Ratings4,663
Average rating4.3
এই বই যে-বছর প্রথম বেরোলো, ১৯৯৭ সালে, সেই বছর আমি প্রাইমারি স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে হাইস্কুলে ক্লাস ফাইভে ভর্তি হই। মানে, হ্যারি পটার পড়ার একেবারে উপযুক্ত বয়স! কিন্তু দুটো কারণে পড়া সম্ভব হয়নি। প্রথমত, আপাদমস্তক বাংলা মাধ্যম স্কুলের ছাত্র হওয়ায়, ইংরিজি গল্পের বই পড়ার সময় হাঁটুতে জোর পেতাম না (তাছাড়া, আমরা ছিলাম পশ্চিমবঙ্গের পোগোতিসিল কমিউনিস্ট বামফ্রন্ট আমলের সরকারি প্রাইমারি ইশকুলের “ইংরিজিবিহীন” ছাত্তর— এই ব্যাপারটা যারা জানে, তারা জানে)।
দ্বিতীয় কারণ, আমাদের টিমটিমে মফস্বল শহরে টেক্সটবুক বাদ দিলে ইংরিজি হরফওয়ালা যে-বইগুলো পাওয়া যেত তার নাম ডিকশনারি। তাই কোথায় পাবো হ্যারি পটারের বিলিতি গল্পের বই? জোগাড় করা সম্ভব হলেও দাম পড়বে আকাশছোঁয়া। সুতরাং, আমার গোটা কিশোরবেলা কেটেছে হ্যারি পটারহীন। যদিও খবরের কাগজে দেখতাম এই বই নিয়ে বিশ্বব্যাপী উন্মাদনা। একেকটা বই বেরোচ্ছে, আর জগৎজুড়ে পটারহেডরা হামলে পড়ছে বইয়ের দোকানে। আনন্দবাজারের প্রথম পৃষ্ঠায় ছবি ছাপা হতো : রাত জেগে লাইনে দাঁড়িয়ে হ্যারি পটার সিরিজের নতুন বই বগলদাবা করে হাসিতে উদ্ভাসিত পটারপ্রেমীর মুখ। সব মিলিয়ে সে এক অশৈলী কাণ্ডকারখানা!
অবশেষে ঠিক ২৭ বছর বাদে মোলাকাত হলো হ্যারি পটারের সঙ্গে। এমন নয় যে ইতিপূর্বে পড়ার সুযোগ পাইনি। সুযোগ পেলেও ইচ্ছে হয়নি। কারণ ফ্যান্টাসি জঁরের বই পড়তে আমার ভালো লাগে না। বেশ কয়েক বছর ধরে বহু muggle-রা আমাকে হ্যারি পটার সিরিজটা পড়ার জন্য প্ররোচনা এবং উৎসাহ দিয়ে আসছিলেন, তবুও পড়িনি। কিন্তু এই বছর কী যে হলো, ঠিক দুর্গাপূজার আগে মা দুর্গার নাম স্মরণ করে গোটা সিরিজটাই কিনে ফেললাম! মারি তো গণ্ডার, লুটি তো ভাণ্ডার। আপাতত সিরিজের প্রথম বইটা শেষ করলাম। তো, কেমন লাগলো হ্যারি পটারের কিসসা?
আমি বরং জে কে রওলিংয়ের ব্যাপারে দু-চারটে কথা বলি। শিশুসাহিত্য মানেই তাকে হতে হবে নিষ্কলঙ্ক। তার মধ্যে থাকবে না কোনো ভায়োলেন্স। শিশুদের গল্পের চরিত্ররা হবে শান্তিপ্রিয় আদর্শবান মানুষ। শিশুসাহিত্যের জগৎ মানেই তাকে হতে হবে গঙ্গার জলে ধোয়া একটা নিষ্পাপ পবিত্র জগৎ। শিশুদের মন যে বড্ডো কচি এবং কোমল। খুনখারাবি আর হিংসা-বিদ্বেষওয়ালা বইপত্তর পড়লে বড় হয়ে তারা নির্ঘাত সিরিয়াল কিলারে পরিণত হবে! হ্যারি পটারের স্রষ্টাকে একটা Hagrid-সাইজের কুর্নিশ জানাই, শিশুসাহিত্যের এইসব ন্যাকাচন্দর ফর্মুলার গালে সপাটে একটা থাবড়া মারার জন্য!
