ধরুন, আপনি একজন লাইনম্যান, হাতের সামনে রাখা সুইচে টিপ দিয়ে ট্রেনের রাস্তা ঘুরিয়ে দিতে পারেন। রোজকার মতো অফিসে বসে সুইচ টিপে টিপে সময়মতো ট্রেনগুলোর রাস্তা বদলে যার যার গন্তব্যে পৌঁছে দিচ্ছেন। এমন সময়ে দেখলেন ঢাকা-সিলেটগামী ট্রেনের লাইনের ওপর ৫ জন ঘুমিয়ে আছে, আর ট্রেন ছুটে আসছে দানবিক গতিতে। হাঁকডাক করে ঘুমিয়ে থাকা ৫ জনকে ওঠাবার কোন উপায় নেই, হাতে সময়ও নেই, একমাত্র উপায় হাতের সুইচটি টিপে সিলেটের ট্রেনকে রাজশাহীর লাইনে উঠিয়ে দেয়া, কিন্তু সে লাইনের ওপর কানে হেডফোন গুঁজে একজন আনমনে হেঁটে চলেছেন, চারপাশে কী হচ্ছে সেদিকে তাঁর কোন নজরই নেই। আপনি কী করবেন? নিশ্চেষ্ট হয়ে চোখের সামনে ৫ জন ঘুমন্ত মানুষের ওপর ট্রেন চলে যেতে দেবেন? নাকি সুইচ টিপে রাজশাহীর লাইনে উঠিয়ে সেই আনমনে হেঁটে চলা লোকটিকেই ট্রেনের চাকার তলে ঠেলে দেবেন? ১ জনের জীবন, নাকি ৫ জনের জীবন? কোনটি বেশী ভারী আপনার কাছে?
দর্শনের ক্লাসের ‘ট্রলি প্রবলেম'-এর এই জটিল ধাঁধাটি তো আমরা অনেকেই জানি। ষাটের দশকের শেষের দিকে একটি গবেষণাপত্রে প্রথমবারের মতো এ ধাঁধাঁটি উপস্থাপন করা হয়, এরপর থেকে ব্যবসা, দর্শন, আইন, নৈতিকতা-ইত্যাদি নানাবিধ বিষয়ের ক্লাসে এ সমস্যাটি বিভিন্ন রূপে শিক্ষার্থীদের পড়ানো হয়ে আসছে। হালের সময়ের দারুণ জনপ্রিয় সিটকম ‘দ্যা গুড প্লেইস'-এও ট্রলি সমস্যা নিয়ে দারুণ একটি এপিসোড হয়েছে। বলছি বটে মাত্রই ষাটের দশকে এ সমস্যাটি জনসমক্ষে এসেছে, কিন্তু এমন নৈতিক ডিলেমাতে পড়ে তো মানুষ সেই কত শত হাজার বছর ধরেই ঘোল খেয়ে আসছে। আমরা চলচ্চিত্রেই দেখেছি, পৃথিবীর শত কোটি মানুষকে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা-ইত্যাদি মৌলিক চাহিদাগুলো মেটাতে হিমশিম খেতে দেখে দয়াপরবশ হয়ে থানোস তাঁর দস্তানা পরা হাতে তুড়ি মেরে পৃথিবীর অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে নিকেশ করে সম্পদের সুষ্ঠু বন্টন নিশ্চিত করতে চান। আমরা ওয়াচমেন-এ পড়েছি, একই যুক্তি দেখিয়ে অজিম্যান্ডিয়াস আজকের পৃথিবীর কয়েক মিলিয়ন মানুষকে মেরে ফেলতে চান, ভবিষ্যতের বিলিয়ন বিলিয়ন মানুষের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে। তর্কপ্রিয়রা বলবেন এরা তো সব কল্পনার মানুষ, এদের ট্রলি প্রবলেমের সেই ডিলেমা কই? তাহলে সত্যিকার মানুষের কল্পনার একটা উদাহরণই দেখা যাকঃ
চীনে ৫০-এর দশকে মাও সে তুং-এর সরকার যখন একের পর এক মুর্খতায় ভরা অবিমৃষ্যকারী সব সিদ্ধান্ত নিয়ে ৪ বছর মেয়াদী দীর্ঘ এক ক্ষরা ডেকে আনে, তাতে সাড়ে ৪ কোটি মানুষ না খেতে পেয়ে প্রাণ হারায় (সে সময়ের পূর্ব পাকিস্তান, আজকের বাঙলাদেশের জনসংখ্যাই তখন ছিলো সাড়ে ৪ কোটির সামান্য নিচে)। মাও নিজে ঘোষণা দিয়ে দেশের মানুষকে উপোস করে মরে যাবার জন্য উৎসাহ যোগান। সাংহাইয়ে দেয়া তাঁর এক বক্তব্যের সারকথা ছিলো, “খাদ্য অপ্রতুল হলে মানুষ মরবে জানা কথা। তাই দেশের অর্ধেক মানুষ খাওয়া ছেড়ে দিলে বাকী অর্ধেক মানুষ বেঁচে যায়, বৃহত্তর স্বার্থে আপনারা সেটাই করুন। দেশ আপনাদের এই মহান ত্যাগের কথা আজীবন সোনার অক্ষরে লিখে রাখবে”। সঙ্গীতের মতোই রাজনীতি, ধর্ম-ইত্যাদিও গুরুমুখী বিদ্যা। গুরু যে সুরে গলা চড়ান, শিষ্য তার বাইরে বেশী একটা সুর ভাঁজেন না। মাও-এরও তেমনি গুরু ছিলো। দেশের মানুষদের না খেয়ে মরে যাবার আহবান জানাবার এ জাদুকরী সুর তিনি শিখেছেন লেনিন আর স্টালিনের কাছ থেকে। সত্যিকার এই মানুষদের মনের ফ্যান্টাসিগুলো বাস্তবায়িত করতে গিয়ে এঁদের ফ্যান্টাসির ট্রলির নিচে চাপা পড়ে প্রাণ হারিয়েছে অর্বুদ কোটি মানুষ।
একটি মাত্র জীবনের চেয়ে পাঁচ পাঁচটি জীবন অনেক বেশী দামী এবং গুরুত্বপূর্ণ, এমন ভেবে অনেকেই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন “সিলেটের ট্রেনটিকে ঘুরিয়ে রাজশাহীর লাইনেই উঠিয়ে দেই” । তাহলে পরিস্থিতিটা আরেকটু ঘোরালো করা যাক, কি বলেন? আচ্ছা, সিলেটের লাইনের ওপর ঘুমিয়ে থাকা ঐ ৫ জন যদি কারওয়ান বাজারের বস্তিতে বাস করা এক রিকশাওয়ালা আর তার পরিবারের লোকেরা হয়, আর রাজশাহীর লাইনে একাকী হেঁটে চলা ব্যক্তিটি যদি হন দেশের সেরা একজন বিজ্ঞানী, কিংবা সাহিত্যিক, কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক? অথবা, সে ৫ জন যদি আপনার পরিবারের কেউ হন, আর একা হেঁটে যাওয়া মানুষটি যদি হন আপনার ধর্মের সবচেয়ে প্রভাবশালী ধর্মগুরুটি, যাঁর প্রতি অন্ধ আনুগত্যই আপনার ধর্মটি পালন করবার প্রধান শর্ত? চাইলে চরিত্রগুলোকে অদল-বদল করে পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে এই থট এক্সপেরিমেন্ট চালিয়ে যেতে পারেন, আমার আর মিছেমিছি নিজের মনের ওপর চাপ বাড়াতে ভালো লাগছে না...
সুইস নাট্যকার ফ্রিডরিখ ডুরেনমাট ট্রলি প্রবলেম গোছের এমন একটি গল্পই ধরেছেন তাঁর নাটক দ্যা ভিজিট-এ। ইওরোপের অখ্যাত, ভীষণ দারিদ্র্যের মধ্যে দিয়ে চলা এক গ্রামে অনেক বছর পর ঘুরতে আসেন এক প্রৌঢ়া নারী, যাঁর জন্ম এখানেই। আজ তিনি শত কোটিপতি। জন্মস্থান ঘুরে দেখার এ সফরে সাথে করে নিয়ে এসেছেন তাঁর বিরাট লটবহর; যে আরাম কেদারায় তিনি বসেন, সেটি কাঁধে তুলে নিয়ে হাঁটবার জন্য আছে দুই মুষকো জোয়ান, আছে খাঁচায় বন্দী তাঁর শখের পোষা চিতাবাঘ, আর আছে তাঁর সপ্তম স্বামী। গ্রামবাসীরা একাগ্র চিত্তে অপেক্ষা করে আছে, নিজ জন্মস্থানের এ গরিবী হাল দেখে ধনকুবের ক্লেয়ারের মন না কেঁদে পারবে না, তিনি নিশ্চয়ই বড় অঙ্কের টাকা দান করবেন, বন্ধ হয়ে যাওয়া কল কারখানাগুলো তাঁর দানে আবার চালু হবে, মানুষের কর্মসংস্থান হবে...ক্লেয়ারের মন গলাবার জন্য তাদের সবচেয়ে বড় অস্ত্র ক্লেয়ারের ছোটবেলার প্রেমিক/ বন্ধু ইল। ইলের সাথে দেখা হলেই প্রায় অর্ধ শতাব্দী আগের সেই প্রেমের ইতিহাস মনে করে ক্লেয়ার যে উদারহস্ত হবেন তাতে সন্দেহ কী? ক্লেয়ার সত্যিই কথা দেন, তিনি সাহায্য করবেন। টাকার যে অঙ্কটা তিনি উল্লেখ করেন, তা গ্রামবাসীদের সুদূর কল্পনার অতীত। সবার মুখ হাঁ হয়ে যায় এই বিপুল পরিমাণ অর্থসাহায্যের কথায়। কিন্তু ক্লেয়ার একটি শর্ত জুড়ে দেন; এ দশ লাখ টাকা পেতে হলে গ্রামবাসীদের ভেতর কাউকে এগিয়ে আসতে হবে ইলকে হত্যা করবার জন্য।
ইলের সাথে তরুণ বয়েসে যখন ক্লেয়ারের প্রেম হয়, তার অব্যবহিত পরেই তিনি সন্তানসম্ভবা হয়ে পড়েন। পিতৃত্বের দায়িত্বের ঝামেলায় জড়াবার ইচ্ছে ইলের ছিলো না। তাই সে মিথ্যে সাক্ষ্য যোগাড় করে ক্লেয়ারের নামে অপবাদ দিয়ে তাঁকে গ্রামছাড়া করে। বিশ শতকের গোড়ার দিকের সে সমাজে অবিবাহিত কিন্তু সন্তানসম্ভবা ক্লেয়ারের ঠিকানা জোটে এক পতিতাপল্লীতে। সেখানেই বহু হাত বদল হয়ে শেষমেষ এক ধনী ব্যবসায়ীকে বিয়ে করে কোটি টাকার মালিক বনেন ক্লেয়ার। এরপর তিনি একের পর এক বিয়ে করে গেছেন। নাটকে ইল-হত্যার ঘোষণা দেবার কয়েক পাতা পরেই দেখা যায় ক্লেয়ার তাঁর সপ্তম স্বামীকে তালাক দিয়ে অষ্টম স্বামী গ্রহণ করেছেন। ক্লেয়ারের গ্রামের অধিবাসীরা শুরুতে বেশ গাঁইগুঁই করে, ক্লেয়ারকে তারা মনে করিয়ে দেয় শত হলেও সভ্যতার প্রাণকেন্দ্র ইওরোপে তাদের বাস, যতই গরীব হোক তারা, হাতে রক্ত মেখে বড়লোক হবার ইচ্ছে তাদের নেই, ক্লেয়ার তাঁর প্রস্তাবটি ফিরিয়ে নিতে পারেন। ক্লেয়ার অবশ্য তাঁর অফার বলবৎ রাখেন। দামী হোটেলের বারান্দায় নবম স্বামীর সাথে বসে হট চকলেটের কাপে সুরুৎ সুরুৎ চুমুক দিয়ে তামাশা দেখতে থাকেন...
ইল ওদিকে ক্রমেই প্যারানয়েড হয়ে ওঠে; গ্রামবাসীর আচরণ তার কাছে অন্যরকম ঠেকতে থাকে। পুলিশের কাছে গেলে পুলিশ তাকে সাত পাঁচ তের বুঝিয়ে বিদেয় করে দেয়, মেয়রকেও আর আগের মতো বন্ধুভাবাপন্ন লাগে না ইলের কাছে। যে মুদি দোকানটি ইল চালায় সেখান থেকে সবাই (বাকীতে) দামী দামী সিগারেট, মদ কিনে নিয়ে যায়, ইলের স্ত্রী-সন্তানেরা (বাকীতে) অভিজাত কাপড় কিনে নতুন মডেলের গাড়ী হাঁকায় (কীভাবে কেনা? সেও বাকীতেই)। গ্রামের কারো কাছেই টাকা নেই, কিন্তু বাকীর হিসেবে সবাই ভোগবিলাস করে চলেছে, সবার মনেই ফূর্তি, সবাই যেন ধরেই নিয়েছে, টাকা আসছে। একসময় মেয়র নিজেই ইলের হাতে বন্দুক তুলে দেন, ইল যেন সসম্মানে নিজের হাতে প্রয়োজনীয় কাজটি করে গোটা গ্রামবাসীকে বাঁচিয়ে দেয়, ইল মরলেই অর্থনীতির চাকাটি সচল থাকে। তাছ��ড়াও, ইলের কৃতকর্মটিও তো কম গর্হিত নয়।
শেষতক কী হলো জানতে চাইছেন? এর উত্তর আপনি নিজেই দিতে পারবেন। ইলের জন্য কি আপনার মনে কোন দয়ার সঞ্চার হয়? মনের দাঁড়িপাল্লায় এক পাশে দায়িত্ব নিতে না চাওয়া, মিথ্যে সাক্ষ্য দিয়ে ক্লেয়ারের জীবন বরবাদ করে দেয়া ইল আর আরেকপাশে গোটা গ্রামবাসীকে উঠিয়ে হিসেব করতে থাকুন।
ফ্রিডরিখ ডুরেনমাট-এর এই দ্যা ভিজিট নাটকটিই তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত কাজ হিসেবে স্বীকৃত। ডুরেনমার্ট বলেছেন তাঁর কাজকে বুঝতে হলে, সঠিকভাবে তারিফ করতে হলে আগে ‘গ্রটেস্কনেস' বুঝতে হবে। ট্র্যাজি-কমেডি ধাঁচের এ নাটকে মানব চরিত্রের কাটাছেঁড়ার কাজটিই তিনি আসলে করেছেন। আর কে না জানে, মানব চরিত্র মাত্রেই ‘গ্রটেস্ক'। চোখা চোখা দারুণ উইটি এবং সূক্ষ্ম সব সংলাপ ও ঘটনার অবতারণা করেছেন ডুরেনমাট, সব দেখেশুনে মনে হয় মানবজাতির ওপর বেশ অনেকটাই বীতশ্রদ্ধ ছিলেন তিনি, এবং তাঁর এই ঘেন্না পাঠক/ দর্শকদের মাঝেও সঞ্চারিত করতে চেয়েছেন তিনি। বড় লেখকদের (বিশেষত নাট্যকারদের) প্রায় সবাইকেই আসলে এটাই কি করতে দেখি না আমরা?
