতেই ওঠে। ধর্মবিশ্বাসের সাথে কমিউনিজমের এখানেই আশ্চর্য মিল। ঠিক এই ছকে পা ফেলেই লেনিনকে অতিমানব বানিয়ে স্টালিন তাঁর সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ লিওন ট্রটস্কিকে হঠান। সেই সাথে ট্রটস্কির চিহ্নও মুছে ফেলতে তৎপর হয়ে ওঠেন। ট্রটস্কিকে তো মেক্সিকোতে খুন করান বটেই, সেই সাথে ট্রটস্কির অনুসারী সন্দেহে ডানে বাঁয়ে যাকে পান তাকেই নির্বাসনে পাঠান।

পালের গোদা'র আসনে বসে পড়লে তখত ধরে রাখার জন্য নিজের নামেও রূপকথা ছড়াতে হয়। স্টালিন অবশ্যই তার ব্যতিক্রম নন। স্টালিন নামটিই আসলে ভুয়া; এ নামটির অর্থ দাঁড়ায় লৌহমানব (man of steel), কিন্তু এটি মোটেই তাঁর পিতৃপ্রদত্ত কোন নাম নয়, নিজেই তিনি নিজেকে এ উপাধিতে ভূষিত করেছেন। ক্ষমতায় বসবার পর স্টালিন প্রথম ৫ বছরের একটি কর্মসূচী তৈরী করেন, যার সারকথা ছিলো ব্যক্তিমালিকানাধীন কোন প্রতিষ্ঠান থাকতে পারবে না; কলকারখানা, অফিস-আদালত সবকিছুই সরকারের করায়ত্ত হতে হবে। মূলত এই নীতিমালার পক্ষ-বিপক্ষ নিয়ে মতবিরোধ থেকেই স্টালিন ও ট্রটস্কির শত্রুতার শুরু। প্রথম জীবনে ধর্মযাজকের প্রশিক্ষণ পাওয়া অর্ধশিক্ষিত স্টালিন কোন অংক না কষেই মনের খেয়ালে এ সিদ্ধান্ত নেন, যা ইউক্রেন, কাজাখস্তান, সাইবেরিয়া সহ গোটা ইউরাল অঞ্চলে ৩ বছর মেয়াদী দীর্ঘ এক দূর্ভিক্ষ ডেকে আনে। ৯০ লাখ মানুষ না খেতে পেয়ে প্রাণ হারায়। সাধারণ জনগণ যখন ক্ষোভে রাগে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে, স্টালিনের নীতির সমালোচনায় অংশ নেয়, তখনি স্টালিন তাঁর লৌহদণ্ডটি বের করে আনেন। শুরু হয়ে যায় দ্যা গ্রেট পার্জ। আপনার বাড়ীতে খাবার নেই? কত খাওয়া লাগে আপনার? সব খেয়ে খেয়ে তো রাষ্ট্রকে ফতুর করে দিচ্ছেন। আপনি রাষ্ট্রীয় শত্রু। আপনার অসুস্থ সন্তান চিকিৎসা পাচ্ছে না? না-ই বা পেলো! দেশ গড়ার কাজে ডাক্তাররা ব্যাস্ত আছেন, তাঁদের বিরক্ত করে মারছেন কেন? আপনি রাষ্ট্রীয় শত্রু। আপনি ক্যাপিটালিস্টদের মতো টাই পরে ঘোরাঘুরি করেন? নির্ঘাত আপনি রাষ্ট্রীয় শ...



১৯৩৬ থেকে ১৯৩৮-এ দুই বছরে সোভিয়েত রাশিয়ায় যখন এই দম বন্ধ করা পরিবেশ চলছে, ঠিক তখনই স্টালিনের নাকের ডগায় বসে লীদিয়া চুকোভস্কায়া তাঁর উপন্যাসিকা ‘সোফিয়া পেত্রোভনা' লেখেন। সোফিয়া পেত্রোভনা একজন সাধারণ সোভিয়েত নারী, যাঁর স্বামী গত হয়েছেন, একমাত্র ছেলে কোলিয়াকে নিয়ে তিনি বেঁচে থাকার সংগ্রাম করছেন। সোভিয়েত প্রপাগ্যান্ডা ছাপাবার এক পাবলিশিং হাউজে তিনি টাইপিস্টের চাকরী নিয়েছেন। সে অফিসে ক'দিন পর পরই কমিউনিস্ট পার্টির সভা হয়, যাতে উপস্থিতি বাধ্যতামূলক। একঘেয়ে, বিরক্তিকর এই সভাগুলোতে কিভাবে কমিউনিজম দিনকে দিন শক্তিশালী হয়ে উঠছে, এবং লেনিনের স্বপ্নের সোভিয়েত গঠিত হচ্ছে তার মুখস্ত বিবরণী থাকে। তবে সভার মূল উদ্দেশ্য স্টালিনের স্তুতি গাওয়া। উন্নতির যে গ্রাফগুলো দেখানো হয় সভাতে, আর যে সোনালী প্রতিশ্রুতির কথা বলা হয়, সেগুলো সহজ-সরল আধপ্রৌঢা সোফিয়ার বোধগম্য হয় না বেশী একটা। নাম লেখানো বাধ্যতামূলক, তাই কমিউনিস্টদের আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা MOPR-এ সোফিয়াও নাম লেখান, তবে এর কার্যকলাপ কী সেসবের ব্যাপারে বিন্দুমাত্র ধারণা তাঁর নেই। সভা শেষ করে স্থানীয় পার্টি-প্রধান আরো একবার ক্যাপিটালিস্টদের মুণ্ডুপাত করে তাঁর (ক্যাপিটালিস্ট দেশ আমেরিকার তৈরী) ফোর্ড গাড়ীতে চড়ে বাড়ী ফেরত যান।

“পার্সোনালিটি কাল্ট” ছাড়া যে কমিউনিজম দাঁড়ায় না, তার দুর্দান্ত সব প্রমাণ চুকোভস্কায়া'র ছোট এ বইয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। নাতি-নাতনী'র স্বপ্নে বিভোর সোফিয়া ভেবে রাখেন তাঁর নাতি হলে নাম রাখবেন ভ্লাদলেন, আর নাতনী হলে লিনেন। ভ্লাদিমির লেনিন-এর সংক্ষিপ্ত রূপ ভ্লাদলেন, আর Lenin-কে উল্টো করলে নিনেল। এই দু'টি নামই সে সময়ে সোভিয়েতে সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিলো। একনিষ্ঠভাবে দায়িত্ব পালনের জন্য পার্টি অফিস থেকে অভিনন্দন পেয়ে গদগদ হয়ে যাওয়া সোফিয়া কোলিয়াকে কেন্দ্র করে সামনের দিনগুলোর স্বপ্ন বুনতে থাকেন। কোলিয়াও এর মাঝে কমসোমল-এ নাম লেখায় (ছাত্রদল/ ছাত্রলীগ গোছের ব্যাপার)। কিছুদিন পরেই কোলিয়া বাড়ী থেকে বেশ দূরে এক ফ্যাক্টরিতে ইঞ্জিনিয়ার-এর কাজ পায়; মাস কয়েক পর সেরা উদ্ভাবক-এর পদক পাওয়া কোলিয়ার ছবি পত্রিকাতেও আসে। যে যুবকদের হাত ধরে সোভিয়েত ক্রমশ পৃথিবীর সেরা দেশে পরিণত হচ্ছে সোফিয়া'র কোলিয়া যে তাদের সর্বাগ্রে তাতে তাঁর কোনই সন্দেহ থাকে না। কমিউনিজমের প্রতি কোলিয়ার ভালোবাসাটাও দেখবার মতই। সোফিয়া'র বান্ধবী নাতাশা বুর্জোয়া পরিবার থেকে উঠে আসায় শতচেষ্টা করেও কিছুতেই কমসোমল-এ নাম লেখাতে পারছিলো না; এ নিয়ে সোফিয়া দুঃখ নিয়ে কোলিয়াকে চিঠি লিখলে কোলিয়া জবাব দেয়, “সমাজে শ্রেণীশত্রু এখনো রয়ে গেছে, কোথায় কোন বুর্জোয়া কি ফন্দী এঁটে অন্তর্ঘাত করে বসে তা ঠিক ভাবে যাচাই না করে তো স্টালিন যাকে তাকে দলে ভেড়াবেন না! তুমি এসব নিয়ে দুঃখ না করে মন দিয়ে বেশী বেশী মার্ক্স, এঙ্গেলস, আর লেনিন পড়ো আর খাতায় নোট নাও”।

ভালোই চলছিলো দিন, এরই মাঝে হঠাৎ হঠাৎ খবর আসতে থাকে সোফিয়ার কাছে, তাঁর পরিচিত অনেকেই নাকি জেলে, রাষ্ট্রদ্রোহীতার অভিযোগে। একদিন সোফিয়ার বাড়ীতেও সংবাদ আসে, কোলিয়াও নাকি দেশের শত্রু, তারও ১০ বছরের জেল হয়ে গেছে। শুরু হয় সোফিয়ার এক অন্যরকম সংগ্রামের জীবন; ছেলেকে ছাড়িয়ে আনতে প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় জেলখানার সামনে হাজিরা দেয়া শুরু করেন প্রতিদিন, কিন্তু কোথায় কোলিয়া? কার সাথে কথা বললে ছেলের সন্ধান পাবেন সোফিয়া? এ কাউন্টার থেকে সে কাউন্টার, এ জেল থেকে সেই জেল এভাবে ঘুরে ঘুরে সোফিয়া ক্লান্ত। জনপ্রতি ১০ সেকেন্ড করে সময় দেয়া বিচারকেরও বয়েই গেছে সোফিয়ার ছেলের খোঁজ রাখতে; রুঢ় ভাষায় দূরদূর করে তাড়িয়ে দেয় তাঁকে। সোফিয়া'র সাথে লাইনে দাঁড়িয়ে আছে আরো হাজার কয়েক নারী, এঁদের কেউ ছেলের জন্য, কেউ ভাইয়ের জন্য, আর কেউ স্বামীর জন্য হাজিরা দিয়ে চলেছেন দিনের পর দিন। কোলিয়ারা কোথায় যায়? কী হয় তাদের? তাদের অপরাধটাই বা কী? কেউ জানে না। স্টালিন জানেন? বছর খানেক অপেক্ষা করবার পর বাধ্য হয়ে সোফিয়া স্টালিনকে চিঠি দেন, একবার, দু'বার, তিনবার। তৃতীয়বারের চিঠি বিশেষ ডাকে পাঠান রসিদ সহ, যাতে স্টালিনের হাতে নিশ্চিতভাবেই পৌঁছায়। রসিদে পাঠের অযোগ্য অস্পষ্ট যে স্বাক্ষরটা থাকে, তা দেখে বোঝার উপায় নেই চিঠি কার হাতে গেছে, কে স্বাক্ষর করেছে। স্টালিনের খেয়ালী এক মুহুর্তের সিদ্ধান্তে সারাজীবনের জন্য ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়া সোফিয়ারা কী করবে?

সোফিয়া'র অবর্ণনীয় কষ্টের যে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরনী চুকোভস্কায়া দিয়েছেন, তাতে পাঠকের মনে প্রশ্ন আসবেই, কী করে তিনি এত ভেতরের সব খবর জানলেন? তিনি কি নিজেই উপস্থিত ছিলেন সোফিয়ার জীবনে? লীদিয়া চুকোভস্কায়া বিয়ে করেছিলেন সোভিয়েত পদার্থবিদ মাতভেই পেত্রোভিচ ব্রনস্টেইনকে। ব্রনস্টেইন ছিলেন কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটি তত্ত্বের অন্যতম পথিকৃৎ। বিজ্ঞানী রিচার্ড ফাইনম্যান ১৯৬৫ সালে তাঁর যে অবদানের জন্য নোবেল পেয়েছিলেন, সেই কোয়ান্টাম ইলেক্ট্রোডায়নামিক্স নিয়ে ব্রনস্টেইনের কাজ রয়েছে। সেমিকন্ডাক্টর এর কোয়ান্টাম তত্ত্ব নিয়ে তিনি বহু মাথা ঘামিয়েছেন। শিশুদের জন্য বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের অসংখ্য বইও তিনি লিখে গেছেন। অসম্ভব কর্মোচ্ছল এই ব্রনস্টেইন ১৯৩৮ সালে মাত্র ৩১ বছর বয়েসে স্টালিনীয় বিচারের শিকার হয়ে লেনিনগ্রাদের এক জেলে খুন হন। তাঁর স্ত্রী, লীদিয়া চুকোভস্কায়াকে সরকার থেকে বলা হয়েছিলো ব্রনস্টেইনের ১০ বছরের জেল হয়েছে। বহুদিন পর্যন্ত চুকোভস্কায়ার কাছে স্বামীর মৃত্যুর খবর অজানা ছিলো। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস তিনি ব্রনস্টেইনকে ছাড়িয়ে আনবার আশায় এক জেল থেকে আরেক জেলে ঘুরেছেন, বিচারকদের দুয়ারে মাথা খুঁড়ে মরেছেন। কাল্পনিক সোফিয়া'র সত্যিকার গল্প বলতে চুকোভস্কায়াকে মোটেই বেগ পেতে হয়নি।

স্টালিনের স্বেচ্ছাচারে রাশিয়া হারিয়েছে তার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের যাঁরা সত্যিকার অর্থে দেশটিকে ঋদ্ধ করতে পারতেন। শুধু উইকিপিডিয়া'র দ্যা গ্রেট পার্জ নিবন্ধটিতে চোখ বোলালেই হাঁ হয়ে যেতে হয়। স্টালিন কাকে খুন করতে বাকী রেখেছেন? কিছুদিন আগেই আইজ্যাক বাবেল-এর ছোট গল্পের একটি সংকলন পড়ছিলাম, যাঁকে চেখভ-পরবর্তী যুগে রাশিয়ার শ্রেষ্ঠতম ছোটগল্পকার হিসেবে ধরা হয়। বাবেলকে ১৯৪০-এর জানুয়ারীতে খুন করে মাটি চাপা দেয়া হয়, ১৯৯০ সালের আগ পর্যন্ত সে লাশের সন্ধানই পাওয়া যায়নি। বাবেলের সূক্ষ্ম হিউমার এক মুহুর্তেই আমাকে তাঁর ভক্ত বানিয়ে দিয়েছিলো; মনে আছে, তাঁর এই করুণ পরিণতির কথা পড়ে মনের অজান্তেই হাত কেমন মুঠো পাকিয়ে ফেলেছিলাম...

গ্রেট পার্জের মূল নকশাকার স্টালিন, কিন্তু ধরপাকড় আর খুন করাবার নোংরা কাজগুলো তিনি করাতেন তাঁর গোপন পুলিশ বাহিনী এনকেভিডি (NKVD)কে দিয়ে। এই এনকেভিডি'র প্রধান নিকোলাই ইয়েজভ ছিলেন স্টালিনের ডান হাত। স্টালিন ইশারা দেবার সাথে সাথে প্রভুভক্ত কুকুরের মতোই ইয়েজভ বিপুল উৎসাহে ঝাঁপিয়ে পড়তেন ‘রাষ্ট্রীয় শত্রু'দের ওপর। বাবেল সহ বহু বহু লেখক-বুদ্ধিজীবিই ইয়েজভের শিকার। ইয়েজভ তাঁর কাজে এতই পারদর্শী ছিলেন যে রাশানরা '৩৬-'৩৮ এর সেই দুই বছরকে গ্রেট পার্জ না বলে ইয়েজভস্কিনা (ইয়াজভের সময়) বলতো। গ্রেট পার্জ নিয়ে যখন আন্তর্জাতিক সমালোচনার সম্মুখীন হন স্টালিন, নিজের ভাবমূর্তি উদ্ধার করতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায় দিয়ে এনকেভিডিকে তিনি আচ্ছা করে কড়কে দেন; একসময়ের জিগরী দোস্ত নিকোলাই ইয়েজভকে সেই একই কায়দায় খুন করান। ইয়াজভ আর স্টালিনের একসাথে তোলা যতো ছবি ছিলো খুঁজে খুঁজে বের করে সেগুলো থেকে ইয়াজভকে মুছে ফেলার এক মহাযজ্ঞ শুরু হয়। আগাগোড়া পুরোটাই ইস্পাতের তৈরী না হলে এতটা নির্লজ্জ বোধহয় হওয়া যায় না। সে অর্থে স্টালিন সত্যি সত্যিই লৌহমানব ছিলেন।


সূত্রঃ রেয়ার হিস্টোরিক্যাল ফটোস

যে লেখক-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবিদের স্টালিন নির্বাসনে পাঠিয়েছিলেন, তাঁদের মাঝে হাতেগোনা অল্প ক'জনই প্রাণ নিয়ে ফিরে আসতে পেরেছিলেন। ১০ বছর কারাভোগের পর আলেকজান্ডার সোলঝিনিৎসেন যখন ওয়ান ডে ইন দ্যা লাইফ অফ ইভান দেনিসোভিচ লেখেন, গোটা বিশ্ব নড়েচড়ে বসে। আজ অব্দি গ্রেট পার্জের সবচেয়ে বিখ্যাত দলিল সোলঝিনিৎসেনের বইগুলো। লীদিয়া চুকোভস্কায়া তাঁর উপন্যাসিকাটি লিখেছেন সোলঝিনিৎসেনেরও কয়েক দশক আগে, অথচ ভাগ্যের একটু এদিক ওদিক হলেই এ বই কখনোই প্রকাশিত নাও হতে পারতো। একাধিকবার চুকোভস্কায়ার বাড়ীতে এনকেভিডি হানা দিয়েছে, তন্নতন্ন করে খুঁজেছে তাঁর বাড়ী, কিন্তু ‘সোফিয়া পেত্রোভনা'র পাণ্ডুলিপি তিনি তদ্দিনে তাঁর এক বন্ধুর কাছে পাচার করে দিয়েছেন। ৫ বছর যক্ষের ধনের মতো আগলে রাখবার পর মৃত্যুশয্যায় সেই বন্ধুটি তাঁর বোনকে পাণ্ডুলিপিটা দিয়ে বলেছিলেন “যদি তুমি আর লীদিয়া দু'জনই বেঁচে থাকো, আর ওর সাথে তোমার দেখা হয়, তাহলে এই বইটা ওকে ফেরত দিও”। গায়ে কাঁটা দেবার মতো ঘটনা, তাই না?

স্টালিন যে তাঁর দেশের বুদ্ধিজীবিদের পাইকারী হারে খুন করা শুরু করেছিলেন, সে ঘটনা প্রায় ৯০ বছর আগের বাসী হয়ে গেছে। কারো কি কুমীর চাষী মুশতাক আহমেদের কথা মনে আছে? তাঁকে জেলে নেবার পর তাঁর স্ত্রী লিপা আহমেদ মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। মা-বাবার একমাত্র সন্তান ও ভরণপোষণের দায়িত্বে থাকা মুশতাকের পরিবারের কী হবে তা নিয়ে ভেবে সরকার সময় অপচয় করেনি। মুশতাক আহমেদের অপরাধ ছিলো কোভিড-১৯ মহামারীর সময়ে বাঙলাদেশ সরকারের দূর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা নিয়ে তিনি একটি ফেইসবুক পোস্ট দিয়েছিলেন।


ছবি কৃতজ্ঞতাঃ কে ছিলেন মুশতাক আহমেদ?

2022-12-15T00:00:00.000Z
The Postman Always Rings Twice

The Postman Always Rings Twice

By
James M. Cain
James M. Cain
The Postman Always Rings Twice

নাভুক্তং ক্ষীয়তে কর্ম কল্প কোটি শতৈরপি।
অবশ্যমেব ভোক্তব্যং কৃতংকর্ম শুভাশুভম্‌”।।



হিন্দুশাস্ত্রে বর্ণিত এই শ্লোকটির অর্থ হলো, কর্মফল ভোগ না করে মানুষের উপায় নেই, এমনকি যদি সে কর্মফল ভোগ করতে শতকোটি বারও জন্মাতে হয়। যত দিন/মাস/বছর/শতাব্দী/ সহস্রাব্দ অব্দি কর্মফল ভোগ শেষ না হচ্ছে, মোক্ষ বা মুক্তি কিছুতেই আসবে না। পুরাতন পাপ নাকি ব্লাড হাউন্ডের মতোই গন্ধ শুঁকে শুঁকে ঠিকই খুঁজে বের করে ঘ্যাঁক করে কামড় বসিয়ে দেয়। যে নমস্য মুনি ঋষিরা বেদ রচনা করে গেছেন, তাঁদের মতে কর্মফল নাকি তিন প্রকারঃ সঞ্চিতা, প্রবর্ধ, আর ক্রীয়ামান (বা আগামী)। তাঁরা যা জানাচ্ছেন তা হলো, আমাদের সবার (আগের জন্মগুলোর) সামষ্টিক কর্মফল টিনের কৌটায় থরে থরে সঞ্চিত রাখা আছে দোকানের তাকে (তাকগুলো আমাদের যার যার নিজেদের নামে আলাদা করে রাখা আছে), কৌটোর মুখ যেহেতু সিলগালা, তাই ভেতরের মালমশলার এদিক ওদিক করা আর আমাদের হাতে নেই। আমরা যখন নতুন কোন মানবদেহে নতুন রূপে জন্মগ্রহণ করে পৃথিবীতে ফিরে আসি, তখন তাকের ওপর সঞ্চিত কৌটোগুলোর একটি নিয়ে আসি। কৌটোর ভেতরে থাকা কর্মফলের যতটুকু আমরা আমাদের জীবদ্দশায় ভোগ করি, তা হলো প্রবর্ধ,আর বর্তমানের আমাদের যে কাজগুলোর ফল ভবিষ্যতে পাবো, সেগুলো ক্রীয়ামান বা আগামী। অর্থাৎ, আপনার অতীত (জন্মের) কাজগুলো নির্ধারণ করে দিচ্ছে কেমন হবে আপনার বর্তমান (জন্ম), আর আপনার বর্তমান (জন্মের) কাজ নির্ধারণ করে দিচ্ছে আপনার ভবিষ্যৎ (জন্ম)।

বেদের বয়ানকে বেদবাক্য মানলে আপনার যে কোন দূর্ঘটনা বা ব্যর্থতার দায় গত জন্মে আপনার খারাপ স্বত্ত্বাটির ওপর চাপাতে পারেন; তখন আপনি খারাপ ছিলেন বলে সে জন্মের কর্মফল এ জন্মে আপনার ব্যর্থতার মাধ্যমে পাচ্ছেন-এ ভেবে আপনার ক্ষতে অয়েন্টমেন্ট লাগাতে পারেন। মানুষ নিজেই যে তার “ভাগ্য” গড়ে নেয়, জন্মের বহু আগেই ঈশ্বরের সই করে দেওয়া চিত্রনাট্য অনুযায়ীই যে কেবল আমরা অভিনয় করে যাই না এমন একটি (নাস্তিক্যবাদী) প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত কেউ কেউ এই দর্শনটিতে খুঁজে পেতে পারেন। হিন্দু দর্শনের বৃহৎ ছাতাটির নিচে ঈশ্বরবাদীরা যেমন আছেন, তেমনি নাস্তিকেরাও আছেন, যাঁরা মনে করেন বেদ আদৌ ঈশ্বর লেখেননি, কারণ, লিখতে হলে হাত চাই, আর হাত থাকলেই সেখানে ঘা হবে, বাত হবে, হাড় ক্ষয় হবে, আর্থ্রাইটিস হয়ে আঙুল বেঁকে যাবে...ঈশ্বর সর্বশক্তিমান হলে তো এমন হবার কথা নয়! এখানে বলে রাখা ভালো, হিন্দু দর্শনের নাস্তিক্যবাদী এই শাখাটির জন্ম ঈশ্বরে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের ভিত্তিতে নয়, বেদের ওপর বিশ্বাসের ভিত্তিতে। নাস্তিকেরা আবহমান কাল থেকেই সমাজের ব্রাত্য অংশ, অচ্ছুৎ এঁদের তাই যেকোন আলোচনাতেই পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়া যায়। এ আলোচনাও তার খুব ব্যক্তিক্রম নয়! তবে প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের সবার কর্মফল যে কৌটায় কৌটায় তাকে সাজানো থাকে, সেই তাকগুলোর রক্ষণাবেক্ষণকারী ‘ম্যানেজার'টি কে? নাম অনুযায়ী কর্মফলের কৌটা লেবেলিং করেন কে? তিনিই কি ঈশ্বর? আমাদের গল্প যেহেতু আগাগোড়া পুরোটাই তিনি জানেন, তিনি কি আমাদের কোন বিপদের আগে ‘স্পয়লার অ্যালার্ট' কিংবা কোন সতর্কতাবাণী পাঠিয়ে সাবধান করে দেন?

মার্কিন থ্রিলার লেখক জেইমস এম কেইন ১৯৩৪ সালে তাঁর ক্রাইম নভেল দ্যা পোস্টম্যান অলওয়েজ রিংস টোয়াইস লিখে বিশ্বব্যাপী সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন। মাত্র শ'দেড়েক পাতার দুরন্ত গতির এ থ্রিলারে রগরগে যৌন দৃশ্য আছে, পরকীয়া আছে, খুনের প্রচেষ্টা আছে, খুন আছে, আইনকে ফাঁকি দেবার ঘোরালো রাস্তা নেবার উদাহরণ আছে...অপরাধমূলক গল্পের প্রতিটি উপকরণ থাকা স্বত্ত্বেও একে আর দশটা সাধারণ থ্রিলার গল্পের কাতারে ফেলা যায় না। প্রায় ৯০ বছর আগে লেখা এ বই আজও সবুজ, আর সম্ভবত অন্য আর যেকোন সময়ের চেয়ে বর্তমানে আরো বেশী মহান!

উপন্যাসের প্রথম পাতায়, প্রথম লাইনেই আমাদের পরিচয় ঘটে যায় গল্পের নায়ক (কিংবা খলনায়ক) ফ্র্যাঙ্কের সাথে। ভবঘুরে ফ্র্যাঙ্ক চেম্বার্সের বয়ানেই গোটা উপন্যাসটি লেখা। অজানা অচেনা নতুন এক শহরে বিনি পয়সার এক ট্রিপে চলে আসে ফ্র্যাঙ্ক। তার বয়ানে ক্রমশ পষ্ট হয়,আগে সে বিভিন্ন শহরে বিভিন্ন অপকর্ম ঘটিয়ে অনেক জিলিপীর প্যাঁচ খেলিয়ে কোত্থাও সুস্থির না হয়ে উপন্যাসের অকুস্থল ক্যালিফোর্নিয়ার এই নতুন শহরে এসে পড়েছে। নতুন অ্যাডভেঞ্চারের সন্ধানে সদা তৎপর তার অভিজ্ঞ ইন্দ্রিয়গুলো। আবির্ভাবের সাথে সাথেই ফ্র্যাঙ্ক এই শহরের এক সরাইখানার মালিকের সাথে খাতির জমিয়ে ফেলে। ফ্র্যাঙ্ক হয়তো কুশলাদি সেরে ফের বেরিয়েই পড়তো তার ভবঘুরে জীবন যাত্রায়, কিন্তু তার সাথে দেখা হয়ে যায় সরাইখানার মালিকের কমবয়েসী বউ কোরার। ফ্র্যাঙ্ক চোখ সরাতে পারেনা, সাথে সাথে শিশ্নটাও অবাধ্য হয়ে ওঠে। কোরার স্বামীর অধীনে সেই সরাইখানাতেই চাকরী নিয়ে থাকা শুরু করে দেয় ফ্র্যাঙ্ক। ওদিকে তেল চিটচিটে আধবুড়ো গ্রীক স্বামী নিক পাপাডাকিসের একঘেয়ে সংসার করে করে উদ্ধতযৌবনা কোরাও হাঁপিয়ে উঠেছে। ব্যাস...যজ্ঞাগ্নিতে ঘি ঢালা হয়ে গেলো!

