"Fate, it seems, is not without a sense of irony."
Morpheus, The Matrix (1999)
রাজা, নাকি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান-রাষ্ট্রের শাসনদণ্ডটি প্রকৃত অর্থে কার হাতে থাকে? আপাতদৃষ্টিতে আমাদের কাছে রাজাই দেশের সর্বেসর্বা নায়ক হিসেবে প্রতীয়মান হন, কিন্তু কার্যত কি তা-ই? পর্দা নামিয়ে, দরজা লাগিয়ে দেশ চালনার জটিল হিসেবগুলো রাজা কার সাথে বসে করেন? রাজার ট্যাঁকে অর্থ যোগান কে? কে রাজা হবেন, তা-ই বা কে নির্ধারণ করে দেয়?
এ প্রশ্নগুলোর মুখোমুখি হলে আমরা বাকস্বাধীনতা, নাগরিকের ভোটাধিকার, জনমত-ইত্যাদি গা-জোয়ারি উত্তরগুলো দাঁড় করাতে পারি, কিন্তু আদতে কি তা-ই হয়? ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বা ধর্মীয় সমাজকে পাশ কাটিয়ে রাজনীতিতে যে টিকে থাকা যায় না তার প্রমাণ তো আমরা সভ্যতার শুরু থেকে আজতক প্রতি মূহুর্তেই পেয়ে চলেছি। আমরা জানি, ঈশ্বরের আশীর্বাদপুষ্ট পবিত্র কোন মানব রাজার আসনে আসলে আসতে পারেন না, বরঞ্চ সিংহাসনে যিনি বসেন, তাঁর জীবনাচার-বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই-রাষ্ট্রটিতে রাজা যে ধর্মমতটি চালু রেখেছেন, তার ভালো ভালো শিক্ষাগুলোর সাথে সম্পূর্ণ সাঙ্ঘর্ষিক। রাজা শোষণে শোষণে আমাদের পিঠ ভাঙেন, কিন্তু আমরা সাধারণেরা এই ভেবে কৃতজ্ঞ হই যে, ভাগ্যিস! ঈশ্বর এবং ধর্ম দুই-ই রাজার সহায় আছেন, ঈশ্বর নিজে ভালোবেসে রাজাকে আমাদের পিঠে ডান্ডা ভাঙতে পাঠিয়েছেন! আমাদের বিশ্বাসের শক্তির কাছে হাজার বছর ধরে চলে আসা বৈষম্য, অনাচার, শোষণ আর অবিচারের ইতিহাস নতজানু হয়ে পড়ে এক নিমিষে। আমরা ভুলে বসি, রাজা আর ধর্মযাজক এক বিছানায় ঘুমোন, গায়ে গা লেপ্টে একে অপরের আদর খান।
একবিংশ শতাব্দীর আমরা আজ গণতন্ত্র বা নাগরিকের অধিকার ইত্যাদি কাঠের তলোয়ার-স্বরূপ অস্ত্র নিয়ে রাজার মুখোমুখি হই; আমাদের আগের শতকগুলোর মানুষের হাতে এই খেলনা অস্ত্রগুলোও ছিলো না। তারা রাজা এবং ধর্মের হাতে যুগপৎভাবে নির্বিচারে মার খেয়ে গেছে। হাজার হাজার বছরের পরিক্রমায় নাগরিকের অধিকারের বলয় যতো বেড়েছে, রাজার ক্ষমতা ততো খর্ব হয়েছে, কিন্তু ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের বিষদাঁত একইরকম তীক্ষ্ণ ও বিষাক্ত রয়ে গেছে। সমাজের বেশীর ভাগ, প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষই কোন না কোন ধর্মে বিশ্বাস রাখেন বলে গণতন্ত্র একটা সময়ে কার্যত ধর্মতন্ত্রের হাতের পুতুল হয়ে পড়ে; ধর্মতন্ত্রের সিদ্ধান্তগুলোই বেশী মানুষের ভোট পেয়ে গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্তের মুখোশ পরে প্রতিষ্ঠিত হয়। আজকের যে আধুনিক গণতন্ত্র তা প্রতিষ্ঠা পাবার আগে যাজক ও রাজা ধর্মতন্ত্র দিয়ে দেশ চালাতেন; পালা করে করে তাঁরা কখনো জল্লাদ হতেন, কখনো হতেন জল্লাদের হাতের খাঁড়া।
তবে কিছু কিছু সময় তো জল্লাদের হাত থেকেও খাঁড়া পিছলে যায়, কিংবা অধিক ব্যবহারে হাতল ভেঙে আসে। সময়ে সময়ে রাজার সাথে যাজকের সম্পর্কও প্রায়ই এমন পিচ্ছিল হয়ে উঠেছে; যে যাজক দীর্ঘকাল রাজার একান্ত বিশ্বস্ত খাঁড়া হয়ে জনগণের গলা কেটে এসেছেন, তিনি-ই শেষতক উল্টো ফিরে রাজার নাড়িভুঁড়ি বের করে আনতে চেয়েছেন। দ্বাদশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডের রাজা দ্বিতীয় হেনরি ও ইংল্যান্ডের ক্যাথলিক চার্চের সর্বেসর্বা আর্চবিশপ থমাস বেকেটের মাঝে ঠিক এভাবেই সংঘাত বাধে। ৮০০ বছর পর ফরাসী নাট্যকার জাঁ আনুই ঐতিহাসিক এ ঘটনা অবলম্বনে তাঁর বেকেট নাটকটি লেখেন।
এ নাটকের পুরো নাম Becket or The Honor of God। থমাস বেকেট ইতিহাসের এক কৌতুহলোদ্দীপক চরিত্র। প্রথম জীবনে আপাদমস্তক ভোগী জীবন যাপন করা বেকেট মূলত ছিলেন রাজা দ্বিতীয় হেনরি'র ‘পার্টনার ইন ক্রাইম'; লাম্পট্য, ফুর্তি-ফার্তা, পান-ভোজন, বিলাস-ব্যাসনে একে অপরকে ছাড়া চলতোই না এঁদের। প্রাণের বন্ধু বেকেটকে হেনরি প্রথমে লর্ড চ্যান্সেলর বানান, যা ইংল্যান্ডের সরকারী কর্মকর্তাদের সর্বোচ্চ পদ। এর খুব অল্প পরেই হেনরি বেকেটকে ক্যাথলিক চার্চের শীর্ষ গুরু আর্চবিশপ অফ ক্যান্টরবিউরি'র পদে অধিষ্ঠিত করেন। পদাধিকারের দিক দিয়ে আর্চবিশপের অবস্থান রাজার ঠিক পরেই। বেকেটের আগে যিনি আর্চবিশপ ছিলেন, সেই থিওবাল্ড রাজা হেনরির চক্ষুশূল হয়ে পড়েন, কারণ থিওবাল্ড রাজাকে অর্থসাহায্য দিতে অস্বীকৃতি জানান।
রাজার আসনে বসলে অনেকরকম খরচের নেশায় পেয়ে বসে; এখানে যুদ্ধ করতে হয়, সেখানে বাইজি নাচাতে হয়, ওখান থেকে দামী অলঙ্কার আনাতে হয় রাণীর মন ভরাবার জন্য...এমন হাজারটা খরচের উৎস। কিন্তু গরীব চাষাভুষা প্রজাদের পিঠ ভেঙে আর কতই বা নেয়া যায়? এদিকে টাঁকশাল খালি। উপায়ন্তর না দেখে শেষমেষ হেনরি আর্চবিশপের কাছেই হাত পাতেন। অতীতে অনেকবার অর্থসাহায্য দিয়ে দিয়ে যাজক সম্প্রদায়েরও আর পোষাচ্ছে না, তাঁরা দেখে এসেছেন চার্চের টাকায় রাজা কিভাবে ফুর্তি করে চলেন। থিওবাল্ড তাই বেশ শক্তভাবে রাজাকে ‘না' বলে দেন।
থিওবাল্ডের হঠাৎ মৃত্যুতে হেনরির সামনে সুযোগ চলে আসে, তিনি বহু যোগ্য এবং অভিজ্ঞ প্রার্থীকে ডিঙ্গিয়ে বেকেটকে আর্চবিশপ বানান। জিগরী দোস্ত বেকেট আর্চবিশপ হয়ে এবার যে দু'হাতে হেনরিকে টাকা যোগাবেন সে বিষয়ে তাঁর কোন সন্দেহ থাকে না। কিন্তু আর্চবিশপ হবার পর সব হিসেব পাল্টে দিয়ে বেকেট বেঁকে বসেন, তিনিও হেনরিকে টাকা যোগাতে অস্বীকৃতি জানান। কারণ? বেকেট এখন ঈশ্বরের সন্ধান পেয়েছেন! ঈশ্বরের ভাগের টাকায় বেশ্যা নিয়ে ফুর্তি করা কি মানায়? ঈশ্বরের সম্মান রক্ষায় দৃঢ়চিত্ত বেকেটের সাথে হেনরির দূরত্ব বাড়তে থাকে, যার শেষ হয় ১১৭০ সালে হেনরির একান্ত কাছের লোকেদের হাতে বেকেটের খুন হওয়া দিয়ে। বেকেটের মৃত্যুর পর পোপ ৩য় আলেক্সান্ডার তাঁকে সন্ত উপাধি দেন, এবং আজতক খৃষ্টান বিশ্ব থমাস বেকেটকে সেইন্ট বেকেট হিসেবেই জেনে আসছে। সংক্ষেপে এই হলো থমাস বেকেটের জীবনী ও আনুই-এর নাটকের মূল গল্প।