ডুরেনমাট-এর একটি উপন্যাস অবলম্বনেই ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাট্যকার বিজয় তেন্ডুলকার তাঁর বিখ্যাত নাটক শান্ত! কোর্ট চালু আহে লেখেন, দেশে বিদেশে এ নাটক বহু বহুবার প্রদর্শিত হয়েছে, আগ্রহী কেউ চাইলে এ নাটক ইউটিউবেও দেখে নিতে পারেন। নাট্যকার মাত্রেই বেয়াদব হন; কোন একটি এজেন্ডা ছাড়া, ওপর মহলের প্রতি মধ্যমা প্রদর্শন ব্যতিরেকে নাটক আসলে হয় না। বিজয় তেন্ডুলকারের নাটকের নাম থেকেই বুঝে নেয়া যায় তাঁর কোর্ট চালু আহে নাটকের উদ্দেশ্য এবং বিষয়বস্তু কী, এবং কতটা বেয়াদব তিনি হতে পারেন। আমেরিকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি নাটক পড়িয়ে সে বেয়াদবী সঞ্চারিত করেছেন তাঁর শিক্ষার্থীদের মাঝেও। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ২০০২ সালে যখন ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী গুজারাত দাঙ্গায় মুসলমান হত্যায় সরাসরি মদদ দেন, সে সময় প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত তেন্ডুলকার বলেছিলেন, “আমার কাছে একটা পিস্তল থাকলে আমি এখনি মোদীকে গুলি করে দিতাম”। এমন চরিত্রের একটি মানুষ যখন ডুরেনমাটের কাছ থেকে ধার করেন, তখন সেই ডুরেনমার্টের বাকী সব বইকেও অবশ্যই তালিকায় রাখতে হয়। ডুরেনমাট তাই থাকছেন, থাকবেন।
বিজয় তেন্ডুলকারের সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন মহর্ষি শ্রী শ্রী ঠাকুর অরূপরতন। তাঁর কাছে অশেষ কৃতজ্ঞতা।
যে কোন যুদ্ধে সবার প্রথমে যে “সত্য” খুন হয় এ জ্ঞান তো আমরা হেরোডটাস, থুসিদিদেস, জেনোফোনদের হাত ধরে কয়েক হাজার বছর আগেই পেয়ে গেছি। যুদ্ধে আধিপত্য বিস্তার করতে হলে আপনাকে উন্নত অস্ত্র বানাতে হবে, শক্তিশালী সামরিক বহর গড়তে হবে, নিশ্ছিদ্র বূহ্য সাজাতে হবে, সত্যকে খুন করতে জানতে হবে, আর...আর? আর একটি উপকরণ আছে, যেটি অনুচ্চারিত রয়ে যায়, যুদ্ধ জেতার কৌশলের কোন হ্যান্ডবুকে তার উল্লেখ থাকে না, কিন্তু প্রতিটি যুদ্ধেই প্রেজেন্ট ইন্ডেফিনিট টেন্সের চিরন্তন সত্যের উদাহরণের মতো অনিবার্যভাবে ব্যবহৃত হয়ঃ ধর্ষণ। যুদ্ধের মূল উদ্দেশ্য ক্ষমতার প্রদর্শন; যুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়া ব্যক্তিটির পেশীটি কতখানি মাংসল, শিশ্নটি কতখানি বড় তার সংবাদই যুদ্ধের বরাতে আমরা পাই। যুদ্ধ ব্যাপারটি যেহেতু পুরুষপ্রধান, যুদ্ধের সাথে ধর্ষণ তাই হাতে হাত ধরে আসে। যুদ্ধে সত্য খুন হয় সবার আগে বটে, তবে যুদ্ধের সবচেয়ে বড় শিকার আসলে নারী।
বাঙলাদেশের স্বাধীনতার মাহাত্ন্য বোঝাতে আমরা কথায় কথায় একটি মুখস্থ বুলি আউড়াই, “২ লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে এ দেশ স্বাধীন করেছি আমরা”। “সম্ভ্রম” কোথায় থাকে? কী হয় এই সম্ভ্রম হারালে? সম্ভ্রম হারাবার পর এই নারীরা কোথায় যায়? কেমন জীবন কাটাতে হয় তাঁদের? তাঁদের মানসিক অবস্থাটাই বা কেমন থাকে? এ প্রশ্নগুলো নিয়ে আমরা খুব একটা ভাবি না। আমাদের কাছে সংখ্যাটাই বড় হয়ে দেখা দেয়, সেটাকেই মোটা দাগে দাগিয়ে আমরা বিজ্ঞাপিত করি নিজেদের স্বাধীনতাকে। ২ লক্ষ না হয়ে যদি শুধু ১ জন নারী ধর্ষিত হতেন, তাহলে আমরা হয়তো সেই তথ্যটা আদৌ আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিজ্ঞাপনে আনতামই না। ২ লক্ষ হোক, কিংবা ১, সারাজীবনের জন্য মানসিকভাবে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়া এই নারীদের প্রত্যেককে ব্যক্তিগতভাবে যে যাতনা পোহাতে হয়েছে, তার মাত্রাটা বাইরের কারো পক্ষেই আন্দাজ করা সম্ভব নয়। ব্যাপকতার দিক দিয়ে ২ লক্ষ অনেক বড় একটি সংখ্যা, কিন্তু যন্ত্রণার প্রেক্ষিতে ১ আর ২ লক্ষ সমান সমান।
ইউগোস্লাভিয়ার পতনের পর ১৯৯১ সালে স্লোভেনিয়া এবং ক্রোয়েশিয়া যখন ইউগোস্লাভিয়া থেকে বেরিয়ে এসে নিজ নিজ স্বাধীনতা ঘোষণা করে, তখন বসনিয়া-হার্জেগোভিনার মুসলমানেরাও ভোটাভুটি করে নিজেদের জন্য একটি আলাদা দেশের প্রস্তাব উত্থাপন করে। বসনিয়ায় বাস করা খ্রীষ্টান সার্বরা এতে আতঙ্কিত হয়ে ভীষণভাবে প্রতিবাদ শুরু করে। তারাও নিজেদের একটি আলাদা সংবিধান রচনা করে। ঐতিহাসিকভাবেই মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ বসনিয়াতে মুসলমান-খ্রীষ্টানে ঠোকাঠুকি চলে আসছিলো প্রায় ৭০০ বছর ধরে। মার্শাল টিটো সমাজতান্ত্রিক ইউগোস্লাভিয়া গঠন করে বেশ শক্ত হাতে এই ঠোকাঠুকি অনেকটাই দমিয়ে এনেছিলেন, তাঁর মৃত্যুর পর ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকয়তার বোতল বন্দী দৈত্য আবারো বেরিয়ে আসে। ১৯৯২-এর ২৯ ফেব্রুয়ারি বসনিয়া স্বাধীনতা ঘোষণা করে; মাসখানেক পরেই ৬ এপ্রিল সার্বিয়ার রাষ্ট্রপতি স্লোবোদান মিলোসেভিচের আশীর্বাদ নিয়ে বসনিয়ান সার্বদের নেতা রাদোভান কারাদচিচ বসনিয়ান মুসলমানদের ওপর হামলা করে বসেন, শুরু হয়ে যায় ৩ বছর মেয়াদী বসনীয় যুদ্ধ।
বসনিয়ান মুসলমান বা বসনিয়াকদের মানসিকভাবে ভেঙে দিতে সার্বরা ধর্ষণের এক মহোৎসবে নামে। জায়গায় জায়গায় ধর্ষণের ক্যাম্প বানিয়ে বন্দী নারীদের ওপর চলে দিনরাত নির্যাতন। মাতাল সার্ব সৈনিকেরা ইচ্ছেমতো সময়ে এসে যাকে পছন্দ হয়েছে টেনে নিয়ে গেছে নিজেদের ঘরে। কিশোরী থেকে বৃদ্ধা-১২ থেকে ৭০-কেউই ছাড় পায়নি। গবেষকেরা আজ বসনিয়ায় ধর্ষিত নারীদের সংখ্যা ২০ হাজার থেকে ৫০ হাজার পর্যন্ত ধারণা করেন। সংখ্যার ব্যাপকতার বিহবলতায় আমরা জানতে পাই না বা চাই না কীভাবে সে নারীরা এই ক্যাম্পগুলোতে দিন কাটিয়েছেন। কী চলেছে তাঁদের মনে। ক্রোয়েশিয়ান সাংবাদিক স্লাভেঙ্কা দ্রাকুলিচ এই ক্যাম্প বন্দী হতভাগ্য নারীদের গল্পই আমাদের শুনিয়েছেন তাঁর এস. উপন্যাসে।
এস. উপন্যাসের নামচরিত্র “এস”। এস কে? সাফিয়া? সায়রা? সেলমা? আমরা জানতে পাই না। যেমন জানতে পাই না “এস”-এর বান্ধবী “এন”, “এল” দের নামও। তাদের একটাই পরিচিতিঃ ধর্ষণ ক্যাম্পের বন্দী তারা, ঘন্টায় ঘন্টায় যাদের ডাক পড়ে সৈনিকদের ঘরে। ক্যাম্পে আসবার আগে এরা কেউ নার্স ছিলো, কেউ ছিলো শিক্ষক, গৃহিণীও ছিলো অনেকেই। এখন আর কারো কোন আলাদা পদমর্যাদা নেই; সবাই সবার সামনে একইরকম নগ্ন। সবাই এরা জানে কার সাথে কী হয়েছে। প্রতি সকালেই সার্ব সৈনিকেরা এদের সবাইকে মাঠে একসাথে বসিয়ে প্রাতঃকৃত্য সারতে বাধ্য করে। পশুর মতো অবস্থায় থাকতে থাকতে কি “এস”দের সব মানবিকতাও লোপ পাবে? তারা কি কেবলই লালসা মেটাবার বোধ-বুদ্ধিহীন বস্তুতে পরিণত হবে? দিনের পর দিনের পর দিন ধর্ষণের ফলে যে অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণের ভেতর দিয়ে যেতে হয় এদের অনেককেই, তারা কি করবে এই সন্তানদের নিয়ে? সার্ব সৈনিকদের এই সন্তানদের কি জন্মের পরপরই মাটিতে আছড়ে মেরে কিংবা নাক টিপে শ্বাসরোধ করে ক্যাম্পের বন্দীরা তাদের অক্ষম প্রতিশোধস্পৃহা চরিতার্থ করবে? গোটা উপন্যাস জুড়ে দ্রাকুলিচ এই প্রশ্নগুলোরই উত্তর খুঁজে বেড়িয়েছেন।
দ্রাকুলিচ নিজে ক্রোয়েশিয়ান, প্রতিবেশী বসনিয়ান নারীদের দুর্ভোগ খুব কাছ থেকে দেখেছেন, সাংবাদিক হিসেবে বসনীয় যুদ্ধের ওপর প্রতিবেদন লিখেছেন, তাই তাঁর বয়ান প্রাসঙ্গিক। উপন্যাস হিসেবে এস. খুব সুখপাঠ্য নয়, বেশ অনেকটাই পত্রিকার রিপোর্টের ধাঁচে লেখা, তবুও এটি বসনীয় যুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল। দ্রাকুলিচ বসনীয় যুদ্ধের টুকরো টুকরো ভয়াবহতার কথা দেখিয়েছেন তাঁর উপন্যাসে; ধর্ষণ-শিবিরে জন্ম নেয়া বহু শিশুকে জন্মের পরপরই তাদের হতভাগ্য মায়েরা প্রবল ঘৃণায় হত্যা করেছে, সার্বরা বসনীয় পিতাদের বাধ্য করেছে সবার সামনে আপন আপন কিশোর বয়েসী পুত্রদের ধর্ষণ করতে। হয় নিজ পুত্রকে ধর্ষণ করতে হবে, নয় বন্দুকের গুলি-এমন বিকৃত বিকল্পের সম্মুখীন হয়ে বহু বহু পরিবার চিরদিনের জন্য মানসিকভাবে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে গেছে। এই ক্যাটাটোনিয়া থেকে মুক্তির উপায় কী কারোই জানা নেই। যুদ্ধ ও নারীর গল্পগুলো আসলে একই; দেশ কাল জাত ভেদে একই ঘটনাই ঘটে চলে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে। বসনীয় যুদ্ধের সার্ব, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নাৎজি, নানকিং-এর জাপানী বাহিনী, ১৯৭১-এর পাকিস্তানী হানাদার... এরা সবাই একে অপরের অবতার মাত্র। স্থান, কাল, আর চরিত্রগুলো ঢেকে দিলে কে যে কে তা আর ঠাহর করা যায় না।
যুদ্ধের বরাতে নতুন নতুন প্রযুক্তি আসে, মানুষের গতিবিধি জানবার আর পাইকারী হারে খুন করবার এক একটা অস্ত্র গবেষণাগারে বিপুল বেগে তৈরী হতে থাকে। যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলে সেই প্রযুক্তির নতুন অন্য কোন ব্যবহার সভ্যতাকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যায়। চিরবিষণ্ণ “এস”রা সেই সভ্যতার বুকে দগদগে এক ঘা।
