এই বইটার ব্যাপারে অনেকদিন আগে একবার লিখেছিলাম। আজকে আবার লিখছি। যদিও এরকম বইয়ের ব্যাপারে বারবার লেখা যায়। ফ্রিজ খুলে বারবার আইসক্রিম খাওয়ার মতো।
সংগীত যতটা শুদ্ধভাবে আমাদের চৈতন্যকে ছুঁতে পারে, পৃথিবীতে আর কিছু কি ততটা পারে? প্রেম পারে, বাৎসল্য পারে, প্রকৃতি পারে, অনেকদিন পরে বাড়ি ফিরে মায়ের মুখ দেখার তীব্র আনন্দানুভূতি ঝংকার তুলতে পারে আমাদের হৃদয়ের তারযন্ত্রে। আর শুধু পারে সংগীত।
একটা কথা আছে, কানের কোনো জানলা নেই। সত্যিই তো নেই! আমি প্রায় সবধরণের গানবাজনা উপভোগ করতে পারি। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে, ভারতীয় ধ্রুপদী সংগীত আমার সামনে একটা সম্পূর্ণ অন্যরকম আবেদন নিয়ে হাজির হয়।
এই আবেদনের বর্ণ কেমন, গভীরতা কেমন, চরিত্র কেমন, উত্তাপ কেমন, ছন্দ কেমন, প্রাবল্য কেমন, এসব নিয়ে আমি অনেক ভেবেছি। কিন্তু ভেবে কূল করতে পারিনি আজও। শুধু এক অসীম মগ্নতাকে আঁকড়ে ধরে ভেসে চলেছি জানিনা কোন্ দিকে, কতো দূরে, কতো ভাবে।
ধ্রুপদী সংগীতের ব্যাকরণগত জ্ঞান আমার প্রায় নেই বললেই চলে। নিজেও গাইতে কিংবা বাজাতে তো পারিনা। পৃথিবীতে বোধহয় মানুষই একমাত্র প্রাণী, যে-কিনা কোনো বিষয়কে বিন্দুমাত্র না বুঝেও সেই বিষয়টির প্রতি নিজেকে নিবেদন করে দিতে পারে। সেই বিষয়টির সামনে হাঁটু ভাঁজ করে বসতে পারে।
আমি যেমন এই রিভিউটা লিখতে লিখতে উস্তাদ বিলায়েত খাঁ সাহেবের সেতার-মন্থিত তিলক-কামোদ রাগ শুনছি। আমি তো কিছুই জানিনা এই রাগের ব্যাপারে। কিচ্ছু না! শুধু এটুকু জানি এই রাগটি শুনতে হয় রাত্রির দ্বিতীয় প্রহরে (রাত ৯টা থেকে ১২টা)। আর শুধু ডুবে যেতে জানি। ডুবে যাওয়ার জন্য কি সাঁতার জানতে হয়?
এই বইটির লেখক কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের পিতৃদেবের নাম ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। সংগীত বিষয়ে ধূর্জটিপ্রসাদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করতেন এমন বহু বিখ্যাত মানুষের মধ্যে দুজন ছিলেন অতুলপ্রসাদ সেন এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এমন বিশারদ মানুষের পুত্র হওয়ার সুবাদে আশৈশব এক রঙিন বৈচিত্র্যময় সাংগীতিক পরিবেশে জীবন কাটিয়েছেন কুমারপ্রসাদ।
তাঁর সেই জীবনব্যাপী সংগীতময় অভিজ্ঞতার ঝুলিতে সঞ্চিত ছিলো অনেক আশ্চর্য গল্প, অনেক বিচিত্র কাহিনি। ভারতীয় ধ্রুপদী সংগীত জগতের এমন কোনো দিকপাল মানুষ নেই যাঁর সঙ্গে কুমারপ্রসাদের সাক্ষাৎ হয়নি। তাঁর সেই বর্ণময় ঝুলি হাতড়ে, আমার মতো সংগীত-বোধহীন ভিখারি মানুষের জন্যে তিনি লিখেছেন এই অসামান্য বইটি। পিপাসা তো মিটবে না। সেই যোগ্যতাও নেই। তবু জিভের প্রান্তে অমৃতের সামান্য স্বাদ যদি পাই!
কিছুই হবার নয়। কিছুই আমার পাবার নেই! আমি রাতারাতি বুঝে ফেলবো না রাগসংগীতের মাহাত্ম্য। আমি পারবো না অনুভব করতে একজন সংগীতশিল্পীর সৃষ্টিযন্ত্রণা। আমি তো কিছুতেই দেখতে পারবো না একজন যন্ত্রবাদকের আচ্ছন্ন একাকী অবগাহন।
তবু এই বইটা থেকে সংগীতসাধকদের গল্প শুনে, সংগীতের গল্প শুনে, সামান্য, অতি সামান্য, যৎসামান্য হলেও যদি কোনোদিন বুঝে ফেলতে পারি, জগতের এই বিপুল আনন্দযজ্ঞে আমারও নিমন্ত্রণ আছে, তাহলে এর বেশি আর কী চাওয়ার থাকতে পারে?
এবার শুনবো পণ্ডিত নিখিল ব্যানার্জি আর উস্তাদ আলি আকবর খাঁ সাহেবের যুগলবন্দিতে বাজানো ভৈরবী রাগ। ভৈরবী যদিও ভোরবেলার রাগ। তবু আমার এখনই শুনতে ইচ্ছে করছে!
[একটা কথা উল্লেখ করতে ভুলেই যাচ্ছিলাম। বইটাতে শিল্পী বিমল দাসের আঁকা অজস্র পোর্ট্রেট রয়েছে। বইটির গুণগত মূল্য একলাফে অনেকটা বেড়ে গেছে এই দারুন অলংকরণগুলোর জন্যে!]