এই নাটকে আনুই-এর ভীষণ তীক্ষ্ণ উইট-এর পরিচয় পাওয়া যায়; দ্বাদশ শতকের রাজকীয় বর্বরতা, স্বার্থের দখল নিয়ে খেয়োখেয়ি, ক্ষমতাশীলদের হাতে বাক্সবন্দী হয়ে থাকা গরীব জনগণ-এই সব কিছুই টুকরো টুকরো ভাবে উঠে আসে আনুই-এর বিষাক্ত কমেডিতে। কিছুটা চ্যাপলিনীয় স্ল্যাপস্টিক কমেডি সংবলিত এ নাটকের শেষে দেখা যায় যে ব্যারনেরা বেকেটকে খুন করেছিলো রাজা হেনরি তাদের-ই পালের গোদাটিকে বেকেট-হত্যার তদন্তের দায়িত্ব দেন। বাস্তবে বেকেট হত্যার সাথে জড়িতদের মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিলো; বেকেটের হত্যাকারীদের কাউকে হেনরি তদন্তের দায়িত্ব দিয়েছিলেন কি না সেটি আমার জানা নেই, ইতিহাস ঘাঁটতে বসলে সে তথ্যও হয়তো পেয়ে যাবো, তবে সে ইচ্ছে আমার নেই। বাঙলাদেশের নাগরিক হিসেবে যে অমোঘ সত্যটি আমি জানি, সেটি হলো রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের অপরাধগুলো সচরাচর নৃপতির অঙ্গুলিহেলনেই হয়, এবং অপরাধকর্মটি যিনি নিজ হাতে করলেন, তাঁকেই এ অপরাধের তদন্ত কমিটির প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়।
ছবি:থমাস বেকেট ও রাজা দ্বিতীয় হেনরি। ১৪ শতকে আঁকা।
কেউ প্রশ্ন করে বসতেই পারেন, আনুই ৮০০ বছর আগের এই ঘটনা নিয়ে কেন নাটক লিখতে গেলেন? শুধু কি ইতিহাস বলাই তাঁর উদ্দেশ্য? কিন্তু সে তো ইতিহাসের যেকোন বই পড়লেই জানা যায়। আনুই-এর নাটকে বেশ কিছু ঐতিহাসিক ভুলও রয়েছে যা তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন (বেকেটকে আনুই তাঁর নাটকে স্যাক্সন হিসেবে দেখিয়েছেন, বাস্তবে বেকেট ছিলেন নরম্যান)। ঐতিহাসিক এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে নাটক লেখার পেছনে আনুই-এর ভিন্ন একটি উদ্দেশ্য রয়েছে, যেটি নিয়ে আলোচনা করবার জন্যই এত সময় লাগিয়ে ৮০০ শব্দের এই ফোরপ্লে।
জাঁ আনুই কামু এবং সার্ত্রে দ্বারা ভীষণভাবে প্রভাবিত ছিলেন। এঁরা দু'জনই দর্শনশাস্ত্রের অস্তিত্ববাদ শাখাটির অন্যতম মূল বিজ্ঞাপন। দর্শনের এ শাখাটি ব্যাক্তির অস্তিত্বকে (কিংবা স্বীয় অস্তিত্বের “শুদ্ধতা”কে) সব কিছুর ঊর্ধে রাখে; এখানে ভাগ্য বলে কিছু নেই, এখানে ঈশ্বর নেই, বিচারকর্তা নেই, স্বর্গ-নরক নেই; ভালো-মন্দ বিচার করবার দায় পুরোটাই আপনার নিজের। আপনি যদি এ পথের অনুসারী হন, তাহলে যেকোন ভালো কাজ করা এবং খারাপ কাজ এড়িয়ে চলার জন্য আপনার বিবেকই যথেষ্ঠ হওয়া উচিৎ; “ওপরওয়ালার কাছে কি জবাব দেবো?”-এই প্রশ্নটির ভীতি আপনাকে জোর করে কোন কাজ করিয়ে নেবে না। তৃষ্ণার্তকে পানি খাওয়ানো কিংবা অন্ধকে হাত ধরে রাস্তা পার করিয়ে দেয়া-ইত্যাদি কাজগুলো আপনি যদি নিজের ইচ্ছেতে না করে ঈশ্বরের শাস্তির ভয়ে করেন, তাহলে আপনার এই ভালো কাজগুলো কতটা আন্তরিক, এবং এ কাজগুলোর জন্য আপনার আদৌ পুরষ্কৃত হওয়া উচিৎ কি না-সে প্রশ্নটি ��িজেকে করে দেখতে পারেন।
আনুই তাঁর অস্তিত্ববাদের প্রপাগ্যান্ডা দিয়ে জানিয়ে দিয়েছেন, পূর্বলিখিত ভাগ্য বলে কিছু নেই, মানুষ কারো হাতের পুতুল নয়। কোন পথটি সঠিক এবং কোন পথটি বেঠিক, তা আপনি জীবনের যে কোন পর্যায়ে, যে কোন মুহুর্তে নির্ধারণ করতে পারেন, এবং সে অনুযায়ী দিক বদলাতে পারেন; আপনার গাড়ীটির চালক আপনি হবেন, নাকি চালকের হাতে নিজের ভাগ্য সঁপে দিয়ে গোটা সময়টা যাত্রীর আসনে বসে থাকবেন-এ সিদ্ধান্তটি সম্পূর্ণই আপনার। জীবনের বড় একটি অংশই ভোগী জীবন যাপন করেও শেষতক ঈশ্বরের সম্মান রক্ষার্থে বেকেট ত্যাগের জীবনকেই বেছে নিয়েছিলেন, মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও। এ প্রসঙ্গে আব্রাহাম লিংকনের একটি বিখ্যাত উক্তি রয়েছে,
আমি যখন কোন ভালো কাজ করি, আমার ভালো লাগে, যখন আমি কোন খারাপ কাজ করি, সেটির অপরাধবোধ আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। এটাই আমার ধর্ম।
Tabula Rasa
সহজ রাস্তা
ঘৃণ্য
নীতির আলাপ ত ম্যালাই দিলেন, আপনেই এবার কনঃ
অহন-ই যদি এক বান্দীর পোলায়
আঁৎকা আয়া চাক্কু মারবার চায়
তারে কি বুকে টাইনা কইবেন,
“খাড়ান, বাপজান! আমি কি আপনের সন্তান?”
নিজে লগে যে চাক্কুডা রাহেন, ঐডা দিয়া কি কান চুলকান?
জানের মায়া ব্যাবাকের-ই আছে।
হাততালি পাইবো ভাইবা দয়ার শইল সাইজা বহে কেউ যদি
খোদার কসম কইলাম আইজ মামা, তার মায়েরে আমি__”
দ্যা ম্যাট্রিক্স
ম্যাট্রিক্স
স্প্যানিশ সাহিত্যিক ইলদেফন্সো ফ্যালকোনেস-এর ঐতিহাসিক উপন্যাস ক্যাথিড্রাল অফ দ্যা সি। ১৩২৯ থেকে ১৩৮৩-এই ৫৪ বছর ধরে বার্সেলোনায় নির্মিত হয় স্পেনের বিখ্যাত সান্তা মারিয়া দেল মার বা সাগর তীরের মাতা মেরির ক্যাথিড্রাল। যে সময়ে এই ক্যাথিড্রালটি'র নির্মাণকাজ শুরু হয়, কাছাকাছি সময়ে ইওরোপে এমন ক্যাথিড্রাল বানাবার ধুম চলছে তখন, সবারই লক্ষ্য সবচেয়ে দশাসই ও সবচেয়ে দেখনদারি ক্যাথিড্রালটি বানিয়ে বাকী সবাইকে হাঁ করিয়ে দেয়া। এই ক্যাথিড্রালগুলোর বেশ কয়েকটিই আজ আর টিকে নেই, তবে সান্তা মারিয়া আজও বার্সেলোনা আলো করে দিব্যি দাঁড়িয়ে আছে ৭০০ বছর ধরে। পাউন্ড দেড়েক ওজনের এ বইতে ফ্যালকোনেস সান্তা মারিয়া ক্যাথিড্রাল নির্মাণের প্রেক্ষাপটে ১৪ শতকের বার্সেলোনার এ গলি সে গলি ঘুরিয়ে দেখিয়েছেন, ৬০০ পৃষ্ঠা ধরে শুনিয়েছেন মধ্যযুগের ইওরোপের প্রতিদিনের জীবনের গল্প।
উপন্যাসের শুরুতেই ফ্যালকোনেস ধর্ম আর স্বার্থের খেয়োখেয়ির সেই চিরন্তন ছবিটিই দেখিয়েছেন ঐতিহাসিক নানা সূত্র টেনে। ক্ষমতার পালাবদলে শত্রু-মিত্রের বহু হিসেব নিকেশই পাল্টে যায়, ধ্রুব সত্য থেকে যায় কেবল একটি বিষয়ইঃ গরীব আরো গরীব হয়, আর ধনী শাসকের পকেট ফুলে ফুলে ঢোল থেকে কোলবালিশে পরিণত হয়। গরীবের রক্ত চুষে খাবার অভিনব সব পন্থা জায়েজ করবার তরে নিত্য নতুন ঐশ্বরিক বিধান নিয়ে রক্তের গন্ধ পাওয়া হাঙরের মতো ছুটে আসে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো। উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্রের দাদার মুখে ফ্যালকোনেস শুনিয়েছেন হাজার হাজার বছর ধরে চর্চিত হয়ে আসা অমোঘ সেই সত্যঃ
“
বাপধন, যারাই কইবো উপরওয়ালার কাছ থিকা আদেশ পায়া তোমার উপকার করতে আসছে, তাগোরে কোনওদিন বিশ্বাস কইরোনা। অরা তোমারে ম্যালা মিঠা মিঠা কথা শুনাইবো, শুনতে তোমার ভালাও লাগবো অনেক, কিন্তু ঐ সব কথার আসলে কোন দাম নাই। অরা যেইভাবে কথা নিয়া খেলবার পারে, আমাগো ঐ জ্ঞান নাইরে বাপ। কিতাব খুইলা তারা তোমারে উপরওয়ালার অনেক বিধি বিধান দেখাইবো, কিন্তু আমরা তো চাষা, কাম করি ক্ষেতে, ঐ কিতাব তো আমরা পড়বার পারিনারে বাপ। ছোট বাল-বাচ্চারে আমরা যেইভাবে এইটা ওইটা বুঝায়া ঘুম পাড়াইতে নিয়া যাই, ঐভাবেই অরা তোমারে বুঝ দিয়া তোমার সব কব্জা কইরা নিতে চাইবো। খু-উ-ব সাবধান থাইকো...”