স্প্যানিশ সাহিত্যিক ইলদেফন্সো ফ্যালকোনেস-এর ঐতিহাসিক উপন্যাস ক্যাথিড্রাল অফ দ্যা সি। ১৩২৯ থেকে ১৩৮৩-এই ৫৪ বছর ধরে বার্সেলোনায় নির্মিত হয় স্পেনের বিখ্যাত সান্তা মারিয়া দেল মার বা সাগর তীরের মাতা মেরির ক্যাথিড্রাল। যে সময়ে এই ক্যাথিড্রালটি'র নির্মাণকাজ শুরু হয়, কাছাকাছি সময়ে ইওরোপে এমন ক্যাথিড্রাল বানাবার ধুম চলছে তখন, সবারই লক্ষ্য সবচেয়ে দশাসই ও সবচেয়ে দেখনদারি ক্যাথিড্রালটি বানিয়ে বাকী সবাইকে হাঁ করিয়ে দেয়া। এই ক্যাথিড্রালগুলোর বেশ কয়েকটিই আজ আর টিকে নেই, তবে সান্তা মারিয়া আজও বার্সেলোনা আলো করে দিব্যি দাঁড়িয়ে আছে ৭০০ বছর ধরে। পাউন্ড দেড়েক ওজনের এ বইতে ফ্যালকোনেস সান্তা মারিয়া ক্যাথিড্রাল নির্মাণের প্রেক্ষাপটে ১৪ শতকের বার্সেলোনার এ গলি সে গলি ঘুরিয়ে দেখিয়েছেন, ৬০০ পৃষ্ঠা ধরে শুনিয়েছেন মধ্যযুগের ইওরোপের প্রতিদিনের জীবনের গল্প।
উপন্যাসের শুরুতেই ফ্যালকোনেস ধর্ম আর স্বার্থের খেয়োখেয়ির সেই চিরন্তন ছবিটিই দেখিয���েছেন ঐতিহাসিক নানা সূত্র টেনে। ক্ষমতার পালাবদলে শত্রু-মিত্রের বহু হিসেব নিকেশই পাল্টে যায়, ধ্রুব সত্য থেকে যায় কেবল একটি বিষয়ইঃ গরীব আরো গরীব হয়, আর ধনী শাসকের পকেট ফুলে ফুলে ঢোল থেকে কোলবালিশে পরিণত হয়। গরীবের রক্ত চুষে খাবার অভিনব সব পন্থা জায়েজ করবার তরে নিত্য নতুন ঐশ্বরিক বিধান নিয়ে রক্তের গন্ধ পাওয়া হাঙরের মতো ছুটে আসে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো। উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্রের দাদার মুখে ফ্যালকোনেস শুনিয়েছেন হাজার হাজার বছর ধরে চর্চিত হয়ে আসা অমোঘ সেই সত্যঃ
“
বাপধন, যারাই কইবো উপরওয়ালার কাছ থিকা আদেশ পায়া তোমার উপকার করতে আসছে, তাগোরে কোনওদিন বিশ্বাস কইরোনা। অরা তোমারে ম্যালা মিঠা মিঠা কথা শুনাইবো, শুনতে তোমার ভালাও লাগবো অনেক, কিন্তু ঐ সব কথার আসলে কোন দাম নাই। অরা যেইভাবে কথা নিয়া খেলবার পারে, আমাগো ঐ জ্ঞান নাইরে বাপ। কিতাব খুইলা তারা তোমারে উপরওয়ালার অনেক বিধি বিধান দেখাইবো, কিন্তু আমরা তো চাষা, কাম করি ক্ষেতে, ঐ কিতাব তো আমরা পড়বার পারিনারে বাপ। ছোট বাল-বাচ্চারে আমরা যেইভাবে এইটা ওইটা বুঝায়া ঘুম পাড়াইতে নিয়া যাই, ঐভাবেই অরা তোমারে বুঝ দিয়া তোমার সব কব্জা কইরা নিতে চাইবো। খু-উ-ব সাবধান থাইকো...”
সান্তা মারিয়া দেল মার
সান্তা মারিয়া
সান্তা মারিয়া
সান্তা মারিয়া
ইনকুইজিশন
Chronica
ব্রিটিশ ম্যাটেরিয়াল সায়েন্টিস্ট মার্ক মিদোভনিক-এর বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণ বই স্টাফ ম্যাটারস। আমাদের আজকের দিনের পৃথিবীতে চারপাশে যেসব বস্তু নিয়ে প্রতিনিয়ত আমরা কাজ করি, কীভাবে সেগুলো এলো, ইতিহাসের কতটা দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে তবে আজ আমাদের নিত্য সঙ্গী হলো তারা তারই আখ্যান এ বই। ১০টি অধ্যায়ে উঠে এসেছে ধাতু, কাগজ, চকলেট, জেল, কাঁচ, গ্রাফাইট ইত্যাদির বৃত্তান্ত। সদ্য লব্ধ জ্ঞানের চুম্বক অংশ এখানে উগড়ে দিচ্ছি:
ধাতু কেন অত শক্ত হয়? এর কারণ, ধাতু মূলত ক্রিস্টাল বা স্ফটিকের সমন্বয়ে গঠিত; বিলিয়ন বিলিয়ন ধাতব ক্রিস্টাল একে অপরের সাথে গায়ে গা লাগিয়ে ভীষণ শক্তিশালী একটি বন্ধন তৈরী করে, এই ক্রিস্টালগুলোর ভেতর পরমাণুরা বিশেষ সজ্জায় নিজেদের গুছিয়ে নিয়ে গঠন করে একটি ত্রিমাত্রিক বূহ্য, যার দরুন ধাতুর কাঠামোটি অমন ‘ধাতব' হয়ে ওঠে। দাঁড়ি কামাবার রেজর যে কিছুদিন পরপর ভোঁতা হয়ে যায় তার কারণ, দাঁড়ির সাথে ক্রমাগত ঘর্ষণের ফলে রেজরের ধাতব ক্রিস্টালগুলোর আকৃতি বিকৃত হয়ে পড়ে, এলোমেলো হয়ে যায় তাদের সাজানো গোছানো সংসার। ধাতব পরমাণুগুলোকে যদি কোনভাবে জোর করে ফের আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে আসা যায়, তাহলেই রেজর বা ক্ষুরের ধার ফিরে আসে। ইলেক্ট্রন মাইক্রোস্কোপ দিয়ে ধাতব ক্রিস্টালে নজর ফেললে দেখা যাবে ক্রিস্টালের গায়ে কিছু আঁকাবাঁকা দাগ রয়েছে, যাদের ডিজলোকেশন বলে। এই ডিজলোকেশনগুলো আসলে একরকম ডিফেক্ট বা খুঁত; পরমাণুগুলোর অবস্থানের কোন উল্টোপাল্টা ঘটলেই এই ডিজলোকেশন ঘটে। ধাতুকে পিটিয়ে, তাপ/ চাপ ইত্যাদি প্রয়োগ করে ইচ্ছেমতো আকার দেয়া সম্ভব, যে কারণে ধাতু গত কয়েক হাজার বছর ধরেই পৃথিবীর সবচেয়ে প্রয়োজনীয় বস্তুগুলোর একটি। ধাতুর এই অনন্য গুণটির পেছনে হাত রয়েছে আসলে এই ডিজলোকেশনের।
আপনি যখন একটি পেপার ক্লিপকে বাঁকান, সেটি ভেঙে না গিয়ে দিব্যি বেঁকে যায় এর কারণ ক্লিপের ধাতব ক্রিস্টালের ডিজলোকেশনগুলো এক ক্রিস্টাল থেকে আরেক ক্রিস্টালে সরে পড়ে। নিজেরা সরে পড়ার সময়ে এই ডিজলোকেশনগুলো খুব ক্ষুদ্র পরিমাণে ধাতব পদার্থ ক্রিস্টালের এ মাথা থেকে ও মাথায় পাচার করে দেয়। এই পাচার করার কাজটি তারা করে শব্দের গতিতে। পেপার ক্লিপটিকে বাঁকালে প্রায় ১০০ ট্রিলিয়ন (১০০, ০০০, ০০০, ০০০, ০০০) ডিজলোকেশনের অবস্থানের পরিবর্তন ঘটে। এই বিপুল পরিমাণ ডিজলোকেশনগুলোর প্রত্যেকেই যখন খুব অল্প পরিমাণে ধাতব পদার্থ কয়েক লাখ মিটার/ সেকেন্ড গতিতে পাচার করে, তখনই ধাতু বেঁকে যায়, আর আমরা আমাদের চাহিদামতো আকার বানিয়ে নিতে পারি, হোক সেটা তলোয়ার কি সেতু কি আলমারী কি চামচ। কোন একটি ধাতুর গলনাঙ্ক থেকে সে ধাতুটির পরমাণুগুলো কতটা শক্তভাবে একে অপরের সাথে জড়িয়ে আছে, আর ধাতুটির ডিজলোকেশনগুলো কতটা তাড়াতাড়ি সটকে পড়তে পারে তার একটা আন্দাজ আমরা করে নিতে পারি। সীসার গলনাঙ্ক বেশ কম, এর ডিজলোকেশনগুলো খুব সহজে ক্রিস্টাল থেকে ক্রিস্টালে সরে যেতে পারে, তাই সীসা অত্যন্ত নরম একটি ধাতু। বিপরীতে, তামার ডিজলোকেশনগুলোকে সরাতে বেশ শক্তি প্রয়োগ করতে হয়, কারণ এর গলনাঙ্ক অনেক বেশী সীসার চেয়ে, তাই তামা অত শক্ত।
ডিজলোকেশনের নড়াচড়া, গতিবিধি ইত্যাদির ওপরই যে ধাতুর শক্তি নির্ভর করে সে তো জানলাম। তাহলে ডিজলোকেশনের নড়াচড়া করাটা কঠিন করে দিলেই শক্ত ধাতু তৈরী করা সম্ভব-এ তো বোঝাই যাচ্ছে! মেটাল অ্যালয় বা সঙ্কর ধাতু প্রস্তুত করা হয় ঠিক এ ধারণাটিকে কাজে লাগিয়েই। মূল host যে ধাতুটি, সেটির ক্রিস্টালের একটি পরমাণুকে সরিয়ে সেখানে অপর একটি ধাতুর পরমাণু যোগ করে সঙ্কর ধাতু বানানো হয়। পরমাণুর এমন অপসারণ প্রকৃতিতে আকছারই ঘটছে। বিশুদ্ধ অ্যালুমিনাম অক্সাইডের ক্রিস্টাল বর্ণহীন হয়, কিন্তু যদি এতে অল্প পরিমাণে লোহা ইম্পিওরিটি বা ভেজাল আকারে মিশে যায়, তাহলেই এর বর্ণ হয়ে যায় নীল, যাকে আমরা নীলকান্তমণি বলে জানি। লোহার জায়গায় যদি ভেজাল ধাতুটি ক্রোমিয়াম হয়, তাহলে তা লাল বর্ণ ধারণ করে। এই পাথরটিকে আমরা রুবি বা চুনী নামে চিনি।
সঙ্কর ধাতুর অন্যতম উদাহরণ স্টিল বা ইস্পাত-লোহা এবং কার্বনের সমন্বয়ে যা তৈরী হয়। ইস্পাতের ওপর ভর করে আধুনিক সভ্যতা বেশ অনেকটাই দাঁড়িয়ে আছে। শুধু আধুনিক সভ্যতা কেন, রোমান সাম্রাজ্যের অন্যতম সব বড় কীর্তিগুলোর পেছনেও আছে ইস্পাতের বিশাল ভূমিকা। বহু কাঠ খড় পুড়িয়ে, বহু ব্যর্থ প্রচেষ্টার পরই ইস্পাতের আধুনিক রূপটি আমরা পেয়েছি। অনেকেই হয়তো ধারণা করবেন লোহার সাথে কার্বন মেশালেই যেহেতু অত শক্ত ইস্পাত তৈরী হয়, তাহলে যথেচ্ছ কার্বন মেশালেই হয়! বাস্তবতা কিন্তু ভিন্ন; মাত্র ১ শতাংশ কার্বন যোগ করলেই ইস্পাত পাওয়া যায়, এর বেশী হয়ে গেলে সে ইস্পাত আর ব্যবহার উপযোগী থাকেনা, তা একেবারেই ঝুরঝুরে নরম হয়ে পড়ে।
প্রাচীন রোমানরা ছাড়াও আরেকটি সভ্যতা ইস্পাতের দারুণ ব্যবহার পৃথিবীকে শিখিয়েছে-জাপান। সামুরাইদের যে কাতানা তলোয়ার, সেটি আজও বিশ্ববাসীর কাছে একটি মহাবিস্ময়কর বস্তু। সামুরাইরা এই তলোয়ারটি বানাতো তামাহাগানে নামক এক ধরণের ইস্পাত থেকে। এই তামাহাগানের মূল উপকরণ ম্যাগনেটাইট নামক এক বিশেষ ধরণের লৌহ আকর; কম্পাসের কাঁটা তৈরী করা হয় এই ম্যাগনেটাইট থেকেই। কাতানা'র মাঝের অংশটুকুতে তারা কম কার্বন ব্যবহার করতো যাতে সে অংশটুকু দৃঢ় হয় এবং ঠোকাঠুকিতে ভেঙে না যায়, আর ধারালো অংশটুকুকে বেশী কার্বন দিয়ে তুলনামূলক নরম করে বানাতো যাতে ইচ্ছেমতো ঘষে এর ধার বাড়ানো যায় বহুগুণে।