ফ্র্যাঙ্ক আর কোরা খুব শিগগীরই প্রেমে জড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন ছুতোয় নিককে বাইরে পাঠিয়ে প্রায়ই তারা উদ্দাম যৌনতায় মত্ত হয়। এভাবে চলতে চলতে একসময় তারা পরিকল্পনা করে নিককে খুন করে দূর্ঘটনার নাটক সাজিয়ে পাকাপাকিভাবে দু'জন দু'জনার হবার। সাথে নিকের সম্পদ প্রাপ্তি তো আছেই। ঘটনাক্রমে তাদের পরিকল্পনা কেবল অর্ধেক বাস্তবায়িত হয়, অর্থাৎ, নিককে তারা ঘায়েল করতে পারে বটে, তবে জানে মেরে ফেলতে পারে না। জীবনের ওপর দিয়ে চলা এ আক্রমণে নিকের কিছুটা স্মৃতিভ্রংশ হয়। কোরা আর ফ্র্যাঙ্ক আবার নবোদ্যমে পরিকল্পনায় নামে। নিক কিছুটা সুস্থ হয়ে ওঠার পর আবার হামলা চালায় তারা। এবার সফলতা আসে বটে, কিন্তু তারা জড়িয়ে যায় জটিল এক আইনী মারপ্যাঁচে। সেখান থেকেও অনেক ঝামেলা করে মুক্তি মেলে, কিন্তু ফ্র্যাঙ্ক বা কোরা-কারোরই শেষরক্ষা আর হয় না। এতদিনের সকল অপকর্মের শাস্তি বুঝি এবার একবারে আষাঢ় মাসের বৃষ্টির মতই ঝপ করে নেমে আসে ওদের ওপর। শেষের অধ্যায়ে এসে বোঝা যায় পুরোটা গল্প ফ্র্যাঙ্ক জেলে বসে বলছে; কোরাকে হত্যার দায়ে সেখানে বন্দী সে। নিক পাপাডাকিসের হত্যা মামলায় প্রমাণের অভাবে পুলিশ ফ্র্যাঙ্ককে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলো, অথচ কোরাকে খুন না করলেও ঘটনার প্রেক্ষিতে ফ্র্যাঙ্ককে খুনের আসামী বনে যেতে হয়। কর্মফলের সেই ঘেয়ো কুকুর অন্ধ হলেও গন্ধ শুঁকে ঠিকই কামড় দিয়ে বসে ফ্র্যাঙ্ককে।

পরিণতির ব্যাপারে উদাসীন, আপাতঃদৃষ্টিতে আগাগোড়া অসচ্চরিত্র, ভোগবাদী, কামুক, খুনী, জেলে বসে ফাঁসির আদেশের অপেক্ষায় থাকবার সময় পাঠককে উত্তম পুরুষে নিজের গল্প বলে যাওয়া-সচেতন পাঠক মাত্রেই মিলটা টের পাবেন। হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন, জেইমস এম কেইনের এই উপন্যাসটি পড়েই আলব্যার কাম্যু তাঁর দ্যা আউটসাইডার লেখেন, হুবহু একই ছকে। কাম্যু আর আউটসাইডার শব্দ দু'টি আজ সমার্থক হয়ে গেছে; এ বইটি তাঁকে বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম গুরুস্থানীয় ওস্তাদের আসনে বসিয়েছে। ওস্তাদেরও যে ওস্তাদ থাকে পোস্টম্যান আবারো তা মনে করিয়ে দিলো।

এ উপন্যাসে কোন পত্রবাহক নেই, দরজার বেলেও কেউ এখানে দু'বার করে আঙুল চাপে না। তাহলে কেন এমন নাম? উপন্যাসটি বের হবার পর কেউ কেউ ধারণা করেছিলেন কেইন এ নাম রেখেছেন রুথ স্নাইডার নাম্নী এক আমেরিকান মহিলার ঘটনা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে। ১৯২৭ সালে স্নাইডার (কোরার মতই) তাঁর প্রেমিককে নিয়ে স্বামীকে খুন করার ফন্দি আঁটেন। খুন করবার আগে স্নাইডার তাঁদের যৌথ জীবন বীমায় কিছু পরিবর্তন আনেন। এই পরিবর্তনগুলো যাতে স্বামী ধরতে না পারেন সেজন্য স্নাইডার তাঁদের ডাকপিয়নকে বলে রেখেছিলেন জীবন বীমা সংক্রান্ত কোন চিঠি এলে যেন দু'বার করে বেল চাপে, তাহলেই স্নাইডার বুঝে যাবেন, আর স্বামীর চোখ এড়িয়ে আড়ালে পরে সে চিঠি পিয়নের কাছ থেকে নিয়ে নেবেন।

এ ব্যখ্যাটি অনেকদিন জনপ্রিয় ছিলো, তবে উপন্যাসের নামকরণের মূল ব্যখ্যাটি কেইন স্বয়ং নিজেই দিয়েছেন যেটি আরো চমকপ্রদ। কেইনের “পোস্টম্যান” আসলে “ঈশ্বর” কিংবা নিয়তি। নিককে খুন করবার পরও প্রমাণের অভাবে ফ্র্যাঙ্ক যখন বেকসুর খালাশ পেয়ে যায়, তখনি ঈশ্বর “সতর্কতাবাণীস্বরূপ” পয়লাবার বেলটা চাপেন। বেপরোয়া ফ্র্যাঙ্কের মাঝে যখন কোন পরিবর্তন আসে না, তখনি বিরক্ত হয়ে ঈশ্বর “ধু-উ-রো শালা” বলে দুসরাবার বেলে আঙুল বসিয়ে দেন। একইভাবে, নিক যখন বলা নেই কওয়া নেই নিজের বাড়ীতেই গুরুতর আহত হয়, তখনও তিনি নিকের জন্য প্রথম বেলটা বাজান, কিন্তু বোকা নিকের মাথাতেই আসেনি তার আদরের বউ ফ্র্যাঙ্কের সাথে একাট্টা হয়ে তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে পারে। ফলাফল, আবারো “ধু-উ-রো শা-আ-লা”...

কাম্যু যে তাঁর আউটসাইডার সরাসরি পোস্টম্যান থেকেই বেশ অনেকখানি ছেপে দিয়েছেন সে তো জানতেই পেলাম। তবে প্লট, উপন্যাসের বয়ানভঙ্গি ইত্যাদি বাহ্যিক সব মিলের ব্যাপারটা নিতান্তই গৌণ। কাম্যু'র ম্যার্সো (Mersault), কেইনের ফ্র্যাঙ্ক, ইভান তুর্গেনেভের বাজারভ (ফাদারস অ্যান্ড সান্স), এবং মিখাইল লেরমন্তভের পেচোরিন (আ হিরো অফ আওয়ার টাইম)- এই ৪ জন নায়কই একে অপরের প্রতিভূ। চরম অস্তিত্ববাদী এই ৪ নায়ককে এক শব্দে বর্ণনা করতে গেলে বেশীরভাগ মানুষই হয়তো asshole-শব্দটি ব্যবহার করবেন। আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস, এই ৪ মহা মস্তান লেখক তাঁদের এই বইগুলো আমাদের জন্য সতর্কতাবাণী হিসেবে লিখে গেছেন, যেগুলোর সারকথাঃ সব যুগের, সব পরিস্থিতিরই একটি সীমারেখা থাকে, আপনি যতই দুর্বিনীত হন, যত বড় বেয়াদবই হন না কেন, আপনাকে আপনার সময়ের/ ভূখণ্ডের/ জাতির বেয়াদবীর সর্বোচ্চ সীমাটির মাপ জানতে হবে, তা নইলে কর্কশ কলিং বেলের বিচ্ছিরি ঘ্যাড়াং ঘ্যাড়াং আওয়াজটি দ্বিতীয়বার শোনা অনিবার্য।

কর্মফলে যাঁদের বিশ্বাস, তাঁরা হয়তো বলবেন, কৌটোয় যতখানি বেয়াদবী সঞ্চিত আছে, তার এদিক ওদিক করবার উপায় নেই, তাই এইসব সতর্কতাবাণী আমাদের কোন কাজে আসবে না। তাঁদের যাঁরা বিরোধী শিবির, সেই ইসলামিক বিশ্বাসের অনুসারীরা এক হাসিতেই বেদ-বেদান্ত আর কাম্যু-কেইন-লেরমন্তভদের উড়িয়ে দেবেন। তাঁরা বলবেন, ওপরওয়ালা যে দু'বার করে বেল চাপেন তা জানতে কি আর এত রকম বই পড়তে হয় নাকি? আমাদের এক বইতেই সব বলা আছেঃ

আর তিনি যদি মানুষকে তাঁদের সীমালঙ্ঘনের জন্য শাস্তি দিতেন তবে ভূপৃষ্ঠে কোন জীব-জন্তুকেই রেহাই দিতেন না; কিন্তু তিনি এক নির্দিষ্ট কাল পর্যন্ত তাদেরকে অবকাশ দিয়ে থাকেন। অতঃপর যখন তাঁদের সময় আসে তখন তাঁরা মুহুর্তকাল আগাতে বা পিছাতে পারেনা”, সূরা নাহল, ৬১
2022-12-09T00:00:00.000Z
Your Inner Fish

Your Inner Fish

By
Neil Shubin
Neil Shubin
Your Inner Fish

“মানুষ কোথা থেকে এলো”- এ প্রশ্নটি তো আমাদের সব্বাইকেই একবার না একবার বিব্রত করেছেই। ধর্মগ্রন্থের সরল ব্যখ্যা যাঁরা মেনে নিতে চান না, তাঁদের জন্য তো প্রশ্নটি আরো বেশী বিব্রতকর! বিজ্ঞানের ব্যখ্যা যাঁরা মানতে নারাজ, তাঁরা “বিজ্ঞান বলে মানুষ বাঁদর থেকে এসেছে” বলে একটি অপপ্রচার চালান। বিজ্ঞান যে দাবীটি মূলত করে সেটি হলো বাঁদর ও মানুষ একই পূর্বপুরুষ থেকে বিবর্তিত হয়ে এসেছে। বাঁদর আমাদের মানুষদের “বাবা” নয়, “খালাতো”/ “চাচাতো”/ “মামাতো” ভাই-বোন। তাহলে এই সব cousin-গোত্রীয় প্রাণীদের common যে পূর্বপুরুষ, সেই “পরদাদা” প্রাণীটি কোনটি? এর উত্তর লুকিয়ে আছে ৩৭৫ মিলিয়ন বছর পুরনো ফসিলে। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নেইল শ্যুবিন ডাঙায় চলাচলকারী সকল মেরুদণ্ডী প্রাণীদের “পরদাদা” যে প্রাণীটি, তার ফসিলের সন্ধান পেয়েছিলেন ২০০৪ সালে। সেই চমকপ্রদ আবিষ্কার নিয়েই তাঁর বই “ইওর ইনার ফিশ”, যা আপনাকে আপনার অভ্যন্তরীণ মাছটির সন্ধান দেবে!


ফসিল শিকারী বিজ্ঞানীরা কোন নির্দিষ্ট সময়ের ফসিল কীভাবে খুঁজে বের করেন? তাঁরা কি চোখ বন্ধ করে ‘অপু দশ বিশ তিরিশ চল্লিশ' জপে আন্দাজে খোঁড়াখুঁড়ি শুরু করে দেন? উত্তরটা অবশ্যই ‘না'। মাটির নিচে ফসিলকৃত শিলা আসলে সময়কাল অনুযায়ী স্তরে স্তরে সুবিন্যাস্ত থাকে; যে শিলা (বা ফসিল) পৃথিবীর যতো গভীরে, তা ততো প্রাচীন। ওপরের স্তরগুলোতে ওঠার সাথে সাথে নতুনতর শিলা এবং ফসিলের দেখা মিলতে থাকে। এ ব্যাপারটি যে সবসময়ের জন্যই অমোঘ সত্য তা ঠিক নয়; ভৌগোলিক অবস্থান ভেদে শিলার স্তরবিন্যাসে পার্থক্য থাকতেই পারে। বিশেষতঃ বিলিয়ন বিলিয়ন বছরের চাপ ও তাপে আগের পরের অনেক শিলাস্তর মিশে একাকার হতেই পারে, তবে এর ভেতর থেকেও সঠিকভাবে সময়কাল অনুযায়ী স্তরগুলোকে আলাদা করা সম্ভব।

যে কোন শিলায়ই কি তবে ফসিল থাকে? এর উত্তরও ‘না'। ফসিল সংরক্ষণের জন্য আদর্শ শিলা মূলত চার রকমঃ চুনাপাথর (limestone), বেলেপাথর (sandstone), পাললিক শিলা (siltstone), এবং অপেক্ষাকৃত নরম শিলা যা শেইল (shale) নামে পরিচিত। এ ধরণের শিলা গঠিত হয় মূলত নদী, সমুদ্র, বা হ্রদের গতিপথের কারণে। প্রাণের বিকাশ ও বিস্তার এমন পরিবেশে হবে সেটিই স্বাভাবিক। পাললিক প্রক্রিয়ার কারণেও এ ধরণের শিলাতে ফসিল প্রাকৃতিকভাবে সংরক্ষিত থাকে শত শত মিলিয়ন বছর ধরে। বিপরীতে, আগ্নেয় শিলা (volcanic rock) এবং রুপান্তরিত শিলা (metamorphic rock) মূলত পৃথিবীর অভ্যন্তরে প্রচন্ড তাপ ও চাপে তৈরী হয়, এমন পরিবেশে প্রাণের বিকাশ না হবার সম্ভাবনাই বেশী, তাই ফসিল শিকারীরা সে পথ বেশী একটা মাড়াননা। মূলত জনপ্রাণহীন বিরান অঞ্চলগুলোতেই সবচেয়ে ভালোভাবে সংরক্ষিত ফসিলগুলো পাওয়া যায়; মরু বা মেরু অঞ্চলে যেহেতু গাছপালা নেই, মনুষ্য নির্মিত দালানকোঠা, গাড়ী-ঘোড়া নেই, মিলিয়ন মিলিয়ন বছর ধরে ফসিলগুলো তাই দিব্যি অবিকৃত থাকতে পারে। সাহারা, গোবি, ইউটাহ ইত্যাদি উষ্ণ মরু অঞ্চল তো বটেই, উত্তর গোলার্ধের তুষার মরুও (arctic desert) ফসিল শিকারের জন্য আদর্শ জায়গা।

শ্যুবিন এ বইয়ের প্রথম অধ্যায়ে বর্ণনা করেছেন আর্ক্টিকের প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় কী অমানুষিক কষ্ট সহ্য করে তাঁরা শিলা সংগ্রহ করেছেন। পদে পদে মেরু ভালুকের আক্রমণের আশঙ্কা, রসদ ফুরিয়ে যাবার ভয়, তুষার ঝড়ে আটকা পড়ে হারিয়ে যাবার চিন্তা...এমন হাজারো বিপদ মাথায় নিয়ে মানুষের বিজ্ঞানযাত্রাকে ঋদ্ধ করার কাজটি এঁরা করে গেছেন নাক মুখ গুঁজে। গোটা বছরের হাতেগোণা অল্প ক'টা দিনেই শুধু আর্ক্টিকে কাজ করা সম্ভব। একদিন এদিক ওদিক হলেই খারাপ আবহাওয়ার খপ্পরে পড়তে হয়। যে ভয়ানক দুর্গম খাড়া পাহাড়ী অঞ্চলে শ্যুবিন ও তাঁর গবেষক দলকে হেলিকপ্টার নামিয়ে দিয়ে যায়, সেখান থেকে নিকটতম বেইস ২৫০ মাইল দূরে। হেলিকপ্টার কতখানি ওজন বইতে পারবে তারও ধরাবাঁধা সীমা আছে, চাইলেই বড় এক টুকরো শিলা ভেঙে নিয়ে চলে আসা যায় না। বরফশীতল পরিবেশে জীবন হাতের মুঠোয় ধরে ছোট একটি হাতুড়ি দিয়ে টুকটুক করে বাছাই করা শিলা কেটে চলা...এ মোটেই কোন সহজ কাজ নয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, শত শত মাইল জুড়ে শুধু বরফ দেখে যাওয়াটাও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য খুব সুখকর কিছু নয়। বিরান এই অঞ্চলে কোন গাছপালা বা বাড়ীঘর যেহেতু নেই, দূরত্বের ঠাহরও পাওয়া যায় না; চোখে ধাঁধা লাগে, ১ মাইল আর ৫ গজ দূরের পার্থক্য নির্ণয় করতে পারে না মানব মস্তিষ্ক। এইসব প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে, ১৫০০ কিলোমিটার জুড়ে ছড়িয়ে থাকা শিলা ঘেঁটে, ৩ বার ব্যর্থ প্রচেষ্টার পর শেষতক কাঙ্ক্ষিত সেই ফসিল উদ্ধার করে শ্যুবিনের দল; মানবজাতির উদ্ভব ও বিকাশের ব্যখ্যা অনেকটাই লুকিয়ে আছে যেখানে।

২০০৪ সালে শ্যুবিনরা ৩৭৫ মিলিয়ন বছর পুরনো যে ফসিলটি খুঁজে পান, সেটির নাম রাখা হয় টিকটালিক; ইনুকটিউট ভাষার এই শব্দটির অর্থ ‘মিঠাপানির বড় মাছ'। এই আবিষ্কারটি এত গুরুত্বপূর্ণ, এর কারণ, বেশ কিছু দিক থেকেই প্রাণীটি অনন্য। আমরা জানি, মাছের ঘাড় থাকে না; তাদের মাথা এবং কাঁধ একসাথে জোড়া লাগানো থাকে কয়েকটি হাড়ের সংযোগে। টিকটালিকের আগের সময়ের যতো মাছের ফসিল পাওয়া গেছে, সেগুলোর কোনটিতেই ঘাড় নেই; চলার পথে বাঁক নিতে গেলে গোটা শরীরের সাথে মাথাটাও এদের ঘোরাতে হতো। একমাত্র টিকটালিকেই ঘাড়ের সন্ধান পাওয়া যায়; এরা শরীর না বাঁকিয়েও মাথা ঘোরাতে পারতো (যেমনটা আমরা পারি)। আমাদের পাশাপাশি এই বিশেষত্বটি আছে উভচর, সরিসৃপ, পাখি, এবং স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মাঝেও।

মাথা এবং ঘাড়ের এই ‘নতুন' বিন্যাস আরো অনেকগুলো দরজা খুলে দেয়। ১৮০০ সালের মাঝামাঝি সময়ে বিখ্যাত অ্যানাটমিস্ট স্যার রিচার্ড ওয়েন বিভিন্ন প্রাণীর শরীর ব্যবচ্ছেদ করে প্রানী জগতের একটি ‘নীলনকশা' আবিষ্কার করলেন। ‘হাত' এবং ‘পা' সংবলিত সকল প্রাণীরই এই প্রত্যঙ্গগুলো আসলে একই ছাঁচে গঠিত। আমাদের জন্য যা ‘হাত' এবং ‘পা', প্রাণীবিশেষে তা কখনো ডানা, কখনো হাত, কখনোবা সাঁতার কাটার ফ্লিপার। প্রত্যঙ্গগুলোর গঠনের দিকে তাকালে আমরা একটি সূত্রই দেখতে পাই সবার ক্ষেত্রেঃ প্রথমে একটি হাড় (হাতের ক্ষেত্রে হিউমেরাস, পায়ের ক্ষেত্রে ফিমার), এরপর দু'টি হাড় (হাতের ক্ষেত্রে রেডিয়াস এবং আলনা ও পায়ের ক্ষেত্রে টিবিয়া এবং ফিবুলা), আর সবশেষে একগোছা ছোট ছোট হাড় (আঙুল)। ওয়েনের এ আবিষ্কারের কিছুদিন পরই ডারউইন তাঁর বিবর্তনবাদের তত্ত্বটি সামনে আনেনঃ এই প্রাণীগুলোর গঠন-প্রকৃতি একরকম কারণ, এদের সবারই উৎপত্তি একই পূর্বপুরুষ থেকে। সোজা বাঙলায়, এই প্রাণীরা সবাই একে অপরের চাচাতো/ জ্যাঠাতো / ফুপাতো ভাই-বোন!

টিকটালিকের অন্যতম প্রধান একটি বৈশিষ্ট্য হলো, মাছটির হাত-পায়ের মতো প্রত্যঙ্গ ছিলো, যেটি এর আগের কোন মাছে দেখা যায়নি। শুধু তাই-ই নয়, হাড়ের কাঠামো সাক্ষ্য দেয় মাছটি রীতিমতো বুকডনও দিতে পারতো! বুকডন দেবার সময় আমাদের কনুই ভাঁজ হয়ে আসে, বুকের পেশীগুলোর সংকোচন প্রসারণের মাধ্যমে আমরা নিজেদের ধাক্কা দিয়ে ওপরে নিচে ওঠানামা করাতে পারি; টিকটালিক এর সবই করতে পারতো। আমরা যে কনুই সোজা রেখেও ওপরে নিচে ইচ্ছেমতো বুড়ো আঙুলটা নাড়াতে পারি, এর কারণ, আমাদের হিউমেরাস ও রেডিয়াসের সংযোগস্থলে থাকা কোটরসন্ধিটি (ball-socket joint)। ভাত বা ডালের বাটি থেকে হাতা দিয়ে তুলে পাতে ঢালতে আমরা দু'টি বিপরীত ভঙ্গিতে হাত ঘোরাইঃ supination (বাটি থেকে ভাত তোলা) ও pronation (পাতে ভাত ঢালা)। হিউমেরাস ও রেডিয়াসের কোটরসন্ধির এ গঠনটি টিকটালিকের মাঝেই প্রথম দেখা যায়, এর আগের কোন প্রাণীতে এমন কোন বৈশিষ্ট্য ছিলো না।

টিকটালিকের সাথে আমাদের বাহ্যিক গঠনগত বৈশিষ্ট্যগুলোর পর এবার একটু অন্যদিকে চোখ ফেরানো যাকঃ জিনতত্ত্ব! ১৯৫০ এবং '৬০-এর দশকে বিজ্ঞানীরা মুরগীর ভ্রুণের ওপর গবেষণা চালানো শুরু করেন। তাঁরা মূলত ভ্রুণের এক অংশ থেকে টিস্যু অপসারণ করে অন্য অংশে প্রতিস্থাপন করলে এর ফলাফল কী দাঁড়ায় তা-ই দেখতে চাইছিলেন। আমাদের হাতে বা পায়ে যেমন বুড়ো আঙুল থেকে কনিষ্ঠা পর্যন্ত ৫টি হাড়ের ভাগ রয়েছে, পাখির ডানাতেও তেমনি অনেকগুলো ভাগ রয়েছে, বোঝার সুবিধের জন্য যেগুলোকে আমরা বৃদ্ধাঙুল, তর্জনি, মধ্যমা, অনামিকা, কনিষ্ঠা ইত্যাদি হিসেবে কল্পনা করে নিতে পারি। ভ্রুণের টিস্যু গ্র্যাফটিং-এর গবেষণায় দেখা গেলো, যে টিস্যুটি পাখির ডানার ‘কনিষ্ঠা' গঠন করে, সেটিকে যদি বিপরীত পাশের ডানার টিস্যুতে প্রতিস্থাপন করে হয়, তাহলে সেখানে স্বাভাবিক ডানাটির গঠন তো হয়ই, সাথে সাথে বিপরীত যে পাশের ডানা থেকে টিস্যু নিয়ে আসা হলো, সে অংশের পূর্ণ একটি ডানাও গজিয়ে যায়। এই টিস্যুটির নাম দেয়া হয় জোন অফ পোলারাইজেশন অ্যাকটিভিটি (জিপিএ)। ডানা বা হাতের বৃদ্ধাঙুলের গঠন যে কনিষ্ঠার চেয়ে ভিন্ন তার জন্য দায়ী এই জিপিএ। এই পরীক্ষাগুলো থেকে বিজ্ঞানীরা উপসংহার টানলেন, এই জিপিএ থেকে কিছু একটা নিশ্চয়ই নিঃসরিত হয়, যা আঙুলগুলোর গঠন কেমন হবে তা নিয়ন্ত্রণ করে (স্পয়লারঃ জিন!)।

মুরগীর ভ্রুণের ওপর চালানো এ গবেষণা নতুন দুয়ার খুলে দেয়। বিজ্ঞানীরা শিগগীরই আবিষ্কার করলেন, মাছির একটি বিশেষ জিন রয়েছে, যা মাছির শরীরের বিভিন্ন অংশকে বিভিন্ন গঠন-রূপ দেয়; জিনটির নাম দেয়া হয় হেজহগ। মাছির পর এবার মুরগীর ওপর পরীক্ষা করেও হেজহগ জিনটির খোঁজ পাওয়া গেলো, তবে সেটি মুরগীর নিজস্ব সংস্করণ, যার নাম দেয়া হয় সনিক হেজহগ। গবেষণায় দেখা গেলো, হাত/ পা (limb) সংবলিত যেকোন প্রাণীরই যেখানেই জিপিএ টিস্যুটি রয়েছে, সেখানেই কেবল হেজহগ জিনটি কাজ করে। মাতৃগর্ভে থাকবার সময় অষ্টম সপ্তাহে যদি এই হেজহগ জিনটি তার কাজ করা শুরু না করতো, তাহলে হয়তো আপনার বাড়তি কিছু আঙুল থাকতো, কিংবা আপনার বৃদ্ধাঙুল আর তর্জনি হয়তো দেখতে একই রকম হতো। হাত/ পায়ের গঠন, প্রতিটি আঙুলের আকারের ভিন্নতা, ডান দিক-বাঁ দিকের প্রতিসমতা-এই সবকিছুই নিশ্চিত করে হেজহগ জিন। মুরগী, ব্যাঙ, ইঁদুর...হাত/ পা সংবলিত যে কোন প্রাণীর ডিএনএ রেসিপি আদতে আসলে একই।

সনিক হেজহগ জিনটি যেহেতু হাত/পা সংবলিত প্রাণীদের হাড়ের কাঠামো গঠন করে, তাহলে যেসব প্রাণীতে হাড়ের গঠন একেবারেই ভিন্ন, তাদের ক্ষেত্রে কী হয়? তখনও কি সনিক হেজহগ কাজ করে? ইঁদুর, মুরগী, ব্যাঙ, বাদুড়-“একইরকম” হাড়ের কাঠামোর এসব প্রাণীদের বেলায় সনিক হেজহগের একই ভূমিকা আবিষ্কার করবার পর বিজ্ঞানীরা এবার গবেষণা শুরু করলেন হাঙর নিয়ে। হাড়ের কাঠামোর দিক দিয়ে হাঙর এবং সমগোত্রীয় মাছেরা (যেমন স্কেইট) আমাদের চেয়ে কিছুটা ভিন্ন। আমাদের কঙ্কালের কাঠামোটি যেমন বয়েস বাড়বার সাথে সাথে শক্ত হাড়ে পরিণত হয়, হাঙরদের ক্ষেত্রে তা ঘটেনা; তাদের কাঠামোটি আজীবন নরম কার্টিলেজের-ই রয়ে যায়, যে কারণে এদের কার্টিলেজিনাস মাছ বলা হয়। পরীক্ষায় দেখা গেলো এই কার্টিলেজসর্বস্ব হাঙরদেরও (কিংবা স্কেইটদের) একটি ‘হাঙর সনিক হেজহেগ জিন' (স্কেইটদের বেলায় স্কেইট সনিক হেজহগ জিন) রয়েছে।

এর মানে কি হাঙর/ স্কেইট ইত্যাদি কার্টিলেজিনাস প্রানীদের চেয়ে আমরা একেবারেই ভিন্ন? স্কেইটের পাখনায় হাড়ের যে রডগুলো রয়েছে, তা সবই দেখতে একইরকম (আমাদের হাতের পাঁচটি আঙুলই যদি দেখতে একই রকম হতো, তেমন)। এমন কোন উপায় কি আছে যাতে ভিন্ন কোন সনিক হেজহগের মাধ্যমে এই রডগুলোর আকারে ভিন্নতা আনা যায়? স্কেইটের ভ্রুণে ইঁদুরের সনিক হেজহগ প্রবেশ করিয়ে একটি পরীক্ষা করা হলো। এই পরীক্ষার দু'টি ফল হতে পারেঃ এক. কিছুই হবে না, সেক্ষেত্রে বোঝা যাবে স্কেইট বা হাঙরেরা আমাদের চেয়ে একেবারেই ভিন্ন প্রাণী, আমাদের মাঝে কোনই সম্পর্ক নেই, আর দুই. যদি স্কেইটের মতো একটি মাছের ভ্রুণে ইঁদুরের মতো একটি স্তন্যপায়ী প্রাণীর জিন কাজ করে, যদি স্কেইটের পাখনার রডগুলো ভিন্ন ভিন্ন আকারে গঠিত হয়, তাহলে বোঝা যাবে মাছ ও স্তন্যপায়ী প্রানী খুব আলাদা কিছু নয়, মাছের ডিএনএ নতুন কোন ডিএনএ নয়; আদিমতম ডিএনএ'র অভিযোজিত একটি সংস্করণ মাত্র। এবং, কার্যতই, সে পরীক্ষায় দেখা যায় ইঁদুরের হেজহগ জিন স্কেইটের রডগুলোকে হাতের পাঁচ আঙুলের মতো ভিন্ন ভিন্ন আকার দিয়েছে। হাঙরের সাথে আমাদের আত্নীয়তার একটি সংযোগ এবার প্রতিষ্ঠিত হলো!