সান্তা মারিয়া দেল মার
সান্তা মারিয়া
সান্তা মারিয়া
সান্তা মারিয়া
ইনকুইজিশন
Chronica
মেনাকমাসঃ তোর যদি মাথায় একটুও বুদ্ধি থাকতো, তাহলে কীভাবে স্বামীর মন জয় করে চলা যায় তারই চেষ্টা করতি সবসময়, এভাবে মুখে মুখে তর্ক করার কথা ভাবতেও পারতি না, একদম সিধে হয়ে যেতি। এরকম বেয়াদবী যদি করতেই থাকিস, তো বলে দিচ্ছি, তোকে সোজা ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দেবো...যখনই বাইরে যাবো, পেছন থেকে ডেকে একশ একটা প্রশ্ন করা শুরু করিস, কোথায় যাচ্ছ, কী কাজ, কার সাথে যাচ্ছ, কতক্ষণ থাকবে, কার সাথে থাকবে...ঘ্যানঘ্যান প্যানপ্যান করে মাথাটা ধরিয়ে দিস, একটু যে ফুরুফুরে মন নিয়ে বাইরে যাবো তার আর উপায় থাকে না, মেজাজটাই খারাপ করে দিস প্রতিবার। যেভাবে জেরা করিস, মনে হয় যেন সীমান্তরক্ষীর কাছে জবাব দিতে বসেছি, কী কী মাল নিয়ে এসেছেন, সবগুলো ব্যাগ খুলে দেখান, আপনার আগমনের হেতু কী...অসহ্য! তোকে আসলে বেশী লাই দিয়ে ফেলেছি। শেষবারের মতো সাবধান করে দিচ্ছি, তোর এই দামী দামী কাপড়, জামা, অলঙ্কার, চাকর-বাকর, শাহী খানাদানা-এগুলো সব কোত্থেকে আসে সেটা কিন্তু মাথায় রাখিস। আমার ওপর গোয়েন্দাগিরি যদি বন্ধ না করিস তো দেখবি আমি তোর কী করি...দাঁড়া, তোর যখন এতই গোয়েন্দাগিরির খায়েশ, তাহলে ভালো করে শুনেই রাখ। আমি এখন আমার বান্ধবীর কাছে যাচ্ছি, আজ একটু ফুর্তিফার্তা করবো দু'জনে, খেয়েদেয়ে রাতে আমার আসতে দেরী হবে। বাসায় খাবো না, কিছু বানানোর দরকার নেই। বুঝেছিস? কথা কানে গেছে?
পেনিকিউলাসঃ মালিক কথা শুনাইতাছেন হ্যার বউরে, কিন্তু আসলে উদ্দেশ্য তো আমারে জানান দেয়া। রাইতে বউয়ের লগে না খাইতে বইলে ম্যাডামের কি আর আইবো যাইবো? খাওন তো মাইর যাইবো আমার।
মেনাকমাসঃ এমন টাইট দিলাম, হারামজাদীর গলা দিয়ে এখন আর আওয়াজই বেরোচ্ছে না। তো, কই স্বামীসমাজ, বউটাকে যে এভাবে ধমকে দিলাম, তার অবস্থানটা কোথায় সেটা তাকে পরিষ্কার বুঝিয়ে দিলাম, একটু বাহবা তো প্রাপ্যই আমার, নাকি? হাত তালি টালি দিন... (দর্শকদের দিকে ফিরে মেনাকমাস দেখাচ্ছেন তাঁর জামার নিচে মেয়েদের একটি গাউন তিনি পরে আছেন)। দেখুন, বউয়ের এই গাউনটা আমি চুরি করে নিয়ে যাচ্ছি আমার কলিজার টুকরাকে উপহার দেবো বলে। ফন্দিটা জব্বর আঁটলাম না, ভাইলোগ? সাপও মরবে, লাঠিও ভাঙবে না, হারামজাদীটারও একটা শিক্ষা হবে। আমারও অবশ্য এই গাউনটার পেছনে একটা ফালতু খরচ হয়ে গেলো...তা যাক, ভালোবাসার রাণীর জন্য শত্রুর পকেট কাটলাম আর কী, এতে দোষ দেখি না।
রোমান নাট্যকার প্লটাস জন্মেছিলেন যীশুর জন্মের আড়াইশ বছর আগে, নাটক লিখে মুখ ভেংচে গেছেন তাঁর সময়ের মানুষদের। গুটেনবার্গ বুড়ো'র বই ছাপাবার মেশিন উদ্ভাবনের পর গত পৌনে ছয়শ বছরে অর্বুদ কোটি বই ছাপা হয়ে গেছে। বই ছাপিয়ে লেখক হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন এমন মানুষের সংখ্যাও শত শত অক্ষৌহিণীতে গিয়ে ঠেকেছে। পড়ার এতসব উপকরণ ফেলে সাড়ে বাইশশ বছর আগে মরে ভুত হয়ে হেজে মজে যাওয়া এক ভদ্রলোকের বই আজকের দিনে পড়বার কি কোন যৌক্তিকতা আছে? এত প্রাচীন সাহিত্যকর্ম পড়ে আমার কি দুটো হাত বাড়তি গজিয়ে গেলো, নাকি মগজের ওজন কয়েক ছটাক বৃদ্ধি পেলো? সে প্রসঙ্গে একটু পরেই আসছি, আগে প্লটাস এবং তাঁর সাহিত্যকর্ম নিয়ে সদ্য লব্ধ জ্ঞান এখানে তড়িঘড়ি করে উগড়ে দেই। নতুন একটা গালি শিখলে যেমন নানা ছুতোয় ওটাই প্রথমে ব্যাবহার করতে মন উশখুশ করে, এ-ও কতকটা তেমনই আর কী...
প্লটাস যদিও জাতে রোমান ছিলেন, তিনি তাঁর নাটকগুলো লিখেছেন তাঁর দুই-আড়াইশ বছর আগের গ্রীক নাট্যকারদের কমেডি নাটকগুলোর অনুসরণে, এমনকি অনেক ক্ষেত্রে নাকি তিনি সরাসরি গ্রীক বিভিন্ন নাটকের অংশ অনুবাদ করে নিজের নাটকে বসিয়েও নিতেন। ল্যাটিন ভাষায় সাহিত্য রচনা শুরু যীশুর জন্মের ২৪০ বছর আগে, অর্থ্যাৎ, প্লটাস ল্যাটিন সাহিত্যের একেবারে শুরুর দিকের লোক। ল্যাটিন সাহিত্য এবং প্লটাস হাত ধরাধরি করেই বড় হয়েছেন, কৈশোর-যৌবন পার করেছেন। ল্যাটিন ভাষায় শুধু যে সিসেরো (খ্রীষ্টপূর্ব ১০৬-খ্রীষ্টপূর্ব ৪৩), ভার্জিল (খ্রীষ্টপূর্ব ৭০-খ্রীষ্টপূর্ব ১৯), ওভিড (খ্রীষ্টপূর্ব ৪৩-১৮ খ্রীষ্টাব্দ) এবং হোরেস (খ্রীষ্টপূর্ব ৬৫-খ্রীষ্টপূর্ব ৮)-দের মতো কয়েক হাজার বছর আগের প্রাচীন লেখকেরাই লিখে গেছেন তা নয়। ফ্রান্সিস বেকন, বারুক স্পিনোজা এবং আইজ্যাক নিউটনদের মতো ১৬-১৭ শতকের মানুষেরাও ল্যাটিনেই তাঁদের বইপত্র লিখেছেন। ল্যাটিন সাহিত্যের পথিকৃৎ-দের একজন বলে প্লটাসের আলাদা গুরুত্ব তো আছেই, এছাড়াও, প্রাচীন ল্যাটিন নাট্যকারদের মাঝে প্লটাসেরই সবচেয়ে বেশী সংখ্যক লেখা আজ অব্দি টিকে আছে; তাঁর ১৩০টি নাটকের মাঝে ২০টি অক্ষত অবস্থায় পাওয়া গেছে।
প্লটাসের সিংহভাগ কাজ হারিয়ে যাবার পেছনের কারণটা বেশ আগ্রহোদ্দীপক। প্লটাসের মূল যে পাণ্ডুলিপি, সেটি আসলে একটি ‘প্যালিম্পসেস্ট'। প্যালিম্পসেস্ট হলো গরু/ ভেড়া / ছাগলের চামড়ার তৈরী পার্চেমেন্টের এমন দলিল, যেখানে আগের লেখা ঘষে মেজে তুল��� ফেলে জায়গা খালি করে নতুন করে লেখা হয়েছে। সে আমলে চামড়ার তৈরী পার্চমেন্ট খুব সহজলভ্য কিছু ছিলো না, তাই খরচ বাঁচাতে বিভিন্ন সময়েই মানুষ এ কাজটি করে এসেছে। প্লটাসের মূল পাণ্ডুলিপির লেখা ঘষে তুলে ফেলে সে জায়গায় এক ধর্মযাজক ৪র্থ শতকের খ্রীষ্টীয় ধর্ম সংস্কারক অগাস্টিন অফ হিপো'র (৩৫৪-৪৩০) ধর্মীয় ব্যখ্যা (তাফসীর) লিখেন।
ধর্মবাদীরা বরাবরই গোটা পৃথিবীটাকেই নিজেদের টাট্টিখানা ঠাউরে এসেছেন; যখন যেখানে জায়গা পেয়েছেন, সেখানেই তাঁরা নিজের নিজের ধর্মমতটি হড়হড় করে ঢেলে দিতে উঠেপড়ে লেগেছেন। ধর্মমতের এ প্রচারকার্যে কখনো ছলনা, কখনো মিছে মিঠে কথা, আর বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই গায়ের জোর-এর প্রয়োগ তাঁরা ঘটিয়েছেন। যাদের উদ্দেশ্যে নিজেদের ধর্মমতগুলোর দাওয়াত তাঁরা দিয়েছেন, তাঁরা আদৌ এ দাওয়াতে শরীক হতে চান কিনা-সে প্রশ্নটির উত্তর কখনো জানবার চেষ্টাও করেননি তাঁরা। কারণ, ধর্মবাদী সবার কাছেই নিজের নিজের ধর্মমতটিই শ্রেষ্ঠ, নিজের ঈশ্বরের বাইসেপটিই তাঁদের কাছে সবচেয়ে পেশিবহুল মনে হয়। নিজেদেরই তৈরি ঈশ্বরের শ্রেষ্ঠত্বের এ প্রপঞ্চে ভুগে ভুগে তাঁরা আর সবাইকে তুচ্ছ জ্ঞান করা শুরু করেন। নিজেদের দলটি ভারী রাখবার চেষ্টায় তাঁদের সারাক্ষণ ব্যাতিব্যস্ত থাকতে হয়, নইলে অন্য ঈশ্বরের অনুসারীদের সাথে মারপিট করে টিকবেন কীভাবে?