কার্বন আর লোহার সমন্বয়ে দৃঢ় কাঠামোর ইস্পাত তো তৈরী হলো, কিন্তু মরিচা ধরে যাওয়া থেকে একে বাঁচাবার উপায় কি? বাতাসের অক্সিজেন ইস্পাতের সাথে বিক্রিয়া করে আয়রন (III) অক্সাইড গঠন করে, যাকে আমরা জং ধরা বা মরিচা পড়ে যাওয়া বলে জানি। ইস্পাতের এক একটি স্তর অক্সিজেন দ্বারা ক্রমাগত আক্রান্ত হতে থাকে এবং মরিচা পড়ে গোটা কাঠামোটিই ঝুরঝুরে হয়ে পড়ে। মরিচা ঠেকাবার জন্য তাই ইস্পাতের সাথে অল্প পরিমাণে ক্রোমিয়াম যোগ করা হয়; ক্রোমিয়াম ইস্পাতের আগেই অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া করে ক্রোমিয়াম অক্সাইডের একটি স্বচ্ছ আস্তরণ তৈরী করে ফেলে; ইস্পাত বেঁচে যায় অক্সিজেনের আক্রমণ থেকে। ক্রোমিয়াম সংবলিত এই ইস্পাতকে আমরা স্টেইনলেস স্টিল বলে চিনি। মজার ব্যাপার হলো ক্রোমিয়ামের এই আস্তরণটি কোন কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হলে বা কিছু অংশ উঠে গেলে তা নিজে নিজেই সেরে যায়! ক্রোমিয়ামের আরো একটি দুর্দান্ত কেরামতি আছে; আধুনিক সময়ের আমরা স্টেইনলেস স্টিলের চামচ দিয়ে খেতে অভ্যস্ত। চামচের ক্রোমিয়াম আমাদের থুতুর সাথে কোন বিক্রিয়া করেনা, ফলে আমাদের মুখে চামচের বাড়তি কোন স্বাদ আমরা টের পাইনা। আমাদের পূর্ববর্তী প্রজন্মের মানুষেরা অতটা সৌভাগ্যবান ছিলেন না! তাঁরা রূপার তৈরী তৈজসপত্র ব্যবহার করতেন, যা থুতুর সাথে বিক্রিয়া করে, ফলে খাবারের পাশাপাশি জিভে রূপার একটি তেতো স্বাদও যুক্ত হতো।
ইস্পাত ছাড়া আধুনিক কোন সভ্যতা যেমন কল্পনা করা যায় না, তেমনি কাগজ ছাড়াও আমরা আজ এক মুহুর্তও ভাবতে পারিনা। গাছ থেকে কাগজ আসে এ তো আমরা সবাই জানি। গাছের কাঠামোটি গঠন করে সেলুলোজ নামক অসংখ্য ছোট ছোট আঁশ যারা কী না লিগনিন নামক এক ধরণের জৈব আঠার সহায়তায় একে অপরের সাথে জুড়ে থাকে। এই লিগনিনের এতটাই শক্তি যে শত শত বছর ধরে সেলুলোজের এই কাঠামোটি অক্ষত থাকে। লিগনিনের এই বন্ধন ভাঙা চুল থেকে চুইং গাম সরাবার মতোই দুঃসাধ্য একটি কাজ। কাগজ প্রস্তুত করবার জন্য প্রথমে উচ্চ তাপ ও চাপ প্রয়োগ করে বিশেষ প্রক্রিয়ায় লিগনিন সরিয়ে সেলুলোজের মণ্ড তৈরী করা হয়, যা কার্যত তরলীকৃত গাছ। এই তরলটিকে সমতল কোন পৃষ্ঠে লেপে শুকালে কাগজ পাওয়া যায়। এই ধরণের প্রাথমিক পর্যায়ের কাগজ বাদামী বর্ণের হয়। আমরা যে অভিজাত সাদা কাগজের সাথে পরিচিত, সেটি প্রস্তুত করতে হলে ক্যালসিয়াম কার্বনেটের সাদা গুঁড়ো মেশাতে হয়।
কাগজ পুরনো হয়ে গেলে হলুদ বর্ণ ধারণ করে এটি আমরা অসংখ্যবারই লক্ষ্য করেছি। মূলত দু'টি কারণে কাগজ হলদেটে হয়ে যায়। প্রথমত, লিগনিন পৃথকীকরণের ধাপটি যদি ভালোভাবে সম্পন্ন করা না হয়, মণ্ডে যদি যথেষ্ঠ পরিমাণে লিগনিন রয়ে যায়, তাহলে তা আলোর উপস্থিতিতে বাতাসের অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া করে ক্রমে হলদেটে হয়ে ওঠে। সময় বাড়বার সাথে সাথে এই হলদেটে ভাবও বাড়তে থাকে। নিউজপ্রিন্ট জাতীয় সস্তা কাগজ এভাবেই প্রস্তুত করা হয়। দ্বিতীয় যে কারণে কাগজ হলদেটে বর্ণ ধারণ করে সেটির কারণ অ্যালুমিনাম সালফেট (Al2(SO4)3); এ রাসায়নিক দ্রব্যটি মূলত পানি পরিশুদ্ধ করবার কাজে ব্যবহৃত হতো, তবে কাগজের খসখসে ভাবটিকে কমিয়ে আনবার জন্য ১৮ এবং ১৯ শতকে মণ্ডের সাথে Al2(SO4)3 মেশানো শুরু হয়, যার ফলে কাগজটি অ্যাসিডিক বা অম্লীয় হয়ে পড়ে। অম্লীয় এই কাগজের সেলুলোজগুলো হাইড্রোজেন আয়নের সাথে বিক্রিয়া করে কাগজের বর্ণ হলদেটে বানিয়ে দেয়, সেই সাথে কাগজের স্থায়ীত্বও কমে যায়। এ ধরণের কাগজকে আমরা অ্যাসিড পেপার নামে জানি আজ।
জীবন যাপনের সুবিধার্থে হরেক কিছিমের কাগজ-ই তো আমরা এখন নিত্য ব্যবহার করছি। এতসব রকম কাগজের মাঝে বিশেষ এক রকম কাগজ হলো থার্মাল পেপার যা আধুনিক মুদি দোকানগুলোর ক্যাশ রেজিস্টারে আমরা দেখতে পাই। ক্যাশ রেজিস্টারে কালি শেষ হয়ে গেছে বলে রসিদ ছাপাতে পারছেনা-এমন কথা আমরা কখনো শুনিনি, এর কারণ, ক্যাশ রেজিস্টারে আদৌ কোন কালি থাকেনা! থার্মাল পেপারে আগে থেকেই কালি মেশানো থাকে, লিউকো ডাই এবং অ্যাসিড রূপে। রসিদ ছাপাবার সময় সামান্য একটু তাপ প্রয়োগ করে কাগজের অ্যাসিড এবং লিউকো ডাই-এর বিক্রিয়া ঘটানো হয়, যার দরুন স্বচ্ছ ডাইটি কালো কালিতে পরিণত হয়। যেহেতু বাইরে থেকে শক্তি প্রয়োগ করে (তাপ) সাময়িকভাবে কালির রং বদলাতে হয়, কিছুদিন পর তাই সেই লিউকো ডাইটি ফের তার আগের স্বচ্ছ বর্ণে ফিরে যায়, ফলে রসিদের লেখাগুলোও মুছে যেতে দেখি আমরা।
কাগজের সবচেয়ে বড় ব্যবহারটি আমাদের সবারই ভীষণ প্রিয়ঃ টাকা! কাগজ তো এই মুহুর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে সহজলভ্য বস্তুগুলোর একটি, তাহলে কেন সবাই ঘরে ঘরে কাগজে টাকা ছাপিয়ে নিতে পারছেনা? এর কারণ, আমরা মূলত গাছ থেকে প্রাপ্ত সেলুলোজ ভিত্তিক কাগজ ব্যবহার করি, আর টাকা বানানো হয় সচরাচর তুলা দিয়ে (ডলারের ৭৫% তুলা, বাকী ২৫% লিনেন)। সেলুলোজ-এর কাগজ দিয়ে তুলা থেকে তৈরী সত্যিকার টাকার নকল বানানো ভীষণ কঠিন। এছাড়াও, টাকার যে জগত ভোলানো কড়কড়ে আওয়াজ, সেটিও তুলা ছাড়া অসম্ভব। নকল টাকা শনাক্ত করবার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় আয়োডিনের কলম ব্যবহার করা হয়। সেলুলোজের তৈরী নকল টাকায় স্টার্চ (শ্বেতসার) রয়ে যায়, যা আয়োডিনের সাথে বিক্রিয়া করে কালো বর্ণ ধারণ করে। বিপরীতে, তুলায় যেহেতু কোন স্টার্চ নেই, আয়োডিনের কলম দিয়ে দাগ দিলেও তাতে কোন কিছু ফুটে ওঠে না।
প্রযুক্তি-নির্ভর আজকের দিনে কাগজের বই অনেকের কাছেই একটি বাড়তি বোঝা; সে জায়গায় চলে এসেছে কিন্ডল, আইপ্যাড, কোবো ই-রিডার ইত্যাদি যন্ত্রগুলো। শুনতে অবাক লাগবে, কিন্তু এই যন্ত্রগুলোর যে পর্দা, যেটিকে ইলেক্ট্রনিক পেপার বলা হয়, সেখানেও সত্যিকার কালি ব্যবহৃত হয়! এই কালি ই-বই রিডারের পর্দায় জ্যানাস পার্টিকেল নামক এক বিশেষ রকম কণার আকারে লেপে দেয়া হয়। এই কণাগুলোর এক পাশ থাকে কালো-যা ঋণাত্নক চার্জ যুক্ত, আর অপর পাশ সাদা (ধনাত্নক চার্জযুক্ত)। ই-রিডারের বুদ্ধিমান চিপটি প্রয়োজন মাফিক ভোল্টেজ প্রয়োগ করে চার্জের কম বেশী ঘটিয়ে কণাগুলোকে উল্টিয়ে পাল্টিয়ে পর্দার এক একটি পিক্সেলে গোটা পৃষ্ঠার লেখাগুলো আমাদের সামনে এনে দেয়। জ্যানাস পার্টিকেলের নামকরণ করা হয়েছে দুই মাথা সংবলিত প্রাচীন রোমান দেবতা জ্যানাস-এর নামে। ল্যাপটপ বা কম্পিউটারের পর্দার লিকুইড ক্রিস্টাল ডিসপ্লেতে পিক্সেলগুলো খুব তাড়াতাড়ি বদলে যেতে পারে যে কারণে চলচ্চিত্র বা ভিডিও দেখা সম্ভব হয়; কিন্তু জ্যানাস পার্টিকেলকে চলচ্চিত্রের দৃশ্যগুলোর গতি অনুযায়ী অত জলদি উল্টেপাল্টে ফেলা যায়না, তাই জ্যানাস পার্টিকেল সংবলিত ই-বই রিডারে চলচ্চিত্র বা ভিডিও দেখা যায় না।
সভ্যতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য সুদৃঢ় দালানকোঠা যা কিনা প্রকৃতি ও সময়ের সাথে যুঝে শতকের পর শতক টিকে থাকতে পারে। এ ধরণের দালান নির্মানে আজ আমাদের প্রথম পছন্দ কংক্রিট। কংক্রিটের মূল উপাদান লাইমস্টোন বা চুনাপাথর থেকে প্রাপ্ত ক্যালসিয়াম কার্বনেট, যার সাথে মেশানো হয় সিলিকন ও অক্সিজেনের সমন্বয়ে তৈরী সিলিকেট। চুনাপাথর তৈরী হয় ভূত্বকে, যখন জৈবিক প্রাণীদেহ পৃথিবীর অভ্যন্তরে প্রচণ্ড চাপ ও তাপে মিলিয়ন মিলিয়ন বছর ধরে চিঁড়েচ্যাপটা হতে থাকে। আর সিলিকেট মূলত কাদামাটি; ভূত্বকের ৯০ শতাংশই গঠিত এই সিলিকেট দিয়ে। এই দুইয়ের মিশ্রণে তৈরী কংক্রিট সেই রোমান আমল থেকে আজও আমাদের নিত্যসঙ্গী। রোমানদের তৈরী বহু কংক্রিটের দালান আজ কয়েক হাজার বছর পরও দিব্যি টিকে আছে, তবে কংক্রিটের কিছু দুর্বলতাও আছে। কংক্রিটের রাস্তায় বা বাড়ীঘরের দেয়ালে আমরা প্রায়ই ফাটল দেখতে পাই; এই ফাটলগুলো ধরে মূলত সূর্যের তাপে কংক্রিটের ক্রমাগত সংকোচন প্রসারণের কারণে। বর্তমানে আমরা কংক্রিটের ঢালাইতে ইস্পাতের একটি কাঠামো যোগ করে দৃঢ়তা বহুগুণে বৃদ্ধি করতে পারি। আমাদের ভীষণ সৌভাগ্য যে কংক্রিট ও ইস্পাতের এক্সপ্যানশন কোএফিশিয়েন্ট (সম্প্রসারণ সহগ) খুব কাছাকাছি, তাই এই দুইয়ের মিশ্রণে রিইনফোর্সড কংক্রিট বানানো সম্ভব হয়েছে।
ইস্পাত দিয়ে কংক্রিটের দৃঢ়তা বাড়ানো গেলেও বড় একটি সমস্যা রয়েই যায়ঃ ইস্পাতে মরিচা পড়ে যাওয়া। ইস্পাত ও কংক্রিটের মিশ্রণে একটি ক্ষারীয় অবস্থার সৃষ্টি হয় যার ফলে ইস্পাতের ওপর আয়রন হাইড্রোঅক্সাইডের একটি আস্তরণ তৈরি হয়। আদর্শিকভাবে, এ আস্তরণটি ইস্পাতকে মরিচা পড়ে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচাবার কথা, কিন্তু ক্রমাগত সংকোচন প্রসারণের ফলে কংক্রিটের গায়ে যে ফাটল দেখা দেয়, তা দিয়ে বিন্দু বিন্দু পানি ঢুকে পড়ে। ঠাণ্ডায় এই পানি জমে যায়, সংকোচিত হয়, ফের গরমে প্রসারিত হয়... এভাবে বিশেষত ঠাণ্ডার দেশে সামুদ্রিক পরিবেশে লবণাক্ত পানি কংক্রিটের ভেতরের ইস্পাতকে আক্রমণ করে পুরো কাঠামোটিকেই ধ্বসিয়ে দিতে পারে। বড় বড় পাহাড়ের প্রাকৃতিকভাবে যে ক্ষয় হয় (ইরোশন), সেটিও হয় ঠিক এই একই কারণেই। তাহলে কি পানির হাত থেকে কংক্রিটের কাঠামোকে বাঁচাবার কোনই উপায় নেই?
