Ratings1
Average rating5
আমাদের বাড়ির পিছনে পাশাপাশি দাঁড়ানো একজোড়া পাড়াতুতো লিচুগাছ ছিল। ছোটবেলার একটা প্রিয় অভ্যাস ছিল জানলা দিয়ে সেই গাছদুটো দেখা। আসলে তো গাছ দেখতাম না। দেখতাম সেই গাছে আশ্রয় নেওয়া কয়েক শ' টিয়াপাখিকে (সংখ্যাটা একটুও বাড়িয়ে বলছি না, বরং হয়তো কমিয়ে বলে থাকতে পারি)। একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখার জন্যে আমি তাকিয়ে থাকতাম গাছদুটোর দিকে। কী যেন এক সম্মিলিত আবেগের তাড়নায় অতগুলো টিয়াপাখি হঠাৎ একসঙ্গে গাছ থেকে হুউউউশ করে বেরিয়ে আকাশের দিকে সশব্দ উড়াল দিত। সে যে কী এক অপার্থিব সৌন্দর্য! আমার ছোটবেলার অন্যতম প্রিয় স্মৃতিদৃশ্য এটা। গাঢ় সবুজ গাছের পাতা থেকে অকস্মাৎ বেরিয়ে আসছে একঝাঁক ফিকে-সবুজরঙা চিৎকৃত টিয়াপাখি। সেই লিচুগাছদুটো এখন কেটে ফেলা হয়েছে। মানুষ বাড়ি বানিয়েছে সেখানে। সেই অগুনতি টিয়াপাখির দল, তাদের সন্তান-সন্ততি, আত্মীয়-পরিজন, বন্ধুবান্ধব, তাদের সযত্নে সঞ্চিত স্বপ্নগুলো নিয়ে আজ কোথায় চলে গেছে? অত টিয়াপাখি একসঙ্গে দেখেছি বলেই বোধহয় আমি এখন টিয়াপাখি দেখতে পাইনা। কোত্থাও না! কতদিন একটাও টিয়াপাখি দেখিনা আমি। (খাঁচায় যেসব টিয়াপাখি দেখি তারা তো পুরোপুরি পাখি নয়, ঠিক যেমন সেইসব খাঁচার মালিক যারা, তারা পুরোপুরি মানুষ নয়।)
মানুষ এবং প্রকৃতি-লালিত অন্যান্য প্রাণীদের সহাবস্থানের গুরুত্ব নিয়ে এই রিভিউতে কিচ্ছু লিখবো না আমি। পাখি নিয়েও লিখবো না। পাখিদের দুঃখ নিয়ে লিখবো না। হারিয়ে যাওয়া পাখিদের খোঁজে গুডরিডসের দেওয়ালে সাঁটাবো না কোনো নিরুদ্দেশের উদ্দেশ্যে ঘোষণা-পোস্টার। লিখবো একটা বইয়ের ব্যাপারে। বইটা আমি উপহার পেয়েছি। গত দুই দশকে ক্যামেরা এবং লেন্সের অভূতপূর্ব সহজলভ্যতা এবং সোশ্যাল মিডিয়াতে আত্মপ্রকাশের আয়াসহীনতার কারণেই সম্ভবত, আশেপাশে একটা নতুন নেশা তৈরি হয়েছে। পাখি দেখার নেশা। আগেও অবশ্যই ছিল এই নেশা, এখন বহুগুণে বেড়েছে। আমার বেশ কিছু পরিচিত মানুষ পূর্ণ উদ্যমে তাদের এই নেশার আগুনে নিয়মিত ঘি ঢেলে চলেছেন। বিশেষত শীতকালে, কাঁধে একটা ভারী ক্যামেরা আর গলায় বাইনোকুলার ঝুলিয়ে, পিঠে একটা ছোট ব্যাগ নিয়ে তারা ছড়িয়ে পড়েন নগরের বাইরে দূরে দূরান্তরে। নিবিষ্ট চোখে পর্যবেক্ষণ করেন পাখিদের। ছবি তোলেন। (পাখির ছবি তোলা পৃথিবীর কঠিনতম কাজের একটি)। গত তিন বছর ধরে তেমনই একজন পাখিনেশাড়ুর টানাটানিতে কয়েকদিন আমিও সঙ্গী হয়েছি তাদের অভিযানে। আমার শহরের খুব কাছে “কাষ্ঠশালী” নামের একটা জলাভূমিতে। এই জলাভূমিটার আরেকটা সুন্দর নাম আছে— “চুপি”।