অস্তিত্বের এ লড়াইয়ে নিজের নিজের বিভাজন সৃষ্টিকারী ধর্মমতগুলো প্রচার করতে গিয়ে শিল্প-সাহিত্য-ইতিহাসকে বারবার তাঁরা গোল্লায় পাঠিয়েছেন। প্লটাসের প্যালিম্পসেস্ট, বখতিয়ার খিলজী'র নালন্দার গ্রন্থাগার পুড়িয়ে দেয়া, ইরাক, সিরিয়া ও লিবিয়াতে আইসিসের হাতে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার বছর পুরনো আসিরীয় সভ্যতার নিদর্শন ধ্বংস, কিংবা গেলো সপ্তাহেই ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় হেফাজতে ইসলাম-এর হাতে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ-র সঙ্গীতাঙ্গন পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া-এগুলো সবই এক সুতোয় গাঁথা (উল্লেখ্য, ২০১৬ সালেও মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা সঙ্গীতাঙ্গনটিতে হামলা চালিয়ে ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে। সেবারের হামলার পর তবুও কিছু নিদর্শন টিকে ছিলো, এবার সব নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলো। পণ্ডিত রবিশংকর ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ-এরই ছাত্র। বাঙলাদেশ রবিশংকরের দেশ নয়, তবুও তাঁর ওস্তাদের দেশের জন্য রবিশংকর নিউ ইয়র্কে '৭১-এর অগাস্টে দ্যা কন্সার্ট ফর বাঙলাদেশ-এর আয়োজন করেন। ১৯৮৫ নাগাদ এ কন্সার্টের অ্যালবাম এবং ফিল্ম থেকে প্রাপ্ত অর্থ থেকে ১২ মিলিয়ন ডলার বাঙলাদেশে পাঠানো হয়)। নিজের নিজের ধর্মমতকে সর্বশ্রেষ্ঠ মনে করেন বলেই হিন্দু, মুসলমান, খ্রীষ্টান, ইহুদী, বৌদ্ধ-মায় গোটা পৃথিবীর বুকে জন্ম নেয়া ৪৩০০টি ধর্মমতের প্রত্যেকটির অনুসারীরাই কখনো না কখনো শিল্প-সাহিত্যের টুঁটি চেপে ধরেছেন, চাপিয়ে দিতে চেয়েছেন অপরের ওপর নিজেদের হিংসাত্নক মতাদর্শগুলো। প্লটাসরা তাই ইতিহাসে ব্রাত্য হয়ে গেছেন, আর টিকে গেছেন অত্যাচারী ধর্মবাদীরা।
এ বইটিতে প্লটাসের ৫টি নাটক ঠাঁই পেয়েছে। নাম শিরোনামের দ্যা পট অফ গোল্ড সম্ভবত এখানে দুর্বলতম, তবে নাটকটি আবিষ্কৃত হয় অসম্পূর্ণ অবস্থায়; পাণ্ডুলিপির ছেঁড়া টুকরো, ঘষে মেজে তুলে ফেলা পুরনো লেখা, ইত্যাদির সূত্র ধরে হেঁটে অনুবাদক নিজের মতো করে সমাপ্তি টেনেছেন। অনেকটা এই ‘পট অফ গোল্ড'-এর অনুসরণেই নাকি মলিয়ের তাঁর দ্যা মাইজার নাটকটি লেখেন, যা তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কর্ম বলেই খ্যাত। প্রতিটি বৃহৎ ভাষাতেই যে এক এক জন মহান সাহিত্যিক এসে ভাষাটির গতিপথ নির্ধারণকারী কম্পাসের কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছেন তা তো আমাদের মোটামুটি জানাই আছে; তাঁদের ভাষারীতিকে কেন্দ্র করেই পরবর্তীতে তাঁদের তাঁদের যাঁর যাঁর ভাষাটির আধুনিক রূপ গড়ে উঠেছে। আমাদের কাছে রবীন্দ্রনাথ যা, ইংরেজ, জার্মান, ইতালীয়ান আর ফরাসীদের কাছে যথাক্রমে শেক্সপিয়র, গ্যেটে, দান্তে আর মলিয়ের কার্যত তা-ই। বলা হয়ে থাকে, সে আমলে লোকজন নাকি ফরাসীকে “মলিয়েরের ভাষা” বলে সম্মান দিতো। সেই মলিয়ের যাঁকে ওস্তাদ মেনে তাঁর নাটকের মাল মশলা ধার করেছেন নিজের নাটকের জন্য, তাঁকে না পড়লে তো চলছিলোই না! এছাড়াও, এই বইতেই সংকলিত প্লটাসের আরেকটি নাটক দ্যা ব্রাদারস মেনাকমাস-এর প্রচ্ছন্ন ছাপ রয়েছে শেক্সপিয়রের দ্যা কমেডি অফ এরর-এ। সাড়ে বাইশ শ বছর পর প্লটাসের নাটক আজকের দিনে কেন পড়বেন তার তিন নাম্বার যুক্তি হলো এটি! দুই আর এক নাম্বার যুক্তিও একে একে পেশ করছি যথাক্রমেঃ
প্লটাস নিজেও যে তাঁর আগের সময়ের গ্রীক নাট্যকারদের কাছ থেকে বেশ স্বাস্থ্যকর পরিমাণেই টুকলিফাই করেছেন, সে তো আগেই উল্লেখ করেছি। প্লটাসের সাথে পরিচিতি ঘটে গেলে অন্যান্য সূত্র মারফত তাঁর পূর্বসুরীদের ব্যাপারেও টুকটাক জানা হয়ে যায়। প্লটাসের বইটি পড়তে গিয়ে আমার তাই পরিচয় হয়ে গেলো প্রাচীন গ্রীক নাট্যকার মেনান্ডারের সাথে। মেনান্ডারের নাটকও প্যালিম্পসেস্টের খপ্পরে পড়ে হারিয়ে গেছে, শুধুমাত্র একটিই নাটকই (ডিসকোলোস/ দ্যা মিসঅ্যানথ্রপ) মোটামুটি পূর্ণ অবয়বে উদ্ধারকৃত হয়েছে ১৯৫২ সালে। মলিয়ের এই নাটকের মূল গল্পটি জানতেন, এবং সেটির ওপর ভিত্তি করেই একই নামে তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত নাটকটি লেখেন ১৬৬৬ সালে। এভাবেই প্লটাস পড়তে গিয়ে ওস্তাদের ওস্তাদের ওস্তাদ-এর সাথে পরিচয় হলো আমার। এতসব মহা মহা রথীর সাথে পরিচয় হয়ে আমার বাড়তি দু'টো হাত গজায়নি ঠিক, কিন্তু, হ্যাঁ, তথ্যের ভারে মগজের ওজন একটু বেশী ঠেকছে বৈকি!