সাম্প্রতিক সময়ে একধরণের ‘সেলফ হিলিং' কংক্রিট তৈরী করা সম্ভব হয়েছে, যা ফাটল ধরা পড়লে নিজে নিজেই মেরামত করে নেয়! এই স্ব-নিরাময়টি সম্ভব হয়েছে বিশেষ এক জাতের ব্যাকটেরিয়ার কল্যানে; B. pasteurii নামক এই ব্যাকটেরিয়ার বাস আগ্নেয় ছাইয়ে ঘেরা ভীষণ ক্ষারীয় এক পরিবেশে, যেখানে pH-এর মাত্রা ৯ থেকে ১১ অব্দি। এমন ক্ষারীয় পরিবেশের মুখোমুখি হলে মানবশরীরের চামড়া তৎক্ষণাৎ পুড়ে যাবে, কিন্তু এই ব্যাক্টেরিয়ার জন্য এটি স্বর্গ বিশেষ! B. pasteurii-এর মলে বিপুল পরিমাণে ক্যালসাইট থাকে (ক্যালসিয়াম কার্বনেটের একটি বিশেষ রূপ), যা কংক্রিটের মূল উপাদান। এই ক্যালসাইট ফাটলগুলোকে বন্ধ করে দেয় আর কাঠামোটিকে আগের মতোই শক্তিশালী করে তোলে। কংক্রিটের ভেতর দশকের পর দশক ধরে জমে থাকতেও এই ব্যাক্টেরিয়াদের মোটেই কোন আপত্তি নেই। এ ধরণের সেলফ হিলিং কংক্রিটের ভেতরে ব্যাক্টেরিয়ার খাদ্য হিসেবে স্টার্চ বা শ্বেতসারের একটি প্রলেপ লেপে দেয়া হয়; ব্যাক্টেরিয়ারা আটকে থাকে ক্যালসিয়াম সিলিকেট হাইড্রেইট-এর একটি বন্ধনে। যখনি কংক্রিটে ফাটল ধরা পড়ে ও পানি ঢোকা শুরু হয়, তখনি সে বন্ধনটি কেটে যায় আর ব্যাক্টেরিয়ারা আড়মোড়া ভেঙে জেগে ওঠে। এরপর শ্বেতসারের সেই প্রলেপ খেয়ে যাওয়া আর মলত্যাগ করে যাওয়া...
সেলফ হিলিং কংক্রিটের মতো সেলফ ক্লিনিং কংক্রিটও তৈরী করা সম্ভব হয়েছে! এ ধরণের কংক্রিটে টাইটেনিয়াম ডাই অক্সাইডের (TiO2) ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণা থাকে যারা সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি শোষণ করে ফ্রি র্যাডিক্যাল আয়ন তৈরী করে। যে কোন জৈবিক ধূলিকণাকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে দিতে পারে এই আয়নগুলো। বাকী ধ্বংসাবশেষ বৃষ্টির পানিতে কিংবা বাতাসে ভেসে যায়। রোমের একটি গীর্জা (দিভেস ইন মিসেরিকরদিয়া) বানানো হয়েছে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে, যা নিজেই নিজেকে পরিষ্কার করে নিতে পারে। TiO2-এর আরেকটি বড় গুণ হলো এটি বাতাসের নাইট্রোজেন অক্সাইডের পরিমাণ কমিয়ে দিতে পারে, ঠিক গাড়ীর ক্যাটালাইটিক কনভার্টার-এর মতো। অদূর ভবিষ্যতে হয়তো পরিবেশ রক্ষায় TiO2-এর আরো বহু ব্যবহারই আমরা দেখবো।
কাগজ, ইস্পাত, কংক্রিট-এগুলো তো সবই আমাদের বেশ চেনাজানা উপকরণ। এবার একটু অচেনা একটি বস্তুর দিকে নজর ফেলা যাকঃ সিলিকা অ্যারোজেল। পৃথিবীর সবচেয়ে হালকা এ বস্তুটির ব্যাপারে জানতে গেলে আগে ‘জেলী' কী সেটা একটু জেনে আসা প্রয়োজন। জেলী মূলত এমন একটি তরল যা একটি কঠিন পদার্থের কারাগারে ভেতর আটকা পড়ে আছে। এই কারাগারটিকে আমরা মেশ বলতে পারি। খাওয়ার যে জেলী, সেটিতে এই কারাগারের কাঠামোটি তৈরী করে জেলাটিন। আমাদের চামড়া তৈরী করে যে প্রোটিনটি, সেটির নাম কোলাজেন; জেলাটিন উৎপন্ন করা হয় এই কোলাজেন থেকেই। পানির সংস্পর্শে জেলাটিনের অণুগুলো একে অপরের সাথে জোড়া লেগে মেশ বা কারাগার তৈরী করে যার ভেতরে জেলীর তরলটি আটক থাকে। তরলের পৃষ্ঠটান বা সারফেইস টেনশনের কারণে মেশের ভেতরের তরলটি বেরোতে পারেনা। আমাদের মুখের ভেতর ৩৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপে জেলাটিনের মেশের কারাগারটি ভেঙে যায়, ফলে আমরা ভেতরের তরলের স্বাদটি গ্রহণ করতে পারি।
জেলের ভেতর যে তরলটি আটক থাকে, সেটিকে যদি বিশেষ একটি মাত্রার তাপ প্রয়োগ করে এমনভাবে বাষ্পীভূত করে ফেলা যায় যাতে মেশের কাঠামোটির পক্ষে আর ‘বোঝা সম্ভব না হয়' যে ভেতরে গ্যাস রয়েছে না তরল রয়েছে, তাহলেই কেল্লাফতে! খুব ধীরে ধীরে এরপর এই গ্যাসটিকে অত্যন্ত সন্তর্পনে বের করে আনলে দেখা যাবে মেশের কাঠামোটি অবিকৃত রয়েছে, যদিও এর ভেতরে এখন শুধুই বাতাস। কাঁচ তৈরী করা হয় যে সিলিকন ডাইঅক্সাইড দিয়ে, সেটির মেশের কাঠামোটির ভেতরে তরল পুরে সেটিকে বাষ্পীভূত করেই সিলিকা অ্যারোজেল তৈরী করা হয়। কাঁচের ভেতর দিয়ে যখন আলো প্রবাহিত হয়, তার কিছু অংশ বেঁকে যায়, যাকে প্রতিসরণ বলে জানি আমরা। একই উপকরণ দিয়ে তৈরী সিলিকা অ্যারোজেলের ভেতরটা যেহেতু পুরোটাই ফাঁপা, আলো তাই সরাসরি প্রবাহিত হয়, কোন প্রতিসরণ ঘটেনা। ঠিক এ কারণে হালকা রঙয়ের আলোর পরিবেশে সিলিকা অ্যারোজেলকে সম্পূর্ণ অদৃশ্য মনে হয়। কিন্তু চমকটা হলো, গাঢ় রঙের পরিবেশের সাপেক্ষে অ্যারোজেলের বর্ণ নীল মনে হয়, যদিও এটি তৈরী বর্ণহীন কাঁচ থেকে। এ ব্যাপারটি কেন হয় সেটি নিয়ে বিজ্ঞানীরা বহুদিন মাথা ঘামিয়েছেন। অবশেষে সে উত্তরটি পাওয়া গেছে!
আমরা জানি, সূর্য থেকে বিভিন্ন বর্ণের, বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো ক্রমাগত ঠিকরে আমাদের চোখে এসে পড়ছে। সব তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো সমানভাবে বিচ্ছুরিত হয় না। আকাশের রং লাল না হয়ে নীল, এর কারণ ছোট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের নীল আলো বিচ্ছুরিত হয় বেশী; লাল আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য বেশ বড়, এর বিচ্ছুরণও তাই অনেক কম। এ ব্যাপারটিকে র্যালে স্ক্যাটারিং বলে আমরা জানি। কোন স্বচ্ছ পদার্থের ভেতর যদি অল্প পরিমাণে বাতাস আবদ্ধ থাকে, যেখানে ঐ পদার্থের বিলিয়ন বিলিয়ন ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পৃষ্ঠতলে আলো বিচ্ছুরিত হতে পারে, তাহলেই র্যালে স্ক্যাটারিং ঘটা সম্ভব। গাঢ় বর্ণের পরিবেশে অ্যারোজেলের ভেতর ঠিক এ ব্যাপারটিই ঘটে, ফলে আমরা নীল বর্ণ দেখতে পাই। অ্যারোজেলের আরেকটি দুর্দান্ত কেরামতি হলো এর অসম্ভব তাপ প্রতিরোধ ক্ষমতা। একটি পাতলা অ্যারোজেলের পর্দার একপাশে একটি বুনসেন বার্নার জ্বালিয়ে (১০০০-১৫০০ ডিগ্রী সেলসিয়াস) অপর পাশে একটি ফুল রাখলে কয়েক মিনিট অব্দি সে ফুলটির গন্ধ দিব্যি শোঁকা যাবে!
অ্যারোজেলের সবচেয়ে দুর্ধর্ষ ফায়দাটি নিচ্ছে নাসা। মহাকাশে তো অগণন মহাকাশীয় ধূলিকণা ও নুড়ি বিপুল বেগে প্রতিনিয়ত ঘুরে বেড়াচ্ছে, যাদের উৎপত্তি পৃথিবী সৃষ্টিরও ঢের ঢের আগে। এই space dust গবেষণাগারে নিয়ে পরীক্ষা করতে পারলে সৃষ্টিরহস্যের অনেক অজানা প্রশ্নের উত্তর যে পাওয়া যেতে পারে এ তো বোঝাই যাচ্ছে! কিন্তু ঘন্টায় ১৮ হাজার মাইল বেগে ছুটে বেড়ানো এই ফেরারী আসামীদের ধরতে গেলেই তো কামানের গোলার মতো সব ফুটো করে তারা বেরিয়ে যাবে; ভয়ানক সেই সংঘর্ষে এই space dust গুলো নিজেরাও ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে, ফলে তাদের আদি অবস্থায় পরীক্ষা করা তো সম্ভব নয়। সমাধান সিলিকা অ্যারোজেল। অত্যন্ত কম ঘনত্বের এই বস্তুটি space dust-এর জন্য নরম তুলোর বালিশের মতো কাজ করে। ১৯৯৭ সাল থেকেই নাসা অ্যারোজেলের জাল বানিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে মহাকাশীয় নুড়িপাথর আটক করে বেড়াচ্ছে।
চুম্বক অংশ টুকে রাখার নোটটা যাচ্ছেতাই রকম লম্বা হয়ে গেছে, তাই এখানেই যবনিকা টানছি। মিদোভনিকের এই বইটি তো শুধু কঠিন পদার্থ নিয়ে; তরল পদার্থ নিয়েও তাঁর একটি বই রয়েছে, ‘লিকুইড ম্যাটারস'। সে বইটিও লিস্টিতে উঠিয়ে রাখলাম...