“The trouble is, humans do have a knack of choosing precisely those things which are worst for them.”
পৃথিবীটা যেমন, ঠিক তেমনটাই দেখিয়েছেন রওলিং। পৃথিবীতে ছোটদের অকারণে হেনস্তা হতে হয়। ছোট হওয়ার জন্য তারা প্রতিবাদ করতে পারে না। অনেক সময়েই, ছোটদের সঙ্গে বড়রা মোটেও আদর্শ আচরণ করে না (একেকজন বাপ মা-র কাজকর্ম দেখলে তো ডিক্টেটররাও লজ্জায় আঁচলে মুখ লুকাবে)। ইশকুলে পড়ার সময়েও বদমাইশ ছেলেপিলের অভাব থাকে না। সহপাঠীরা একে-অপরের পিছনে লাগে। মানসিক এবং শারীরিক— দুভাবেই ক্ষতি করার চেষ্টা করে। এমনকি শিক্ষকদের মধ্যেও বদমাইশির কমতি থাকে না। ক্লাসরুমের ভিতরে হোক কিংবা বাইরে, এই দুনিয়াটা মোটেও সুবিধের জায়গা নয়। এবং বিশ্বাস করুন ছাই না করুন, ছোটরা কিন্তু এইসব ব্যাপার-স্যাপার খুব ভালো করেই বোঝে! তবু দুনিয়ার এই কর্কশ পাথুরে মাটিতেই ক্যাকটাসের মতো ফুটে ওঠে বন্ধুত্বের রঙিন ফুল। দুনিয়াটা কর্কশ বলেই বোধহয় বন্ধুরা আমাদের কাছে এত দামি! বই পড়ে কিংবা সিনেমা দেখে হিংসা-বিদ্বেষ শেখার দরকার হয় না। ওসব জিনিস নিশ্বাস-প্রশ্বাস দিয়ে যাতায়াত করে ছোটদের মনোজগতে। তাদের থেকে এইসব জিনিস জোর করে লুকিয়ে রাখলে বরং উপকারের চেয়ে ক্ষতি করা হয় বেশি।
জে কে রওলিং তাঁর ক্ষুদে পাঠকদের সঙ্গে ভণ্ডামি করেননি। Hogwarts-এর জগৎটাকে তিনি দ্বিধাহীন স্পষ্টতার সঙ্গে নির্মাণ করেছেন। রওলিংয়ের লেখনীও চমৎকার— সরস এবং স্মার্ট। তাঁর জগতে ভালো-খারাপ পাশাপাশি অবস্থান করে। এই জগতে ছোটরা সবসময় বাই-ডিফল্ট ভালোমানুষ হয় না, আবার বড়রাও অনেকসময় ছেলেমানুষী কাজ করে। কাহিনির ভাঁজে ভাঁজে উজ্জ্বল, আশ্চর্য এবং বুদ্ধিদীপ্ত কল্পনার শ'য়ে শ'য়ে ফুলঝুরিকে ডানা মেলে উড়তে দিয়েছেন বটে, কিন্তু কাহিনির চরিত্ররা কেউই কাল্পনিক নয়। তাদের সবাইকে আমরা কমবেশি চিনি। আর চিনি বলেই, ২৭ বছর দেরি করে পড়া শুরু করলেও জমজমাট এই কাহিনির সঙ্গে আমি দিব্যি একাত্মতা অনুভব করতে পারছি। সবেমাত্র প্রথম বইটা শেষ করলাম, তাই সামগ্রিকভাবে খুব বেশি মতামত জানানো উচিত হবে না। এখনও তো অনেকটা পথ পাড়ি দেওয়া বাকি আছে। জিন্দেগি এক সফর হ্যায় সুহানা... ইয়াহাঁ কাল ক্যায়া হো কিসনে জানা?