এই বইয়ের ৫টি নাটকেই ঘুরেফিরে একটি ব্যাপার বড় হয়ে ধরা পড়েঃ ক্রীতদাস প্রথা। ক্রীতদাসের চরিত্রগুলো তাঁর নাটকগুলোতে প্রায়ই বেশ মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে, এবং আর সবকিছু ছাপিয়ে ক্রীতদাসরাও যে মানুষ, তাদেরও যে মুক্ত স্বাধীন জীবনের অধিকার আছে সেটিই উঠে এসেছে। প্লটাস কখনো সূক্ষ্ম, কখনো যথেষ্ঠই স্থূল স্বরে ক্রীতদাস প্রথার বিরুদ্ধে রীতিমতো প্রপাগ্যান্ডা চালিয়েছেন। প্রপাগ্যান্ডা শব্দটি আমরা খুব খারাপ বলেই জানি, তবে প্লটাসের মতো এ ধরণের মহান উদ্দেশ্যে “হোয়াইট প্রপাগ্যান্ডা” পৃথিবী যে একেবারে দেখেনি তা নয়। সাহিত্যে এমন হোয়াইট প্রপাগ্যান্ডা এর আগে একটির সাথেই পরিচিতি ছিলো আমার, জন স্টেইনবেকের “"দ্যা মুন ইজ ড্যাউন"। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় লেখা উপন্যাসটির গল্প ছিলো এমনঃ ইওরোপের অখ্যাত এক সাদামাটা গ্রামে নামহীন এক হানাদার বাহিনী অতর্কিতে এসে আক্রমণ করে (নাৎজি?)। নিরস্ত্র গ্রামবাসী হানাদার সেই সৈনিক বাহিনীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় মৌনতা আর অসহযোগীতা দিয়ে। একান্ত প্রয়োজন না পড়লে গ্রামের কেউ এই বাহিনীর কারো সাথে কথা বলে না, তাদের রাস্তা এড়িয়ে চলে। ভয়ানক বর্ণবাদী এক জীবন দর্শন নিয়ে চলা আক্রমণকারী এই হানাদার বাহিনীর সদস্যরাও যে দিন শেষে মানুষ, এবং গ্রামবাসীদের অসহযোগ ও ঘৃণা যে তাদেরও ছুঁয়ে যেতে পারে, মানবিক সাহচর্যের অভাব যে তাদের আক্রমণাত্নক সেই মানসিকতাটাকেই ভোঁতা করে দিতে পারে, এটাই স্টেইনবেক তাঁর ছোট্ট এই উপন্যাসে দেখান। যুদ্ধের সময় এ বইটির হাজার হাজার কপি প্লেন থেকে নাৎজি দখলকৃত এলাকাগুলোতে বিলানো হয়, জার্মানদের মনোবল ভেঙে দেবার জন্য। ‘অসীর চেয়ে মসীর জোর বেশী'-এ কথাটি তাত্ত্বিকভাবে আমরা সবাই জানি বটে, তবে স্টেইনবেক সেটি হাতেকলমে করেই দেখিয়ে দেন।
কলমের জোর কত বেশী হতে পারে ঠিক এই আলোচনাতেই প্লটাস গুরুত্বপূর্ণ। ধর্মবাদীরা তো কথায় কথায় গলার রগ ফুলিয়ে আপন আপন কিতাবটিকেই সকল মানবিকতা এবং নৈতিকতার উৎস হিসেবে দাবী করে বসেন। ক্রীতদাসদের স্বাধীনতা সংক্রান্ত প্রপাগ্যান্ডা দিয়ে প্লটাস মনে করিয়ে দেন নৈতিকতা বা মানবতা শেখার জন্য ধর্মগ্রন্থের প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন মানুষ হবার। খ্রীষ্টধর্ম বা ইসলাম আসার বহু বহু আগেই প্লটাস ক্রীতদাসদের নিয়ে মাথা ঘামিয়ে গেছেন, দেখিয়ে গেছেন মানবিক আচরণ কাকে বলে।
প্লটাসের নাটকগুলোর অন্যতম একটি বিশেষত্ব হলো চরিত্রগুলো মাঝে মাঝেই চতুর্থ দেয়াল ভেদ করে দর্শকের সাথে টুকটাক বাতচিৎ করে নেয়। প্লটাস তাঁর সমসাময়িক নাট্যকারদের নাটকের বিষয় এবং মান নিয়েও যথেষ্ঠই ভাবিত ছিলেন। ব্রাদার্স মেনাকমাস নাটকের শেষে সমাপনী বক্তব্যে তাঁর সেই ভাবনাগুলোই প্রতিফলিত হয়েছেঃ
দর্শকেরা, আপনেরা যারা কষ্ট কইরা আইলেন নাটকখান দেইখা কি সুন্দর উপদেশ-ই না পাইলেন! নোংরামি, ফাতরামির বালাই নাই, মাইয়া-পোলার লদকা-লদকির সিনও নাই। চরিত্রগুলান কেউ ধান্দাবাজির কাম করে না, বাপের পকেট কাইটা নেশাও তারা খায় না। এমুন নাটক এই জামানায় দেখছেন আর কয়টা? নষ্টামির-ই কাহিনী হালায় দশটার ভিতর নয়টা। প্রেম-পিরিতি, পরকীয়ার কাহিনি আইজকাইল যা দ্যাহায় মুরুব্বীরা ভি ভুইলা সব হাঁ কইরা গিল্লা খায়। নীতিকথার নাটক দেইখা যদি না হন বেচ্যান যদি মনে হয় লেখক হালায় একটা মাল-ই তাইলে আর বয়া দেরী করেন ক্যান দেন না হালায় জোরসে দুইখান তালি।।
"Spectators, you have seen today A highly edifying play: No sex, no secret love affairs, No baby smuggled in backstairs. Here is no fraud or knavery, No boy buys girl from slavery Behind his father's back. Such plays Are far from common nowadays. Playwrights no longer use the pen To improve the minds of decent men. If we have pleased, not wearied you, If you think virtue worth reward, Kind friends, you all know what to do... Just let us know it-and applaud."
এক সিরিয়াল কিলার আর তার লগে টম অ্যান্ড জেরি খেলা নায়িকার গল্প ইন্টেন্সিটি। নায়িকার নাম চায়না, ব্যাপারটা এমন না যে তার লগে চায়না দেশের কোন সম্পর্ক আছে। বাপ-মা তারে ছোটবেলার থিকা চায় না, তাই নাম হয়া গেছে চায়না। গল্পের ধাপে ধাপে চায়না'র নামকরণের সার্থকতা পাওন যায়, মানে, এইরকম মাথামোটা, বেকুব মাইয়া আপ্নের হোউক আপ্নেও কখনো চাইবেন না। গল্পের কাহিনী হইলো এইরকমঃ কুফা মাইয়া চায়না তার জিগরী বান্দুবি লরার বাড়ীতে উইকেন্ড কাটাইতে যায়। সেই রাইতেই, লরার গোটা ফ্যামিলি শত শত মাইল দূর থিকা আসা এক সিরিয়াল কিলারের হাতে খুন হয়া যায়। চোউক্ষের সামনে বান্দুবিরে মরতে দেইখা চায়নার বুকে প্রতিশোধের আগুন দাউ দাউ কইরা জ্বইলা উঠে, সে তাই কিলারের অজান্তে টুপ কইরা তার মোটর হোমের ভিতরে লুকায়া উইঠা পড়ে। কেন্দ্রীয় চরিত্রের যেইখানে সুবিধা হয়, আর ভিলেন চরিত্রের যেইখানে অসুবিধা হয়, সেই সেই জায়গাগুলাতে কাকতালীয় সব ঘটনা ঘটায়া লেখক দুষ্টরে দোজখের আগুনে পুড়ায়া দিছেন আর শিষ্টরে জান্নাতুল ফেরদাউস দান করছেন। হিন্দী সিরিয়ালের মতোন নাটকে ভরা এই বই আপনেরে বিভিন্ন টাইমে জানান দিয়া দিবো বইয়ের নামের বানান “Intensity” হইলেও উচ্চারণটা হইবো “চায় না”, কারণ বইয়ের পাত্রমিত্ররা তাগোর যা করনের কথা তার কিছুই করবার চায় না। যেমুনঃ
১। কিলার ভদ্রলোক চায় না তার মোটর হোমটারে একটু পরিষ্কার কইরা রাখতে, তার গাড়ীতে তার আগের দুই চাইরটা খুনের বডি এবং আলামত রাইখা সে এক স্টেট থিকা আরেক স্টেট দাবড়ায়া বেড়ায়।
২। চায়না চায় না কিলারের মোটর হোমটারে ভালো কইরা দেইখা সেইটার রঙ, হুলিয়া, কোন কম্পানির তৈরী এইসব মুখস্ত কইরা পুলিশের কাছে সেই বিবরণী দিতে।
৩। কিলার ভদ্রলোক সাধারণ খাবার খাইতে চায় না, তাই সে দেয়াল থিকা খাবলা মাইরা মাকড়সা ধইরা কচকচ কইরা খায়া ফ্যালায়।
৪। অনেক নাটক কইরা একখান রিভলবার এস্তেমাল করতে পারলেও চায়না চায় না রিভলবারে আদৌ গুল্লি আছে কিনা সেইটা পরীক্ষা কইরা দেখতে, যদিও এই কাজের জন্য ১৪ ঘন্টা সময় সে পাইছিলো। ফলাফল, কিলারের হাতে ধরা পড়া। তবে চিন্তার কিছু নাই, কিলার চায় না চায়না মইরা যাক। লেখকও চায় না চায়নার গুল্লিতে কিলার মইরা যাক।
৫। মোটর হোমের ভিতরে চায়নার অস্তিত্ব টের পাইলেও কিলার চায় না চায়নারে মারতে।