ব্রিটিশ জিন বিজ্ঞানী ব্রায়ান সাইকসের বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণ বই দ্যা সেভেন ডটারস অফ ইভ। ২০ বছরেরও বেশী আগে প্রকাশিত এ বই আজকের দিনে বেশ অনেকটাই অচল। এই ২০ বছরে জিন প্রযুক্তি লাফিয়ে লাফিয়ে এত এগিয়ে গেছে যে এ বইয়ের অনেক আলোচনাই হয় বড্ড পুরনো, এবং “বালখিল্য” হয়ে গেছে, নয়তো আগাগোড়া ভুল প্রমাণিত হয়েছে। বইটির কথা প্রথম যখন জানতে পেরেছিলাম, এটি পড়বার এক অদম্য ইচ্ছে আমাকে গিলে খাচ্ছিলো, পড়ে ফেলবার পর এখন বেশ অনেকটাই আফসোস হচ্ছে! তবে বইটি ফেলনা নয় কোনভাবেই; ২০০১ সালে প্রকাশের পর যথেষ্ঠই সাড়া ফেলেছিলো সেভেন ডটারস। আমি বইটি পড়ে যা যা জানতে পেলাম তার চুম্বক অংশ এখানে নোট করে টুকে রাখছি স্রেফ।
সাইকস মূলত গবেষণা করছিলেন অস্টিওজেনেসিস ইম্পার্ফেক্টা নামক একটি ভীষণ দুরারোগ্য রোগ নিয়ে। কিছু কিছু নবজাতক শিশুদের মাঝে এ রোগটি দেখা যায়; তাদের হাড় এতই নরম থাকে যে যখন শিশুটি বুক ভরে তার প্রথম শ্বাসটি নেয়, তার বুকের পাঁজরের হাড়গুলো বাতাসের সে চাপে সঙ্গে সঙ্গে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়। এতেই শ্বাসরোধ হয়ে এই শিশুরা মৃত্যুবরণ করে। আমাদের হাড়ে কোলাজেন নামক এক ধরণের প্রোটিন আছে, হাড়ের শক্ত কাঠামোর জন্য এই প্রোটিনটিই দায়ী। কনক্রিটের স্থাপনায় স্টিলের রড যে কাজটি করে, হাড়ের ভেতর কোলাজেন ঠিক তা-ই করে। এই কোলাজেনের জিনের ছোট একটু ত্রুটি বিচ্যুতি থেকেই ভয়ানক এই রোগটির উদ্ভব। শত হাজার বছর ধরে মৃত প্রাণীর হাড় থেকে যে কার্বন ডেটিং করা যায় সেটিও সম্ভব হয় এই কোলাজেনের কার্বনের জন্যই। প্রোটিন তৈরী হয় বিভিন্ন রকম অ্যামাইনো অ্যাসিড দিয়ে; এই অ্যামাইনো অ্যাসিডের ক্রমটি কেমন হবে, কার পরে কে বসবে সেটি নির্ভর করে জিনের ভেতর ডিএনএ কিভাবে সজ্জিত আছে তার ওপর। যার যেখানে বসবার কথা, সে সে জায়গা থেকে নড়ে গেলেই ঘটে যায় মহা বিপত্তি।
১৯৯১ সালে অস্ট্রিয়া এবং ইটালীর সীমানায় অটজটাল আল্পস পাহাড়ী এলাকায় প্রায় সাড়ে ৫ হাজার বছর পুরনো এক মমি পাওয়া যায়, যার ডিএনএ অনুসন্ধানের দায়িত্ব এসে পড়ে সাইকসের ওপর। এই মমিটি আজ অব্দি সবচেয়ে পুরনো প্রাকৃতিকভাবে তৈরিকৃত মমি হিসেবে স্বীকৃত এবং এর নাম দেয়া হয়েছে অজি দ্যা আইসম্যান। যে সময়টাতে সাইকসরা তাঁদের গবেষণা করছিলেন, সেই নব্বইয়ের দশকে জিন প্রকৌশল সবে হাঁটি হাঁটি পা পা করছে; যে সব পরীক্ষা তখন তাঁরা চালাচ্ছেন, আজ সেগুলো খুবই সহজ এবং খেলো হয়ে গেছে। সে সময়ে বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিলো ডিএনএ সবসময় শূণ্যের ৭০ ডিগ্রী নিচে তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করতে হয়, ঘরোয়া তাপমাত্রায় আনলে কয়েক মিনিটের মধ্যেই ডিএনএ'র গুণাগুণ নষ্ট হয়ে যায়, তাই তা ফেলে দেয়া ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না। হাজার হাজার বছর ধরেও যে মমিতে ডিএনএ অবিকৃত থাকতে পারে, এটি একটি অসম্ভব চিন্তা ছিলো সে সময়ে। সাইকসরা তবুও একটি সুযোগ নেন। দাঁত বা হাড়ে ক্যালসিয়াম হাইড্রক্সিঅ্যাপেটাইট-এর রূপে থাকে। এই হাইড্রক্সিঅ্যাপেটাইট মিলিয়ন মিলিয়ন বছর ধরেও অবিকৃত থাকতে পারে, তাই সাইকস তাঁর অনুসন্ধান শুরু করেন আইসম্যানের হাড় থেকে।
আইসম্যানের হাড়ের ক্যালসিয়াম সরাবার পর যে প্রোটিন থাকে সেটিকে একটি এনজাইম দিয়ে দূর করা হয়। এনজাইম মূলত একধরনের অণুঘটক, যা জৈবিক বিক্রিয়াগুলোকে ত্বরান্বিত করে। এরপর ক্লরোফর্ম প্রয়োগ করে সরানো হয় চর্বি। সবশেষে ফেনল দিয়ে ধুয়ে পরিষ্কার করা হয় আইসম্যানের নমুনা। ক্লোরোফর্ম, এবং কার্বলিক সাবানের মূল ভিত্তি ফেনল-উভয়েরই ভয়ানক রাসায়নিক দ্রব্য হিসেবে (কু)খ্যাতি রয়েছে তবে আশার কথা হলো এরা কেউই ডিএনএ'র গুনাগুণ নষ্ট করতে পারে না। আইসম্যানের নমুনা টিউবে নিয়ে এবার মেশানো হয় পলিমেরাইজ নামক আরেকটি এনজাইম যা ডিএনএ'র নকল কপি বানানো শুরু করে। একে বলা হয় পলিমেরাইজ চেইন রিঅ্যাকশন বা সংক্ষেপে পিসিআর। কোভিড শনাক্তকরণে রোগীর নমুনা পরীক্ষা করা হয় আজ এই পিসিআর ব্যবহার করেই। সাইকসের দল আইসম্যানের মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ নিয়ে কাজ শুরু করেন। কেন নিউক্লিয়ার ডিএনএ না নিয়ে মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ? সে প্রশ্নের উত্তর আসছে শিগগীরই, তবে আপাতত এইটুকুই বলে রাখা যায় যে, এই বই প্রায় পুরোটাই মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ'র কেরামতি নিয়ে!
প্রায় সাড়ে ২৩০০ বছর আগে অ্যারিস্টটল ধারণা করেছিলেন, সন্তান কেমন হবে সেটি নির্ধারণ করে দেয় পিতা; মায়ের কাজ শুধুই সন্তানকে গর্ভের ৯ মাস যত্নে লালন করা, এবং জন্মের পর খাওয়ানো দাওয়ানো। যদি পিতার ছাঁচেই সন্তান হয়, তাহলে পুরুষ মানুষের কন্যাসন্তান কেন হয়-এ প্রশ্ন তখন অ্যারিস্টটলকে করা হয়। অ্যারিস্টটল উত্তর দেন সন্তানের সকল বৈশিষ্ট্য, লিঙ্গ সমেত, সম্পূর্ণভাবে পিতার ওপর নির্ভরশীল। সকল ভ্রুণই আসলে পুরুষ, কিন্তু গর্ভে থাকবার সময় কোন ত্রুটি বিচ্যুতির কারণেই সে ভ্রুণটি বিকৃত হয়ে কন্যার ভ্রুণে পরিণত হয়। আজ আমরা জানি, সন্তান মায়ের কাছ থেকে এক প্রস্ত, এবং বাবার কাছ থেকে আরেক প্রস্ত ক্রোমোজম পেয়ে দু'জনেরই বৈশিষ্ট্য একটু একটু করে ধারণ করে। ক্রোমোজমের ডিএনএতে ২০টি ভিন্ন অ্যামাইনো অ্যাসিড একের পর এক বিভিন্ন ক্রমে বসে। এই অ্যামাইনো অ্যাসিডগুলোর কিছু কিছু আমাদের নিত্য ব্যবহৃত বিভিন্ন পণ্যেই আছে, যেমন ফেনাইলঅ্যানাইনঃ ডায়েট সোডায় কৃত্রিম চিনি হিসেবে যে অ্যাসপার্টামি দেয়া হয় তার অন্যতম উপকরণ। বাবা-মা'র জিনে এই অ্যামাইনো অ্যাসিডেরা কি ক্রমে রয়েছে সেটিই নির্ধারণ করে দেয় কেমন হবে সন্তানের বৈশিষ্ট্যগুলো।
ডিএনএ'র যে চারটি মূল উপকরণ, অ্যাডেনিন (A), সাইটোসাইন (C), গুয়ানাইন (G), এবং থাইমাইন (T), এরা ATG TGA CGT TCA ইত্যাদি বিভিন্ন ত্রয়ী বানিয়ে এক একটি অ্যামাইনো অ্যাসিড তৈরী করে, যেমন, ATG তৈরী করে মেথায়োনাইন, ACC করে থেরোনাইন, TCC সেরাইন, TTC ফেনাইলঅ্যানাইন...ইত্যাদি। এমন এক একটি অ্যামাইনো অ্যাসিড একের পর এক বসার ফলে তৈরী হয় এক একটি প্রোটিন। মাথার চুল টেনে উপড়ে আনলে আমরা চুলের এক মাথায় যে সাদা গোল পুটুলিস্বরুপ ফলিকেল দেখতে পাই, তা মূলত কেরাটিন নামক একটি প্রোটিন যার ডিএনএ ক্রম হলো ATGACCTCCTTC; কেরাটিনে অ্যামাইনো অ্যাসিডগুলো সজ্জিত থাকে ATG-ACC-TCC-TTC-এমন একটি ক্রমে। এই A, C, G, Tরা কে কার সাথে বসবে তারও বাঁধা নিয়ম রয়েছে। A শুধু T-এর সাথেই বসে, আর কারো সাথে নয়। ঠিক একই ভাবে C এবং G শুধুমাত্র একে অপরের সাথেই বসে, A বা T-এর সাথে নয়। ডিএনএ'র যে ডাবল হেলিক্স গঠন, তার একটি তন্তুর কোড যদি হয় ATTCAG, তাহলে অপর তন্তুটি হবে TAAGTC। এভাবেই ছোট ছোট এক একটি অ্যামাইনো অ্যাসিডের ‘ইঁট' দিয়ে তৈরী হয় প্রাণীজগতের ইমারত।
ডিএনএ'র সাথে রক্তের গ্রুপের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক; আজ আমরা জানি এক গ্রুপের দাতা অপর গ্রুপের গ্রহীতাকে রক্ত দিতে পারে না, তবে এ জ্ঞানটি বহু প্রাণের বিনিময়ে কিনতে হয়েছে। ১৬২৮ সালে ইতালীতে প্রথম রক্তদানের প্রক্রিয়া শুরু হয়, কিন্তু ভুল রক্তের গ্রুপের মিশ্রণের ফলে এত মানুষ তখন মারা যায় যে রক্তদানের ব্যাপারটিই তখন আইন করে নিষিদ্ধ করা হয়। ১৮৭৫ সালে আবিষ্কৃত হয় বিভিন্ন প্রাণীর রক্ত একসাথে মেশালে কোষগুলো ছোট ছোট দল পাকিয়ে বিস্ফোরিত হওয়া শুরু করে। এই আবিষ্কারের হাত ধরে ১৯০০ সালে বিজ্ঞানীরা মানুষের রক্তকে ৪টি গ্রুপে ভাগ করেন: এ, বি, এবি, এবং ও। প্রাচীন ইনকারা বেশ সফলতার সাথে রক্তদানের প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করেছিলো বলে বেশ কিছু প্রমাণ পাওয়া যায়। কী করে তারা ইওরোপীয়দেরও ঢের আগে কাজটি করলো? দক্ষিণ আমেরিকার বড় অংশের মানুষেরই আসলে রক্তের গ্রুপ "ও", তাই দাতা ও গ্রহীতার রক্তের গ্রুপ “দৈবক্রমে” মিলে গেছে বেশীর ভাগ সময়েই।
উপর্যুক্ত ৪টি রক্তের গ্রুপকে পজিটিভ-নেগেটিভের ভিত্তিতে রেসাস গ্রুপ বলে আরেকটি গ্রুপে ভাগ করা যায়। ১৯৪০-এর দিকে বিজ্ঞানীরা মানুষের রক্তের সাথে খরগোশের রক্ত মেশান, যে খরগোশগুলোর শরীরে আগে রেসাস বাঁদরের কোষ ইঞ্জেকশন দিয়ে প্রবেশ করানো হয়। এভাবেই রেসাস গ্রুপটির সন্ধান পাওয়া যায়। এই রেসাস জিনের জন্যই নবজাতক শিশুদের মাঝে হিমোলাইটিক ডিজিজ বলে একটি রোগ হয়। মা যদি রেসাস নেগেটিভ হন, অর্থাৎ তাঁর রক্তে রেসাস অ্যান্টিজেন না থাকে (নেগেটিভ রক্তের গ্রুপ), এবং বাবা যদি রেসাস পজিটিভ হন, অর্থাৎ তাঁর রক্তে রেসাস অ্যান্টিজেন থাকে (পজিটিভ রক্তের গ্রুপ), তাহলে দ্বিতীয় সন্তানের রেসাস পজিটিভ হবার অনেক ঝুঁকি থাকে। প্রথম সন্তানের ক্ষেত্রে হয় না, কারণ, সন্তানের জন্মের সময় তার কিছু রক্ত কোষ মায়ের শরীরে চলে যায়; মা যেহেতু রেসাস নেগাটিভ, তাই তার শরীর এই রেসাসের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি বানানো শুরু করে দেয়। দ্বিতীয় সন্তান যখন গর্ভে আসে তখন মায়ের শরীরের সেই অ্যান্টিবডি এই রেসাস পজিটিভ ভ্রুনটিকে শত্রু জ্ঞান করে আক্রমণ করে বসে। এই শিশুরা অক্সিজেনের অভাবে জন্মের পর সচরাচর নীলাভ বর্ণের হয়।
