Ratings1
Average rating4
যে-কোনো বড়ো শহরের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো সেই শহরের একাকীত্ব। শহরের একাকীত্ব মানে সেই শহরের মানুষের একাকীত্ব। যে শহরে যত বেশি মানুষ, সেই শহর তত বেশি একলা। সেইসব গণনাতীত মানুষের পরিত্যাগ করা কার্বন ডাইঅক্সাইডে ভরে ওঠে শহরের ছালওঠা ময়দান, ত্বকচর্চাহীন পিচের রাস্তা, প্লাস্টিক আলো আর আসবাবের কিউবিজমে ডুবে থাকা শহরের কাফে রেস্টুরেন্ট শুঁড়িখানা সিনেমাঘর, এবং চৌকো আয়ত ত্রিকোণ গোল লম্বা বেঁটে হাজার হাজার হাজার হাজার হাজার হাজার বাসাবাড়ি। মানুষের ফেলে দেওয়া দীর্ঘনিঃশ্বাস উড়ে আসে মানুষেরই ঘরের ভিতরে।বড়ো শহরের এই চরিত্র আমি প্রথম চিনতে পেরেছিলাম কলেজজীবনে হোস্টেলে থাকার সময়। হোস্টেলও একরকম সরাইখানা বটে। পার্থক্য শুধু, সরাইখানার মতো রোজ রোজ মানুষের মুখ পাল্টে যায় না হোস্টেলে। কিন্তু সেই একইরকম চিৎকার হুজ্জতি লৌন্ডা বদনাম হুয়া লৌন্ডিয়া তেরে লিয়ে জন বন জোভি ব্রায়ান অ্যাডামস খেউড় খিস্তি আব্বে চুতিয়া বেটিচোদ হাহাহাহাহাহা হাসির দমক সিগারেটের ধোঁয়া মৃত বিয়ারের বোতল বিকল হয়ে যাওয়া বেসিনের জলে ভেসে যাচ্ছে বারোয়ারি বাথরুমের নোংরা মেঝে ঘরের দেয়ালে টাঙানো স্বামী বিবেকানন্দ এবং ভগবান তিরুপতির পরিপাটি বাঁধানো ছবির ঠিক পাশেই পোস্টারে ঝুলে আছে প্যামেলা অ্যান্ডারসনের সাহসী পশ্চাৎদেশ।একটা বইয়ের দোকানে নিয়মিত যেতাম, সেখানেই পৃষ্ঠা উল্টে প্রথম দেখেছিলাম এডোয়ার্ড হপার-এর আঁকা ছবি (যে বইটার রিভিউ লিখছি, এটাই সেই বইটা, অনেকদিন পরে কিনেছিলাম)। মূল্যবান বইয়ের মসৃণ পৃষ্ঠাগুলো ভিজে আছে একাকীত্বের আর্দ্রতায়। বড়ো শহরের জ্যামিতিক একাকীত্ব। শিল্পী হিসেবে হপারকে “reverse-প্রথাভঙ্গকারী” বলা যেতে পারে। শিল্পীসুলভ উচ্ছৃঙ্খল ছিলেন না তিনি। বোহেমিয়ান ছিলেন না। যাঁকে বিয়ে করেছিলেন তাঁর সঙ্গেই সারাজীবন কাটিয়েছেন, একটাও গুপ্ত প্রেমিকার অস্তিত্ব নেই তাঁর জীবনে। কথাবার্তায় ছিলেন অশিল্পীসুলভ মৃদুভাষী। তাঁর জীবন নিয়ে বায়োপিক তৈরি করলে সেই সিনেমা অবধারিত ফ্লপ হবে। সমকালীন সকল শিল্পতত্ত্ব, অমুক ইজম তমুক ইজম, সবরকম প্রাসঙ্গিক ইজমকে এড়িয়ে গেছেন তিনি। কোনো বিদ্রোহ নেই, কোনো তত্ত্বের প্রচার নেই, কিংবা সমাজকে তাচ্ছিল্য কিংবা আঘাত করার প্রবণতা নেই। শিল্পী ছিলেন? নাকি শিল্পীবেশী অহিংস কেরানি ছিলেন তিনি?