৬। কিলার তার বাড়ীতে চায়নারে শিকল দিয়া বাইন্ধা রাখলেও সে চায় না চায়না বন্দী থাকুক, তাই তারে কামে যাওনের আগে কয়া যায় কখন ফিরত আইবো, যাতে সেই টাইমে (৬ ঘন্টা) চায়না তার সুবিধামতো যন্ত্রপাতি টোকায়া নিজেরে মুক্ত কইরা নিতে পারে।
৭। কিলারের বাড়ীতে চায়নার লগে আরেকটা যেই বাচ্চা মাইয়া বন্দী থাকে, সেও চায় না কিলারের হাত থিকা মুক্তি পাইতে। তারে বুঝানোর লিগা চায়না দেড় ঘন্টা ধইরা তার ছোডবেলার কাহিনী শুনায়। এইসব নাটকে আরো পরিষ্কার হয়া উঠে, কেন তারে চাওনা যায় না।
... এইরকম আরো অনেক “চায় না” আছে, সব “চায় না”র লিষ্টি করতে আমার মনও আর সাড়া দিতে চায় না।
ইন্টেন্সিটি মূলত একটা ধান্দাবাজি বই, লেখক এইখানে যেইটা দেখাইছেন তা হইলো ধর্মহীন, নাস্তিক পাশবিক চরিত্রের এক খুনি বনাম ঈশ্বরপ্রেমী বাইবেলপড়ুয়া চায়নার ফাইট। ধর্মের পতাকা উচ্চে ধরা যাগো জীবনের মূল এজেন্ডা, তাগোর একটা কমন প্যাটার্ন আছে। ঐতিহাসিকভাবেই, ধর্মবিশ্বাস আর চিন্তার গভীরতার সম্পর্ক ব্যাস্তানুপাতিক। এই প্রসঙ্গে ছোটবেলায় শোনা একটা দুষ্ট গল্প বলা যাক। তো ম্যাডামের বাসায় অনেক রাত অব্দি ছাত্র পড়ালেখা করার পর হুঁশ হইছে দুইজনেরই যে এত রাত হয়া গেছে। ম্যাডাম তখন বলছে আজকা রাতটা তুমি আমার লগেই থাইকা যাও। সকালে উইঠা ম্যাডাম ছাত্ররে জিগাইছে, তুমি রাইতে আমার নাভিতে আঙুল দিতেছিলা ক্যান? ছাত্র কইলো এইটাই আমার অভ্যাস। বাইদিওয়ে, আপ্নে যেটারে আঙুল বলতেছেন, ঐটা আমার আঙুল না আসলে। ম্যাডাম বলছে, তুমিও যেটারে আমারে নাভি মনে করছ সেইটা আমার নাভি না! কম বয়সে হরমোনের জোয়ারে স্কুল পড়ুয়া পোলাপাইন এইসব যুক্তিহীন আজেবাজে গল্প বন্দু বান্দবরে কয়া মজা পায়-তাগো দোষ নাই এইখানে। কিন্তু কুন্টজ সাহেব যেটা করছেন সেটা জাস্ট নির্জলা ফাতরামি। বাইবেলের উপর কঠিন বিশ্বাস রাখা চায়না যে কত ভালো, তার বর্ণনা দিতে গিয়া চিন্তার গভীরতার অভাবে ভোগা ডিন কুন্টজের ‘আঙুল' ম্যালাবারই ‘নাভি'তে চইলা গেছে অনর্থক।
গোটা বইয়ে একমাত্র যেই বিষয়ে লেখক মাথা খাটাইছেন সেইটা হইলো খুনির নাম নির্বাচন। আমাগো সিরিয়াল কিলার ভদ্রলোকের নাম Edgler Foreman Vess। এই নামের অক্ষরগুলান দিয়া ‘semen', ‘rage', ‘fear' ইত্যাদি শব্দগুলান হয়, আর হয় একখান বাক্য, ‘God fears me'। এইসব আবোল তাবোল কথা বানানির লিগা লেখক ডিন কুন্টজ এইরকম অদ্ভুত একটা নাম বানাইছেন। ব্যক্তিগত জীবনে কুন্টজ সাহেব ধর্মের ব্যবসা করা রিপাব্লিকান পার্টিরে সমর্থন করেন, যেটারে বাঙলাদেশের বিভিন্ন ইসলামী দলগুলার সমান্তরাল কওন যায় (হেফাজতে ইসলাম, জামায়াতে ইসলাম, ইসলামী শাসনতন্ত্র... ইত্যাদি)। চাইলে রিপাব্লিকান পার্টিরে বিএনপির লগেও তুলনা দেওন যায়, তবে সেইক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠে, তাইলে আওয়ামী লীগের লগেও তুলনা টানন যায় না ক্যান? ধর্ম যেহেতু দুইটা দলেরই রাজনীতির মূল হাতিয়ার, এবং দল দুইটার নাম আর কর্তাব্যক্তিদের নাম ছাড়া আর সব কিছুতেই যেহেতু তারা সেম সেম এক কালার। একটা দল গাধার খোলস পইরা থাকা শুয়োর, আরেকটা খোলাখুলি শুয়োর, এইতো পার্থক্য। যাউক, মূল কথা হইলো এইরকম ধর্মীয় এজেন্ডা নিয়া যেইসব লেখকেরা লিখতে বসেন, এবং নিজ নিজ ধর্মের গুণগান গল্পের চিপায় চাপায় গায়া দেন, তাঁগো কল্পনাশক্তি আর জানাশুনার দৌড় বরাবরই খুব সীমাবদ্ধ। ঈশ্বরবিশ্বাসের যেই চশমাডা পিন্দা থাকেন তাঁরা, সেইটার কাঁচটা খুব ঘোলা, ধর্মের চৌহদ্দীর কয়েক ফুটের বাইরে আর তাঁরা নজর ফেলবার পারেন না। ডিন কুন্টজ বাঙলা জানলে সম্ভবত উনি কাশেম বিন আবুবাকার হইতেন, কিংবা কাশেম সাহেব ইংরাজী জানলে......
‘ডাইভিং বেল' হলো ডুবুরীদের সমুদ্রের গভীরে পাঠাবার বিশেষ এক ব্যবস্থা। বাতাসকে কাজে লাগিয়ে অত্যন্ত সরল এই যন্ত্রটির ব্যবহার শুরু সম্ভবত অ্যারিস্টটল এর সময়কাল থেকে। ছোটবেলায় গোসল করতে গেলে প্রায়ই একটা খেলা খেলতাম। মগের ভেতর শুকনো গামছা দলা পাকিয়ে ভরে মগটিকে উপুড় করে বালতির পানিতে চাপ দিয়ে দিয়ে ভেতরে ঠেলতাম। মগের পুরোটাই পানির তলায় চলে গেলেও ভেতরের গামছায় পানির স্পর্শ লাগতো না, কারণ মগের ভেতরের বাতাস পানিকে ভেতরে ঢুকতে দেয় না। এই একই কার্যপ্রনালী ব্যবহার করেই ডাইভিং বেল তৈরী করা। ঘন্টা আকৃতির নিচের দিকে খোলা এই যন্ত্রতে করে ডুবুরীদের নামিয়ে দেয়া হতো গভীর পানিতে। গন্তব্যে পৌঁছাবার আগ পর্যন্ত ডুবুরীকে ডাইভিং বেল এর ভেতরে বসে বা দাঁড়িয়ে থাকতে হতো (ছবি দ্রষ্টব্য):
ছোট্ট একটু সময়ের জন্য এক-দুজন মাত্র ডুবুরী বয়ে নিতে হতো বলে আগেকার যুগের ডাইভিং বেলগুলোর আয়তন খুব বেশী হতো না, তাই ভেতরের সঞ্চিত বাতাসের পরিমাণও খুব সামান্যই হতো। জানালাবিহীন, অন্ধকার, বদ্ধ খুব ছোট একটি খোলস, যেখানে প্রতি নিঃশ্বাসের সাথে সাথে অক্সিজেন কমে আসছে, সেখানে অল্প কিছুক্ষণ সময় কাটানোটাই কত কষ্টকর হতে পারে মনে মনে তার মোটামুটি একটি ধারণা আমরা বোধহয় করতে পারি। নিতান্ত পেশা বলেই ডুবুরীদের এই যন্ত্রের ভেতর বসে থাকতে হতো, তা-না হলে কে আর যেতে চাইবে দম বন্ধ করা অন্ধকার এই কুঠুরির ভেতর?
দি ডাইভিং বেল অ্যান্ড দি বাটারফ্লাই হলো এমনই এক অন্ধ কুঠুরির ভেতর আটকে পড়া একজন মানুষের স্মৃতিকথা। তবে, এ ক্ষেত্রে, ডাইভিং বেল শুধুই একটি রূপক। স্মৃতিকথার লেখক জাঁ দমিনিক বোবি আটকা পড়েছিলেন তাঁর নিজের শরীরের ভেতর, দারুণ দুরারোগ্য এক রোগে আক্রান্ত হয়ে। ১৯৯৫ সালের ৮ ডিসেম্বর ফরাসী ফ্যাশন ম্যাগাজিন এলের সম্পাদক বোবি হঠাৎ এক ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হন। বেখ সুখ মেখ (Berck-Sur-Mer) হাসপাতালে নিয়ে যাবার পর বোবি আবিষ্কার করেন কী ভয়ানক এক অভিশাপ নেমে এসেছে তাঁর ওপর। হার্ট অ্যাটাকের পর বিরল যে রোগটিতে তিনি আক্রান্ত হন তার ডাক্তারী নাম ‘লকড ইন সিনড্রোম' (Locked In Syndrome)। এ রোগে আক্রান্ত রোগীর মস্তিষ্কের বোধবুদ্ধি নিয়ন্ত্রণকারী অংশটুকু শতভাগ সক্রিয় থাকে, অসাড় হয়ে যায় গোটা শরীর। হার্ট অ্যাটাকের বিশ দিন পর হাসপাতালে জেগে উঠে বোবি আবিষ্কার করেন তাঁর শরীরে কোন সাড় নেই, হাত পা নাড়াবার ক্ষমতা নেই, নেই বাকশক্তিও। শুধু দুটি চোখ আর ঘাড়ের সামান্য একটু অংশ সচল। কারো প্রশ্নের কোন জবাব দেবার উপায় তাঁর নেই, নাকের ওপর বসা সামান্য মাছিটাকে তাড়াবার শক্তিও নেই, শুয়ে শুয়ে কেবল চোখ দুটো দিয়ে যতদূর দেখা যায় ততটুকু দেখা। এই সুখও খুব বেশীদিন সইলো না। ইনফেকশন হবার ভয়ে ডাক্তার তাঁর ডান চোখ সেলাই করে দেন। বহির্বিশ্বের সাথে বোবির যোগাযোগের একমাত্র উপায় এখন তাঁর বাম চোখ। এই বাম চোখ দিয়েই বোবি তাঁর ১৩০ পৃষ্ঠার স্মৃতিকথা লিখেন হাসপাতালে শুয়ে শুয়ে!