মাইটোকন্ড্রিয়া যে কোষের শক্তি উৎপাদক সে তো আমরা ছোটবেলাতেই জেনেছি। কোষ যতো বেশী অক্সিজেন গ্রহণ করে, তত বেশী শক্তি উৎপাদন করতে পারে। মাইটোকন্ড্রিয়া এই বেশী করে অক্সিজেন গ্রহণ করবার কাজটিতেই সহায়তা করে। আমাদের শরীরের যে উত্তাপ, তার কিছুটার জন্য মাইটোকন্ড্রিয়া দায়ী। মাইটোকন্ড্রিয়ার মূল কাজ শরীরকে ATP সরবরাহ করা; হৃৎপিণ্ডের ওঠানামা, চোখের রেটিনা-যা এই লেখাটি পড়ছে, মস্তিষ্কের কোষ-যা এই লেখাটির অর্থ দাঁড় করাচ্ছে, এই সবগুলো কাজের শক্তি যোগায় ATP। এই মাইটোকন্ড্রিয়ার ঠিক কেন্দ্রে বাস করে একটি বিশেষ ডিএনএ, যাকে মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ বলে। নিউক্লিয়ার ডিএনএ থেকে বেশ অনেকটাই আলাদা মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ'র অস্তিত্ব আবিষ্কারটাই বিজ্ঞানীদের জন্য বেশ অবাক করা একটি ব্যাপার ছিলো। মাইটোকন্ড্রিয়াতে ডিএনএ কিভাবে এলো তার অন্যতম জনপ্রিয় একটি ব্যখ্যা হলো মিলিয়ন মিলিয়ন বছর আগে মাইটোকন্ড্রিয়া আসলে ছিলো স্বাধীনভাবে ঘোরাফেরা করে বেড়ানো ব্যাকটেরিয়া বিশেষ, যা অন্য কোষকে আক্রমণ করে ভেতরে জায়গা দখল করে বসে। মাইটোকন্ড্রিয়া পেলো আবাসস্থল, আর কোষ পেলো শক্তি উৎপাদক ATP। কোষ ও মাইটোকন্ড্রিয়া দু'জনই কিছুটা করে দু'জনের পিঠ চুলকে দিচ্ছে; এই সিম্বায়োটিক রিলেশনের জন্যই শেষতক এই ব্যবস্থাটি দাঁড়িয়ে গেলো।
নিউক্লিয়াসের ক্রোমোজমে যে ডিএনএ থাকে, তা মানুষ বাবা এবং মা, উভয়ের কাছ থেকেই পায়। কিন্তু মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ মানুষ পায় শুধুমাত্র মায়ের কাছ থেকে। ডিম্বাণুর যে বহির্স্তর, সাইটোপ্লাজম, তাতে প্রায় লাখ দশেক মাইটোকন্ড্রিয়া থাকে। বিপরীতে, শুক্রাণুতে থাকে হাতে গোণা অল্প কয়েকটি মাইটোকন্ড্রিয়া; জরায়ু অব্দি সাঁতার কেটে ডিম্বাণুর কাছে পৌঁছাবার জন্য যতটুকু শক্তি প্রয়োজন ঠিক ততটুকুই এই মাইটোকন্ড্রিয়াগুলো যোগান দেয়, এরপর এদের আর কোন কাজ থাকেনা, তাই তারা স্রেফ ঝরে পড়ে। ডিম্বাণুর ভেতর ঢুকতে পারা সফল শুক্রাণুটি নিউক্লিয়ার ডিএনএ নিয়ে আসে, কিন্তু মায়ের ডিম্বাণুর সাইটোপ্লাজমে তো মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ শুরু থেকেই বসে ছিলো। এ কারণেই মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ শুধুমাত্র মা'র কাছ থেকেই আসে। মা'র মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ'র একটি নকল কপি পায় মেয়ে, এরপর সেটিরও আরেকটি নকল কপি পায় নাতনি...এভাবে চলতেই থাকে। পুরুষেরাও মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ পায় তাদের মায়েদের কাছ থেকে, কিন্তু সেটি তারা তাদের সন্তানদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে পারে না।
মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ'র ভেতর মিউটেশন বা জিনেটিক পরিবর্তন হয় বটে, তবে এই ডিএনএ'র বিশেষ একটি অঞ্চলে এই মিউটেশন অনেক বেশী হয়, যাকে বলা হয় কন্ট্রোল রিজিয়ন। শরীরের গঠন কেমন হবে তার বিভিন্ন নির্দেশ মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ'র বিভিন্ন অংশে থাকলেও এই কন্ট্রোল রিজিয়নের এ ক্ষেত্রে তেমন কোন ভূমিকা নেই। কিছু কিছু স্নায়বিক রোগ রয়েছে যেগুলো মাইটোকন্ড্রিয়ার গুরুত্বপূর্ণ অংশের মিউটেশনের জন্য ঘটে। এ সকল ক্ষেত্রে মাইটোকন্ড্রিয়া এতটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয় যে তা প্রাকৃতিকভাবেই ঝরে পড়ে, পরবর্তী প্রজন্মের মাঝে আর সে পরিবর্তিত জিনগুলো সঞ্চারিত হয় না। অপরদিকে, কন্ট্রোল রিজিয়ন অংশটির যেহেতু সরাসরি কোন ভূমিকা নেই, তাই তাদের মিউটেশন অব্যাহত থাকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে। প্রতি দশ হাজার বছরে কন্ট্রোল রিজিয়ন-এর এক একটি মিউটেশন হয়, তাই, যদি দুজন ব্যক্তির কন্ট্রোল রিজিয়ন-এর ডিএনএ'র ক্রমটি হুবহু একই হয়, তাহলে ধরে নিতে হবে তাঁদের দুজনের যে ‘কমন' নারী পূর্বপুরুষ রয়েছেন, তিনি গত দশ হাজার বছরের ভেতরের মানুষ ছিলেন।
কিছু কিছু রোগ রয়েছে যা নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চলেই বেশী দেখা যায়, যেমন, আফ্রিকার দক্ষিণে সিকল সেল অ্যানিমিয়া (বক্র কোষ রক্তাল্পতা), এবং এশিয়া, ও ইওরোপে থ্যালাসেমিয়া। সিকল সেল অ্যানিমিয়াতে লোহিত রক্ত কণিকাগুলো বিকৃত আকার ধারণ করে কাস্তের মতো দেখতে হয়। এমন আকারের কারণে বিশেষতঃ সরু রক্তনালীগুলো দিয়ে তারা আর চলাচল করতে পারে না, ফলে শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অংশে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে ভয়ানক এক অবস্থার সৃষ্টি করে। অপরদিকে, থ্যালাসেমিয়ার ক্ষেত্রে লোহিত রক্ত কণিকার ভেতরের হিমোগ্লোবিন জমে পিণ্ড তৈরী করে, যা পরে প্লীহার ভেতরে সম্পূর্ণরূপে ধ���বংস হয়ে যায়। নিয়মিত রক্ত স্থানান্তর করা ছাড়া এর স্থায়ী সমাধান নেই।
প্রশ্ন হলো, এই সিকল-সেল অ্যানিমিয়া বা থ্যালাসেমিয়া হয় কেন? এর উত্তরঃ ম্যালেরিয়া। প্রতিটি ম্যালেরিয়া-প্রবণ অঞ্চলেই এই দু'টি রোগের প্রাদুর্ভাব বেশী। বাবা এবং মা-উভয়ের কাছ থেকেই এক একটি করে পরিবর্তিত হিমোগ্লোবিন জিন পেলেই সন্তানের এ রোগগুলো হতে পারে। বহু জিনেটিক রোগই এভাবে ছড়ায়; ইওরোপীয়দের ভেতর সবচেয়ে বেশী যেমন সিস্টিক ফাইব্রোসিস। যে জীবাণুটি ম্যালেরিয়া ঘটায়, কোন একটি অজানা কারণে তা সিকল সেল অ্যানিমিয়া বা থ্যালাসেমিয়া'র বাহককে আক্রান্ত করতে পারে না, বরং বাহকের শরীরে এই দু'টি রোগের বিরুদ্ধে কিছুটা প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। অপরদিকে, বাহকের শরীরে এই প্রতিরোধের জন্যই পরবর্তী প্রজন্মগুলোর মাঝে এই রোগগুলো ছড়াবার সুযোগ থাকে। প্রকৃতি এভাবেই এক আশ্চর্য নিষ্ঠুর খেলা খেলে নতুন-পুরানের একটি সাম্যাবস্থা বজায় রাখে। ম্যালেরিয়ার কারণেই যেহেতু হিমোগ্লোবিনের জিনের এই মিউটেশনগুলো ঘটে, তাই কোন অঞ্চলকে ম্যালেরিয়া-মুক্ত করে ফেললেও থ্যালাসেমিয়া দূর করা সম্ভব হয় না। সার্ডিনিয়া, ইতালী, গ্রিস, সাইপ্রাস, তুরস্ক ইত্যাদি অঞ্চলে ঠিক তাই-ই হয়েছে। সেখানে ম্যালেরিয়ার জন্য দায়ী মশাটিকে সম্পূর্ণরূপে নিকেশ করে ফেলা হয়েছে, কিন্তু থ্যালাসেমিয়া রয়ে গেছে বহাল তবিয়তে।
বাইবেল-কোরানে আমরা যে আদম-ইভের গল্প পড়ি, তার একটি জিনগত ব্যখ্যা দেয়া সম্ভব! মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ যে আমরা শুধু মা'র কাছ থেকে পাই সে তো আগেই জেনেছি; আমাদের মা'রা পেয়েছেন তাঁদের মায়েদের কাছ থেকে, তাঁরা পেয়েছেন তাঁদের মায়েদের কাছ থেকে্...এভাবে পেছনের দিকে ক্রমাগত যেতে থাকলে শেষ পর্যন্ত ২ লাখ বছর আগে আফ্রিকার একজন মা'র কাছে গিয়েই ঠেকতে হয়, যাঁর হাত ধরে পৃথিবীর সমস্ত মানুষ এসেছে! এই নারীকে বলা হয় ‘মাইটোকন্ড্রিয়াল ইভ'। এই মাইটোকন্ড্রিয়াল ইভ যে পৃথিবীর প্রথম নারী ঠিক তা নয়, সে সময়ে মনুষ্য প্রজাতির আরো নারী নিশ্চয়ই ছিলেন, কিন্তু তাঁদের উত্তরসূরী কন্যারা বা নাতনীরা টিকে থাকতে পারেনি ডারউইনীয় ন্যাচারাল সিলেকশনের জন্যই। ইভের কন্যা, তস্য কন্যা, তস্য তস্য কন্যারা বেঁচে গেছেন বলেই আমরা আসতে পেরেছি-এটাই এখন সবচেয়ে গৃহীত বৈজ্ঞানিক ব্যখ্যা। কিভাবে বিজ্ঞানীরা এই ২ লাখ বছরের হিসেবে আসলেন? সেই যে মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ'র মিউটেশনের হার, প্রতি ৮ থেকে ১০ হাজার বছরে একটি করে মিউটেশন হয়, তার কথা মনে আছে তো? পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের ডিএনএ নমুনায় কতগুলো মিউটেশন আছে সেটি বের করে তার সাথে মিউটেশনের হার গুণ করে তাঁরা এই সময়টা পেয়েছেন। ব্যাপারটি যতো সহজে বলে ফেললাম, অমনও ঠিক নয়, তবে মোটামুটি ধারণাটি এমনই।
মাইটোকন্ড্রিয়াল ইভ-এর হাত ধরে পরবর্তীতে যে নারীরা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে গত ২ লাখ বছরে নতুন নতুন জনগোষ্ঠীর জন্ম দিয়েছেন, এদের বলা হয় হ্যাপলোগ্রুপ। সাইকস ধারণা করেছেন ইভ-এর পর ৭ জন নারীর হাত ধরে বাকী পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে মানুষ ছড়িয়েছে, যাদের তিনি ইভের কন্যা বলে অভিহিত করেছেন। এ বইয়ের প্রথমার্ধে জিন বিজ্ঞান নিয়ে যাবতীয় তথ্য প্রদানের পর সাইকস বাকী অর্ধেকে তাঁর সেই কল্পিত ৭ জন নারীর কল্পিত গল্প বলেছেন। সেটুকু পড়া নিতান্তই সময়ের অপচয়। এই শ'খানেক পাতা অতিরিক্ত যোগ করায় বইয়ের বাহ্যিক ওজন বেড়েছে বটে, কিন্তু বইটির গ্রহণযোগ্যতার যে ওজন, সেটি অনেকটাই কমে গেছে।
সিহানো দে ব্যেহজেহাচ (Cyrano de Bergerac) একাধারসে ছিলেন কবি, বিজ্ঞান-কল্পকাহিনীকার, দার্শনিক, চিকিৎসক, নাট্যকার, চিঠি-লেখিয়ে, সৈনিক, এবং তলোয়ারবাজ। যে সময়টায় সিহানো'র জন্ম, সেই ১৬১৯ সালে ইওরোপের মধ্যভাগ জুড়ে চলছে থার্টি ইয়ারস' ওয়ার। ১৬১৮ থেকে ১৬৪৮ সাল পর্যন্ত চলা এ যুদ্ধে প্রায় ৮০ লক্ষ মানুষ প্রাণ হারায়, জার্মানীর জনসংখ্যা নেমে আসে অর্ধেকে। এ যুদ্ধের হাত ধরে ইওরোপ খুব অল্প সময়ের ব্যবধানেই আরো বেশ কয়েকটি যুদ্ধ দেখে যার মাঝে উল্লেখ্যযোগ্য নেদারল্যান্ড ও স্পেনের ৮০ বছরের যুদ্ধ, ফ্রান্স-স্পেনের মাঞ্চুয়ান যুদ্ধ, পর্তুগাল-স্পেনের যুদ্ধ, এবং সবশেষে ফ্রান্স-স্পেনের যুদ্ধ। শেষের এই যুদ্ধে ফরাসী সিহানো নিজেও লড়াই করেন এবং যুদ্ধে আহত হবার পর সৈনিকের দায়িত্ব ছেড়ে পুরোপুরি লেখালেখিতে মনোনিবেশ করেন।