হাড় নিয়ে হড়বড় করে এত্তগুলো কথা খর্চা করে ফেললাম, প্রাণীজগতে এই হাড়ের উৎপত্তিটা কোথায়? মেরুদণ্ডে? চোয়ালে? নাকি শরীরের বাহ্যিক আস্তরণে? অনেকের কাছেই আশ্চর্য ঠেকবে, কিন্তু সত্যিটা হচ্ছে হাড়ের উৎপত্তি আসলে দাঁতে! ১৮৩০-এর দিকে ২৫০ থেকে ৫০০ মিলিয়ন বছরের পুরনো কিছু প্রাচীন সামুদ্রিক প্রাণীর ফসিলের খোঁজ পাওয়া যায়, এদের নাম দেয়া হয় কনোডন্টস। ছোট আকৃতির নরম শরীরের এই প্রাণীগুলোতে একধরণের শক্ত শক্ত কাঁটার দেখা মেলে যা বাইরের দিকে মেলে থাকে। এই কনোডোন্টসরা যে আসলে কী, সে নিয়ে বিজ্ঞানীরা অনেকদিন তর্ক করেছেন; কেউ বলেছেন এরা উদ্ভিদ, কেউ বলেছেন এরা আসলে প্রাকৃতিক মিনারেল, আর অল্প কেউই এরা যে প্রানী তার পক্ষে রায় দিয়েছেন। এই রহস্যের সমাধান হয় যখন ল্যাম্প্রে নামক এক ধরণের আদিম মাছের সন্ধান মেলে। চোয়াল বিহীন এই ল্যাম্প্রে মাছগুলো অন্য মাছের গায়ে আটকে থেকে সে মাছের তরল অংশটুকু চুষে খেয়ে নিতো। ল্যাম্প্রের ফসিলে কনোডোন্টস-এর সেই ধারালো কাঁটা দেখতে পাওয়া যায়।


ছবি সূত্রঃ উইকিপিডিয়া

যে উপাদানটির উপস্থিতি দাঁতকে অত শক্ত বানায় সেটিকে বলে হাইড্রক্সিঅ্যাপেটাইট। হাইড্রক্সিঅ্যাপেটাইট এতটাই শক্ত যে মিলিয়ন মিলিয়ন বছর পরেও তা ফসিলে অবিকৃত থাকে, এবং ফসিলের দাঁত থেকে বুঝে নেয়া যায় প্রাণীটি মাংসাশী ছিলো নাকি উদ্ভিদ্ভোজী (মাংসাশী প্রাণীর দাঁত সূক্ষ্ম, ধারালো ও সূঁচালো হয়, মাংস কেটে বসবার জন্য; উদ্ভীদ্ভোজীর দাঁত হয় সমান, যাতে তা সহজে বাদাম জাতীয় ফল ভেঙে ফেলতে পারে)। কনোডন্টস-এর দাঁতে পাওয়া হাইড্রক্সিঅ্যাপেটাইট ইঙ্গিত করে, প্রাণীজগতে হাড়ের উদ্ভব প্রতিরক্ষার জন্য নয়, খেয়ে পরে বেঁচে থাকবার জন্য! শ্যুবিন মন্তব্য করেছেন, প্লাস্টিক উদ্ভাবনের পর যেমন গাড়ীর কলকব্জা থেকে শুরু করে ইয়ো ইয়োতে তা ব্যবহৃত হয়েছে, দাঁতের ব্যাপারটাও ঠিক অমনি। যখনই খেয়ে বেঁচে থাকবার জন্য প্রাণীকুলে দাঁতের উৎপত্তি ঘটেছে, পরিপার্শ্ব এবং অবস্থানের প্রেক্ষিতে অভিযোজিত হয়ে হয়ে এ দাঁত আস্তে আস্তে অন্যান্য অঙ্গের জন্ম দিয়েছে; দাঁত না থাকলে শরীরে আঁশ, পালক, বা স্তন এসবের কিছুই নাকি হতো না!

হাঙরের সাথে আমাদের আত্নীয়তার কথা তো একটু আগেই জেনেছি। হাঙর ও মানুষের ভ্রুণের দিকে নজর ফেরালে বেশ কিছু মিল চোখে পড়ে। উভয় ক্ষেত্রেই চোয়াল গঠিত হয় ভ্রুণের ৪টি খাঁজের প্রথমটি থেকে (ছবির arch 1)



হাঙরের সাথে পার্থক্য হলো, মানুষের বেলায় প্রথম এ খাঁজটি থেকে চোয়ালের পাশাপাশি কানের কিছু হাড়ও গঠিত হয়, হাঙরের বেলায় তা হয় না। হাঙরের ভ্রুণে দ্বিতীয় খাঁজের কোষগুলো বিভাজিত হয়ে কার্টিলেজ ও পেশী গঠন করে, মানুষের বেলায় মধ্য কান ও গলার কিছু গুরুত্বপূর্ণ অংশ তৈরী করে, যার মাঝে অন্যতম হাইওয়েড নামের ছোট হাড়টি। ঢোঁক গেলা, গান শোনা এই কাজগুলো আমরা করতে পারি এই হাইওয়েডের জন্যই। বস্তুতঃ মাছ, সরিসৃপ, ও স্তন্যপায়ী-সব্বার ক্ষেত্রেই ভ্রুণ গঠিত হয় তিনটি স্তর থেকে, যাদের জার্ম লেয়ারস বলা হয়। প্রতিটি মেরুদণ্ডী প্রাণীর ক্ষেত্রেই-যতই তারা ভিন্ন হোক-হৃৎপিণ্ড গঠিত হয় এই জার্ম লেয়ারের একই স্তর থেকে, মস্তিষ্ক গঠিত হয় আরেকটি ভিন্ন স্তর থেকে।

জার্ম লেয়ারের এই তিনটি স্তরের নাম যথাক্রমে এক্টোডার্ম, এন্ডোডার্ম, ও মেসোডার্ম। এক্টোডার্ম গঠন করে চামড়া ও স্নায়ুতন্ত্র। ভেতরের স্তর এন্ডোডার্ম গঠন করে পরিপাকতন্ত্র, আর মাঝের স্তর মেসোডার্মের কাজ আমাদের হাড় ও পেশী তৈরী করা। এই ব্যবস্থাটিকে অনেকটা একটি টিউবের ভেতর আরেকটি টিউব হিসেবে দেখা যায়। এ ব্যাপারটি কেন এত গুরুত্বপূর্ণ? ১৯২০-এর দশকে হিল্ডে ম্যানগোল্ড একটি পরীক্ষা করেন; তিনি স্যালামান্ডারের একটি ভ্রুণে অন্য প্রজাতির একটি প্রাণীর জার্ম লেয়ারের একটি টিস্যু লাগিয়ে দেন। এ কাজটি করবার জন্য যে হাতের ওপর দুর্দান্ত নিয়ন্ত্রণ থাকা প্রয়োজন সে তো বলা বাহুল্য। স্যালামান্ডারের গোলাকার এই ভ্রুণের ব্যাস ছিলো ১ ইঞ্চির ১/১৬ ভাগ! হিল্ডের পরীক্ষায় দেখা গেলো অন্য প্রাণী থেকে এনে জোড়া লাগিয়ে দেয়া সেই টিস্যুর বরাতে যমজ স্যালামান্ডারের জন্ম হয়েছে! এই টিস্যুটিকে পরবর্তীতে অরগ্যানাইজার নাম দেয়া হয়। জিন প্রকৌশলে এটি সম্ভবত আজতক সবচেয়ে বড় আবিষ্কার; স্তন্যপায়ী, মাছ, পাখি, সরিসৃপ-সবারই অরগ্যানাইজার আছে। কাট, স্লাইস, অ্যান্ড ডাইস; মুরগীর অরগ্যানাইজার কেটে এনে স্যালাম্যান্ডারের ভ্রুণে লাগিয়ে দিন, ব্যাস, পেয়ে গেলেন যমজ স্যালাম্যান্ডার!


ছবিসূত্রঃ Know your meme

পৃথিবীর বয়েস সাড়ে ৪ বিলিয়ন বছর। আধুনিক মানুষের আবির্ভাব মাত্রই লাখখানেক বছর আগে। এই গোটা সাড়ে ৪ বিলিয়ন বছরকে যদি এক বছরে প্রকাশ করতে হয়, ১ জানুয়ারী থেকে ৩১ ডিসেম্বর, তাহলে জুন মাসেই কেবল এককোষী প্রাণীরা এলো। মাথা ওয়ালা প্রাণীদের আবির্ভাব অক্টোবরে, আর মানুষের আবির্ভাব আজকের দিনে, ৩১ ডিসেম্বরে। অসম্ভব লম্বা একটি রাস্তা পেরিয়ে, বহু বহু পরিবর্তনের বাঁকে ঘুরে তবে মানুষ আজ আজকের এই অবস্থায় এলো। পানির মাছেদের বিবর্তন ঘটে ঘটে, তাদের বহু বৈশিষ্ট্য নিয়ে দিয়ে থুয়ে ডাঙার আমরা আজ মঙ্গলে উপগ্রহ পাঠাচ্ছি। এই বই লিখে নেইল শ্যুবিন মূলত দু'টি বিষয়ের দিকে ইঙ্গিত করেছেন। প্রথমত, আমরা সব প্রাণীরাই একে অপরের আত্নীয় কোন না কোনভাবে। কুমির, বাদুড়, বিড়াল, পাখি, মাছ, বাঁদর-এরা সবাই আসলে একটু একটু আমরা, আর আমরা একটু একটু ওরা। এ ব্যাপারটিকে অনুধাবন করতে না পারলে “মানবিকতা” আমাদের কাছে সবসময়ই অভিধানের একটি আলঙ্কারিক শব্দ হয়ে থাকবে। কোন আসমানী কিতাব দিয়েই আমরা নিজেদের মানবিক করে তুলতে পারবো না।

দ্বিতীয়ত, এই অসম্ভব বড় পরিবর্তনগুলোর হাত ধরে যে আজ আমরা মানুষ হলাম, সেই কনোডন্টস-এর প্রাথমিক দাঁত থেকে আজকের আমরা, এর পেছনের কারণটা হলো আমরা বিলিয়ন বিলিয়ন বছর ধরে ক্রমশঃ অবস্থা ও পরিপার্শ্বের সাপেক্ষে নিজেদের বদলেছি; আমাদের জন্মই হয়েছে গতিশীল থাকবার জন্য। আমরা যদি কোন শারীরিক পরিশ্রম না করি, নিজেদের জীবনকে ক্রমাগত পরিবর্তন করতে না থাকি, শুধুই সোফায় শুয়ে মুখে চিপস গুঁজে নেটফ্লিক্স-বিলাস করতে থাকি, বিবর্তনের উল্টো রাস্তায় হেঁটে আমরা ডোডো পাখির মতোই বিলীন হয়ে যাবো। দূর সম্পর্কের এক জ্যাঠাতো ভাইয়ের হঠাৎ অন্তর্ধানে প্রাণীজগতের কারোরই তাতে কিছুই এসে যাবে না।

2022-10-31T00:00:00.000Z
Saint Joan

Saint Joan

By
George Bernard Shaw
George Bernard Shaw
Saint Joan

“জাতীয়তাবাদ হলো হামের মতো চরম ছোঁয়াচে একটি রোগ, যাতে মানবজাতি শিশুকাল থেকেই আক্রান্ত হতে শুরু করে।”
-আলবার্ট আইনষ্টাইন

“নিজের সাথে নিজেই যখন ক্রমাগত মিথ্যা কথা বলে আর অভিনয় করে করে ক্ষমতার প্রতি নিজের লোভটিকে জায়েজ করে নিতে হয়, সেটিই তখন জাতীয়তাবাদ হয়ে দাঁড়ায়।”
-জর্জ অরওয়েল

“যে সকল জাতির জাতীয়তাবাদের অনুভূতিটি ভোঁতা হয়ে গেছে, তাদের ধ্বংস অনিবার্য।”
-মুয়াম্মার গাদ্দাফি

জাতীয়তাবাদ কি ভালো? নাকি খারাপ? এক কথায় এর উত্তর কি দেয়া যায়? না বোধহয়। ২০২২ সালে আজকের দিনে দাঁড়িয়ে ভূগোলকের দিকে তাকালে শ'দুয়েকের ওপর দেশের নাম দেখতে পাই; এই দেশগুলোর অধিবাসীরা নিজের নিজের চাহিদা আর রুচি মোতাবেক ভূপৃষ্ঠের ওপর কাটাকুটি করে নিজের নিজের এলাকা ভাগ করে নিয়েছেন। এই ভাগাভাগি করার কাজটা এঁরা করেছেন মূলত ধর্ম নইলে ভাষার ভিত্তিতে। ব্রিটিশরা ধর্মের ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তান বানিয়ে দিয়ে গিয়েছিলো, সেখান থেকে ভাষার ভিত্তিতে পরবর্তীতে বাঙলাদেশ হলো। ভাষার ভিত্তিতে নিজেদের স্বতন্ত্র দেশ গড়ার এমন নজির পৃথিবীতে খুব বেশী একটা নেই। বাঙলাদেশ তো পৃথিবীর নবীনতম দেশগুলোর একটি; যে দেশগুলো শত শত বছর ধরে পৃথিবীর মানচিত্রের শোভাবৃদ্ধি করে চলেছে, সেগুলোর প্রায় সবক'টিরই সৃষ্টি হয়েছে ধর্মকে কেন্দ্রে রেখে। প্রথমে ধর্ম, এরপর জাতীয়তাবাদের চেতনা প্রাচীন এই দেশগুলোর ভিত্তিটা গড়ে দিয়েছে। জাতীয়তাবাদের সাথে ধর্মবিশ্বাস সবসময়ই দারুণভাবে মিশে যায় কারণ, দুটি মতবাদই নিজেকে অপরের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ভাবতে শেখায়।

ধর্মবিশ্বাসের ব্যাপারটিকে আজকের এই দিনে খুব খেলো ঠেকতে পারে অনেকের কাছেই। মনে হতে পারে, এ শুধুই দুর্বল ও বুনো অসভ্য মনের শিশুতোষ কল্পনা। কিন্তু এ কথা অস্বীকার করবার উপায় নেই যে পৃথিবীর বড় বড় পরিবর্তনগুলো ধর্মের হাত দিয়েই এসেছে। মিশর, গ্রীস কিংবা ভারতবর্ষের জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা তাঁদের নিজ নিজ ঈশ্বরের পূজার সময় নির্ধারণ করবার জন্য সেই কত হাজার হাজার বছর আগেই মহাকাশের মানচিত্র ছকে গেছেন, যার হাত ধরেই আজ জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ এলো। ওদিকে বাখ, মাইকেল এঞ্জেলোরা তাঁদের ঈশ্বর-পুত্রের বন্দনায় সুর ভেঁজেছেন, দেয়ালজুড়ে বিস্ময়কর ছবি এঁকেছেন। মাইকেল এঞ্জেলো থেকে বাখ, জোয়ান অফ আর্ক থেকে ইয়াহিয়া খান-রাজনীতি, ভাষাবিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞান, শিল্প, মানচিত্রবিদ্যা...প্রদায়ক হিসেবে ধর্ম কোথায় কাজ করেনি? এঁদের প্রত্যেকের ঈশ্বর হয়তো একে অপরের চেয়ে ভিন্ন, কিন্তু বিজ্ঞান বা শিল্পের অগ্রযাত্রায় ধর্মবিশ্বাসটাই কোন না কোনভাবে জ্বালানী হিসেবে কাজ করেছে সবার বেলায়ই।

জোয়ান অফ আর্ক ফ্রান্সের ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। কেউ যদি বলে বসেন আধুনিক ফ্রান্সের পথ চলা শুরুই হয়েছে জোয়ানের হাত ধরে, খুব একটা অত্যুক্তি বোধহয় হয় না তাতে। খুবই অস্থির এক সময়ে জন্ম জোয়ানের, যে সময়ে ফ্রান্স এবং ইংল্যান্ড একে অপরের সাথে জমির দখল নিয়ে ১১৬ বছর ধরে কামড়াকামড়ি করে চলেছে; ইতিহাসবিদেরা একে হান্ড্রেড ইয়ারস' ওয়ার বলে থাকেন (১৩৩৭-১৪৫৩)। ফ্রান্স এবং ইংল্যান্ড-উভয় দেশকেই আমরা আজ সভ্যতার অন্যতম ধারক ও বাহক বলেই জানি, তবে এই সভ্যতার হুঁশ তাদের একদিনে আসেনি। কতটা অসভ্য হলে ১১৬ বছর ধরে মারামারি করে যাওয়া যায় তার আন্দাজ পেতে হলে আমাদের এই মারামারির ইতিহাসের দিকেও একটু চোখ ফেরাতে হবে। ইতিহাসের এই কচকচানি বাদ দিলে জোয়ানের ভূমিকা আমাদের কাছে পরিষ্কার হবে না, হবে না জোয়ানকে নিয়ে লেখা বার্নার্ড শ-এর এ নাটকের এজেন্ডাটিও।

ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের শতবর্ষীয় এ যুদ্ধ শুরু হয় মুলত যখন ইংল্যান্ডের রাজা তৃতীয় এডওয়ার্ড ফ্রান্সের সিংহাসন দাবী করে বসেন। ১৩২৮ সনে ফ্রান্সের রাজা চতুর্থ চার্লস মারা যাবার পর ফ্রান্সের সিংহাসনের গদি গরম করবার জন্য উপযুক্ত কোন পুরুষ উত্তরাধিকার পাওয়া যাচ্ছিলো না। ৭ ছেলেমেয়ের বাবা চার্লসের একটি কন্যাসন্তান বাদে আর কেউই বেশীদিন বাঁচেনি। সেই ৯৮৭ সাল থেকেই ফ্রান্সে নিয়ম চলে আসছিলো, রাজার ছেলে রাজা হবে; রাজার পুত্রসন্তান না থাকলে নিকটতম পুরুষ আত্নীয়ের ওপর গদির ভার ন্যাস্ত হবে। ইংল্যান্ডের রাজা তৃতীয় এডওয়ার্ড ছিলেন এই চার্লসের বোন ইসাবেল অফ ফ্রান্স-এর ছেলে। তিনি দাবী করে বসলেন পুত্রহীন চার্লসের নিকটতম পুরুষ আত্নীয় যেহেতু তিনিই, ফ্রান্সের সিংহাসনটি এখন তাঁরই প্রাপ্য। মায়ের দিক থেকে আত্নীয়তার সূত্রে সিংহাসনের দাবীর কথা এর আগে ফ্রান্সে কেউ কোনদিন শোনেনি, শোনার প্রয়োজনও ছিলো না, কারণ আগের সব রাজারই গণ্ডায় গণ্ডায় পুত্রসন্তান ছিলো।

ফরাসী যে সংস্কৃতি, তার সাথে আরবীয় ধর্ম ইসলামের কোনই মিল নেই, বরঞ্চ অনেক ক্ষেত্রেই এ দুটির অবস্থান একে অপরের সম্পূর্ণ বিপরীতে, তবুও মধ্যযুগের ফ্রান্সের একটি নিয়মের সাথে ইসলামের একটি বিধানের আশ্চর্য সাদৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়ঃ নারী নেতৃত্বের অস্বীকৃতি। ইসলামী বিধানে যেমন নারীর প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি এসবের কিছুই হওয়া চলে না, মধ্যযুগের ফ্রান্সও ঠিক তেমনিভাবে নারীদের এসকল রাজকার্য থেকে বঞ্চিত রাখতো; নারী নেতৃত্ব'র ব্যাপারটি মধ্যযুগের ফরাসীদের কাছে কার্যত কল্পনার অতীত ছিলো। এডওয়ার্ড যখন তাঁর মায়ের সূত্রে ফ্রান্সের শাসনভার দাবী করেন, ফ্রান্স তা প্রত্যাখ্যান করে নারী নেতৃত্বের প্রতি তাদের ঐতিহাসিক অস্বীকৃতি থেকেই। যে আইনি বিধানটি ফরাসী আইন প্রণেতারা দেখান সেটির গালভরা ল্যাটিন নাম “Nemo plus juris ad alium transfere potest quam ipse habet”-সোজা বাঙলায় এর অর্থ দাঁড়ায়, “আপনার নিজের যে সামাজিক অবস্থান, তার চেয়ে উঁচু পদের কোন অবস্থানের দায়িত্ব আপনি কাউকে দিতে পারেন না” (এ নিয়মটি কি আমাদের দেশে এখনো বলবৎ আছে? এ নিয়মটির কারণেই কি সাধারণ জনগণ, ছাত্র, শিক্ষক, মজুর, রিকশাওয়ালারা ভোট দিয়ে আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত করতে পারে না? প্রধানমন্ত্রীর চেয়ে পদে বড় যেহেতু আর কেউই দেশে নেই, তাই তাঁর নিজেকেই নিজে নির্বাচিত করে নিতে হয়?)। ফ্রান্সের গদি না পেয়ে এডওয়ার্ড গোস্বা হয়ে ফ্রান্সকে ট্যাকশো দেয়া বন্ধ করে দেন, এতে ফ্রান্সের রাজা পাল্টা ক্ষিপ্ত হয়ে ইংল্যান্ডের কিছু জমিজমা দখল করে নেন। শুরু হয়ে যায় একশো বছরের কাজিয়া।

এডওয়ার্ডের দেখানো পথে তাঁর বংশধরেরা এই কাজিয়া চালিয়ে যায়। অবশেষে মারামারি শুরু হবার ৮৩ বছর পর ১৪২০ সালে ইংরেজরা ফরাসীদের একটি চুক্তির প্রস্তাব দেয়। চুক্তিমতে ইংরেজরা (ফরাসী) ষষ্ঠ চার্লসকে ফ্রান্সের রাজা হিসেবে মেনে নেয়, কিন্তু শর্ত জুড়ে দেয় চার্লসের মেয়ে-জামাই ইংল্যান্ডের রাজা পঞ্চম হেনরি হবে চার্লসের উত্তরাধিকারী। এই চুক্তির মাধ্যমে মূলতঃ চার্লসের পুত্র চার্লস জুনিয়রকে (যিনি পরবর্তীতে সপ্তম চার্লস হবেন) বঞ্চিত করার ব্যবস্থা করা হয়, এবং ফরাসী সিংহাসনটি যেন ইংরেজদের দখলেই যায় তা নিশ্চিত করা হয়। চুক্তিটি করবার অল্প কিছু পরেই চুক্তির কেন্দ্রে থাকা দুই চরিত্র ষষ্ঠ চার্লস এবং পঞ্চম হেনরি দুজনই ধরাধাম ত্যাগ করেন। ফ্রান্সের তখতে এবার এসে বসেন পঞ্চম হেনরির ৯ মাস বয়েসী পুত্র ষষ্ঠ হেনরি। এখানে বলে রাখা ভালো, এই ষষ্ঠ হেনরিই একমাত্র ইংরেজ রাজা যিনি দস্তুর মেনে ফ্রান্সেরও রাজা হন। এর আগে এবং পরে অনেক ইংরেজ রাজাই নিজেকে ফ্রান্সের রাজা ঘোষণা করেছেন, কিন্তু সেটা নিতান্তই গায়ের জোরে। ষষ্ঠ হেনরি একমাত্র ‘ডি ফ্যাক্টো' ইংরেজ রাজা যিনি যুগপৎভাবে ফ্রান্সেরও রাজা হয়েছেন।