সেখানে শয়ে শয়ে নয়, হাজারে হাজারে পাখিদের মুখোমুখি হয়ে চোখে ঝিলমিল লেগে যাওয়ার মতো অবস্থা। কত প্রজাতির কত ধরনের কত কিসিমের কত চরিত্রের পাখি যে দেখলাম! বিদেশ থেকে পরিযায়ী পাখিরা এসেছে। স্থানীয় দেশি পাখিদের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় করছে তারা। পাখিপ্রেমীদের কাছে সেই পরিযায়ী পাখিদের খাতির বেশি, কারণ কয়েকদিন পরেই আবার দেশান্তরী হবে তারা। তাদের তুলনায় দেশীয় পাখিদের জামাকাপড় যেন একটু কম স্টাইলিশ। নৌকা থেকে দেখলাম একটা বড় সাইজের “মঙ্গোলিয়ান রেড-ক্রেস্টেড পোচার্ড” জল থেকে ঝপাং করে উড়ে আমার ঘাড়ের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গ্যালো (নামটা বন্ধুর কাছে জেনেছি)। মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো : ওরেব্বাস! এই না হলে পাখি! আমার বন্ধুটি বললো, আমাদের দেশেও কিন্তু দারুন দারুন সব পাখি আছে, অরূপদা। মুখে কিছু না বললেও মনে মনে ভাবলাম, বিদেশি পাখির ব্যাপারই আলাদা। আমার এই কলোনিয়াল হ্যাংওভার-সুলভ হাভাতে মনোভাব আন্দাজ করেই কিনা জানিনা, সেই বন্ধুটি উপহার দিয়েছে এই দুর্ধর্ষ বইটা। শুধু দুর্ধর্ষ বললে শুনতে ঠিকঠাক লাগে না।
বলতে হবে : দু র ধ র ষো ও ও...!!
বইটা প্রকাশ করেছে ভারত সরকারের অধীনস্থ “জুলজিক্যাল সার্ভে অভ ইন্ডিয়া” সংস্থা। ছ'শো পৃষ্ঠার বই, পুরোটা রঙিন চকচকে মসৃণ দামি কাগজে মুদ্রিত, অথচ দাম মাত্র ছ'শো টাকা। পঁয়ষট্টিজন “বার্ড-ফটোগ্রাফার” এবং ছয়জন পক্ষীবিশারদ দুই বছর ধরে অক্লান্ত পরিশ্রম করে নির্মাণ করেছেন বইটা। বেশি সুন্দর বই দেখলে আমার জ্ঞানগম্যি লোপ পায়, বর্ণনক্ষমতা হাপিস হয়ে যায়। মুখ দিয়ে বারবার শুধু বেরিয়ে আসে : ক্কী সুন্দর মাইরি বইটা! ক্কী দুর্দান্ত বই রে ভাই এটা! সবমিলিয়ে ১৩৩১ রকমের ভারতীয় পাখির সচিত্র পরিচয় রয়েছে এতে। সবক'টি পাখির স্ত্রী এবং পুরুষের আলাদা রঙিন ছবি দেওয়া আছে। সাধারণ পরিচিত নামের পাশাপাশি দেওয়া আছে বৈজ্ঞানিক নাম, বাসস্থান, আকৃতি, বিশেষ দেহবৈশিষ্ট্যের তত্ত্বতালাশ এবং তাদের সংক্ষিপ্ত বিবরণ। এবং ছবি। আহা কী দারুন ছবি। এমন মনভোলানো রাশি রাশি পাখির ছবি দেখে আমি বিস্মিত! অভিভূত! “...and what is the use of a book without pictures and conversations?” — “অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড” বইয়ের শুরুতেই অ্যালিস এই কথাটা বলেছিল বটে, কিন্তু কথাটা যে এমন ভয়ংকর সত্যি সেটা আমি এতদিন পরে এসে বুঝলাম!
আমার প্রিয় পাখি কাক। তাদের মতো স্মার্ট, অ্যাটিটিউডওয়ালা এবং চালাকচতুর হতে চাই আমিও (যদিও বেচারাদের বাসায় কোকিল ডিম পেড়ে আসে