জনশ্রুতি আছে, সিহানো'র নাকটি নাকি (আক্ষরিক অর্থেই) ছিলো বিশাল বড়। টেনিদা'র বইয়ের প্রচ্ছদে যেমন সবার প্রথমে তাঁর নাকের দিকেই নজর যায়, সিহানো'র ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম কিছু ছিলো না নাকি। সিহানো'র মৃত্যুর প্রায় আড়াইশ বছর পর ১৮৯৭ সালে ফরাসী নাট্যকার এদমোঁ হোস্তাঁ (Edmond Rostund) সিহানোকে নিয়ে নাম শিরোনামে একটি নাটক লেখেন, যা আজ অব্দি তাঁর শ্রেষ্ঠতম কাজ হিসেবে টিকে আছে; বস্তুতঃ হোস্তাঁ এবং ‘সিহানো দে ব্যেহজেহাচ' আজ সমার্থক শব্দই হয়ে গেছে প্রায়।
হোস্তাঁ তাঁর এ নাটকে সিহানোকে নিয়ে যে গল্পটি ফেঁদেছেন, সে ধরণের গল্প আমরা ৮০-৯০-এর দশকের বাঙলা সিনেমায় অনেকই হয়তো দেখেছি। ট্র্যাজি-কমেডি ঘরানার এ নাটকে আমরা দেখতে পাই সিহানো তাঁর বিসদৃশ নাকের কারণে ভীষণ হীনমন্যতায় ভোগেন, এবং লজ্জায় ও শঙ্কায় তিনি কখনোই তাঁর ভালোবাসার নারী হক্সেইন (Roxanne)কে মনের কথা জানাতে পারেন না। হক্সেইন এদিকে মন দিয়েছেন সিহানো'র কম্পানি'র আরেক সৈনিক খ্রিস্তীয়ঁকে (Christian)। হক্সেইন দুর্দান্ত বুদ্ধিমতী, শিল্প-সাহিত্যে দারুণ আগ্রহ তার; ওদিকে, জীবনভর শুধুই তলোয়ার চালাতে শেখা খ্রিস্তীয়ঁ'র একেবারেই কাব্য আসে না! হক্সেইন খ্রীস্তীয়ঁ'র রূপে মজেছে, কিন্তু খ্রিস্তীয়ঁ নিজের থেকে বুদ্ধি খাটিয়ে কথা বলতে গেলেই হক্সেইন-এর হাঁপ ধরে যায়। আদতে একইরকম বোকা বোকা কথার বিরক্তিকর পুণরাবৃত্তি ছাড়া খ্রিস্তীয়ঁ'র ঝুলিতে আর কিছুই নেই। পাছে ভুল মানুষকে ভালোবাসার যাতনায় হক্সেইন আত্নদহনে ভোগে, সে ভয়ে সিহানো হাতে কলম তুলে নেন, আর বুকে চেপে নেন পাথর; খ্রিস্তীয়ঁ'র নাম দিয়ে হক্সেইনকে একের পর এক চিঠি লিখে দিতে থাকেন। মাতাল করা ভাষায় লেখা সে চিঠির কাব্যসুধা আকণ্ঠ পান করে হক্সেইন খ্রিস্তীয়ঁর প্রেমে আরো, আরো ডুবে যেতে থাকে, আর ‘কুৎসিত-দর্শন' সিহানো দূর থেকে দেখে যান। হক্সেইন সিহানো'র হয়নি, কিন্তু তাতে কী? খ্রিস্তীয়ঁকে বিয়ে করে হক্সেইন তো সুখে আছে, হক্সেইনের সুখেই সিহানো'র সুখ।
খ্রিস্তীয়ঁর সাথে হক্সেইন-এর বিয়েটা শেষমেশ দীর্ঘস্থায়ী হয় না; ফ্রান্স-স্পেনের যুদ্ধে খ্রিস্তীয়ঁ প্রাণ হারায়, এরপর ১৪ বছর কেটে যায়, কিন্তু সিহানো একবারও মনের কথাটা জানান না। এই ১৪টা বছর হক্সেইন জেনে এসেছে তাকে লেখা চিঠিগুলো সবই খ্রিস্তীয়ঁ'র লেখা; এমনকি যুদ্ধের ময়দান থেকেও নিয়ম করে প্রতিদিন সিহানো খ্রিস্তীয়ঁ'র সই দিয়ে চিঠি লিখে গেছেন, প্রাণ হাতের মুঠোয় নিয়ে শত্রু শিবিরের চোখ এড়িয়ে সে চিঠি প্রতিদিন পাচার করেছেন, কারণ যুদ্ধে যাবার আগে হক্সেইনকে সিহানো কথা দিয়েছিলেন খ্রিস্তীয়ঁ যেন নিয়মিত চিঠি লেখে তা তিনি দেখবেন। প্রায় পুরোটা নাটকে সিহানো তাঁর দারুণ চোখা চোখা সব সংলাপে পাঠক/ দর্শককে হাসিয়ে মেরে শেষের দৃশ্যে উদাস ও স্তম্ভিত করে দেন। হক্সেইন-এর কোলে মাথা রেখে ৩৬ বছর বয়েসী সিহানো যখন মারা যাচ্ছেন, সেই মুহুর্তেই কেবল হক্সেইন বুঝতে পারে কী নিদারুণ এক মিথ্যের সাথে গত ১৪টা বছর সে বাস করে এসেছে। মৃত্যুপথযাত্রী সিহানো'র একটিই আবদার, সিহানো'র জন্য হক্সেইনকে আলাদা সময় ব্যয় করতে হবেনা, শুধু খ্রিস্তীয়ঁর জন্য যখন হক্সেইন-এর খুব মন খারাপ হবে, প্রাণ কাঁদবে, তখন যেন সিহানোকেও একটু সে মনে করে, তাঁর জন্য এক ফোঁটা চোখের পানি ফেলে...
১৮৯৭ সালে লেখার পর থেকে হস্তোঁ'র এ নাটকটি গত ১২৬ বছরে অসংখ্যবার মঞ্চে এবং পর্দায় অভিনীত হয়েছে। মার্কিন অভিনেতা হোসে ফেরার ১৯৪৭ সালে টনি ও ১৯৫০ সালে অস্কার জেতেন সিহানো'র চরিত্রে অভিনয় করে। এরপর থেকে সিহানো প্রায় প্রতি দশকেই ফিরে ফিরে এসেছে কোন না কোন রূপে। ২০২১-এই টিরিওন ল্যানিস্টার খ্যাত পিটার ডিংক্লেজ সিহানো হয়েছেন। একান্ত সাক্ষাৎকারে ডিংক্লেজ বলেছিলেন কিভাবে সিহানো'র সাথে তিনি নিজে মিশে একাকার হয়ে গেছেন। সিহানো'র মতোই তাঁরও যে নিজের শারীরিক গঠন ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে প্রবল আক্ষেপ, হতাশা, লজ্জা ও হীনমন্যতা ছিলো! গত বছর প্রফেসর এক্স-খ্যাত জেইমস ম্যাকঅ্যাভয়ও সিহানোর চরিত্রে মঞ্চে এসে ভীষণ প্রশংসা কুড়িয়েছেন, তবে এটি আধুনিক ‘অ্যাডাপ্টেশন', হস্তোঁর মূল নাটকটি নয়।
সিহানো আর হক্সেইনকে নিয়ে লেখা প্রেমের গপ্পোটি সম্পূর্ণ বানোয়াট, তবুও কেন সিহানোকে মানুষ অতো ভালোবাসে? কেন তাঁকে নিয়ে হস্তোঁ নাটক লিখতে গেলেন? এর কারণটি লুকিয়ে আছে সিহানো'র লেখালেখিতে এবং তাঁর ব্যক্তিত্বে। নাটকে যেমন দেখা যায়, সিহানো বাস্তব জীবনেও খুব সম্ভব তেমনি বাকচতুর ছিলেন, কথার ইয়র্কারে প্রতিপক্ষকে সম্ভবত একইভাবে তিনি ক্লিন বোল্ড করে দিতেন। ১৭ শতকের সেই অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়টাতেই সিহানো হাসির বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী লিখে ধর্মীয় কুসংস্কারে আক্রান্ত এক সমাজকে চাবকিয়েছেন, কর্তৃত্ববাদকে মুখ ভেঙিয়েছেন। যে ধরণের বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে সিহানো'র আস্থা ছিলো সেটিকে আজ ‘এপিকিউরান অ্যাটোমিজম' বলে। গ্রীক দার্শনিক ডেমোক্রিটাস প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে ধারণা করেছিলেন সকল বস্তুই বিভাজনের অযোগ্য ভীষণ ছোট ছোট সব কণা দিয়ে গঠিত (স্পয়লারঃ অ্যাটম/ পরমাণু)। তাঁর শিষ্য এপিকিউরান এ ধারণাটিকে আরো পোক্ত এবং প্রসারিত করেন। ১৭ শতকের ক্যাথলিক ফরাসী সমাজ এ ধারণাটিকে কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলো না। এর কারণঃ অ্যারিস্টটল!
ডেমোক্রিটাস পরমাণু'র যে ধারণা দিয়ে যান, তাতে দু'টি পরমাণু'র মাঝে একটি ফাঁকা জায়গা থাকে (void)। এই ভয়েড বা শূণ্যতা নিয়েই অ্যারিস্টটলের যতো আপত্তি ছিলো। “কোন একটি ঘুর্ণায়মান বস্তু যতোখানি জোরে ঘুরছে, এর চেয়েও বেশী জোরে কেন ঘুরতে পারছে না?”-এ প্রশ্নের উত্তর অ্যারিস্টটল ভেবে বের করেন, নিশ্চয়ই কোথাও কোন একটি প্রতিরোধী বল কাজ করছে যা এর ঘুর্ণনকে নিয়ন্ত্রণ করছে। পরমাণুগুলো'র মাঝে যদি নিঃসীম শূণ্যতাই থাকতো, তাহলে তো আর এ বল কাজ করতে পারতো না, কারণ, যেখানে কিছু নেই সেখানে তো কিছুই থাকতে পারে না! অতএব শূণ্যতার তত্ত্ব বাদ, পরমাণুর তত্ত্বটিকে গোল্লায় পাঠানো হোক। বাঙলাদেশের আজকের ধর্মীয় সমাজ যেভাবে শিশুদের পাঠ্যবইতে বিবর্তনবাদ পড়ানো নিয়ে প্রবল আপত্তি জানিয়ে চলেছে, বিবর্তনবাদের অংশটুকু ছিঁড়ে ফেলে দিয়ে বাকী বইটুকু পড়তে আহ্বান জানাচ্ছে, ১৭ শতকের ফরাসী ক্যাথলিক সমাজের পরমাণুবাদের বিরোধীতা এর চেয়ে ভিন্ন কিছু ছিলো না। ফ্রান্সের ধর্মবাদীরা তাঁদের ভীষণ ক্ষুদ্র জানাশোনার পরিধি, এবং তার চেয়েও ক্ষুদ্র মনকে সম্বল মেনে সিহানোকে ধর্মনিন্দা'র অভিযোগে ফাঁসিয়ে তাঁর জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছিলেন।
দারুণ আধুনিকমনস্ক সিহানো তাঁর গল্পে মানুষকে রকেটে চাপিয়ে চাঁদ এবং সূর্যে পাঠিয়েছেন, সেখানের অধিবাসীদের সাথে পৃথিবীর অধিবাসীদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন, দুই ভুবনের সামাজিক আচার-রীতির পার্থক্যের হিসেবও কষে দেখিয়েছেন নানা ব্যঙ্গাত্নক গল্পের অবতারণা করে। আজ আমরা জোনাথন সুইফটের গালিভার'স ট্র্যাভেলসকে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যাঙ্গাত্নক কাজ বলেই জানি, সুইফট-এর অনুপ্রেরণা হিসেবে সিহানো কাজ করেছেন, এটি নিশ্চয়ই এখন আর অবাক করা কোন তথ্য নয়! বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর অন্যতম শীর্ষ গুরু আর্থার সি ক্লার্কও সিহানোকে ওস্তাদ মেনেছেন। শুধু সুইফট বা ক্লার্ক-ই নন, মলিয়ের, যাঁকে দিয়ে মানুষ ফরাসী ভাষাটিকে চিনেছে (“ফরাসী মলিয়েরের ভাষা”-লোকমুখে প্রচলিত ছিলো), পর্যন্ত তাঁর Scapin the Schemer নাটকের দু'টি দৃশ্য সিহানো'র Le Pédant joué থেকে সরাসরি ছেপে দিয়েছেন! পৌনে ৪শ বছর আগের মানুষ সিহানো আজও আমাদের চারপাশের বহু বহু মানুষের চেয়ে ঢের আধুনিক।
সিহানোকে অমরত্ব দান করা ছাড়াও বিশ্বসাহিত্যে হস্তোঁ'র আরেকটি বড় অবদান রয়েছে; তাঁর বরাতে প্রথমে ফরাসী এবং পরে ইংরেজী অভিধানে 'panache' শব্দটি যুক্ত হয়। প্যানাশ শব্দের অর্থ আমরা আড়ম্বরপূর্ণ আচরণ, নিজস্ব একটি স্টাইল ইত্যাদিকে বুঝি। বাঙলা একাডেমি'র অভিধানে এ শব্দটির অর্থ লেখা হয়েছে "বড়াই ভাব"। নাটকে মৃত্যুপথযাত্রী সিহানো তাঁর টুপির পালকে হাত বুলিয়ে অনেকটা দম্ভ নিয়েই বলেন, তিনি রিক্ত, শূণ্য হাতে পৃথিবী ছাড়ছেন বটে, কিন্তু সাথে করে নিয়ে যাচ্ছেন তাঁর সেই প্যানাশ। প্যানাশ বিষয়টি আদৌ কী, এবং সিহানো'র প্যানাশটি কেমন ছিলো তার উত্তরে আত্নবিশ্বাস, হামবড়া ভাব, দৃঢ় প্রত্যয়, আপুন কা ইশটাইল...ইত্যাদি নানা শব্দের তাত্ত্বিক প্রয়োগ ঘটানো যায়, কিন্তু তাতেও কি পরিষ্কার হয়? নাটকটি পড়ে সিহানো'র প্যানাশ কেমন হতে পারে তার যে একটি ধারণা পেয়েছি সেটির একটি approximation সম্ভবত একমাত্র শিবাজিই হতে পারেনঃ
ইউটিউবে খুঁজলে হস্তোঁ'র নাটকটির অনেকগুলো মঞ্চায়ন-ই চোখে পড়বে, আমার সবচেয়ে দুর্দান্ত লেগেছে ২০১৪ সালে বব জোন্স ইউনিভার্সিটির এই পার্ফর্ম্যান্সটি। কারো হাতে ঘন্টা দু'য়েক সময় থাকলে বসে যেতে পারেন কিন্তু!