জোয়ান অফ আর্কের যখন জন্ম হয়, সেই ১৪১২ সালে ফ্রান্সের রাজা ছিলেন ষষ্ঠ চার্লস, যার সাথে ইংরেজরা ঐ হঠকারী চুক্তিটি করে। ষষ্ঠ চার্লস মানসিকভাবে ভীষণ অসুস্থ ছিলেন, রাজকার্য চালানো প্রায়ই তাঁর জন্য অসম্ভব হয়ে পড়তো। তাঁর দুর্বল শাসনের সুযোগ নিয়ে ক্ষমতার দখল নিয়ে লড়াইয়ে নামে তাঁর ভাই লুইস (ডিউক অফ অরল্যান্ডো), এবং তাঁদের নিকট আত্নীয় জন দ্যা ফিয়ারলেস (ডিউক অফ বার্গার্ন্ডি)। জন আততায়ী লাগিয়ে লুইসকে খুন করান, যার ফলে ফ্রান্সে গৃহযুদ্ধ্বের এক আবহাওয়া তৈরী হয়। ফ্রান্সে দুটি ভিন্ন রাজনৈতিক মত গড়ে ওঠে, যার একপাশে থাকে ডিউক অফ বার্গান্ডি জন দ্যা ফিয়ারলেস, এবং অপরপাশে খুন হওয়া লুইসের দল, যাঁরা নিজেদের আরম্যানিয়াক (Armagnacs) বলে পরিচয় দেয়া শুরু করে।

এতদিন পর্দার আড়ালে থাকা চার্লস জুনিয়র (যাঁকে সিংহাসন থেকে বঞ্চিত করে ইংরেজরা তাঁর পিতা ষষ্ঠ চার্লসের সাথে চুক্তি করে) এবার আরম্যানিয়াকদের সাথে হাত মেলান এবং রাজনীতিতে জোরেসোরে পা ফেলেন। এর মাঝে অতি-উৎসুক আরম্যানিয়াকদের একটি দল জন দ্যা ফিয়ারলেসকে খুন করে বসে, যার দায় ষষ্ঠ চার্লস আপন-পুত্র চার্লস জুনিয়রের ওপর চাপান। আগেই ইংরেজদের সাথে চুক্তি করে ষষ্ঠ চার্লস তাঁর পুত্রকে বঞ্চিত করেছিলেন, এবার খুনের দায়ও তাঁর ওপর চাপানোর ফলে দেশে গুজব রটে গেলো চার্লস জুনিয়র আদৌ ষষ্ঠ চার্লসের পুত্র নয়, বরং ষষ্ঠ চার্লসের স্ত্রী ইসাবিউ এবং খুন হওয়া অরল্যান্ডোর ডিউক লুইসের অবৈধ সন্তান। ষষ্ঠ চার্লস ও পঞ্চম হেনরি যখন ২ মাসের ব্যবধানে পটল তোলেন, ৯ মাস বয়েসী ষষ্ঠ হেনরির বিরুদ্ধে সিংহাসনের দাবী নিয়ে এবার সরাসরি সামনে আসেন চার্লস জুনিয়র। তিনি নিজেকে দ্যোফাঁ (Dauphin) বা সিংহাসনের যোগ্য ও প্রকৃত উত্তরসূরী হিসেবে ঘোষণা করেন। এতদিকের নানা অভ্যন্তরীণ সংঘাত, ও কয়েক দশক ধরে চলা যুদ্ধে চরম দুর্দশাগ্রস্ত ফ্রান্স তখন ধুঁকছে। ইংরেজদের করাল থাবায় ফ্রান্স প্রতিদিন একটু একটু করে নিজেদের হারাচ্ছে। ঠিক এই সময়েই ফ্রান্সের রক্ষাদূত হয়ে পটে হাজির হন ১৭ বছরের কিশোরী জোয়ান অফ আর্ক।

খুব সাধারণ এক কৃষক পরিবার থেকে উঠে আসা জোয়ান তাঁর গ্রামে প্রচার করা শুরু করেন তিনি স্বপ্নে আদেশপ্রাপ্ত হয়েছেন, “দ্যোফাঁ” চার্লস জুনিয়রকে রেইমস ক্যাথিড্রালে মুকুট পরিয়ে তাঁকে রাজা সপ্তম চার্লস হিসেবে অভিষিক্ত করাতে হবে; স্বপ্নাদেশের মাধ্যমে জোয়ানকে এ গুরুদায়িত্ব দিয়েছেন ফেরেশতা মাইকেল (মুসলমানেরা যাঁকে মিখাইল নামে জানেন), সেইন্ট মার্গারেট এবং সেইন্ট ক্যাথেরিন। সেইন্ট মার্গারেট এবং সেইন্ট ক্যাথেরিন উভয়ই ১৫-১৬ বছর বয়েসে রোমানদের হাতে খুন হন, তাঁদের খ্রীষ্টীয় বিশ্বাসে অনড় থাকবার জন্য। জোয়ান রেইমস ক্যাথিড্রালে চার্লসকে অভিষিক্ত করার ব্যাপারে জোরেসোরে জনমত তৈরী করতে শুরু করেন; সুদূর অতীত থেকেই রেইমস ক্যাথিড্রাল ফরাসী রাজাদের অভিষেকস্থল হিসেবে পালিত হয়ে আসছিলো। জোয়ানের এই স্বপ্নে সওয়ার হয়ে ফরাসী বাহিনী ইংরেজদের বিরুদ্ধে শুরুতে বেশ কিছু সাফল্য পায়, জোয়ান যে সত্যিই ঈশ্বরের আদেশপ্রাপ্ত হয়ে ফরাসীদের মুক্তির জন্য সংগ্রামে নেমেছেন-এ ব্যাপারে অনেকেই নিশ্চিত হয়ে পড়ে। জোয়ান রেইমসের ক্যাথিড্রালে চার্লসের অভিষেক ঘটান, দীর্ঘ অন্ধকার এক সুড়ঙ্গের শেষ মাথায় ফ্রান্সের স্বাধীনতার একটু ছটা যেন দেখতে পাওয়া যায়...জোয়ানের জয়রথ থামাবার জন্য ইংরেজ এবং ইংরেজ-মিত্র বার্গান্ডিদের (যারা মূলত ফরাসী) শিবিরে শুরু হয়ে যায় ষড়যন্ত্রের এক নীল নকশা।

জোয়ানের ভাগ্য বেশীদিন সুপ্রসন্ন থাকে না। কিছুদিন পরেই তিনি বার্গান্ডিদের হাতে ধরা পড়েন। ইংরেজ চার্চ-এর অধীনে জোয়ানের বিচার শুরু হয়। জোয়ানের বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগটি গুরুতরঃ ধর্ম অবমাননা! জোয়ান পুরুষের মতোন কাপড় চোপড় পরে ঈশ্বরের বিধানকে অস্বীকার করেছে, জোয়ান নিজেকে চার্চের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে, জোয়ানের স্বপ্নে অলৌকিক দর্শন থাকে-শয়তানের উপাসনা ছাড়া এ কি করে সম্ভব? জোয়ানের এ বিচারকার্যের পুরো খরচ বহন করে ইংরেজরা; যে ১৩১ জন ধর্মীয় পুরোহিতকে জোয়ানের ধর্ম অবমাননার এ অভিযোগটি খতিয়ে দেখার দায়িত্ব দেয়া হয়, তাদের ৮ জন বাদে বাকী সবাই ফরাসী ছিলো বটে, কিন্তু এরা সবাই-ই ছিলো ইংরেজ কিংবা বার্গান্ডিদের অনুগত। সাজানো বিচারের দেশের আমাদের বুঝে নিতে মোটেই বেগ পেতে হয় না এ বিচারের ফলাফল কী হয়েছিলো। জোয়ানকে জ্ব্যান্ত পুড়িয়ে মারার সিদ্ধান্ত এ বিচারকাজ শুরুর বহু আগেই নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিলো।

বার্নার্ড শ দাবী করেছেন তাঁর সেইন্ট জোয়ান নাটকে তিনি কোন ভিলেন রাখেননি; জোয়ানের বিচার যাঁরা করেছেন, বা শাস্তির সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, তাঁরা কেউই খারাপ ঠিক নন। ইংরেজরা তাদের দেশপ্রেম থেকেই ফ্রান্সের স্বাধীনতা আটকে রেখেছিলো, তাদের ফরাসী মিত্র বার্গান্ডিরা-ফরাসীদের চোখে যারা রাজাকার-তারাও ইংরেজদের সাথে হাত মিলিয়েছে ঐ দেশপ্রেমের জন্যই, এখানে কাউকেই নাকি মোটাদাগে সাদা-কালো ছোপে ছাপানো যায় না। মধ্যযুগের অন্ধকারাচ্ছন্ন ইউরোপের প্রেক্ষিতে হয়তো অনেকটাই সত্যিও এ দাবীটি। জোয়ানের সময় থেকে ৬-৭০০ বছর পরে দাঁড়িয়ে আমাদের সময়ের ভালো-খারাপের মাপকাঠি দিয়ে হয়তো সে সময়টাকে মাপতে যাওয়া উচিৎ নয়। কিন্তু তবুও শ-এর নাটকে প্রহসনের সে বিচারের দৃশ্যে আমরা ঐতিহাসিক চরিত্রগুলোর যাকে যেমন দেখতে চাই, তেমন ভাবেই দেখতে পাই। যে নিরাবেগ স্বরের কথা শ দাবী করেন, সেটির তেমন সন্ধান মেলে না, ‘খারাপ লোকগুলো' তাদের কাজ এবং সংলাপের মাধ্যমে ‘খারাপ' হিসেবেই উঠে আসে।

শ নাটক শেষ করেছেন নাটকীয় একটি দৃশ্য দিয়েই; মৃত্যুলোক থেকে অশরীরী জোয়ান পৃথিবীতে কিছু সময়ের জন্য ফিরে আসেন, তখন তিনি জানতে পান নাটকটি লেখার সময়কালে, ১৯২০ সালে, ক্যাথলিক চার্চ জোয়ানকে সন্ত উপাধিতে ভূষিত করেছে। জোয়ান তখন অনুরোধ জানান, তিনি আবারো মানুষরূপে মর্ত্যে ফিরে যেতে চান; তাঁর এ অনুরোধের জবাব কেউ দেয় না, কারণ মর্ত্যের পৃথিবী তার মহাপুরুষদের (বিশেষত ‘মহানারীদের') বরণ করে নিতে আজও প্রস্তুত নয়। জোয়ানের মৃত্যুর ৭০০ বছর পরে আজও প্রশ্ন উঠবে কেন তার পোষাক নারীসুলভ নয়, কেন সে পুরুষদের মতো যুদ্ধে লড়াই করে, কেন সে ঘরের কোণে মাথায় কাপড় দিয়ে মুখ গুঁজে বসে থাকে না?

পৃথিবীর বড় বড় চিন্তাবিদেরা প্রায় সবাই-ই জাতীয়তাবাদকে ঘৃণা করেছেন, ঘৃণা করতে শিখিয়েছেন। কিন্তু জোয়ান যে জাতীয়তাবাদের বীজ বুনে দিয়েছিলেন ফরাসী জনগণের মনে, সেটি না করলে হয়তো ফ্রান্স দেশটির ইতিহাস সম্পূর্ণ ভিন্ন হতো, হয়তো এ নামে কোন দেশ থাকতো না। জাতীয়তাবাদের এই দিকটি না থাকলে বাঙলাদেশ নামক দেশটির অস্তিত্বও হয়তো আজ থাকতো না। এ লেখা শুরু করেছিলাম খুব বিখ্যাত তিনজন মানুষের উক্তি দিয়ে, যার একটির বক্তব্য বাকী দুজনের বক্তব্যের সম্পূর্ণ উল্টোরথী। আলবার্ট আইনস্টাইন কিংবা জর্জ অরওয়েলের মতো মহান চিন্তার মানুষেরা জাতীয়তাবাদকে কষে গালাগাল করেছেন, মুয়াম্মার গাদ্দাফি জাতীয়তাবাদকে বুকে জড়িয়ে নিয়েছেন। ভুলটা তাহলে কোথায়? অরওয়েল বা আইনস্টাইনরা কি তাহলে অতোটা মহান আদৌ নন?

পৃথিবীতে আসলে সবাই-ই কমবেশী গাদ্দাফি। অরওয়েল বা আইনস্টাইনরা কোটিতে মাত্র একজন।

2022-10-07T00:00:00.000Z
The Visit

The Visit

By
Friedrich Dürrenmatt
Friedrich Dürrenmatt,
Patrick Bowles
Patrick Bowles(Translator)
The Visit

ধরুন, আপনি একজন লাইনম্যান, হাতের সামনে রাখা সুইচে টিপ দিয়ে ট্রেনের রাস্তা ঘুরিয়ে দিতে পারেন। রোজকার মতো অফিসে বসে সুইচ টিপে টিপে সময়মতো ট্রেনগুলোর রাস্তা বদলে যার যার গন্তব্যে পৌঁছে দিচ্ছেন। এমন সময়ে দেখলেন ঢাকা-সিলেটগামী ট্রেনের লাইনের ওপর ৫ জন ঘুমিয়ে আছে, আর ট্রেন ছুটে আসছে দানবিক গতিতে। হাঁকডাক করে ঘুমিয়ে থাকা ৫ জনকে ওঠাবার কোন উপায় নেই, হাতে সময়ও নেই, একমাত্র উপায় হাতের সুইচটি টিপে সিলেটের ট্রেনকে রাজশাহীর লাইনে উঠিয়ে দেয়া, কিন্তু সে লাইনের ওপর কানে হেডফোন গুঁজে একজন আনমনে হেঁটে চলেছেন, চারপাশে কী হচ্ছে সেদিকে তাঁর কোন নজরই নেই। আপনি কী করবেন? নিশ্চেষ্ট হয়ে চোখের সামনে ৫ জন ঘুমন্ত মানুষের ওপর ট্রেন চলে যেতে দেবেন? নাকি সুইচ টিপে রাজশাহীর লাইনে উঠিয়ে সেই আনমনে হেঁটে চলা লোকটিকেই ট্রেনের চাকার তলে ঠেলে দেবেন? ১ জনের জীবন, নাকি ৫ জনের জীবন? কোনটি বেশী ভারী আপনার কাছে?

দর্শনের ক্লাসের ‘ট্রলি প্রবলেম'-এর এই জটিল ধাঁধাটি তো আমরা অনেকেই জানি। ষাটের দশকের শেষের দিকে একটি গবেষণাপত্রে প্রথমবারের মতো এ ধাঁধাঁটি উপস্থাপন করা হয়, এরপর থেকে ব্যবসা, দর্শন, আইন, নৈতিকতা-ইত্যাদি নানাবিধ বিষয়ের ক্লাসে এ সমস্যাটি বিভিন্ন রূপে শিক্ষার্থীদের পড়ানো হয়ে আসছে। হালের সময়ের দারুণ জনপ্রিয় সিটকম ‘দ্যা গুড প্লেইস'-এও ট্রলি সমস্যা নিয়ে দারুণ একটি এপিসোড হয়েছে। বলছি বটে মাত্রই ষাটের দশকে এ সমস্যাটি জনসমক্ষে এসেছে, কিন্তু এমন নৈতিক ডিলেমাতে পড়ে তো মানুষ সেই কত শত হাজার বছর ধরেই ঘোল খেয়ে আসছে। আমরা চলচ্চিত্রেই দেখেছি, পৃথিবীর শত কোটি মানুষকে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা-ইত্যাদি মৌলিক চাহিদাগুলো মেটাতে হিমশিম খেতে দেখে দয়াপরবশ হয়ে থানোস তাঁর দস্তানা পরা হাতে তুড়ি মেরে পৃথিবীর অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে নিকেশ করে সম্পদের সুষ্ঠু বন্টন নিশ্চিত করতে চান। আমরা ওয়াচমেন-এ পড়েছি, একই যুক্তি দেখিয়ে অজিম্যান্ডিয়াস আজকের পৃথিবীর কয়েক মিলিয়ন মানুষকে মেরে ফেলতে চান, ভবিষ্যতের বিলিয়ন বিলিয়ন মানুষের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে। তর্কপ্রিয়রা বলবেন এরা তো সব কল্পনার মানুষ, এদের ট্রলি প্রবলেমের সেই ডিলেমা কই? তাহলে সত্যিকার মানুষের কল্পনার একটা উদাহরণই দেখা যাকঃ

চীনে ৫০-এর দশকে মাও সে তুং-এর সরকার যখন একের পর এক মুর্খতায় ভরা অবিমৃষ্যকারী সব সিদ্ধান্ত নিয়ে ৪ বছর মেয়াদী দীর্ঘ এক ক্ষরা ডেকে আনে, তাতে সাড়ে ৪ কোটি মানুষ না খেতে পেয়ে প্রাণ হারায় (সে সময়ের পূর্ব পাকিস্তান, আজকের বাঙলাদেশের জনসংখ্যাই তখন ছিলো সাড়ে ৪ কোটির সামান্য নিচে)। মাও নিজে ঘোষণা দিয়ে দেশের মানুষকে উপোস করে মরে যাবার জন্য উৎসাহ যোগান। সাংহাইয়ে দেয়া তাঁর এক বক্তব্যের সারকথা ছিলো, “খাদ্য অপ্রতুল হলে মানুষ মরবে জানা কথা। তাই দেশের অর্ধেক মানুষ খাওয়া ছেড়ে দিলে বাকী অর্ধেক মানুষ বেঁচে যায়, বৃহত্তর স্বার্থে আপনারা সেটাই করুন। দেশ আপনাদের এই মহান ত্যাগের কথা আজীবন সোনার অক্ষরে লিখে রাখবে”। সঙ্গীতের মতোই রাজনীতি, ধর্ম-ইত্যাদিও গুরুমুখী বিদ্যা। গুরু যে সুরে গলা চড়ান, শিষ্য তার বাইরে বেশী একটা সুর ভাঁজেন না। মাও-এরও তেমনি গুরু ছিলো। দেশের মানুষদের না খেয়ে মরে যাবার আহবান জানাবার এ জাদুকরী সুর তিনি শিখেছেন লেনিন আর স্টালিনের কাছ থেকে। সত্যিকার এই মানুষদের মনের ফ্যান্টাসিগুলো বাস্তবায়িত করতে গিয়ে এঁদের ফ্যান্টাসির ট্রলির নিচে চাপা পড়ে প্রাণ হারিয়েছে অর্বুদ কোটি মানুষ।

একটি মাত্র জীবনের চেয়ে পাঁচ পাঁচটি জীবন অনেক বেশী দামী এবং গুরুত্বপূর্ণ, এমন ভেবে অনেকেই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন “সিলেটের ট্রেনটিকে ঘুরিয়ে রাজশাহীর লাইনেই উঠিয়ে দেই” । তাহলে পরিস্থিতিটা আরেকটু ঘোরালো করা যাক, কি বলেন? আচ্ছা, সিলেটের লাইনের ওপর ঘুমিয়ে থাকা ঐ ৫ জন যদি কারওয়ান বাজারের বস্তিতে বাস করা এক রিকশাওয়ালা আর তার পরিবারের লোকেরা হয়, আর রাজশাহীর লাইনে একাকী হেঁটে চলা ব্যক্তিটি যদি হন দেশের সেরা একজন বিজ্ঞানী, কিংবা সাহিত্যিক, কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক? অথবা, সে ৫ জন যদি আপনার পরিবারের কেউ হন, আর একা হেঁটে যাওয়া মানুষটি যদি হন আপনার ধর্মের সবচেয়ে প্রভাবশালী ধর্মগুরুটি, যাঁর প্রতি অন্ধ আনুগত্যই আপনার ধর্মটি পালন করবার প্রধান শর্ত? চাইলে চরিত্রগুলোকে অদল-বদল করে পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে এই থট এক্সপেরিমেন্ট চালিয়ে যেতে পারেন, আমার আর মিছেমিছি নিজের মনের ওপর চাপ বাড়াতে ভালো লাগছে না...

সুইস নাট্যকার ফ্রিডরিখ ডুরেনমাট ট্রলি প্রবলেম গোছের এমন একটি গল্পই ধরেছেন তাঁর নাটক দ্যা ভিজিট-এ। ইওরোপের অখ্যাত, ভীষণ দারিদ্র্যের মধ্যে দিয়ে চলা এক গ্রামে অনেক বছর পর ঘুরতে আসেন এক প্রৌঢ়া নারী, যাঁর জন্ম এখানেই। আজ তিনি শত কোটিপতি। জন্মস্থান ঘুরে দেখার এ সফরে সাথে করে নিয়ে এসেছেন তাঁর বিরাট লটবহর; যে আরাম কেদারায় তিনি বসেন, সেটি কাঁধে তুলে নিয়ে হাঁটবার জন্য আছে দুই মুষকো জোয়ান, আছে খাঁচায় বন্দী তাঁর শখের পোষা চিতাবাঘ, আর আছে তাঁর সপ্তম স্বামী। গ্রামবাসীরা একাগ্র চিত্তে অপেক্ষা করে আছে, নিজ জন্মস্থানের এ গরিবী হাল দেখে ধনকুবের ক্লেয়ারের মন না কেঁদে পারবে না, তিনি নিশ্চয়ই বড় অঙ্কের টাকা দান করবেন, বন্ধ হয়ে যাওয়া কল কারখানাগুলো তাঁর দানে আবার চালু হবে, মানুষের কর্মসংস্থান হবে...ক্লেয়ারের মন গলাবার জন্য তাদের সবচেয়ে বড় অস্ত্র ক্লেয়ারের ছোটবেলার প্রেমিক/ বন্ধু ইল। ইলের সাথে দেখা হলেই প্রায় অর্ধ শতাব্দী আগের সেই প্রেমের ইতিহাস মনে করে ক্লেয়ার যে উদারহস্ত হবেন তাতে সন্দেহ কী? ক্লেয়ার সত্যিই কথা দেন, তিনি সাহায্য করবেন। টাকার যে অঙ্কটা তিনি উল্লেখ করেন, তা গ্রামবাসীদের সুদূর কল্পনার অতীত। সবার মুখ হাঁ হয়ে যায় এই বিপুল পরিমাণ অর্থসাহায্যের কথায়। কিন্তু ক্লেয়ার একটি শর্ত জুড়ে দেন; এ দশ লাখ টাকা পেতে হলে গ্রামবাসীদের ভেতর কাউকে এগিয়ে আসতে হবে ইলকে হত্যা করবার জন্য।

ইলের সাথে তরুণ বয়েসে যখন ক্লেয়ারের প্রেম হয়, তার অব্যবহিত পরেই তিনি সন্তানসম্ভবা হয়ে পড়েন। পিতৃত্বের দায়িত্বের ঝামেলায় জড়াবার ইচ্ছে ইলের ছিলো না। তাই সে মিথ্যে সাক্ষ্য যোগাড় করে ক্লেয়ারের নামে অপবাদ দিয়ে তাঁকে গ্রামছাড়া করে। বিশ শতকের গোড়ার দিকের সে সমাজে অবিবাহিত কিন্তু সন্তানসম্ভবা ক্লেয়ারের ঠিকানা জোটে এক পতিতাপল্লীতে। সেখানেই বহু হাত বদল হয়ে শেষমেষ এক ধনী ব্যবসায়ীকে বিয়ে করে কোটি টাকার মালিক বনেন ক্লেয়ার। এরপর তিনি একের পর এক বিয়ে করে গেছেন। নাটকে ইল-হত্যার ঘোষণা দেবার কয়েক পাতা পরেই দেখা যায় ক্লেয়ার তাঁর সপ্তম স্বামীকে তালাক দিয়ে অষ্টম স্বামী গ্রহণ করেছেন। ক্লেয়ারের গ্রামের অধিবাসীরা শুরুতে বেশ গাঁইগুঁই করে, ক্লেয়ারকে তারা মনে করিয়ে দেয় শত হলেও সভ্যতার প্রাণকেন্দ্র ইওরোপে তাদের বাস, যতই গরীব হোক তারা, হাতে রক্ত মেখে বড়লোক হবার ইচ্ছে তাদের নেই, ক্লেয়ার তাঁর প্রস্তাবটি ফিরিয়ে নিতে পারেন। ক্লেয়ার অবশ্য তাঁর অফার বলবৎ রাখেন। দামী হোটেলের বারান্দায় নবম স্বামীর সাথে বসে হট চকলেটের কাপে সুরুৎ সুরুৎ চুমুক দিয়ে তামাশা দেখতে থাকেন...

ইল ওদিকে ক্রমেই প্যারানয়েড হয়ে ওঠে; গ্রামবাসীর আচরণ তার কাছে অন্যরকম ঠেকতে থাকে। পুলিশের কাছে গেলে পুলিশ তাকে সাত পাঁচ তের বুঝিয়ে বিদেয় করে দেয়, মেয়রকেও আর আগের মতো বন্ধুভাবাপন্ন লাগে না ইলের কাছে। যে মুদি দোকানটি ইল চালায় সেখান থেকে সবাই (বাকীতে) দামী দামী সিগারেট, মদ কিনে নিয়ে যায়, ইলের স্ত্রী-সন্তানেরা (বাকীতে) অভিজাত কাপড় কিনে নতুন মডেলের গাড়ী হাঁকায় (কীভাবে কেনা? সেও বাকীতেই)। গ্রামের কারো কাছেই টাকা নেই, কিন্তু বাকীর হিসেবে সবাই ভোগবিলাস করে চলেছে, সবার মনেই ফূর্তি, সবাই যেন ধরেই নিয়েছে, টাকা আসছে। একসময় মেয়র নিজেই ইলের হাতে বন্দুক তুলে দেন, ইল যেন সসম্মানে নিজের হাতে প্রয়োজনীয় কাজটি করে গোটা গ্রামবাসীকে বাঁচিয়ে দেয়, ইল মরলেই অর্থনীতির চাকাটি সচল থাকে। তাছাড়াও, ইলের কৃতকর্মটিও তো কম গর্হিত নয়।

শেষতক কী হলো জানতে চাইছেন? এর উত্তর আপনি নিজেই দিতে পারবেন। ইলের জন্য কি আপনার মনে কোন দয়ার সঞ্চার হয়? মনের দাঁড়িপাল্লায় এক পাশে দায়িত্ব নিতে না চাওয়া, মিথ্যে সাক্ষ্য দিয়ে ক্লেয়ারের জীবন বরবাদ করে দেয়া ইল আর আরেকপাশে গোটা গ্রামবাসীকে উঠিয়ে হিসেব করতে থাকুন।

ফ্রিডরিখ ডুরেনমাট-এর এই দ্যা ভিজিট নাটকটিই তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত কাজ হিসেবে স্বীকৃত। ডুরেনমার্ট বলেছেন তাঁর কাজকে বুঝতে হলে, সঠিকভাবে তারিফ করতে হলে আগে ‘গ্রটেস্কনেস' বুঝতে হবে। ট্র্যাজি-কমেডি ধাঁচের এ নাটকে মানব চরিত্রের কাটাছেঁড়ার কাজটিই তিনি আসলে করেছেন। আর কে না জানে, মানব চরিত্র মাত্রেই ‘গ্রটেস্ক'। চোখা চোখা দারুণ উইটি এবং সূক্ষ্ম সব সংলাপ ও ঘটনার অবতারণা করেছেন ডুরেনমাট, সব দেখেশুনে মনে হয় মানবজাতির ওপর বেশ অনেকটাই বীতশ্রদ্ধ ছিলেন তিনি, এবং তাঁর এই ঘেন্না পাঠক/ দর্শকদের মাঝেও সঞ্চারিত করতে চেয়েছেন তিনি। বড় লেখকদের (বিশেষত নাট্যকারদের) প্রায় সবাইকেই আসলে এটাই কি করতে দেখি না আমরা?