তিরিশ/চল্লিশের দশকের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক দুর্দশাগ্রস্ত বিশ্বে, পিকাসো যখন আঁকছেন “গের্নিকা”, সালভাদর দালি আঁকছেন “দা পার্সিস্টেন্স অফ মেমোরি”, পল ক্লি আঁকছেন “অ্যাড পারনাসাম”, মার্ক শাগাল আঁকছেন “দা চেলিস্ট “, ফ্রিদা কাহলো আঁকছেন জাদুবাস্তবিক আত্মপ্রতিকৃতি, সেই সময় এডোয়ার্ড হপার তেলরঙের বাটিতে প্রশান্ত তুলি ডুবিয়ে নিশ্চুপে ফুটিয়ে তুলছেন একাকীত্বের বাস্তবসম্মত চিত্রভাষ্য। তাঁর ছবির ভাষায়, রঙে, রেখায়, সমসাময়িক শৈল্পিক ভাঙাগড়া, উন্মত্ততার ছিঁটেফোঁটা নেই। (বোধহয় সেই কারণেই ই. এইচ. গমব্রিচের বিখ্যাত The Story of Art বইতে একবারের জন্যেও হপারের নামের উল্লেখ নেই!) আমেরিকার দৈনন্দিন জীবনের টুকরো টুকরো মুহূর্তকে, প্রতিবিম্বের মতো, নির্বিকার রিয়ালিস্ট ভঙ্গিমায় এঁকেছেন একটার পর একটা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধপূর্ব (এবং তার পরেরও) আমেরিকান জীবনের একাকীত্বের সেই শুকনো ফুলের গন্ধ আমি আজকে ২০২৩ সালের জানুয়ারির দু-তারিখ সোমবার সকালবেলাতেও পাচ্ছি।তাঁর ছবির মেলানকলিক চরিত্ররা কেউ গাড়িতে গ্যাস ভরছে ফাঁকা গ্যাসস্টেশনে, কেউ একলা বসে আছে মোটেলের বিছানায়, অফিসে একা বসে কাজ করছে, সেলাই করছে একা, থিয়েটার দেখছে একা, রেস্টুরেন্টে কফি খাচ্ছে একা, বই পড়ছে একা। এমনকি চরিত্র যখন একাধিক, তখনও তারা চুপচাপ। নিজেদের মধ্যে একা। হপারের এই অদ্ভুত একলা বিশ্বে ছবির দর্শক হিসেবে আমরা বিশ্লেষণ করতে পারি নিজেদের একলা আত্মাকে। তাঁর ছবিকে নিখুঁত আয়না হিসেবে ব্যবহার করতে পারি। আমার খুব প্রিয় একটা ছোটোগল্পের সংকলন, [b:The Oxford Book of American Short Stories 13689875 The Oxford Book of American Short Stories Joyce Carol Oates https://i.gr-assets.com/images/S/compressed.photo.goodreads.com/books/1346004335l/13689875.SY75.jpg 1270467], যেটি সম্পাদনা করেছেন আরেকজন বিখ্যাত গল্পলেখক জয়েস ক্যারল ওটস, সেই বইটা যখন কিনলাম, দেখলাম প্রচ্ছদে ব্যবহার করা হয়েছে হপারেরই আঁকা একটা ছবি। হঠাৎ অনুভব করলাম, এডোয়ার্ড হপার তাঁর প্রত্যেক ছবিতে, ছবির দৃশ্যবস্তুর পাশাপাশি, খুব সন্তর্পণে প্রবেশ করিয়ে দিয়েছেন নিশ্চুপ নিরিবিলি একেকটা গল্প। খুব মৃদু গলায় কথা বলছে তাঁর সেইসব গল্পের চরিত্ররা? কী কথা বলছে? কে জানে!(“সামার ইভনিং”, ১৯৪৭, ক্যানভাসে তেলরং)