রোমান অক্ষর ব্যবহার করা ভাষাগুলোর (যেমন ইংরেজী, ফরাসী, জার্মান, ইতালিয়ান ইত্যাদি) একটি মজার ব্যাপার আছে। ভাষাগুলোর যার যার ব্যবহারের প্রেক্ষিতে অক্ষরগুলোকে ব্যবহারের ক্রম অনুযায়ী সাজানো যায়, অর্থাৎ, সবচেয়ে বেশী ব্যবহৃত অক্ষরটি থেকে সবচেয়ে কম ব্যবহৃত অক্ষর পর্যন্ত একটি তালিকা তৈরী করা যায়। ইংরেজীতে এটিকে ‘লেটার ফ্রিকোয়েন্সি' বলে (যাঁরা এডগার অ্যালান পো'র দি গোল্ড বাগ পড়েছেন তাঁদের কাছে বিষয়টি পরিষ্কার, এবং এটুকু পড়ে তাঁরা হয়তো মনে মনে হাসছেন! হেমেন্দ্রকুমার রায় এই গোল্ড বাগের ছায়া অবলম্বনেই যখের ধন লেখেন)। ফরাসী ভাষায় ব্যবহারের ক্রম অনুযায়ী অক্ষরগুলোর তালিকাটা এরকমঃ
ESARINTULOMDPCFBVHGJQZYXKW
বাকশক্তি রহিত বোবিকে বেশীর ভাগ সময় হ্যাঁ অথবা না বাচক প্রশ্ন করতে হতো, যার জবাব তিনি চোখ টিপে দিতেন। একবার চোখ টিপলে ‘হ্যাঁ', দুবার টিপলে ‘না'। বোবির সামনে তাঁর স্মৃতিকথার লেখিকা ক্লদ মেঁদিবিল লেটার ফ্রিকোয়েন্সির ওপরের তালিকাটা নিয়ে বসতেন এবং এক এক করে অক্ষরগুলো পড়ে যেতেন। যখনই বোবির চাহিদামাফিক শব্দটি আসত, বোবি চোখ টিপে বোঝাতেন। এভাবে এক একটি করে অক্ষর দিয়ে দিয়ে একটি শব্দ তৈরী হতো। এ কায়দায় একটি শব্দ লিখতে গড়ে দু মিনিট সময় লাগতো! বোবি প্রতিদিন গড়ে চার ঘন্টা ‘ডিকটেশন' দিতেন। ধীরে ধীরে দশ মাসের অসামান্য পরিশ্রমের পর অবশেষে বইটি লেখা শেষ করেন বোবি। গোটা বইটি লেখার ডিকটেশন দিতে বোবিকে মোটামুটি দু লক্ষ বার চোখ টিপতে হয়েছে।
লকড-ইন সিনড্রোম নিয়ে জানবার পর প্রথম যে কথাটি আমার মনে হয়েছিলো, আমি যদি এই রোগে আক্রান্ত হই, আমি কি আর বই পড়তে পারবো না? কক্ষনো কিছু লিখতে পারবো না? ছবি দেখতে পারবো না? প্রিয় মানুষগুলোকে ছুঁয়ে দেখতে পারবো না? জাগতিক বিষয়ে তাঁদের সাথে নানা কুতর্কে জড়াতে পারবো না? শিক্ষার একধরণের কুফল আছে, মানুষকে এটি অতিরিক্ত কৌতূহলী করে তোলে, জানতে চাইবার জন্য মনকে ছটফট করায়। আমি জানি না অক্ষরজ্ঞানহীন কেউ এ রোগে আক্রান্ত হলে তাঁর মানসিক অবস্থা কেমন হবে; আমার কেবলি মনে হয়, তাঁর জন্য কষ্টটা হয়তো তুলনামূলক কম হবে, হতে পারে এটি আমার হঠকারী একটি চিন্তা-শিক্ষিত/অশিক্ষিত ভেদে যেই হোন, কষ্টটা তো মানুষই ভোগ করবে-তবুও মনের কোনায় অন্ধ এক বিশ্বাস বাস করে, জগতের বেশীরভাগটাই দেখা হলো না, জানা হলো না এই ভীষণ সত্যটি যিনি জেনে গেছেন, তাঁর আফসোস আর অসহায়ত্বটাই বেশী।
শিল্প সাহিত্যের সমঝদার জাতি হিসেবে ফরাসীদের খ্যাতি দুনিয়াজোড়া। ফরাসী বোবি তাঁর বইয়ে সে প্রমাণ রেখেছেন। আকাশজোড়া অবসর সময় কাটাতে বোবি স্মরণ করেছেন তাঁর অসংখ্য প্রিয় চলচ্চিত্র আর বইকে। সমুদ্রের বালুকাবেলার দিকে তাকিয়ে জাঁ লুক গদা আর অরসন ওয়েলস এর চলচ্চিত্রগুলোর শুটিং চালিয়েছেন মনে মনে। আফসোস করেছেন সামনেই পড়ে থাকা এমিল জোলার বইটি পড়তে না পেরে। নিজের অবস্থা বর্ণনায় ব্যবহার করেছেন অভিজাত কাব্যিকতা। যে চমৎকার সেন্স অফ হিউমার এর পরিচয় এই বইয়ে দিয়েছেন বোবি, তাতে করে সংবেদনশীল পাঠকের জন্য এতো বুদ্ধিদীপ্ত একজন মানুষের এই পরিণতি মেনে নেয়াটা কিছুটা কষ্টকর-ই হবে। অনেকেই হয়তো মৃত্যুই কামনা করবেন এ অবস্থায়, বোবি তা চাননি। শারীরিক ভাবে বোবি আটকা পড়েছিলেন তাঁর পক্ষাঘাতগ্রস্ত শরীরের ডাইভিং বেলে, কিন্তু মন ছিলো তাঁর প্রজাপতির মতোই অস্থির, তা ছুটে বেড়িয়েছে বোবির ৪৩ বছরের সঞ্চিত অগণিত স্মৃতির পাতাগুলোয়। জাঁ দমিনিক বোবির স্মৃতিকথা প্রকাশের পরপর প্রচন্ড সাড়া ফেলে দেয়, তবে বোবি এ সাফল্য দেখে যেতে পারেননি। বইটি প্রকাশের দু'দিন পরই, ১৯৯৭ সালের ৯ মার্চ বোবির ইহজগতের কষ্টের শেষ হয় আকস্মিক নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে।
আমাদের অনেকেরই স্লিপ প্যারালাইসিস এর ভয়ংকর অভিজ্ঞতা আছে, বাংলায় যাকে বলে ‘বোবায় ধরা'। ঘুম থেকে হঠাৎ জেগে উঠে আবিষ্কার করা শরীর অচল হয়ে আছে, জিভ নাড়াবার উপায় নেই, শুধু গলার ভেতরের এক ধরণের অসহায় গোঁ গোঁ আওয়াজ জানিয়ে দেয় ‘বেঁচে আছি'। কী নিঃসীম শূণ্যতা আর শীতল আতঙ্ক, সেই বেঁচে থাকার অনুভূতিতে! স্লিপ প্যারালাইসিস এর গড় সময়কাল মাত্র ত্রিশ সেকেন্ড। যাঁদের এ অভিজ্ঞতা আছে কেবল তাঁরাই হয়তো কিছুটা বুঝবেন বিশ দিন পর জেগে উঠে প্রথম ধাক্কাটা সামলাতে বোবির কেমন লেগেছে, কেমন লেগেছে অথর্ব ভাবে এই দেড়টা বছর বেঁচে থাকাটা।
পুনশ্চঃ লকড-ইন সিনড্রোম নিয়ে পড়াশোনা করতে গিয়ে অন্য আরেকটি ঘটনার কথা জানলাম। কিছুটা ভিন্ন প্রসঙ্গ, তবে একেবারে অপ্রাসঙ্গিক সম্ভবত নয়। ১৯৭৩ সালের ২৭ নভেম্বর রাতে ভারতীয় নার্স অরুণা সেনবাগ তাঁর হাসপাতালের আর্দালি দ্বারা আক্রান্ত হন। আর্দালি তাঁকে কুকুর বাঁধার শিকল দিয়ে শ্বাসরোধ করে পায়ুপথে ধর্ষণ করে। অরুণা ‘ভেজিটেটিভ স্টেট' এ চলে গিয়েছিলেন, বেয়াল্লিশ বছরেও যে ঘুম ভাঙ্গেনি (ভেজিটেটিভ স্টেট এর সাথে কোমা'র পার্থক্য হলো, কোমায় রোগীর কিছু বোধশক্তি থাকে, ভেজিটেটিভ স্টেট এ রোগীর মস্তিষ্কের কার্যকলাপ আরো অনেক কমে যায়)। ২০১১ সালে অরুণা ৬৬ বছর বয়েসে মারা যান। অরুণার পক্ষে আবেদন করা হয়েছিলো তাঁকে ‘শান্তিপূর্ন মৃত্যু'র অনুমতি দেয়া হোক। আদালত তা খারিজ করে দেয়। অরুণার ধর্ষণকারীর ৭ বছরের জেল হয়েছিলো ডাকাতির অভিযোগে, ধর্ষণের বিষয়টি আদৌ আদালতে আসেনি, কারণ ১৯৭৩ সালের ভারতীয় আইনে পায়ুপথে ধর্ষণ বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত ছিলো না! আমি নিশ্চিত হতে পারছি না কোন বিষয়টি অধিকতর নিষ্ঠুরঃ অরুণা'র ধর্ষণ, নাকি তাঁকে ৪২ বছর ‘ভেজিটেবল' হিসেবে বাঁচিয়ে রাখা, নাকি সাধারণের অগম্য আইনের জটিল মারপ্যাঁচ?