ডুরেনমাট-এর একটি উপন্যাস অবলম্বনেই ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাট্যকার বিজয় তেন্ডুলকার তাঁর বিখ্যাত নাটক শান্ত! কোর্ট চালু আহে লেখেন, দেশে বিদেশে এ নাটক বহু বহুবার প্রদর্শিত হয়েছে, আগ্রহী কেউ চাইলে এ নাটক ইউটিউবেও দেখে নিতে পারেন। নাট্যকার মাত্রেই বেয়াদব হন; কোন একটি এজেন্ডা ছাড়া, ওপর মহলের প্রতি মধ্যমা প্রদর্শন ব্যতিরেকে নাটক আসলে হয় না। বিজয় তেন্ডুলকারের নাটকের নাম থেকেই বুঝে নেয়া যায় তাঁর কোর্ট চালু আহে নাটকের উদ্দেশ্য এবং বিষয়বস্তু কী, এবং কতটা বেয়াদব তিনি হতে পারেন। আমেরিকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি নাটক পড়িয়ে সে বেয়াদবী সঞ্চারিত করেছেন তাঁর শিক্ষার্থীদের মাঝেও। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ২০০২ সালে যখন ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী গুজারাত দাঙ্গায় মুসলমান হত্যায় সরাসরি মদদ দেন, সে সময় প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত তেন্ডুলকার বলেছিলেন, “আমার কাছে একটা পিস্তল থাকলে আমি এখনি মোদীকে গুলি করে দিতাম”। এমন চরিত্রের একটি মানুষ যখন ডুরেনমাটের কাছ থেকে ধার করেন, তখন সেই ডুরেনমার্টের বাকী সব বইকেও অবশ্যই তালিকায় রাখতে হয়। ডুরেনমাট তাই থাকছেন, থাকবেন।

বিজয় তেন্ডুলকারের সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন মহর্ষি শ্রী শ্রী ঠাকুর অরূপরতন। তাঁর কাছে অশেষ কৃতজ্ঞতা।

2022-09-11T00:00:00.000Z
The Plays and Fragments

The Plays and Fragments

By
Menander
Menander,
Maurice Balme
Maurice Balme(Translator)
The Plays and Fragments

প্রাচীন গ্রীক কমেডি নাটকগুলোকে বিষয়বস্তু, নাটকের স্বর, এবং সময়কাল অনুযায়ী ৩টি ভাগে ভাগ করেছেন পণ্ডিতেরাঃ ওল্ড কমেডি, মিডল কমেডি, এবং নিউ কমেডি। ওল্ড কমেডি এবং নিউ কমেডির মাঝে সময়ের পার্থক্য মেরেকেটে ২শ বছরের মতো। আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগের গ্রীসে মূলতঃ কিছু রাজনৈতিক পরিবর্তনের হাত ধরেই প্রাচীন গ্রীক কমেডি নাটকের এই পরিবর্তনগুলো আসে। ওল্ড কমেডি লেখার চল যখন ছিলো, সেই খ্রীষ্টপূর্ব ৫ম শতকে পেলোপনেজিয়ান যুদ্ধের অবসান ঘটে; এথেন্স ও স্পার্টার মাঝে ২৭ বছর ধরে চলা এ যুদ্ধে এথেন্স পরাজিত হয়, যার ফলে এথেন্সে চর্চিত গণতন্ত্র বেশ অনেকটাই শেকলবদ্ধ হয়ে পড়ে। ওল্ড কমেডির অন্যতম বিশেষত্ব ছিলো ব্যক্তি আক্রমণ, যেটি পরবর্তী সময়ের নাটকে সেভাবে আর দেখা যায় না। ওল্ড কমেডি ঘরানার সবচেয়ে জাঁদরেল নাট্যকার হিসেবে আমরা আজ অ্যারিস্টোফেনেস-এর নাম জানি, যিনি সক্রেটিসকে ব্যঙ্গ করে ভাঁড়ামি-সর্বস্ব নাটক লিখেছেন, ইউরিপিদেস-এর নাটকের একরকম প্যারোডি সংস্করণ বানিয়েছেন, পেলোপনেজিয়ান যুদ্ধের বিরোধীতা করে হাসির নাটক লিখে রীতিমতো প্রপাগ্যান্ডাও চালিয়েছেন। অ্যারিস্টোফেনেস-এর সক্রেটিসকে নিয়ে লেখা ব্যাঙ্গাত্নক নাটকটিই শেষতক সক্রেটিসের বিচার এবং প্রাণদণ্ডের কারণ হয়ে দাঁড়ায় বলে অনেকে রায় দেন।

পেলোপনেজ-এর যুদ্ধে এথেন্স হেরে যাওয়ার পর ওল্ড কমেডিতে ব্যবহৃত অনেক কৌশলই পরবর্তীতে নাট্যকাররা এড়িয়ে যান তাঁদের নবধারার নাটকে। ব্যক্তিগত আক্রমণ বা সমাজের কোন ব্যক্তিবিশেষকে লক্ষ্য না বানিয়ে এবার তাঁরা মনোনিবেশ করেন বিবিধ সামাজিক বিষয়ের ওপর। এই নাটকগুলো এক একটা জানালার মতো কাজ করে; শার্সিতে চোখ রাখলে নিমিষেই যেন আড়াই হাজার বছর আগের একটা ছবি দেখে ফেলা যায়। তবে সে সময়ের অধিকাংশ, প্রায় ৯০ ভাগ কাজই ধ্বংস হয়ে গেছে এতগুলো বছরের পরিক্রমায়, তাই সে জানালাটা আকারে বেশ ছোটই বলা যায়। পণ্ডিতেরা ‘মিডল কমেডি' বলে একটি ধারা চিহ্নিত করেছেন বটে, কিন্তু সে সময়ের একটি নাটকও আজ টিকে নেই। মূলত অ্যারিস্টোফেনেসের পর এবং মেনান্দারের আগ পর্যন্ত সময়টিকে মিডল কমেডির সময় বলে অভিহিত করা হয়। অ্যারিস্টোফেনেস যেমন ওল্ড কমেডির সর্বেসর্বা গুরু, নিউ কমেডির পালের গোদা তেমনি মেনান্দার। সাহিত্যের একটা ধারার মাইলফলকই আজ যিনি হয়ে পড়েছেন, তাঁকে পড়বার লোভ দীর্ঘদিন থেকেই ছিল, অবশেষে সেটা মেটানো গেলো!

মেনান্দার লিখেছিলেন ১০৮টির মতো নাটক, তার মাঝে পূর্ণাঙ্গ পরিসরে মাত্র একটি নাটকই আজ বেঁচে আছে, বাকী নাটকগুলোর কোনটির কয়েক পৃষ্ঠা, কোনটির কয়েক অনুচ্ছেদ, আর কোনটির কয়েক চরণ কেবল টিকে রয়েছে। মেনান্দারের যে একমাত্র নাটকটি আজ টিকে আছে (ডিস্কোলোস), সেটির ছায়ায় প্রাচীন রোমান নাট্যকার প্লটাস ও ফরাসী নাট্যকার মলিয়ের পরবর্তীতে নিজেরা নাটক লিখেছেন। তবে মেনান্দারের প্রভাব শুধু এই দু'জনের মাঝেই থেমে থাকেনি, হালের সময়ে টিভিতে আমরা যে সিচুয়েশনাল কমেডি সিরিজ বা চলচ্চিত্রগুলো দেখি, সেগুলোর বিভিন্ন দৃশ্যের সাথে মেনান্দারের নাটকের দৃশ্যের আশ্চর্য মিল পাওয়া যায়। সিটকমে সচরাচর বিভিন্ন বিভ্রান্তির ঘটনা দেখিয়ে হাসির উদ্রেক ঘটানো হয় (যমজ ভাইদের নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি, অপরের স্ত্রীর সাথে কথা বলা নিয়ে বিভ্রান্তি ইত্যাদি)। দর্শক হাসাবার কাজে মেনান্দার এ ‘ডিভাইস'গুলোই বারবার ব্যবহার করেছেন তাঁর নাটকে। যে ধরণের চরিত্রগুলোকে আমরা সিটকমে ঘুরেফিরে দেখতে পাই, যাদের ‘স্টক ক্যারেক্টার' বলা হয় (অর্থ্যাৎ, লেখক-পরিচালকের আস্তিনের তলায় স্টকে এমন কিছ চরিত্র মজুদ থাকেই, যখনই সিরিজের গতি ঝুলে যায়, কিংবা হাসির দৃশ্যের প্রয়োজন পড়ে, এ চরিত্ররা আস্তিনের তলা থেকে বেরিয়ে আসে), সেই চতুর মুখরা গৃহপরিচারিকা (টু অ্যান্ড আ হ্যাফ মেন), শ্বাশুড়ী ও কন্যা/ পুত্রবধূর যুগপৎভাবে গর্ভধারণ (ফাদার অফ দ্যা ব্রাইড), বোকা বোকা কথা বলা নায়কের বন্ধু (আম্মাজান চলচ্চিত্রে মান্নার সহচর ‘নবাব' চরিত্রটি)-ইত্যাদির উৎস হিসেবে মেনান্দারকেই চিহ্নিত করা যায়।

মেনান্দারের পকেট থেকেই কি তবে এত এত সব ঘাঘু নাট্যকার-চিত্রনাট্যকারদের জন্ম? ব্যাপারটা ঠিক তেমনও নয়। মেনান্দারকে নিউ কমেডির প্রবর্তক বলে আমরা জানি বটে, কিন্তু তিনিও তাঁর পূর্বসুরীদের কাছ থেকে বেশ স্বাস্থ্যকর পরিমাণেই নাকি টুকলিফাই করতেন। কালের গর্ভে পূর্বসুরীদের সেসব লেখা হারিয়ে গেছে, তাই আজ আর জানবার উপায় নেই মেনান্দার আসলে কতটুকু কার কাছ থেকে মেরে দিয়েছেন। তবে একটি ব্যাপার স্পষ্ট হয়ে আসে, আড়াই হাজার বছর আগের প্রাচীন সেই গ্রীক সমাজই সভ্যতার শুরু নয়, এর আরো বহু হাজার হাজার বছর আগেই মানুষ তার সামাজিক জীবনের কাঠামোটি গড়ে নিয়েছিলো, যে ছকে আমরা আজও এই ২০২২ সালের জীবন যাপন করি। মেনান্দারের বেশ কয়েকটি নাটকের প্লটই আবর্তিত হয়েছে বিবাহ-বহির্ভূত ‘অবৈধ সন্তান'কে ঘিরে। সন্তানের বৈধতা/অবৈধতার যে মুখরোচক গপ্পে আমরা আজ মজি, সেটির আবেদন আড়াই হাজার বছর আগেও একইরকমই ছিলো।

মেনান্দার খুব সূক্ষ্মভাবে একরকম প্রপাগ্যান্ডা চালিয়েছেন; বিবাহ-বহির্ভূত সন্তানকে অবহেলা না করা, এবং তাকে স্বীকৃতী দেবার একটি আহবান শুনতে পাওয়া যায় দিব্যি। তবে সে সময়ের সাথে আমাদের সময়ের একটি বড় পার্থক্য রয়েছে; মেনান্দার তাঁর অনেকগুলো নাটকেই ধর্ষণকে কৌতুকের বিষয় বানিয়েছেন, অনেকটা যেমন বিগত দশকগুলোতে সমকামীদের কৌতুকের বিষয় বানিয়ে পাঠক/ দর্শককে হাসাবার চেষ্টা করা হতো। এক সময়ের সামাজিক প্রথার মূল্যায়ণ আরেক সময়ে বসে করা যায় না, সত্যিই, তবে বারবার ধর্ষণ বিষয়ক সংলাপ এবং গল্প পড়াটা আজকের দিনে খুব সুখকর কিছু নয়। এ নাটকগুলোর কোনটিই পূর্ণাঙ্গ আকারে টিকে নেই আগেই বলেছি, ২-৩ পাতা পড়বার পরই সে নাটক শেষ হয়ে গেছে, তাই ধর্ষণের ব্যাপারে মেনান্দারের নিজের দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় খুব একটা পাওয়া যায় না।

প্লুতার্ক মেনান্দারকে খুব উঁচুদরের নাট্যকার বলে গণ্য করতেন, আর অ্যারিস্টোফেনেসকে নাকি ধর্তব্যই মনে করতেন না। প্লেটোর একনিষ্ঠ ভক্ত প্লুতার্ক সক্রেটিসের মৃত্যুর পেছনে প্রচ্ছনভাবে দায়ী অ্যারিস্টোফেনেস-এর ওপর চটে থাকবেন সেটাই স্বাভাবিক। প্লুতার্কের এ মূল্যায়ণ কতটুকু যৌক্তিক সেটি আজকের দিনে নিরুপণ করা অসম্ভব, তবে প্লুতার্ককে আমি ওস্তাদ মান্য করি। হলিউডের চোখা চোখা উইটি সংলাপের আড়ালে মেনান্দার যে লুকিয়ে আছেন সেটি আমি জেনে ফেলেছি এখন, আমার ধারণা প্লুতার্ক এটি দু'হাজার বছর আগেই জেনে বসেছিলেন!

2022-09-10T00:00:00.000Z
Franny and Zooey

Franny and Zooey

By
J. D. Salinger
J. D. Salinger
Franny and Zooey

ধর্মীয় উপদেশ-এর গল্প মানুষ হুনবার চায় না; লোকজনেরে জোর কইরা নিজের ধর্মবিশ্বাসের দিকে টাননের লিগা তাই অনেক রকম ফন্দি ফিকির করতে হয়। আমরা কাশেম বিন আবুবাকার-এর বইতে দেখি, নায়ক-নায়িকা একজন অপরজনের কাছে আসবার চায়, হাত ধরবার চায়, চুমা খাইবার চায়... কিন্তু ধর্মে বাধা আছে বইলা বিয়ার আগে কিছুই করে না তারা, শুধু মুখ লুকায়া উল্টা দিকে দৌড় লাগায়...প্রেমের গল্পের উছিলায় কাশেম সাহেব আমাগোরে ছবক দেন, “বিয়ার আগে চুমা খায়ো না বাবারা”। গল্পের উছিলায় ধর্মের কথা শুনানোর এই ঘটনা তো আমরা আজকে থিকা দেখতেছি না; স্বয়ং যীশু এইভাবে নানান বানানো গল্প বইলা ঈশ্বরের বাণী প্রচার করছেন, যেইগুলারে আমরা আজকা ‘প্যারাবল' বইলা জানি। উনারও ম্যালা আগে ঈশপের গল্পে আমরা নৈতিকতা, ভালো/ খারাপের শিক্ষা পাইছি। ঈশপের রাখাল বালক, কাছিম আর খরগোশ, কিপ্টা লোক আর তার সোনার টেগা...এইসব গল্প আমরা সবাই-ই কমবেশী জানি। বরং বাইবেলের এক দুইটা প্যারাবল এইখানে চিকা মাইরা রাখি। বাইবেল সত্য হইলে, কে জানে, এই উছিলায় কোনদিকে আমার কোন দরজা খুইলা যায়...আফটার অল, গড ওয়ার্কেথ ইন মিস্টিরিয়াস ওয়েইস

এই প্যারাবলটা নবী নেইথান (Nathan) আর নবী ডেভিডের-যাঁরে আমরা ‘যবুর'-এর লেখক দাউদ (আঃ) বইলা জানি; নেইথান ডেভিডরে শিক্ষা দেওনের লিগা এই গল্পটা বলেন। গল্পটা হইলো এইরকমঃ এক ছিলো ধনী খামারি, তার আছিলো ম্যালা ম্যালা গবাধি পশু। তার কয়েক বাড়ী পাশে আছিলো আরেক গরীব খামারি, যার সম্পদ বলতে আছে খালি একটাই মাদী ভেড়া; সে কঠিন কষ্ট কইরা চলে, খায়া না খায়া দিন পার করে, কিন্তু তবুও তার আদরের ভেড়ীটারে সে জবাই কইরা খায়া ফ্যালে না। বড়লোক খামারি সিস্টেমে গরীব খামারির ভেড়ীটারে ভাগায়া নিয়া কাইটা কুইটা তার গেস্টগোরে খাবায়া দেয় (বড়লোক খামারি হইলে সবাই যা করে আর কী...)। ডেভিড নবী আছিলেন বটে, পাশাপাশি সাইড ব্যবসা হিসাবে রাজার কামও করতেন। উনার আন্ডারে কাম করা এক সৈনিক উরাইয়াহ (Uriah)-এর বউয়ের লগে উনি (view spoiler)[ঝক্রেউবফববফফঊট্ব্যাও (hide spoiler)] কইরা ফালান। বড়লোক খামারির গল্প কয়া নেইথান আসলে ডেভিডরে মনে মনে একটা চোপাড় মারছেন। এই গল্প থিকা আমরাও শিক্ষা পাই, ঘরে বউ থাকলে, নিজের অধীনে কাম করা কর্মচারীর বউয়ের লগে (view spoiler)[মক্সকচদ্বযগদসদ্সগ (hide spoiler)] করা উচিৎ না। নবী কিছিমের লোকজনের ব্যাপারে কথা কওয়া বিপজ্জনক, তাই রেফারেন্স, তথ্যসূত্র এইসব দেওয়া জরুলী। নেইথান আর ডেভিডের এই গল্প পাইবেন ওল্ড টেস্টামেন্টের 'স্যামুয়েল' পর্বের ২য় ভাগের ১২ নাম্বার আয়াতে।

সেকেন্ড এই প্যারাবলটা নিউ টেস্টামেন্ট থিকা ম্যাথিউ সাহেবের মারফৎ আমরা পাইছিঃ এক বিয়ার অনুষ্ঠানে জামাই বউরে বরন কইরা নেয়ার দায়িত্ব পড়ছে দশটা কুমারী মাইয়ার উপরে (তারা আদৌ কুমারী কি না, এবং কুমারী মাইয়াই কেন এই কামের লিগা দরকার-এইসব প্রশ্ন কইরা বিব্রত কইরেন না, নিজেও বিব্রত হয়েন না)। কিন্তু রাইত পার হয়া যায়, জামাই আহে না, আহে না, আহে না...অপেক্ষা করতে করতে দশ মাইয়াই ঘুমায়া যায়। তারা যখন গভীর ঘুমে, তখন আঁৎকা জামাই আয়া পড়ে বিয়ার মঞ্চে। তখন বাইর হয় ঐ দশ মাইয়ার পাঁচজন বুঝদার জ্ঞানী, আর বাকী পাঁচজন বেকুব। কারণ, জামাই বউরে বরন কইরা নেয়ার লিগা যেই কুপি বাতি নিয়া আসছিলো এরা দশজনে, তাগো মইধ্যে বুরবাক পাঁচজন তাগো কুপিতে ত্যাল ভরে নাই, জ্ঞানী পাঁচজনে ভরছে। এই গল্প দিয়া যীশুর বন্ধু ম্যাথিউ সাহেব বুঝাইছেন যীশু যখন আইবেন, তখন আপনে ঘুমে থাকলেও আপনের কুপিতে যেন ত্যাল ভইরা রেডী থাকেন।

আগের গল্পে 'ভেড়ী' মানে যেরকম ‘পরের বউ', এই গল্পের 'ত্যাল' মানে কিন্তু ঈশ্বরভীতি, যীশুপ্রেম এইসব। হ্যারি পটারের ভবিষ্যদ্বাণী কোর্সের মাষ্টারনি মিস ট্রেলনি যেইরকম কাপের নিচে চায়ের পাতি দেইখা ঘটনা আন্দাজ করা পারেন, এইসব প্যারাবল-এর বিভিন্ন উপমা থেইকা আপনেরেও একইভাবে মূল ভাব আন্দাজ কইরা নিতে হবে। বুদ্ধিমানের লিগা তো ইশারাই...

আদালতে সাক্ষ্য নেয়ার সময় একটা আইন গোটা দুনিয়ায় মানে, সেইটা হইলো আপনে ‘হিয়ারসে' করবার পারবেন না। মানে হইলো, কাঠগড়ায় খাড়ায়া আপনে কইতে পারবেন না, “আমি শুনছি অমুক এই কথাটা বলছে”। আপনে যদি নিজের কানে কথাটা শুইনা থাকেন তাইলেই আপনের সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য হবে। ধর্মের আইন মানুষের বানানো আইনের উপরে চলে বইলা ধর্মে এই হিয়ারসে ব্যাপারটা আবার জায়েজ আছে ; “আমি অমুকের চাচা তমুকের কাছ থিকা শুনছিলাম এই কাহিনী, যিনি আবার এইটা শুনছেন চমুকের বয়ানে, চমুক এই কাহিনী জানেন, কারণ ঘটনাটা ঘটছিলো উনার প্রতিবেশীর তালতো ভাইয়ের বারান্দায়...” -এইধরণের বয়ানেই ধর্মীয় গল্পগুলা আমাদের কাছে আসে। ধর্মের বিশ্বাস থিকা আমরা জানি, এই বয়ান যাগো হাত ধইরা আসছে, এনারা সব্বাই খাঁটি সোনার মানুষ, তাগোর ভিত্রে কোন ভেজাল নাই, নিজে নিজে বানায়া গল্প কইবো, এইরকম মানুষই তাঁরা না(!) আমাগো বিশ্বাসের খুঁটি ইস্পাতের মতো পোক্ত বইলাই অরিজিনাল বই প্রকাশের কয়েক হাজার বছর পরে এখনো তাই গল্প প্রচারের পারপাসে প্যারাবল-ই সবচায়া ভালো উপায়।

প্যারাবল নিয়া এতো প্যানপ্যানানির কারণ হইলো, আলোচ্য বই, এই 'ফ্র্যানি অ্যান্ড জুই' আসলে একটা আধুনিক প্যারাবল। এইখানে লেখক চরিত্রগুলানরে দিয়া ম্যালা ম্যালা ইতং বিতং বেফায়দা কথা কওয়ায়া পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা নষ্ট করছেন, যেই কারণে ২০০ পাতার বইরেও এক পর্যায়ে গন্ধমাদন পর্বতের মতোন ভারী মনে হইতে থাকে। যাউক, অনেক প্যাঁচ দেওনের পরে ফাইনালি স্যালিঞ্জার সাহেব রিভিল করছেন এই বই লেখনের উদ্দেশ্যঃ আপনে যখন যেইখানে যা-ই করেন, মনে মনে সারাক্ষণ জপতে থাকবেন, "যীশু আমারে ক্ষমা করো, যীশু আমারে ক্ষমা করো"। এইটা জপতে জপতে এমুন পর্যায়ে নিয়া যাইবেন যে আপনের দিলের ভিতরে অটোমেটিক এই জপুনি চলতে থাকবো। আপনে হয়তো ব্যাংক ডাকাইতি করতেছেন, কিংবা কোন মেয়ের ওড়না ধইরা টান দিতেছেন, তখনও যেন আপনের কলব যীশুর কাছে মাফ চাইতেই থাকে।

ধর্মীয় শিক্ষার এই ব্যাপারটাই ভয়ংকর। ধর্ম পয়লাই আমাগোরে শিখাইয়া দেয় আমার দলে যারা নাই, তারা সব বুরবাক। এর উপরে ডাকাইতি করনের টাইমেও যদি তসবি গুননের বুদ্ধি দেয়, তাইলে আপনে তারে আদালতে আর লইবেন ক্যামনে? আমরা তো শতাব্দীর পর শতাব্দী ধইরা দেখতেই আছি, চোর, ডাকাইত, বাটপার, ধর্ষকেরা তাগো কুকর্ম সাধনের পরে নদীতে ডুব দিয়া, নাইলে পাত্থরে চুমা খায়া, নাইলে কপালে ত্যালের ক্রুশ আঁইকা, নাইলে দেয়ালে মাথা ঠুইকা (মানে যার কিতাবে মাফ চাওনের রেসিপি যেইটা আর কী) সব পাপের ইতিহাস ডিলিট কইরা ফালান, মনে মনে জপেন, "আমি দুই চাইর পাঁচ দশটা রেপ করছি ঠিক আছে, কিন্তু আমি তো বিশ্বাসী! আমারে উনি ঠিকি মাপ কইরা দিবেন"।

'ফ্র্যানি অ্যান্ড জুই'-বইটা খুবই আমেরিকান; আমেরিকান কেরেস্তান ছাড়া বহির্বিশ্বের আর কেউ এই বইয়ের সাথে সেইভাবে সম্পর্ক মনে হয় স্থাপন করতে পারবেন না। আমেরিকান কেরেস্তান-ই হওয়া দরকার, কারণ, বাকী খ্রীষ্টান বিশ্বের সাথে আমেরিকান খ্রীষ্টান বিশ্বাসের কিছু পার্থক্য আছে। আমেরিকা বাদ দিলে বাকী কেরেস্তান বিশ্ব মোটা দাগে মোটামুটি ক্যাথলিক; আমেরিকা প্রটেস্ট্যান্ট (মোটা দাগে, মাইন্ড ইট)। আবহাওয়া, জায়গার অবস্থান, সংস্কৃতি, ভূগোল-এইসবের সাথে সেই অঞ্চলের ঈশ্বরের স্বভাব চরিত্রের আনুপাতিক সম্পর্ক। ক্যাথলিক বিশ্ব আমেরিকার তুলনায় গরীব, তাগোর ঈশ্বরও তাই কথায় কথায় প্রজাগোরে শূলে চড়াইবার চান, কারণ গরীবের মনে মহব্বত, প্রেম-ভালোবাসা কম, আমরা জানি; প্রটেস্ট্যান্ট ধনী আমেরিকার ঈশ্বররে সেই তুলনায় অনেক বেশী দিলখোলা, নেভার-মাইন্ড টাইপের লোক মনে হয়, যিনি ক্যাপিটালিস্টগো দিকে চোখ টিপ মাইরা মেসেজ পাঠাইতেই থাকেন, "যা করতাছ, করতে থাকো, আমি তো আছিই লগে, নাকি?"

প্যারাবল প্রচারের যেই সিস্টেম, এরে ওরে রেফারেন্স ধইরা ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করা, সেটা এইখানেও আছে। স্যালিঞ্জার সংলাপ ভালো লেখেন। প্যারাবল কওয়ার লিগা এই গুণটার দরকার আছে। স্যালিঞ্জার নিজেও নিশ্চয়ই উনার এই ক্ষমতার ব্যাপারে জানতেন, এই কারণেই আমেরিকান যীশু হওনের খায়েশ উনার মাথায় চাপছিলো। ২ তারা দেয়া গেলো ওই সংলাপের বরাতেই। বইটা ক্ষীণকায়, তবুও তাকে একটা বইয়ের জায়গা খায়া দেয়।

2022-07-25T00:00:00.000Z
Antigone

Antigone

By
Jean Anouilh
Jean Anouilh
Antigone

অ্যান্টিগনির গল্পটা আমরা অনেকেই জানি। আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে খ্রীষ্টপূর্ব ৫ম শতকে গ্রীক নাট্যকার সফোক্লিস তাঁর বিখ্যাত ইডিপাস সাইকেল-এর নাটক ৩টি লিখেছিলেন (ইডিপাস রেক্স, ইডিপাস অ্যাট কলোনাস, এবং অ্যান্টিগনি), যেগুলো আজ থিবান প্লেইস নামে পরিচিত। সফোক্লিসের অ্যান্টিগনি গত আড়াই হাজার বছর ধরেই নানা কারণে আলোচিত হয়ে আসছে। সফোক্লিস-পরবর্তী যুগে ইতিহাস বা সাহিত্যের পাতায় যখনই কোন বিপ্লবী (বিশেষত) নারী চরিত্র এসেছেন, যিনি কী না কোন মহান উদ্দেশ্যে নিজের প্রাণের মায়া ত্যাগ করেছেন, তাঁকেই সে যুগের অ্যান্টিগনি উপাধি দেয়া হয়েছে। অ্যান্টিগনি কে, এবং কেন তিনি ইতিহাসে বারবার আলোচিত হয়ে আসছেন-এ বিষয়ে যাঁদের জানা নেই, তাঁদের জন্য সংক্ষেপে অ্যান্টিগনির উপাখ্যানটি এখানে দিয়ে রাখছি। সফোক্লিসের অ্যান্টিগনি-পুরাণ এর কচকচি সেরেই আমরা জাঁ আনুইল-এর আধুনিক অ্যান্টিগনি-এর দিকে চোখ ফেরাবো।

রাজা লাইয়াস ও রাণী জোকাস্টার ঘর আলো করে যখন তাঁদের পুত্র সন্তান ইডিপাস জন্মগ্রহণ করেন, দেবতারা অভিশাপ দিয়ে বসেন (কারণ, অভিশাপ দেবার কাজটাই দেবতারা সবচেয়ে ভালো পারেন), ইডিপাস বড় হয়ে তাঁর আপন পিতা লাইয়াসকে হত্যা করবে, এবং মাতা জোকাস্টাকে বিয়ে করবে। এহেন ভয়ানক দৈববাণী শুনে লাইয়াস ও জোকাস্টা ইডিপাসকে নদীতে ভাসিয়ে দেন, কিন্ত দেবতাদের লীলাখেলা বোঝা বড় দায়! ইডিপাস বেঁচে যান, এবং ভিন্ন এক রাজ্যের রাজার পালিত সন্তান রূপে বড় হতে থাকেন। পরিণত বয়েসে ইডিপাস তাঁর পিতা লাইয়াসের রাজ্যে গিয়ে নিজের অজান্তেই লাইয়াসকে হত্যা করেন, এবং বিধবা জোকাস্টাকে বিয়ে করেন (সেও তাঁর অজান্তেই)। জোকাস্টার সাথে ইডিপাসের ৪টি সন্তান হয়ঃ দুই পুত্র পলিনেসেস, ও এটিওক্লেস, এবং দুই কন্যা ইজমিন, ও অ্যান্টিগনি।

পলিনেসেস ও এটিওক্লেস-কথা ছিলো এ দু'ভাই মিলে পালা করে দেশ শাসন করবে। একজন এক বছর, তো অপর জন পরের বছর। কিন্তু ক্ষমতার লোভ দু'জনকেই পেয়ে বসে; দু'জনই একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে, এবং দু'জনই এ যুদ্ধে প্রাণ খোয়ায়। রাজ্য শাসনের ভার এবার এসে পড়ে তাদের মামা, জোকাস্টার ভাই ক্রেওণের ওপর (যিনি মূলত ইডিপাসেরও মামা)। ক্রেওণ সিংহাসনে বসে প্রথমেই ঘোষনা দেন, এটিওক্লেস যেহেতু পূর্ববর্তী রাজা ছিলো, তাই মহাসমারোহে তার শেষকৃত্য সম্পাদন করা হবে, আর রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করা বদমায়েশ পলিনেসেস-এর মৃতদেহ রাস্তায় পড়ে থাকবে, তা শেয়াল-কুকুর-শকুনে ঠুকরে খাবে। কেউ যেন সে মৃতদেহের ধারেকাছে না যায়, বা কবর দেবার চেষ্টা না করে। এর ব্যত্যয় ঘটলেই মৃত্যুদণ্ড। ক্রেওণ-এর এ ঘোষণায় অ্যান্টিগনি-এর তীব্র ভ্রাতৃপ্রেম জেগে ওঠে, এবং সে রাতের অন্ধকারে লুকিয়ে লুকিয়ে পলিনেসেস-এর পঁচে গলে যাওয়া মৃতদেহ কবর দেবার অভিযানে নামে। শেষরক্ষা হয় না, অ্যান্টিগনি হাতেনাতে ধরা পড়ে, এবং প্রহরীরা তাকে টেনেহিঁচড়ে ক্রেওণের সামনে এনে হাজির করে। এখানে বলে রাখা ভালো, অ্যান্টিগনি ক্রেওণের ভাগনিই নয় শুধু, ক্রেওণের পুত্র হিমনের দয়িতাও বটে। হবু পুত্রবধুকেই নিজের আদেশ অমান্য করতে দেখে ক্রেওন যারপরনাই বিস্মিত ও রাগাণ্বিত হন, এবং এহেন বেয়াড়া আচরণের হেতু কী জানতে চান। জবাবে অ্যান্টিগনি বলে নিজের রক্তের সম্পর্কের জন্য সবরকম ত্যাগ স্বীকার করতে সে প্রস্তুত; নিজের পরিবারের একজন সদস্যের সম্মান রক্ষায় সে মৃত্যুকে তুচ্ছজ্ঞান করতে জানে। একদিকে হবু পুত্রবধূকে শায়েস্তা না করতে চাইবার ইচ্ছে, অপরদিকে শাসক হিসেবে দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করবার প্রেষণা-এ দুইয়ের যাঁতাকলে পড়ে যাওয়া ক্রেওণ শেষতক অ্যান্টিগনিকে মৃত্যুদন্ডেই দণ্ডিত করেন।

নিজ ধর্ম এবং পারিবারিক সম্মান রক্ষার লড়াইয়ে অ্যান্টিগনি হেরে গিয়েও জিতে যায় এবং যুগে যুগে বিপ্লবীরা অ্যান্টিগনির অবতার হয়েই ফিরে আসে-মোটামুটি এই বক্তব্য দাঁড় করিয়ে অ্যান্টিগনিকে ট্র্যাজিক হিরো বানিয়ে সফোক্লিস তাঁর নাটকের উপসংহার টেনেছেন।

অ্যান্টিগনির মতো এমন ট্র্যাজিক হিরোর উদাহরণ ইতিহাসের পাতায় বেশ কয়েকটিই আছে; তর্কসাপেক্ষে সবচেয়ে বিখ্যাত উদাহরণটি প্রায় সাতশ বছর আগের। ১৪ শতকে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের একশ বছর ধরে চলা যুদ্ধে ফ্রান্স যখন প্রায় ব্রিটেনের করাল থাবায়, যুদ্ধের ডামাডোলে ভয়ানক অর্থকষ্টে ভোগা ফ্রান্সের জনগণকে ফরাসী জাতীয়তাবাদের স্বপ্ন দেখিয়েছিলো ১৮ বছরের এক কিশোরী-যাকে আজ আমরা জোয়ান অফ আর্ক নামে জানি। রাজনীতির প্যাঁচে ফেলে ফরাসী ক্যাথলিক চার্চ ও ব্রিটিশরা জোয়ানকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারে। ফরাসীরা জোয়ানের মাঝে অ্যান্টিগনির ছায়াই খুঁজে পান। সফোক্লিসের অ্যান্টিগনির বয়েস ছিলো ২০, আর জোয়ানের ১৮। এঁরা দুজনই যাঁর যাঁর ধর্মীয় বিশ্বাস দ্বারা প্রবলভাবে প্রভাবিত ছিলেন। জোয়ান দাবী করতেন, তিনি নাকি স্বপ্নে নির্দেশপ্রাপ্ত হতেন ফ্রান্সের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দিতে। যে দুজন সন্ত জোয়ানের স্বপ্নে এসে তাঁকে বিপ্লবের এ উৎসাহ দিয়ে যেতেন, তাঁরা হলেন সেইন্ট ক্যাথেরিন, ও সেইন্ট মার্গারেট। এ দু'জনই ১৩/১৪ বছর বয়েসে নিজেদের খ্রিষ্টীয় বিশ্বাস রক্ষা করতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন রোমানদের হাতে। ধর্ম রক্ষার তাগিদে ক্যাথলিক চার্চ ও অর্থোডক্স চার্চ এই দুই কিশোরীকে পূজোর সামগ্রী বানিয়েছে। ওদিকে সফোক্লিসের অ্যান্টিগনি যে তার ভাই পলিনেসেস-এর অনাদরে ফেলে রাখা মৃতদেহটির সৎকার করতে চায়, সেও প্রাচীন রীতিনীতি ও ধর্ম রক্ষার তাগিদেই। ক্রেওণ যখন জিজ্ঞেস করে কেন ভাইয়ের কবর দেয়া নিয়ে অ্যান্টিগনি অত উতলা, তার জবাব আসে,

“মরা লাশের কবর হইলো আসমানী হুকুম;
ব্যাবাকেরই দরকার এইটা, যেমুন দরকার বাথরুম”

নৃপতির হুকুম অমান্য করে আপন ভাইকে কবর দিতে গিয়ে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া অ্যান্টিগনি (কিংবা সফোক্লিস) আমাদের একটা ছবক দিতে চেয়েছেনঃ পরাজয় নিশ্চিত জানবার পরও নিজের যা কিছু আপন (দেশ, ধর্ম, রাজনৈতিক দল, জাতীয়তাবাদ, পরিবার...), সেগুলোর পক্ষে দাঁড়িয়ে লড়াই করতে হয়, নিজের অবস্থানটা শক্তভাবে জানিয়ে দিতে হয়। বিপ্লবীরা জানেন, তাঁদের বেঁচে ফেরার সম্ভাবনা সবসময়ই শূণ্যের কোঠায়, তবুও তাঁরা নিজেদের দাবীর সাথে কখনো আপোষ করেন না। অ্যান্টিগনি, জোয়ান অফ আর্ক, প্রীতিলতা...এঁরা সবাই একই মালার পুঁতি বিশেষ।

কিন্তু...কিন্তু, নিজের যা কিছু আপন, সেগুলো কি সবসময়ই ‘ভালো'? যেকোন পরিস্থিতিতেই কি নিজের একান্ত আপন ব্যক্তি বা বস্তু বিশেষের জন্য আনুগত্য দেখানো উচিৎ? ঠিক এ প্রশ্নে এসেই জাঁ আনুইল আড়াই হাজার বছর ধরে গড়ে তোলা অ্যান্টিগনির সুউচ্চ বিপ্লবী মূর্তিটি ভেঙে চুরমার করে দেন। আপনার নিজের যে দেশ বা জাতি বা পরিবার বা ধর্মবিশ্বাস, সেটির প্রতি আপনার লাগামহীন ভালোবাসা থাকতেই পারে, কিন্তু সার্বিক বিচারে আপনার জাতি বা দেশটি বা পরিবারটি বা ধর্মবিশ্বাসটি কি আপনার এমন শর্তহীন ভালোবাসা আর আনুগত্যের উপযুক্ত? আপনার এই একান্ত ব্যক্তিগত আপন জিনিষগুলো গোটা বিশ্বের মানবসমাজের জন্য আদৌ কতটুকু উপকারী? আপনার নিজের যে জাতি বা দেশ বা পরিবার বা বিশ্বাস-সেগুলোর প্রতি আপনার আনুগত্য থাকা না থাকায় পৃথিবীর কতটুকু এসে যায়? ধরা ছোঁয়া বা শোঁকা যায়না এমন সব বিষয়ের পেছনে আপনার সময়, শ্রম, শক্তি, অর্থ ইত্যাদি ব্যয় করা সবসময় আদৌ কি পোষায়?

এ প্রশ্নগুলোই বারবার উঁকি দেয় আনুইল-এর অ্যান্টিগনিতে, উঠে আসে এক চরম সত্য; সাম্রাজ্যের দখল নিয়ে লড়াইয়ে নামা দুই ভাই পলিনেসেস ও এটিওক্লেস, এদের কেউই আসলে মহান নয়। দু'ভাই-ই সমান লোভী, এবং এদের কারো শোকেই অশ্রুপাত করা চলে না। ক্রেওণ আমাদের জানান তিনি ঘোষণা দিয়ে এটিওক্লেসের শেষকৃত্য সম্পন্ন করছেন আর পলিনেসেস-এর লাশ মাঠে ফেলে রেখেছেন বটে, কিন্তু ভেতরের সত্যটা হলো, রণক্ষেত্রে দু'ভাই এর লাশই এমনভাবে তালগোল পাকিয়ে মিশে গেছে, কোন অংশটি কার সেটি আর আলাদা করবার উপায় নেই। ক্রেওণ নিজেই জানেন না তিনি কাকে কবর দিচ্ছেন, আর কাকে মাঠে ফেলে রেখেছেন; স্রেফ রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করবার জন্যই এটিওক্লেসকে কবর দিতে হচ্ছে তাঁর। সিংহাসনে বসে নৃপতি যদি তাঁর আগেরজনকে ইজ্জত না দেন, নিজের বেলাতেও যে জনরোষে ইজ্জতহানির আশঙ্কা থাকে-ইতিহাসের চিরাচরিত এ শিক্ষা ক্রেওণের ভালোই জানা ছিলো।

কেন আমরা আমাদের দেশকে অন্ধভাবে ভালোবাসি? কেন আমাদের নিজেদের জাতীয়তাবাদকে রক্ষা করতে আমরা বদ্ধপরিকর? কেন আমাদের ধর্মীয় বিশ্বাসকে আমরা দাঁতমুখ খিঁচিয়ে, সর্বস্ব পণ করে আঁকড়ে ধরে থাকি? এ প্রশ্নগুলোর উত্তরে আমরা যা বলি, তাতে আবেগটাই বেশী থাকে, যুক্তি থাকে কম। স্পর্শ করা যায় না এমন একটি বিমূর্ত মনগড়া কাঠামোর ওপর আমরা আমাদের আনুগত্য, ভালোবাসা ইত্যাদি দাঁড় করাই। এই অনুভূতির ব্যাপারগুলো আবেগ-তাড়িত বলে আমরা আমাদের পছন্দের পক্ষ অবলম্বনের পেছনে এমন সব কারণ দেখাই যেগুলোর হয়তো কোন অস্তিত্বই বাস্তবে নেই। অ্যান্টিগনি পলিনেসেস-এর কবর দিয়েই ছাড়বেন বলে যে ধনুকভাঙ্গা পণটি করেছেন, সেটির কারণ হিসেবে তিনি বারবার ছেলেবেলায় ভাইয়ের সাথে তাঁর মধুর সম্পর্কের ইতিহাসকে দেখিয়েছেন, আপন মায়ের পেটের ভাইকে কবর না দিয়ে কীভাবে জীবনভর তিনি এ অপরাধবোধ টেনে চলবেন এ প্রশ্ন করেছেন। কিন্তু এর সব কি আসলেই সত্যি? নাকি অ্যান্টিগনি চোখ দিয়ে নিজের মনকে ঠারিয়েছেন?

অ্যান্টিগনির বোন ইজমিনের বয়ানে আমরা পাই কীভাবে দু' ভাই-ই ছোটবেলায় তাঁদের দু'বোনকে পীড়ন করতেন; ক্রমেই আমাদের কাছে পষ্ট হয়ে আসে, অ্যান্টিগনির অমন ভীষণ প্রতিজ্ঞার পেছনে দাঁড় করানো কারণগুলো সবই তাঁর মনগড়া, নিজের কল্পনাপ্রসূত। ক্রেওণকে দিয়ে জাঁ আনুইল বলিয়েছেন, আসলে অ্যান্টিগনির মরবার একটা ছুতো দরকার, ভ্রাতৃপ্রেম ট্রেম ওসব স্রেফ বকওয়াস। ঊনিশ-কুড়িতে থাকবার সময় আবেগ মানুষকে গিলে খায়, শহীদী মর্যাদা পাবার ইচ্ছেটা সবচেয়ে জোরালো হয় বোধহয় এ সময়েই। ফরাসী বিপ্লব বলুন, বলশেভিক বিপ্লব বলুন, নকশাল আন্দোলন বলুন, হলি আর্টিজান বলুন, আর নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন বলুন-সৃষ্টিশীল বা ধ্বংসাত্নক যেকোন আন্দোলনের ‘ভ্যানগার্ড' আসলে ঐ ঊনিশ-কুড়ির তরুণ (কিংবা তরুণী) সমাজ। তিরিশ কী চল্লিশ-এ এসে মানুষ কদাচিৎ-ই বিপ্লবী হয়। সমাজের সবচেয়ে সবুজ অংশটি যদি রোমান্টিকতার মাদকতায় গা ডুবিয়ে অ্যান্টিগনির মতোই স্রেফ মরবার একটি ছুতোর সন্ধানে বিপ্লবী হয়, তার ফলাফল কী হতে পারে তার শিক্ষা ইতিহাস বইয়ের পাতায় পাতায় রয়েছে। এবং, কার্যতই, আনুইল-এর এ নাটকটিরও একটি ঐতিহাসিক পটভূমিকা রয়েছে।

আনুইল যখন অ্যান্টিগনি লেখেন, সেই ১৯৪৪ সালে ফ্রান্স ছিলো নাৎজি জার্মানির দখলে। ফ্রান্সের শাসনদণ্ডটি তখন নাৎজিদের পুতুল ভিচি সরকারের হাতে। জার্মানীর সাথে হাত মিলিয়ে ভিচি সরকার তার নিজের দেশের প্রায় ৭৫ হাজার ইহুদীদের ধরিয়ে দিয়েছিলো, যাদের ৯০ শতাংশই প্রাণ হারায় বিভিন্ন গ্যাস চেম্বারে। ইহুদী নিধনে ভিচি সরকারের ব্যাপক এ সাফল্যের পেছনে অন্যতম কারণ ফরাসী জনগণের ইহুদীবিদ্বেষ (আমরা তো জানিই, শাসক ঠিক তেমনই হন, যেমনটি হয় দেশের মানুষ)। ফ্রান্সের তরুণ সমাজ সে সময়টায় ফরাসী জাতীয়তাবাদের চেতনায় টগবগ করে ফুটছে, ভিচি সরকারের প্রতি তাদের অগাধ আস্থা; তাদের বিশ্বাস, নিজ দেশের ইহুদীদের মেরে তাড়িয়ে দিলেই ফ্রান্স তরতর করে উন্নতির মহাসড়কে উঠে যাবে। জাতীয়তাবাদের বিষাক্ত পিলটি গলাধঃকরণ করে ফ্রান্সের তরুণ সমাজ যেন নাৎজিদের ক্রীড়নকে পরিণত না হয় তার আহবান-ই সম্ভবত আর সবকিছুকে ছাপিয়ে এই নাটকে উঠে আসে।

সফোক্লিসের ক্রেওণ একগুঁয়ে, স্বেচ্ছাচারী। আনুইল-এর ক্রেওণ ট্র্যাজিক অ্যান্টিহিরো। অ্যান্টিগনির মৃত্যুসংবাদে ক্রেওণের পুত্র হিমন ও স্ত্রী ইউরিডাইস দুজন'ই আত্নহত্যা করে। স্ত্রী, পুত্র, হবু পুত্রবধূকে একসাথে হারিয়ে হতবুদ্ধি হয়ে পড়া ক্রেওণ পরের মুহুর্তেই নিজেকে সামলে নেন, কারণ বিকেল ৫টায় সভাসদদের সাথে তাঁর আলোচনা সভা আছে। শাসককে যে ব্যক্তিগত অনুভূতি, রোগ, শোক, উত্তাপ-এসবের ঊর্ধ্বে উঠতে হয়! ওদিকে লাশের পাহারায় থাকা প্রহরীরা তাস খেলেই যেতে থাকে। অ্যান্টিগনি কে, কোন উদ্দেশ্যে সে প্রাণের মায়া ত্যাগ করেছে, কেন রাজপরিবারের অন্য দুই সদস্য হিমন এবং ইউরিডাইস আত্নহত্যা করেছে, সেসব বিষয় তাদের সায়েব বিবি গোলাম নক্কা টেক্কার হিসেবে কোন ভূমিকা রাখে না...

...কারণ, দেশপ্রেম, জাতীয়তাবাদ, ধর্মবিশ্বাসের মর্যাদা ...ওসব নিরাকার কিন্তু অসম্ভব ভারী কথা দু'বেলা খাবারের সন্ধানে থাকা ছাপোষা সাধারণ মানুষের পেট ভরায় না। এসব রক্ষা না রক্ষায় সৌরজগতের মায় এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কিছুই এসে যায় না।

2022-07-06T00:00:00.000Z
The Bridge on the Drina

The Bridge on the Drina

By
Ivo Andrić
Ivo Andrić,
Lovett F. Edwards
Lovett F. Edwards(Translator)
The Bridge on the Drina



বসনিয়ায় জন্মগ্রহণকারী ক্রোয়েশিয়ান লেখক ইভো আন্দ্রিচ-এর ঐতিহাসিক উপন্যাস দ্যা ব্রিজ অন দ্যা দ্রিনা। এই একটি বই দিয়েই জগৎজোড়া খ্যাতি পেয়ে যাওয়া আন্দ্রিচ ১৯৬১ সালে নোবেল পুরষ্কার জেতেন। ঐতিহাসিক উপন্যাস যেহেতু, তাই ইতিহাসের আলোচনা করতেই হচ্ছে কিছুটা। এই লেখাটির শেষ পর্যন্ত আপনি যাননি এখনো, আমি গিয়েছি; আমি জানি, কত দীর্ঘ একটি আলোচনা ফেঁদে বসেছি এখানে! তাই উপক্রমণিকায় আর বাজে কথা খরচ না করে মূল আলোচনায় চলে যাই, ওপরের ছবিটির apology তখনই দেয়া যাবে খন।

'৮০ এবং '৯০-এর দশকে যাঁদের বেড়ে ওঠা, তাঁরা প্রায় সবাই-ই সংবাদপত্র বা টিভিতে দিনের পর দিন একটি সংবাদ দেখে গেছেনঃ বসনিয়ায় প্রাণঘাতী যুদ্ধ চলছে, হাজার হাজার মানুষ নির্বিচারে মারা পড়ছে প্রতিদিন। ভারতবর্ষে যেখানে আমাদের নিবাস, সেখান থেকে বলকান ব্লকের এ অঞ্চলগুলো এত এত ভীষণ দূরে যে সেখানের এ সংঘর্ষের কারণ বা পরিস্থিতি আমরা কখনো আসলে বুঝে উঠতে পারি না; কে কাকে মারছে, কারা যুদ্ধ করছে-এ বিষয়গুলো আমাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে ওঠে না। ইসলাম-প্রধান দেশ হবার কারণে শুক্রবারের জুমুয়া'র নামাজের সময় আমরা মসজিদে শুনতে পাই ইমাম সাহেব বসনিয়ার মুসলমানদের ওপর চলা এথনিক ক্লিনজিং-এর প্রতিকার চেয়ে দোয়া করছেন, ওপরওয়ালা যেন বসনিয়ায় আমাদের মুসলমান ভাইদের সব কষ্ট লাঘব করে দেন, সে প্রার্থনা করে আমরাও ‘আমিন আমিন' স্বরে ইমাম সাহেবের সাথে গলা মিলিয়ে বসনিয়ার মুসলমানদের প্রতি আমাদের দায়িত্ব সম্পন্ন করি। পরের শুক্রবারটি না আসা পর্যন্ত আমরা বসনিয়ার সংঘর্ষ নিয়ে আর বেশী একটা মাথা ঘামাই না। কেন বসনিয়ায় মুসলমানদের নিশ্চিহ্ন করে দেবার প্রচেষ্টা চলছে, এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের আসলে তাকাতে হবে প্রায় পৌনে এক হাজার বছর বয়েসী লম্বা এক ইতিহাসের দিকে। যে বাঙলাদেশী প্রতিবার রাজনৈতিক ক্ষমতার পালা পরিবর্তনের সাথে সাথে নিজের দেশের ইতিহাস নতুন করে শেখে, তার কাছে বিশ্ব রাজনীতির ইতিহাস জানতে চাওয়া বাতুলতা। আমরা তাই জানতে পাই না (বা চাই না) রাশিয়ার দোরগোড়ায় সেই সুদূর বলকানে স্লাভদের মাঝে মুসলমান মানুষ কোথা থেকে এলো, আর কেনই বা এতগুলো দশক কি শতক ধরে এত রক্ত ঝরে চলেছে।

১৩৮৯ সনে তুর্কী অটোমান সাম্রাজ্য ব্যাটল অফ কসোভো-তে জয়লাভ করে বলকান অঞ্চলের ওপর বিশাল আধিপত্য বিস্তার করে। ক্রমশ ক্ষয়িষ্ণু বিজেন্টাইন সাম্রাজ্যের পতন অবশ্য এর বেশ আগেই শুরু হয়ে গেছে, তখতের দখল নিয়ে নিজেদের মাঝে খেয়োখেয়ির দরুন। অটোমানরা এসে কফিনে শেষ পেরেকটা ঠুকে দেয়। একে একে বুলগেরিয়া, সার্বিয়া, বসনিয়া ইত্যাদি অঞ্চলগুলো চলে যায় অটোমান মুসলমান শাসকদের পুরোপুরি দখলে। বলকানে অটোমান সাম্রাজ্য গেঁড়ে বসবার পর শুরু হয় এক তুঘলকী কাণ্ড; খ্রীষ্টান পরিবারগুলোতে নিয়মিত অটোমান সৈনিকেরা হানা দিতে শুরু করে এবং ৮-১০ বছর বয়েসী বালকদের অপহরণ করে তারা ইস্তাম্বুলে নিয়ে যায়। এই বলকান খ্রীষ্টান বালকদের অটোমানরা প্রশিক্ষণ দিয়ে দিয়ে যোদ্ধা বানায়, যাদের অনেকেই পরবর্তীতে অটোমান সাম্রাজ্যের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সব পদেও আসীন হয়। অপহরণ করে নিয়ে আসার পর প্রথম যে কাজটি করা হয়, তা অবশ্যই ধর্মান্তরকরণ। এ ধরণের জোরপূর্বক ধর্মান্তরকরণের মাধ্যমেই মূলত বলকানে ইসলামের প্রসার ঘটে। মেহমেত পাশা সকোলোভিচ এমনই একজন বাল্যে অপহৃত বলকান, যিনি পরবর্তীতে অটোমানদের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয়ে দিগ্বিজয়ী যোদ্ধা হন, এবং অটোমান সাম্রাজ্যের গ্র্যান্ড ভিজির-এর সিংহাসনে বসেন (ভিজির => উজির, বা সরকার প্রধান; অটোমান সুলতানের পরেই এই পদের অবস্থান। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীকে আজও উর্দুতে ‘উজির-এ-আজম' বলা হয়)।