পোলিশ কিংবদন্তি সাংবাদিক রিজার্ড কাপুচিন্সকি সংবাদের খোঁজে দাবড়ে বেড়িয়েছেন বিশ্বের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা তাঁর ঝুলিতে; দীর্ঘ ক্যারিয়ার শেষে হিসেব করে দেখা যায় তিনি মোট ২৭টি অভ্যুত্থান প্রত্যক্ষ করেছেন, ৪০ বার জেল খেটেছেন, আর অন্তত ৪ বার মৃত্যুদণ্ড পেয়েছেন। তাঁর এ ঘুরে বেড়ানোর সময় সাথী হিসেবে ছিলো ২৫০০ বছর আগে লেখা ইতিহাসের জনক হেরোডটাস-এর Histoies। দেশ-বিদেশে ঘুরতে ঘুরতে কল্পনায় কখনো কখনো হেরোডটাস-এর জুতোয় পা গলিয়েছেন। সেই সব অভিজ্ঞতার প্রেক্ষিতেই তাঁর বিখ্যাত বই ট্র্যাভেলস উইথ হেরোডটাস।
কাপুচিন্সকি শুরু করেছেন ২য় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার ৬ বছর পর ১৯৫১ সালের গল্প দিয়ে, যখন সদ্যই বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকেছেন তিনি। যুদ্ধের বিহ্বলতা তখনো যেন মানুষ কাটিয়ে উঠতে পারেনি; অত ধ্বংসযজ্ঞ দেখে অনেকেই তখন আশ্রয় খুঁজছেন সাহিত্যের পাতায়। বইয়ের প্রথম পাতাতেই কাপু জানিয়ে দেন পড়ালেখার জন্য তখন তাঁদের বই বা গ্রন্থাগার কিছুই ছিল না। যুদ্ধের ডামাডোলে সবই তখন ধ্বংস। পাঠ্যসূচীতে হেরোডটাস অন্তর্ভূক্ত ছিল বটে, কিন্তু সে বই কিছুতেই তাঁরা পড়ে উঠতে পারছিলেন না। ১৯৪০-এর দশকেই পোলিশ ভাষায় হেরোডটাস অনূদিত হবার পরও কেন বইটি পোল্যাণ্ডে প্রকাশিত হচ্ছিল না তার ব্যাখ্যায় কাপু পোল্যাণ্ডের কমিউনিস্ট শাসন ব্যবস্থাকে দায়ী করেছেন। পোল্যাণ্ডের পাশেই সোভিয়েত রাশিয়ার তথা গোটা কমিউনিস্ট বিশ্বের (সাদা চামড়ার অংশের) ঈশ্বর জোসেফ স্টালিন তখনো বহাল তবিয়তে। স্টালিনের ইশারাতেই কমিউনিস্ট সোভিয়েতের উপগ্রহ কমিউনিস্ট পোল্যাণ্ডে হেরোডটাস-চর্চা বন্ধ থাকে। কী কারণে আড়াই হাজার বছর আগের একটি বই নিয়ে স্টালিনের অমন ঢাকঢাকগুড়গুড়?
কাপু দাবী করেছেন হেরোডটাসের ইতিহাসে প্রচুর “ইঙ্গিত” রয়েছে, কেউ যদি সামান্য মনোযোগ দিয়ে পড়ে, তাহলেই বহু বহু শুয়োরের বাচ্চার প্রকৃত চেহারাটি স্পষ্ট হয়ে ধরা দেয়। কেন স্টালিনকে খুশী রাখতে পোল্যাণ্ডে হেরোডটাস-এর অনুবাদ প্রকাশিত হয়নি সে আলোচনায় কাপু হেরোডটাস-এর ৫ম খণ্ড থেকে একটি গল্প উদ্ধৃত করেছেনঃ
করিন্থের নিষ্ঠুর একনায়ক সিপসেলাস ৩০ বছর দমন-পীড়নের মাধ্যমে দেশ শাসন করে মারা যাবার পর তাঁর অধিকতর নিষ্ঠুর পুত্র পেরিয়্যাণ্ডার সিংহাসনে বসেন। তিনি পাশের রাজ্য মিলেটাস-এর একনায়ক থ্র্যাসিবিউলাস-এর কাছে দূত পাঠান, কী করে জনগণকে কৃতদাস বানিয়ে আজীবন ক্ষমতা ধরে রাখা যায় তা যেন শিখিয়ে দেন। থ্র্যাসিবিউলাস দূতকে নিয়ে একটি শস্যক্ষেতে যান, এবং ক্ষেতের এ মাথা থেকে ও মাথা হেঁটে বেড়ান, আর দূতকে একটু পর পর একই প্রশ্ন করতে থাকেন, কী উদ্দেশ্য নিয়ে করিন্থের এই দূত মিলেটাস-এ এল, সে কী জানতে চায়? ক্ষেতের মাঝে এভাবে এলোমেলোভাবে চরে বেড়ানোর ফাঁকে ফাঁকেই থ্র্যাসিবিউলাস যে চারাগাছগুলোর দৈর্ঘ্য তাঁর কানের সমান এসে দাঁড়িয়েছে, সেগুলোর মাথা ভেঙে দিচ্ছিলেন। এভাবে কয়েক ঘন্টা দূতকে গোটা ক্ষেতে হাঁটিয়ে মেরে কোন উপদেশ না দিয়ে থ্র্যাসিবিউলাস সেই দূতকে পেরিয়্যাণ্ডার-এর কাছে ফেরত পাঠান। দূতকে ফিরে আসতে দেখেই পেরিয়্যাণ্ডার উদগ্রীব হয়ে জিজ্ঞেস করেন কী শিক্ষা সে নিয়ে এসেছে। দূত বিরক্তি নিয়ে বলে এই থ্র্যাসিবিউলাস একটা পাগল স্রেফ। গোটা সময় শস্যক্ষেতে হাঁটিয়ে শুধুমুধু তার উঠতি চারাগুলো নষ্ট করল। পেরিয়্যাণ্ডার কিন্তু ঠিকই ইঙ্গিত বুঝে নিলেন। তিনি তাঁর রাজ্যে ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, বুদ্ধিধর, এবং সংবেদনশীল নাগরিকদের একে একে কতল করেন। যে অল্প কয়েকজন বুদ্ধিজীবী সিপসেলাস-এর করাল থাবা থেকে বেঁচে গিয়েছিল, পেরিয়্যাণ্ডার এবার তাঁদেরও নিকেশ করে ছাড়লেন।
রাষ্ট্রের বৃহত্তর কল্যাণ
...ভারতীয় যতগুলো গোষ্ঠীর কথা উল্লেখ করলাম, এরা সবাই পশুর মতো প্রকাশ্যেই যৌনক্রিয়ায় লিপ্ত হয়। এরা দেখতেও ইথিওপিয়ানদের মতোই কৃষ্ণ বর্ণের, এমনকি এদের বীর্যও এদের চামড়ার মতোই কালো। একই কথা ইথিওপিয়ানদের বেলায়ও খাটে।
হলুদ/ বাদামী চামড়ার অংশের
মহামতি মাও-এর সমস্ত লেখা মুখস্থ করে ফেলুন
বাইরের পৃথিবীর সাথে আমার যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম কমরেড লী, কিন্তু এ যোগাযোগের পথে তিনিই সবচেয়ে বড় অন্তরায়
আমি অফিসে জানাবো
দেখো, মানুষ সর্বোচ্চ বাঁচে ধরো ৭০ বছর, অর্থ্যাৎ প্রায় ২৫,২০০ দিন। কোন মানুষের জীবনেই প্রতিটা দিন একই রকম যায় না, কিছু না কিছু বেশকম থাকেই। অর্থ্যাৎ, আমরা যে বেঁচে আছি, এটা স্রেফ ভাগ্য। একটু এদিক ওদিক হলেই আমরা যে কোন মুহুর্তে মারা যেতে পারি। তোমার সম্পদের পাহাড় দেখিয়ে জিজ্ঞেস করছ তোমার চেয়ে সুখী কাউকে দেখেছি কি না, কিন্তু শান্তিপূর্ণভাবে মৃত্যুবরণ না করতে পারলে যে তোমাকে সুখী বলতে পারছি না!
কত রক্ত খাবি, এবার খা
ম্যাসাগেটান কেউ কোন নারীকে কামনা করলে তার কাপড়টি খুলে সে নারীর দরজার বাইরে টাঙিয়ে রেখে তার সাথে মিলিত হয়, কারোর এতে কিছু যায় আসে না। তবে তাদের জীবনে কঠোর একটি বিধি আছেঃ এদের কেউ অনেক বুড়ো হয়ে গেলে তার আত্নীয়-স্বজনেরা এসে তাকে কেটেকুটে রান্না করে খেয়ে ফেলে। ম্যাসাগেটাদের কাছে এর চেয়ে সম্মানজনক মৃত্যু আর হয় না। বিপরীতে, কেউ খুব অসুস্থ হয়ে মারা গেলে তাকে তারা মাটিতে কবর চাপা দিয়ে দেয়। এই মানুষটি যে অন্যদের ভোগে এলো না-এর চেয়ে দুর্ভাগ্যজনক আর কিছু নেই বলে তারা মনে করে।
ব্যাবিলনীয়রা সবাই এক জায়গায় জড়ো হয়ে একটি সিদ্ধান্ত নেয়। প্রত্যেক পুরুষ নিজের পরিবার থেকে তার মা, এবং রান্নায় পারদর্শী এমন আরেকজন নারীকে রেখে বাকী সব নারী সদস্যকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে। দারিয়াস এসে ব্যাবিলন অবরোধ করে রাখলে যেন খাদ্য-পানি ইত্যাদির সরবরাহে টান না পড়ে তাই এ কাজটি করা।
যে জাতির সৈনিকেরা যুদ্ধের মাঝেই এমন প্রগলভতার পরিচয় দেখাতে পারে তাদের বিরুদ্ধে জয় লাভ অসম্ভব
একা একজন মানুষকে বোকা বানাবার চেয়ে একদল মানুষকে বোকা বানানোটা সম্ভবত বেশি সহজ
ফল অফ মিলেটাস
নাটকের উদ্দেশ্য চিত্তের বিনোদন, পুরনো ক্ষত জাগিয়ে তোলা নয়