বসনিয়ার দ্রিনা নদীটি বেশ অদ্ভুত; আর সব নদীর মতো এই নদীর পানি নীল নয়, সবুজ! সার্বিয়ান- বসনিয়ান শহর ভিজেগ্রাদে এ নদীর অবস্থান। এই ভিজেগ্রাদেই মেহমেত পাশার বাল্যকাল কেটেছে, এখান থেকেই ছেলেবেলায় অপহৃত হয়েছিলেন তিনি। সময়ের পরিক্রমায় অটোমান সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদে আসীন হবার পরেও মেহমেত পাশা খুব সম্ভব তাঁর সার্বিয়ান-অর্থোডক্স খ্রীষ্টান জন্মপরিচয়টি ভুলে যেতে পারেননি; শেকড়ের টানেই কী না কে জানে, ১৫৭৭ সালে তিনি দ্রিনা নদীর ওপর একটি সেতু নির্মাণ করেন। সাড়ে চারশ' বছরের ইতিহাসের সাক্ষী এই সেতু আজও দিব্যি দাঁড়িয়ে আছে সগৌরবে। মাঝে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ঠিক আগে বলকান যুদ্ধে বেশ অনেকখানি ধ্বংস করে ফেলা হয়েছিলো, আবার তা পুণঃনির্মাণ করা হয়েছে। এই সেতুটি আজ জাতিসংঘের ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ তালিকায় রয়েছে। ইভো আন্দ্রিচ-এর ঐতিহাসিক উপন্যাস এই সেতু এবং এর ইতিহাস নিয়েই। এই সেতুটি আসলে শুধু একা মেহমেত পাশা বা ৬০০ বছরের অটোমান সাম্রাজ্যের শাসনকালের সাক্ষ্যই দেয় না; বলকান ব্লকে শত শত বছর ধরে যে হানাহানি হয়ে আসছে, সে ইতিহাসের নীরব সাক্ষী এই সেতু। আন্দ্রিচের উপন্যাসে উঠে আসে বলকানের ঐ অঞ্চলে মানুষে মানুষে হানাহানি কিভাবে দ্রিনার সবুজ পানি বারবার রক্তে লাল করেছে। ১৯১৪ সালে ঘটে যাওয়া প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপট জানতে এবং বুঝতে হলেও আমাদের চোখ কিছুটা ফেরাতে হবে মেহমেত পাশার শখের এই সেতুর দিকেই।


ছবি-সূত্রঃ উইকিপিডিয়া

যে ব্যাপারটি আন্দ্রিচ-এর এ বইতে বারবার চোখে পড়ে তা হলো ভিনদেশী, ভিন্ন ভাষা ও ভিন্ন সংস্কৃতির শাসকদের যাঁতাকলে স্লাভিক জনগণের ক্রমাগত পিষ্ট হয়ে চলা। ২০ শতকের শুরুর দিকে অটোমানরা বলকানে তাদের ৬০০ বছরের শাসনে যতি টানে বটে, কিন্তু তাতে বলকান জনগণের পরাধীনতার পালা শেষ হয় না। এবার সেখানে হাত বাড়ায় অস্ট্রীয়-হাঙ্গেরীয় (বা হাবসবার্গ) সাম্রাজ্য । অটোমান এবং হাবসবার্গীয়-দুই সময়েই বলকানের জনগণ ভুগেছে, তবে আন্দ্রিচ তাঁর বইতে অটোমান শাসনামল নিয়ে সুক্ষ্ম এবং স্থুল-দু'ভাবেই বেশ অনেকটা খেদ ঝেড়েছেন। ইসলামিক শাসন-ব্যবস্থার সাথে ঐতিহাসিকভাবে অর্থোডক্স-খ্রীষ্টান বলকান এলাকাগুলো কখনো সেভাবে মানিয়ে নিতে পারেনি। শাসন-ব্যবস্থার বিরোধীদের প্রতি কঠোরতা প্রদর্শনের জন্য অটোমানদেরও ছিলো আকাশছোঁয়া খ্যাতি। পান থেকে চুন খসলেই ভয়ানক সব শাস্তির খড়্গ নামিয়ে আনতো তারা। আন্দ্রিচ টুকে রেখেছেন সেইসব বিদ্রোহী স্লাভদের কথা, অটোমান শাসকদের বিরোধীতার জন্য যাদের চরম মূল্য দিতে হয়েছে। তাদের শিরোচ্ছেদ করে কাটা মুণ্ডুগুলো দ্রিনা নদীর সেই সেতুর ওপর দিনের পর দিন ঝুলিয়ে রাখা হতো প্রদর্শনীর জন্য। সেতুর প্রবেশমুখে, বা সেতুর ওপরেই এখানে সেখানে এত এত কাটা মাথা নিত্যনতুন শোভা পেতো যে অভ্যেসের দাস মানুষের সেদিকে আর চোখই পড়তো না। কয়েকশ বছর পর যখন এভাবে কাটা মাথা ঝুলিয়ে রাখা বন্ধ করা হয়, তখন নাকি অনেকে খেয়ালই করেনি দুই সময়ের পার্থক্যটা কী!

এছাড়াও, বিদ্রোহীদের পশ্চাৎদ্দেশ দিয়ে চোখা, ভীষণ মসৃণ বাঁশ ঢুকিয়ে পিঠ বা কাঁধ দিয়ে বের করে রোদ কি প্রচণ্ড ঠাণ্ডার মাঝে ঘণ্টার পর ঘন্টা টাঙিয়ে রেখে রক্তক্ষরণ ঘটিয়ে ঘটিয়ে একটু একটু করে খুন করার কায়দাটিও অটোমান শাসকদের বেশ প্রিয় ছিলো। নারকীয় এইসব শাস্তির বিধান জারী রেখে যে ভয়ের সংস্কৃতিটি অটোমানরা আরোপ করে, তা বলকানের ওপর তাদের ৬শ বছরের প্রায় নিরুপদ্রব শাসনের পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে। শাসক শ্রেণীর সাথে জনগণের সাংস্কৃতিক পার্থক্যটা ৬শ বছরে এত বেড়ে যায় যে, ১৯০৮ সালে যখন অটোমানরা বলকানের পাট চুকায়, তখনও ক্যাথলিক ও অর্থোডক্স খ্রীষ্টান, এবং ইহুদীরা মুসলমানদের জুজুর ভয়ে থাকতো। হাবসবার্গ খ্রীষ্টান সাম্রাজ্য ক্ষমতায় আসার পর মুসলমানদের ওপর এবার পাল্টা ঝাল ঝাড়া শুরু করে খ্রীষ্টানরা। অবিশ্বাস ও প্যারানয়া-যেকোন যুদ্ধের এই-ই তো রেসিপি। দুই ধর্ম বিশ্বাসের এই প্যারানয়া আজও একই শক্তিতে দীপ্যমান, যার হাত ধরেই ১৯৯২ সালে ঘটে যায় বসনিয়ার যুদ্ধ। বলকানের বুক থেকে মুসলমানদের নিশ্চিহ্ন করে দেবার হীন এক প্রতিজ্ঞায় নামে সার্ব ও ক্রোয়াটরা।

একটি দেশের মূল ভিত্তি কী হওয়া উচিৎ? ধর্ম, নাকি ভাষা? আমাদের উপমহাদেশের ভারত, পাকিস্তান, ও বাঙলাদেশ ভাগ হয়েছে ধর্মের ভিত্তিতে; এই ভাগাভাগির পেছনে বহু ধর্মীয় সংঘাত, হানাহানি, ধর্ষণ ও রক্ত জড়িয়ে আছে। যে দেশগুলোই ধর্মের ভিত্তিতে নিজেদের পরিচয় নির্ধারণ করেছে, বা সেদিকে যাবার পাঁয়তারা কষছে, তারা কেউই আজ ভালো নেই, থাকবার কথাও নয়। একই ধর্মের সব মানুষদের নিয়ে দেশ বানাবার মতো বর্বর, মধ্যযুগীয়, এবং বর্ণবিদ্বেষী আর কিছু আছে কি? এ ধরণের রাষ্ট্রব্যবস্থায় মানব চরিত্রের বৈচিত্র্যতা, ব্যক্তিস্বাধীনতা, এবং সৃষ্টিশীলতার স্থান থাকে না। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোই পরোক্ষভাবে দেশগুলোর রাজনৈতিক আসনগুলো নিয়ন্ত্রণ করে, এবং দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক নীতিগুলো ধর্মকে কেন্দ্র করেই গঠিত হয়। যেহেতু গোটা বিশ্বের সবাই একই ধর্মের অনুসারী নয়, একটি নির্দিষ্ট ধর্মীয় অনুশাসন দিয়ে দেশ চালাতে গেলে তাই অন্য পদ্ধতিতে চালনাকৃত দেশগুলোর সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-সাহিত্য, বা যেকোন মানবিক যোগাযোগই কার্যত বাধাগ্রস্ত হয়। ধর্মীয় অনুশাসনে চলা দেশগুলো একদিকে যেমন নিজেদের জনগণকে ধর্মের কলা খাইয়ে প্রতারিত করে চলে, তেমনি বৈশ্বিক ধর্মীয় উন্মাদনাতেও ঘি ঢালে। ভাষার ভিত্তিতে দেশ বানাবার ধারণাটির শামিয়ানা ধর্মের শামিয়ানার চেয়ে ঢের, ঢের বড়-এটাই আমার ব্যক্তিগত মত। কিন্তু... কিন্তু, ভাষার ভিত্তিতে দেশ হলেই কি সব হানাহানি, মারামারি শেষ হয়ে যাবে? মানুষে মানুষে পার্থক্য ঘুচে যাবে?

স্লোভেনিয়া, ক্রোয়েশিয়া, বসনিয়া-হার্জেগোভিনা, মন্টেনেগ্রো, সার্বিয়া, ও ম্যাসেডোনিয়া-এই ছ'টি অঞ্চলকে নিয়ে মার্শাল টিটো সমাজবাদী ইউগোস্লাভিয়া বানিয়েছিলেন; সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর এই অঞ্চলগুলোর প্রত্যেকটিই ইউগোস্লাভিয়া থেকে বেরিয়ে এসে নিজ নিজ স্বাধীনতা ঘোষণা করে। সাবেক ইউগোস্লাভিয়ার এই ছ'টি দেশ জুড়ে যে আড়াই কোটি মানুষ আছে, তাদের মুখের ভাষা ‘দক্ষিণ স্লাভিক' পরিবারের অন্তর্গত (বলকানে আরো দু'রকম স্লাভিক ভাষার প্রচলন রয়েছে; পশ্চিমী স্লাভিকঃ রুশ ও ইউক্রেনীয়, এবং পূর্বীয় স্লাভিকঃ পোলিশ, চেক ইত্যাদি)। ইভো আন্দ্রিচ তাঁর তরুণ বয়েসে দক্ষিণ স্লাভিক ভাষাভাষীদের নিয়ে একটি দেশ গড়ার স্বপ্ন দেখতেন, বলকানের বাস্তবতায় ক্রমে সে দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সরে এসেছেন। বসনিয়া-হার্জেগোভিনা, ক্রোয়েশিয়া, ও সার্বিয়াতে মানুষ ‘একই ভাষায়' কথা বলে, যাকে এখন বসনিয়ান-ক্রোয়েশিয়ান-সার্বিয়ান বা বিসিএস ভাষা বলা হয়। ক্যাথলিক ক্রোয়েশিয়ানরা এই ভাষা লেখেন ল্যাটিন হরফে, অর্থোডক্স সার্বরা লেখেন সিরিলিক হরফে, আর বসনিয়ার মুসলমানেরা এই একই ভাষায় কিছু তুর্কী শব্দ আমদানী করেছেন, ভাষাটিকে ইসলামিক একটি রুপ দেবার জন্য, অনেকটা আমাদের জল-পানি যেমন (অর্থাৎ, নিজেদের ভাষার পার্থক্যের ভিত্তিটি এঁরা আপন আপন ধর্মবিশ্বাসকে কেন্দ্র করেই গড়েছেন)। যদিও এঁরা সবাই সবার কথা দিব্যি বুঝতে পারেন, তিনটি অঞ্চলের মানুষেরাই নিজ নিজ ভাষাটিকে একটি স্বকীয় ভাষা হিসেবে দাবী করে আসছেন। ১৯৯২-এর বসনিয়ার যুদ্ধে এই তিনটি দেশই একে অপরের বিরুদ্ধে মেক্সিক্যান স্ট্যান্ডঅফে দাঁড়িয়ে যায়; লক্ষাধিক মানুষ অনর্থক প্রাণ হারায়, ধর্ষিত হয় অগুনতি নারী (বিশেষত বসনিয়ান মুসলমান নারী)। ভাষার একাত্নতা এঁদের একে অপরের কাছে নিজেদের পশু হিসেবে প্রতীয়মান করাবার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। তবে এই সংঘাতের গোড়ায় কার্যত পানি ঢেলেছে সেই ধর্মবিশ্বাস-ই।

ভাষাবিদদের মাঝে একটি কৌতুক প্রচলিত রয়েছেঃ ভাষা (language) এবং আঞ্চলিক টান (dialect)-এর মাঝে পার্থক্য কোথায়? এর উত্তর হলোঃ ভাষা আসলে এমন একটি আঞ্চলিক টান যার সমরশক্তি রয়েছে। অর্থাৎ, নিজের ভাষাটির মর্যাদা স্থাপন করতে গেলে আপনাকে কিছুটা গায়ের জোর খাটাতেই হবে! বলকান অঞ্চলের জন্য এই কথাটি ভীষণভাবে খাটে। চট্টগ্রামে বহুল প্রচলিত স্থানীয় চাটগাঁইয়া ভাষাটি বাঙলাদেশের সিংহভাগ মানুষই বোঝেন না, এবং এটিকে বাঙলাদেশে প্রচলিত বাঙলা ভাষার একটি আঞ্চলিক রূপ হিসেবেই দেখেন। চাটগাঁইয়া ভাষাভাষীরা আবার চট্টগ্রামের বাইরের কাউকে বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, ইতার তন ছিটাইঙ্গা ন আইশ্যে দ্দে, ইতা বৈঙ্গা (“এই ব্যক্তি চাটগাঁইয়া পারে না, সে বহিরাগত!”)। ওদিকে রোহিঙ্গারা প্রায় এই চাটগাঁইয়া ভাষাটিরই খুব কাছাকাছি একটি রূপ আরবী হরফে লিখে সেটিকে রোহিঙ্গা ভাষা হিসেবে স্বকীয়তা দান করেছেন। ধর্ম কিংবা ভাষা কিংবা জাতীয়তাবোধ-মানুষ আসলে কোন না কোন একটার ছুতোয় নিজেকে/ নিজের দলকে অপরের চেয়ে উঁচুতে দেখতে চায়। বসনিয়ায় যে খ্রীষ্টধর্মী সার্বরা রয়েছে, এবং সার্বিয়ায় যে মুসলমান বসনিয়ানরা রয়েছে, তারা তাদের শতাব্দী-প্রাচীন সংঘাতের ইতিহাসটি ভুলতেই পারছে না; অবিশ্বাস এবং সন্দেহের দুষ্ট চক্রে পাক খেতে খেতে বারবারই তারা জড়িয়ে পড়ছে নিত্যনতুন সংঘাতে। ১৯৯২-১৯৯৫, এই ৩ বছর ধরে বসনিয়া-হার্জেগোভিনার দখল নিয়ে যুদ্ধ এবং গণহত্যার দুঃস্বপ্নের পর শেষমেষ বসনিয়া-হার্জেগোভিনাকে দু'ভাগে ভাগ করা হয়। এক ভাগে থাকে বসনিয়ান সার্বরা (রিপুবলিকা সেরপ্‌স্কা, মানচিত্রের লাল অংশ), আরেকভাগে বসনিয়ান মুসলমানরা (ফেডারেশন অফ বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনা)।


ছবি-সূত্রঃ উইকিপিডিয়া

সার্বিয়ার সাবেক রাষ্ট্রপতি রাদোভান কারাদচিচ বসনিয়ান মুসলমানদের ওপর গণহত্যা চালিয়ে এখন আজীবন জেলের সাজা খাটছেন, কিন্তু সার্বিয়ায় তাঁকে জাতীয় নায়ক হিসেবে দেখেন এমন মানুষের সংখ্যাও খুব কম নয়। জাতীয়তাবাদ ও ধর্ম-এ দু'টি বিষাক্ত পিল একসাথে গলাধঃকরণ করে বর্ণবিদ্বেষী কুৎসিত একটি রূপ গ্রহণ করা (মূর্খ) মানুষের চিরাচরিত লক্ষণ। বসনিয়ার যুদ্ধের প্রায় ৩০ বছর পেরিয়ে যাবার পর জাতিগত বিদ্বেষ আজ আবার নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। সার্বিয়ান নেতা মিলোরাদ দোদিচ তাঁর পূর্বসুরী কারাদচিচের সিলসিলায় আবার যুদ্ধ লাগাতে চাইছেন, বসনিয়ান মুসলমানদের বের করে দিতে চাইছেন। সুদূর তুরস্ক থেকে আসা শাসকদের হাত ধরে মুসলমান হয়ে যাওয়া স্লাভ এখন বাকী সব স্লাভদের কাছে ‘বৈঙ্গা'।

ইভো আন্দ্রিচ তাঁর এ গোটা বইয়ে মুসলমানদের প্রায় পুরোটা সময় হয় ‘তুর্কী' নয় ‘আরব' বলে সম্বোধন করেছেন। বিদেশী একটি সংস্কৃতি যে ৬শ বছরেও তাঁর নিজের সংস্কৃতির সাথে খাপ খাইয়ে নেয়নি, এক হবার চেষ্টা করেনি, এমন একটি আক্ষেপই সম্ভবত মোটা দাগে উঠে আসে শেষ পর্যন্ত এ বইয়ে। বসনিয় সাহিত্য সমালোচকরা আন্দ্রিচের প্রতি মুসলিম-বিদ্বেষ-এর অভিযোগ টানেন, আন্দ্রিচ একেবারে দুধে ধোয়া তুলসী পাতাও হয়তো নন, কিন্তু আন্দ্রিচকে কৃতিত্ব দিতেই হয় একটি কারণে। এ বইটি লিখে বসনিয়ার জনগণের ৬শ বছরের সংঘাতের ইতিহাস জানিয়ে আন্দ্রিচ মূলত আমাদের মনে করিয়ে দেন, ধর্মের পার্থক্য এ অঞ্চলের ওপর যে গভীর ক্ষত তৈরী করে দিয়ে গেছে বিগত শতকগুলোতে, এর প্রভাব খুব সহজে চলে যাবে না, আরো বহু বহু দশক ধরেই সম্ভবত এই সংঘাত টেনে যেতে হবে। এ লেখা শুরু করেছিলাম টুইটার থেকে প্রাপ্ত একটি ছবি দিয়েঃ গত বছর নভেম্বরে বিশ্বকাপ ফুটবলের বাছাই ম্যাচে ইউক্রেনীয় দর্শকেরা রাশিয়ার আগ্রাসনের প্রতিবাদ করতে রাশিয়ার পতাকাটি উল্টো করে ঝুলিয়ে রেখেছিলো, কিন্তু সেটি তখন আবার দেখতে সার্বিয়ার পতাকার মতো দেখায়। খেলা দেখতে আসা বসনিয় দর্শকেরা ইউক্রেনীয়দের সার্ব ভেবে আক্রমণ করে বসে। বলকানের ইতিহাস যাঁর জানা আছে, তিনি কি এতে মোটেই অবাক হবেন?

আন্দ্রিচ যে এ বই লিখে আমাদের মনে করিয়ে দিলেন এই সংঘাত আরো বহুদিন চলবে, এর পেছনে একটি ঐতিহাসিক পর্যবেক্ষণকে দাঁড় করানো যায়ঃ সত্য স্বীকার করে নেবার ক্ষেত্রে ইসলামিক রাষ্ট্রগুলোর ভীষণরকম কৃপণতা। ইসলামিক বিশ্বের প্রতিটি দেশেই গণতন্ত্র, বাকস্বাধীনতা, নাগরিকের ভোটাধিকার, রাষ্ট্র ও শাসনব্যবস্থার পৃথকীকরণ, ও শাসকদের জবাবদিহিতা-এ বিষয়গুলো চরমভাবে অপব্যবহৃত হয়; এই দেশগুলোর মাথা যাঁরা, নিজেদের গদি টিকিয়ে রাখতে মধ্যযুগীয় প্রথাতেই তাঁরা দেশ চালিয়ে থাকেন, ফলে তাঁদের দেশগুলোর জনগণেরা সত্য-সন্ধানী হতে পারে না, সত্যের চর্চা করতে শেখে না, এবং কার্যত সত্য কথাও বলতে তারা জানে না। যেখানে সত্যের চর্চা ছিনতাই হয়ে গেছে, সেখানে কোন বিশ্বাসযোগ্য গবেষণা হতে পারে না, কোন ঘটনার সঠিক কার্যকারণও সেখানে জানা যায় না। এইসব কারণে গোটা ইসলামিক বিশ্বই জ্ঞানচর্চার দিক থেকে, এবং পড়াশোনার ক্ষেত্রে ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে। এ ব্যাপারটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ, পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার ৪ ভাগের ১ ভাগ ইসলামিক বিশ্বের; এঁরা যদি নিজেদের ধর্মবিশ্বাসটিকেই সর্বশ্রেষ্ঠ মনে করে শুধু সেটিকেই অন্ধভাবে আঁকড়ে ধরে রেখে বাকী বিশ্বকে শত্রু ঠাউরে নিজেদের অজ্ঞানতার অন্ধকারে ঠেলে যাবার চিরাচরিত ঐতিহ্যটি চালিয়ে যান, পৃথিবীর বাকী ৩ ভাগ মানুষের জনজীবনের ওপরও তা বিরূপ ভূমিকা রাখা শুরু করবে।

অটোমান বা যেকোন ইসলামিক শাসকগোষ্ঠীর অত্যাচারের ইতিহাস ইসলামিক বিশ্বের কোথাওই স্বীকৃত নয়; নিজেদের ধর্মের ভাইরা কখনোই কোন খারাপ কাজ করতে পারেন না-এমন একটি আত্নসৃষ্ট প্রপঞ্চে গা ডোবাতে মুসলমান জনগণ ভালোবাসেন। তাঁদের এই ভ্রান্তিবিলাসের জন্যই আর্মেনিয়ার ওপর চালানো তুরস্কের বা ইয়েমেনের ওপর চালানো সৌদি আরবের, বা বাঙলাদেশের ওপর চালানো পাকিস্তানের গণহত্যার কোন বিচার আন্তর্জাতিক কোন আদালতে হয় না, যেমনটা হয়েছে রাদোভান কারাদচিচ বা তাঁর দোসর স্লোবোদান মিলোসেভিচের। তুরস্কে বা পাকিস্তানে বা সৌদিতে উপর্যুক্ত গণহত্যাগুলোর ব্যাপারে কথা বলা কার্যত রাষ্ট্রদ্রোহের সামিল। মুসলিম দেশগুলোর মাঝে যেহেতু কোন ঐক্য নেই, এরা একজোট হয়ে মুসলমানদের ওপর চলা কোন অবিচারের প্রতিবাদও তাই করতে পারে না, ফলে অত্যাচারিতের ওপর অত্যাচার বাড়তেই থাকে। বসনিয়ায় নতুন করে যে ধর্মীয় টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়েছে তা নিয়ে ইসলামিক বিশ্ব আদৌ ভাবিত নয়, যেমনটি তারা নয় চীনের উইঘুরদের নিয়েও। ইরান, সৌদী-আরব, তুরস্ক, মিশর, পাকিস্তান, কাতার, সিরিয়া, কুয়েত, বাহরাইন, ওমান-ইসলামিক বিশ্বের চাঁই এই সবক'টি দেশ রায় দিয়েছে চীন উইঘুরদের মোটেই অত্যাচার করছে না। বসনিয়ার ক্ষেত্রেও ভিন্ন কিছু হবে না, কারণ ধর্মের ভাইকে বাঁচাতে গিয়ে এরা কেউই রাশিয়ার (বা চীনের) অর্থনৈতিক আশীর্বাদ থেকে বঞ্চিত হতে চায় না।

ইভো আন্দ্রিচ-এর এ বইটির প্রেক্ষাপট নিয়েই সব কথা খর্চা করে ফেললাম, বইটি কেমন সে আলোচনায় যাবার সুযোগ পাইনি। এক কথায় বলতে গেলে বইটি আসলে খুব সুখপাঠ্য কিছু নয়। উপন্যাসের যে চিরাচরিত ধারা, সেটির চেয়ে বেশ অনেকটাই ব্যতিক্রম এ বই, কারণ এটি লেখা হয়েছে বেশ অনেকটাই নন-ফিকশন বা প্রবন্ধের আকারে। স্থায়ী কোন চরিত্র নেই, ৩১৫ পাতার বইতে সংলাপও সাকুল্যে ১০ পাতার মতো। শিল্পমান বিবেচনায় বইটি আসলে বেশ কম নাম্বারই বোধহয় পাবে, অন্তত ইংরেজী অনুবাদে পড়ে আমার তাই মত! আগ্রহোদ্দীপক, বর্ণিল এক ঐতিহাসিক সময়ের গল্প ধরেছেন আন্দ্রিচ, সেই সময়ের মায়াতেই বইটি এগিয়ে যায়, আন্দ্রিচের লেখনশৈলীতে বেশী একটা নয়। মুসলমানদের কাছ থেকে নিন্দা কুড়নো, ‘মুসলিম-বিদ্বেষী' তকমা এঁটে যাওয়া, এবং নিজ বইতে স্লাভিক মুসলমানদের তুর্কী কিংবা আরব বলে যাওয়া আন্দ্রিচ নোবেল জেতার পর যা টাকা পেয়েছিলেন, তার সবটাই তিনি বসনিয়ার গ্রন্থালয়গুলোতে বই কেনার জন্য দান করে দেন, নিজের জন্য কিছুই রাখেননি। ঐতিহাসিকভাবেই মুসলমান-সংখ্যাগরিষ্ঠ বসনিয়ার গ্রন্থাগারের প্রতি তাঁর এই মায়া সম্ভবত ইঙ্গিত দেয় দিনশেষে তিনি মুসলমান-ক্যাথলিক-অর্থোডক্স-ইহুদী ভেদে একটি দক্ষিণ-স্লাভিক ঐক্যই দেখতে চেয়েছেন, ফালতু ধর্মীয় দলাদলি নয়।

১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপট রচিত হয় এই বসনিয়ার রাজধানী সারায়েভোতে। অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর হাবসবার্গ সাম্রাজ্য যখন বসনিয়া ও হার্জেগোভিনাকে এক করে ঘোষণা করে তারাই এই অঞ্চলের নতুন মালিক, বসনিয়ান সার্বদের মোটেই পছন্দ হয় না এই প্রস্তাবনা। ৬ শতকের পরাধীনতার শেকলে আবদ্ধ থাকা স্লাভরা নিজেদের জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্রব্যবস্থা দাবী করে। হাবসবার্গ সাম্রাজ্যের রাজপুত্র আর্চডিউক ফ্রাঞ্জ ফার্দিনান্দ তখন সশরীরে সারায়েভো গিয়ে হাজির হন তাঁর দাবীটি জোরালো করবার জন্য। সারায়েভো'র রাস্তা দিয়ে আর্চডিউক সার্বিয়ার জনগণের সামনে গাড়ীবহর হাঁকিয়ে শোডাউন করবেন-এমনটাই ছিলো পরিকল্পনা। নিরাপত্তাজনিত কারণে শেষ মূহুর্তে ভিন্ন এক রাস্তা দিয়ে গাড়ী চালাবার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, কিন্তু গাড়ী বহরের দুই চালক ছিলো জাতে চেক, গাড়ী ডানে ঘোরাবার জার্মান ভাষার নির্দেশ তারা বোঝেনি। বামের রাস্তায় ১৯ বছরের সার্বিয়ান তরুণ গাভ্রিলো প্রিন্সিপে পিস্তল হাতে প্রস্তুত হয়েই ছিলো, আর্চডিউকের বুকে দু'টো গুলি সেঁধিয়ে দিতে বেশী কষ্ট করতে হয়নি।

শুরু হয়ে যায় ৪ বছর মেয়াদী প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, যাতে প্রাণ হারায় ৪ কোটি মানুষ, চিরদিনের জন্য তছনছ হয়ে যায় অগুনতি মানুষের জীবন, আর ২ দশক পরেই ডেকে নিয়ে আসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ।

2022-04-03T00:00:00.000Z
Medea and Other Plays

Medea

By
Euripides
Euripides,
James Morwood
James Morwood(Translator)
Medea and Other Plays

সফোক্লিস, অ্যাস্কাইলাস ও ইউরিপিদেস-শুধুমাত্র এই তিন প্রাচীন গ্রীক ট্র্যাজিক নাট্যকারেরই এক বা একাধিক নাটক প্রায় আড়াই হাজার বছরের ব্যবধানে সম্পূর্ণ অবস্থায় আজও টিকে রয়েছে। এঁরা তিনজনের প্রত্যেকেই গড়ে ৮০-৯০টি করে নাটক লিখে গেছেন; এগুলোর মাঝে সফোক্লিস ও অ্যাস্কাইলাসের ৭টি করে মোট ১৪টি, ও ইউরিপিদেস-এর ১৯টি-এই ৩৩টি নাটকই শুধু আজ আমরা পড়তে বা দেখতে পাই, বাকী সব সময়ের নির্বিকার থাবায় হারিয়ে গেছে। ইউরিপিদেস-এর টিকে যাওয়া ১৯টি নাটকের কালানুক্রমিক হিসেব করলে ‘মিদিয়া' ২য়; খ্রীষ্টপূর্ব ৪৩১ সনে তিনি নাটকটি লেখেন।

বাবা-মা চেয়েছিলেন ইউরিপিদেস সেনাবাহিনীতে নাম লেখান, কিন্তু তাঁর মন ছিলো নাটক লেখায়। সমসাময়িক দুই পূর্বসুরী সফোক্লিস ও অ্যাস্কাইলাসের সাথে প্রায়ই তিনি প্রতিযোগীতায় নামতেন, যদিও ১ম, ২য় বা ৩য় স্থান অর্জন করে পুরষ্কৃত হয়েছেন মোটে ৭বার। মিদিয়া লিখে এমনই এক প্রতিযোগীতায় তিনি ৩য় হন। সেবারের প্রতিযোগীতা নাকি এতই তীব্র হয় যে ট্র্যাজেডি নাটকের সর্বেসর্বা গুরু যিনি, সেই সফোক্লিসও ২য় হন। ১ম স্থানটি জিতে নেন অ্যাস্কাইলাস-পুত্র ইউরিফোরিওন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, অ্যাস্কাইলাসের যে ৭টি নাটক আজ আমাদের হাতে আছে, তাদের মাঝে সবচেয়ে বিখ্যাত প্রমিথিয়াস ব্যাউন্ড; আধুনিক গবেষণা বলছে এই নাটকটি খুব সম্ভব অ্যাস্কাইলাস আদৌ লেখেননি, লিখেছেন তাঁর পুত্র ইউরিফোরিওন। ইউরিপিডেস-এর একটি নাটক রেসাস-এর লেখকস্বত্ত্বা নিয়েও বিতর্ক আছে; যদি ইউরিপিদেস ও অ্যাস্কাইলাস সত্যিই রেসাস ও প্রমিথিয়াস ব্যাউন্ড না লিখে থাকেন, তাহলে আসলে ৩জন নয়, ৫ জন গ্রীক ট্র্যাজিক নাট্যকারের কাজ আমাদের হাতে আছে। যাকগে, এসব পণ্ডিতদের তর্ক-বিতর্কের বিষয়, এখানে আমাদের ভূমিকা শুধুই নির্বাক দর্শকের।

মিদিয়া মূলত প্রতিহিংসার নাটক। ইউরিপিদেস তাঁর অনেক নাটকই বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনীর ওপর ভিত্তি করে লিখেছেন; মিদিয়াও তার ব্যতিক্রম নয়। পুরাণের মূল গল্পটি জানা না থাকলে আধুনিক পাঠক ইউরিপিদেস-এর নাটকটি পড়তে বা দেখতে গেলে কিছুটা হোঁচট খেতেই পারেন, তাই গ্রীক পুরাণ অনুযায়ী মিদিয়ার আখ্যান সংক্ষিপ্ত পরিসরে এখানে আগে লিখে রাখছি, এরপর নাটকের ব্যখ্যা বিশ্লেষণ, কাটাছেঁড়া ইত্যাদির অভিনয় করা যাবেঃ

থেসালি'র রাজা এইসনকে (Aeson) তাঁর ক্ষমতালোভী সৎ ভাই (সৎ মা/বাবা/বোন/ভাই রা বরাবরই ‘অসৎ' হন, সন্দেহ কি?) পিলিয়াস সিংহাসন থেকে উৎখাত করেন এবং এইসনের সকল উত্তরসূরীদের তিনি নির্মমভাবে হত্যা করেন। এইসনের স্ত্রী আলসিমেদে গোপনে এক সন্তানের জন্ম দেন (জেসন) যাকে তিনি পিলিয়াসের চোখ এড়িয়ে কাইরন নামক এক সেন্টরের কাছে দীক্ষা নিতে পাচার করে দেন। পিলিয়াসের কাছে দৈববানী আসে, বাঁকা রাস্তায় ক্ষমতায় বসার জন্য একদিন তাঁর পতন হবে, আর সে পতন নিয়ে আসবে এমন এক লোক যার এক পায়ে জুতো নেই।

বহু বছর পর পিলিয়াস একদিন তাঁর রাজ্যে এক খেলার আয়োজন করেন যেখানে জেসন এসে হাজির হন। পিলিয়াসের টুর্নামেণ্টে আসার পথে আনাভারোস নদী পার হবার সময় জেসনের এক পায়ের জুতো হারিয়ে যায়; সে অবস্থাতেই জেসন বাকী রাস্তা পাড়ী দিয়ে পিলিয়াসের দুয়ারে আসেন। পিলিয়াস যখন বোঝেন এই জেসনই দৈববানীর সে লোক যে তাঁকে সিংহাসনচ্যুত করবে, তিনি জেসনকে এক কঠিন শর্ত দেনঃ জেসনকে কলকিস যেতে হবে এবং সেখান থেকে স্বর্ণালী মেষচর্ম (golden fleece) নিয়ে আসতে হবে। জেসন তাঁর দলবল (আর্গোনটস) নিয়ে এই অভিযানে বেরিয়ে পড়েন। মেষচর্মটি ছিলো কলকিসের রাজা এইতি (Aeetes)-এর দখলে, তিনি জেসনকে ফাঁদে ফেলার জন্য কঠিন এক ফন্দি আঁটেন, কিন্তু তাঁর এ প্রচেষ্টা মাঠে মারা যায়, কারণ এইতি'র কন্যা মিদিয়া জেসনের প্রেমে পড়েছেন।

মিদিয়া তন্ত্রমন্ত্রের সাধণা করতেন; তিনি জাদুবলে জেসনকে গোল্ডেন ফ্লিস পাইয়ে দেন এবং দু'জনে একসাথে কলকিস থেকে পালান। জেসনের জন্য গোল্ডেন ফ্লিস যোগাড় করার সময় মিদিয়া তাঁর আপন ভাইকে হত্যা করেন এবং সে মৃতদেহের বিভিন্ন টুকরো সমুদ্রপথে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেন যাতে সেগুলো এক এক করে কুড়িয়ে নিতে মিদিয়া ও জেসনের পেছন পেছন ধাওয়ারত এইতি'র দেরী হয়ে যায়। জেসন ও মিদিয়া জেসনের রাজ্য ইওলকাসে এসে পৌঁছান, কিন্তু রাজা পিলিয়াস সৎ-ভাতিজা জেসনকে আবারো ঠকান, তিনি সিংহাসন ছাড়বেন না বলে দেন। মিদিয়া তখন পিলিয়াসের তিন কন্যাকে ভুল বুঝিয়ে তাদের পিতৃহত্যায় প্ররোচনা দেন। পিলিয়াস মারা যান, কিন্তু জেসন-মিদিয়ার ভাগ্যে শিকে ছেঁড়ে না। তাঁদের ইওলকাস থেকে বহিষ্কার করা হয়। জেসন, মিদিয়া এবং তাঁদের দুই পুত্র এবার এসে আশ্রয় নেন করিন্থে। এই করিন্থই হলো ইউরিপিদেস-এর মিদিয়ার অকুস্থল।

জেসন-মিদিয়ার আখ্যান থেকে আমরা দেখতে পাই, জেসনের জন্য মিদিয়ার ভালোবাসার কোন কমতি ছিলোনা; প্রেমের জন্য খুনাখুনিতে জড়াতে মিদিয়া মোটেই পিছপা হননি। এহেন মিদিয়ার বুকে শেল বিঁধে জেসন হঠাৎ না বলে কয়ে করিন্থের রাজা ক্রেওনের মেয়েকে বিয়ে করে বসেন। ক্ষোভে দুঃখে মিদিয়া যখন এ নিয়ে জেসনকে প্রশ্ন করেন এবং জেসনের প্রান বাঁচানোর জন্য কত বড় ত্যাগ স্বীকার করেছেন, তা মনে করিয়ে দেন, জেসন পাল্টা খোঁটা দিয়ে মিদিয়াকে বলেনঃ

“

স্বীকার করি, তুই আমার জান বাঁচাইছস
মাগার লাভ কিন্তু তুই-ই বেশী পাইছস।
আবে, তুই তো হালায় আছিলি বস্তির মাইয়া
কই থিকা কই তরে আনছি, দ্যাখ একবার চায়া।
তর তো আছিলো না হালায় জন্মেরও ঠিক
বাপ-কাকার নাম জিগাইলে হেঁচকি তুলতি “হিঁক, হিঁক”।
বান্দীর থিকা রানী বানাইছি, ভুইলা য্যান না যাস
হিসাব রাখছস বে, কয় ট্যাকার খাওন তুই ডেইলী হান্দাস?

জেসনের এমন আচরণ মিদিয়া মেনে নিতে পারেননি। তিনি জাদুবলে প্রথমে জেসনের নববিবাহিত স্ত্রীকে হত্যা করেন, এরপর তাঁর নিজের দুই ছেলেকেও হত্যা করেন। এর সবই তাঁর ভালোবাসার জেসনকে শাস্তি দেবার জন্য। করিন্থবাসীকে দুঃখের সাগরে ভাসিয়ে মিদিয়া এরপর তাঁর ড্রাগন-চালিত রথে চড়ে রাজা এইগাস (Aegus)এর রাজ্যে চলে যান। ইউরিপিদেস এখানেই তাঁর নাটকের যবনিকা টেনেছেন।

জনশ্রুতি আছে, মিদিয়ার ছেলেদের আসলে হত্যা করেছে করিন্থবাসী, কিন্তু ইউরিপিদেস করিন্থিয়ানদের কাছ থেকে টাকা খেয়ে নাকি মিদিয়াকে আপন সন্তান হত্যার দোষে দোষী করেছেন। ইউরিপিদেস টাকা খেয়েছেন কি না, তার সত্য-মিথ্যা আড়াই হাজার বছর পর আজ আর নিরুপণ করা সম্ভব নয়, তবে দু'চারটি কথা এ প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে। ইউরিপিদেস-এর নাটকে দেখা যায় জেসন মিদিয়াকে বোঝানোর চেষ্টা করছেন, নতুন বিয়েটি তিনি করছেন বাধ্য হয়ে, অর্থনৈতিক লাভের আশায়। করিন্থের রাজার মেয়েকে বিয়ে করে তাঁদের নিজেদের সংসারের যদি চাকা ঘোরানো যায়, মন্দ কী?

কেউ কেউ সন্দেহ প্রকাশ করে থাকেন, জেসন আসলে তাঁর ভয়াল চরিত্রের এই বিদেশী বউকে নিয়ে হাঁসফাঁস করছিলেন। ভালোবাসার জন্য কথায় কথায় যে বিনা প্রশ্নে রক্ত ঝরাতে পারে, তার প্রেমময় বন্ধন নাগপাশের মতনই লাগবার কথা। যে প্রেম লাগামহীন, যে প্রেম অতি অন্ধ, বোধবুদ্ধি ভুলিয়ে দেয় যে প্রেম, ইউরিপিদেস কি সে প্রেমের ব্যাপারেই সতর্ক করে দিলেন? সংসার জীবনে দু'বার দাগা খেয়েছিলেন ইউরিপিদেস; শেষমেষ নাকি তিনি সব ছেড়েছুড়ে এক গুহায় গিয়ে বসবাস করতেন, সেখানেই বিশাল এক গ্রন্থাগারও নাকি বানিয়েছিলেন। যা দেখতে হাঁসের মতো, ডাকে হাঁসের মতো... এই যুক্তিতে এগিয়ে কেউ যদি ইউরিপিদেসকে Loveguru মেনে মিদিয়া থেকে প্রেমের শিক্ষা নেন, মন্দ কী তাতে?

অনেকটা মিদিয়ার আদলেই সম্ভবত, হেনরিক ইবসেন ১৮৯১ সালে লিখেছিলেন তাঁর নাটক হেডা গ্যাবলার। ইবসেনের হেডা মিদিয়ার মতোই ‘নিউরোটিক' ও প্রতিহিংসাপরায়ণ; নিজের বা পরের ধ্বংস ডেকে আনতে এঁদের দু'জনের হাত কাঁপে না। মিদিয়া'র মতো মায়েদের সাথে আমাদের বেশ ভালোভাবেই পরিচয় আছে; এঁরা নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য মিদিয়ার মতোই প্রচণ্ড আবেগে নিজেদের কোটি কোটি মানুষের মা বানিয়ে নেন, এরপর প্রয়োজন মতো মিদিয়ার মতোই এই সন্তানদের গলায় ছুরি চালিয়ে দেন। সবচেয়ে বড় মিলটা অন্য জায়গায়। খুন করবার পর আমাদের এই মা'রাও মিদিয়ার মতোই তাঁদের ড্রাগন-চালিত রথে চড়ে ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যান (গাজিয়াবাদ কি?)। তাঁরা তখন শুধুই এক একটি কিংবদন্তি।

ছবিঃ জারমান হার্নান্দেজ আমোরেস। সূত্রঃ উইকিপিডিয়া

2022-02-12T00:00:00.000Z
Alcestis

Alcestis

By
William Arrowsmith
William Arrowsmith,
Euripides
Euripides
Alcestis

প্রাচীন গ্রীক নাট্যকার ইউরিপিদেস-এর নাটক আলসেস্তিস। যদিও ট্র্যাজেডি নাটক হিসেবে স্বীকৃত, অনেকেই একে ট্র্যাজিকমেডি বলেও অভিহিত করেন। ট্র্যাজিক নাটকে সচরাচর যা হয়, আপাত চোখে একজন নায়ক-যিনি ভালোমানুষীর প্রায় সকল গুণ নিজের মাঝে ধারণ করেন-তিনিই হঠাৎ ছোটখাটো কোন দোষ/ ত্রুটির কারণে স্বর্গ থেকে নিক্ষিপ্ত হন বিড়ম্বনার আস্তাকুঁড়ে। এ ধরণের প্রাচীন ট্র্যাজিক নাটকে নায়কের ভিলেনে পরিণত হওয়া, কিংবা ভাগ্যের সুদৃষ্টি থেকে ছিটকে পড়া-ইত্যাদি বিবিধ রকম পতনের পেছনে নাট্যকারেরা সাধারণত দেবতার ষড়যন্ত্র বা লীলাখেলাকে দায়ী করেন, যেমনটা আমরা সফোক্লিসের ইডিপাস সাইকেল-এ দেখতে পাই। আলসেস্তিসকেকে ট্র্যাজিকমেডি বলার কারণ এই নাটক চিরাচরিত গ্রীক ট্র্যাজেডির উল্টোরথ; এ নাটক শুরু হয় নায়কের দুর্দশা দিয়ে, এবং শেষ হয় নায়কের প্রাপ্তিতে। নাটকের মধ্যপথে কিছু “কমেডি” দৃশ্যের সাথেও আমাদের পরিচয় ঘটে। ট্র্যাজেডি না ট্র্যাজিকমিক-সে নিয়ে গ্রীক নাটকের পণ্ডিতেরা একে অপরের চুল ছিঁড়তে থাকুন, সাধারণ পাঠক হিসেবে আমার কাজ শুধু দূর থেকে এঁদের দেখা আর পপকর্ণ চিবোনো।

ইউরিপিদেস সফোক্লিসের সমসাময়িক ছিলেন, এবং তাঁরা একাধিকবার প্রতিযোগীতায়ও নেমেছিলেন। বস্তুতঃ আলসেস্তিস-এর জন্য ইউরিপিদেস দ্বিতীয় হন এমনই এক প্রতিযোগীতায়; প্রথম পুরষ্কারটি জেতেন সফোক্লিস। খ্রীষ্টপূর্ব ৪৩৮ সালে, অর্থাৎ, আজ হতে ২৪০০ বছরেরও বেশী আগে লেখা এই নাটক খুব যে নতুন কিছু শেখায় আমাদের, তা নয়। নাটকের মূল গল্পটিও ইউরিপিদেস-এর নিজস্ব কোন উদ্ভাবন নয়। নাটকের মূল যে প্রস্তাবনা, গত ২৪০০ বছরে স্থান-কাল-পাত্রভেদে তার বিভিন্ন ব্যখ্যা মানুষ দাঁড় করিয়েছে। অন্তর্জাল ঘাঁটলে এই নাটকের অনেকরকম ওস্তাদী ব্যখ্যার সন্ধান পাওয়া যায়। শনিবারের দুপুরগুলোয় বাবা কেন চাকর বা বউ-শ্বাশুড়ির চিরাচরিত দ্বন্দ্বময় বাঙলা সিনেমা দেখে আসা আমার কাছে আর সবকিছু ছাপিয়ে বউ বড় না বাবা বড়-এই দ্বন্দ্বই মুখ্য হয়ে থাকলো। ইউরিপিদেস একটি পৌরাণিক কাহিনীর ওপর ভিত্তি করে আলসেস্তিস নাটকটি লেখেন-যেমনটি তিনি তাঁর অন্য আরো বেশ কয়েকটি নাটকের ক্ষেত্রেই করেছেন। ইউরিপিদেস-এর নাটকটি পুরোপুরি বুঝতে চাইলে পৌরাণিক গল্পটি আগে জানা থাকলে ভালো। সংক্ষেপে গল্পটি তাই নিচে টুকে রাখলামঃ

ইওলকাসের রাজা পিলিয়াস তাঁর সবচেয়ে সুন্দরী কন্যা আলসেস্তিস-এর বিয়ের জন্য পাত্র খুঁজে বিজ্ঞাপন দিয়েছেনঃ যে ব্যক্তি তাঁর রথে একইসাথে একটি সিংহ এবং একটি ভালুক জুড়তে পারবেন তাঁর সুযোগ্য হাতেই আলসেস্তিসকে তিনি তুলে দেবেন। ফিরি'র (phere) রাজা অ্যাডমেটাস এই প্রতিযোগীতায় বিজয়ী হন। অ্যাডমেটাস যে একেবারে হেসেখেলে ভালুক-সিংহকে একঘাটে জল খাওয়ালেন তা-ও নয়; তাঁকে এ কাজে সাহায্য করেন ধনুর্বিদ্যা ও সংগীতের দেবতা অ্যাপোলো, যিনি স্বর্গ থেকে এক বছরের জন্য নির্বাসিত হয়েছেন। এই এক বছর অ্যাপোলোকে অ্যাডমেটাসের অধীনে তাঁর মেষপালক হিসেবে কাজ করতে হয়, এবং সে দায়িত্বের অংশ হিসেবেই তিনি অ্যাডমেটাসকে আলসেস্তিস-এর পাণি জেতার প্রতিযোগীতায় সাহায্য করেন। অ্যাডমেটাস খুশীমনে আলসেস্তিসকে বিয়ে করলেন বটে, কিন্তু বিয়ে নামক এ মহাযজ্ঞের হুটোপাটিতে তিনি দেবী আর্টেমিসের উদ্দেশ্যে দেয় বলী'র কথা বেমালুম ভুলে গেলেন। দেব-দেবীর রাগ বড় কঠিন; অ্যাডমেটাসের ওপর মৃত্যুর অভিশাপ নেমে এলো বলীদানের কথা ভুলে যাওয়ায়। আবারো অ্যাডমেটাসের সাহায্যে এগিয়ে এলেন অ্যাপোলো। তিনি কৌশলে ভাগ্য রচনাকারী ফিউরিস ভগ্নীত্রয়ীকে (ক্লথো, লাখেসিস, ও অ্যাট্রোপোস) মদ খাইয়ে একটি চুক্তি করিয়ে নিলেন। অ্যাডমেটাসের পরিবর্তে তাঁর পরিবারের অন্য যেকোন সদস্য যদি স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণ করে, তাহলেই প্রাণে বেঁচে যাবেন অ্যাডমেটাস। বৃদ্ধ বাবা-মা'র কাছে গিয়ে অ্যাডমেটাস এবার তাঁদের যেকোন একজনকে স্বেচ্ছামৃত্যু বেছে নিতে বলেন, কিন্তু তাঁরা কেউই এতে রাজী হন না। মৃত্যুচিন্তায় তরুণ অ্যাডমেটাস যখন পাগলপারা, তখন তাঁর স্ত্রী আলসেস্তিস স্বামীর প্রাণরক্ষায় স্বেচ্ছামৃত্যু বেছে নেন।

ইউরিপিদেস তাঁর নাটক শুরু করেছেন আলসেস্তিসের মৃত্যুশয্যায়। অ্যাডমেটাস ও তাঁর সন্তানদের থেকে শুরু করে প্রাসাদের দাস-দাসী, রাজ্যের জনগণ-সবাই-ই আলসেস্তিসের শোকে কাতর। মৃত্যুশয্যায় শুয়ে আলসেস্তিসও স্বামীর কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি আদায় করে নিলেন, তাঁর মৃত্যুর পর অ্যাডমেটাস আর কখনোই যেন বিয়ে না করেন (রাজা-রাজড়াদের প্রতিশ্রুতি-তার কতখানি দাম সে আমরা সক্কলেই জানি)। মৃত্যুপথের যাত্রী স্ত্রীকে স্বান্তনা ও প্রতিশ্রুতি দেবার ফাঁকে ফাঁকেই অ্যাডমেটাস তাঁর বাবা ফিরেস (Pheres)-কে বকাঝকা করে আসেন, কেন তিনি এই বুড়ো বয়েসে বেঁচে থাকার গোঁ ধরে আছেন, তিনি মরে গেলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়; অ্যাডমেটাসের কমবয়েসী কচি বউটাকে মরতে হয় না। ফিরি নগরীর প্রতিষ্ঠাতা ফিরেস তাঁর পুত্র অ্যাডমেটাসকে কে দয়া করে রাজার সিংহাসনে বসিয়েছে তা মনে করিয়ে দিয়ে পাল্টা ধমক দিয়ে বলেনঃ

“খামোশ! কার লগে কথা কইতাছত, সেই হিসাব রাখছত?
আমারে কি তর বাজার থিকা কিনা বান্দীর পোলা ভাবছত?
তুই কি ভুইলা গেছত কুন ফেমিলির পোলা আমি?
যেই কমোডে বহি আমি, আন্দাজ আছে তর, ঐডা কত দামী?
আবে হালায় তরে তো পয়দা দিছি আমিই বে
তর লিগা হুদাই আমি জান দিবার যামু ক্যা?
বাপের জন্মে এমুন কথা হুনিনিকা হালায়,
নিজে বাঁচনের লিগা পোলায় বাপের জান এক্সচেঞ্জ করবার চায়!
টেগা-পয়সা, জমি-জিরাত, মাইয়া-পোলা, বাদ রাখছি কি?
যখন যা চাইছত, খোদার কসম, দুই হাতে বিলাইছি।
কোন মুখে তুই আমারে কস, “এইবার আপনে মরেন, বস”!
লম্বা টাইম বাঁইচা বহুত মজা লইবি-এইডা কি তর একার মনেই চায়?
আমি হালায় বুড়া হইছি, মাগার ইমানে কই, যন্ত্র ভি আমারো __”

2022-02-08T00:00:00.000Z
Next

Footer links

Community

Readers & Supporters
Join Our DiscordHow to link roles on Discord

Follow Along

BlogHardcover LiveAbout HardcoverRequest a feature

We're an Open Book

Frequently Asked QuestionsContact SupportRoadmapOur Policies
iOSAndroidDiscordTikTokMastodonInstagram

Home

Library

Explore

Trending