Bengal Beyond the Bhadralok
পরিমল ভট্টাচার্যের কলম ইংরিজি ভাষাতেও সমান সরেস। ইদানিংকার লেখক-সাহিত্যিকদের মধ্যে আঙুলে-গোনা কয়েকজন আছেন যাঁরা বাংলা-ইংরিজি দুটো ভাষাতেই একইরকম উপভোগ্যতা সৃষ্টি করতে পারেন। পরিমল ভট্টাচার্য সেই বিরল লেখকদের একজন।
লেখকের প্রতিটি বইতেই তাঁর একটা পরিব্রাজক সত্তা দেখতে পাই। শুধু বাড়িতে বসে বইপত্র ঘেঁটে গবেষণা নয়, উপজীব্য বিষয়বস্তুকে সরেজমিনে তদন্ত করতে তিনি দূরে দূরান্তরে চলে যান। এবারও গেছেন। শান্তিনিকেতনে, সুন্দরবনে, ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত অঞ্চলে, উড়িষ্যার সিমলিপাল অরণ্যে, পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড়ে, এমনকি আমার শহর নবদ্বীপেও এসেছেন।
এইসব জায়গায় গিয়েছেন বাঙালি ছোটলোকদের খোঁজে। মজা করছি না, সত্যিই। বইটির উপ-শিরোনাম হলো : Bengal Beyond the Bhadralok. ভারতবর্ষে বাঙালি বলতে গণ্য করা হয় শহুরে সংস্কৃতিপ্রেমী সফিস্টিকেটেড একটি “ভদ্রলোক” গোষ্ঠীকে। যাদের পূর্বপুরুষরা বিলেতি ঔপনিবেশিকতার সামনে প্রথম বশ্যতা স্বীকার করেছিলেন। প্রথম ইংরিজি শিখেছিলেন। এবং ইংরিজি শিক্ষার সমস্ত সুফল এবং কুফলগুলি প্রথম আত্তীকরণ করেছিলেন।
এদের বাইরেও রয়ে গেছে বাঙালিজাতির একটা বিরাট অংশ, যাঁরা তথাকথিত “ভদ্রলোক” নয়। শহুরে রীতি রিওয়াজ শিক্ষা দীক্ষা সংস্কৃতি সুশীলতার পালিশ লাগেনি যাদের শরীরে মনে— স্বাধীনতার ৭৭ বছর পরেও। সেই “ছোটলোক” বাঙালিদের খোঁজে বেরিয়েছেন লেখক। খুঁজেছেন এই প্রান্তিক মানুষদের অস্তিত্ব, বুঝতে চেয়েছেন তাঁদের জীবনদর্শন, অনুভব করতে চেয়েছেন তাঁদের বেঁচে থাকার স্ট্রাগলকে। নিজে একজন ভদ্রলোক বাঙালির প্রতিভূ হয়ে অনুপ্রবেশ করেছেন ছোটলোক বাঙালির ভুবনে।
একশো বছরেরও আগে স্বামী বিবেকানন্দ উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন : নীচ, মূর্খ, দরিদ্র, অজ্ঞ, মুচি, মেথর, চণ্ডাল— সবাই তাঁর ভাই। এতদিন পরেও, আমরা সেই ছোটলোকদের ভাই বলে ভাবা তো দূরে থাক, তাঁদের দৈনন্দিন জীবনসংগ্রামের ব্যাপারেই বা কতটুকু জানি? কতটুকু জানি অযোধ্যা পাহাড়ের সেই নারীটির ব্যাপারে, লেখাপড়া শেখার অপরাধে যাঁকে ডাইনি বলে চিহ্নিত করে গ্রাম থেকে বিতাড়িত করা হয়েছিল। কিংবা উড়িষ্যার গহন জঙ্গলের ভিতরে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রত্যহ চার কিলোমিটার হেঁটে পড়াশুনা করতে আসা সেই কোলহো জনজাতির বালকটিকে কি চিনি? “তোমার রাষ্ট্রের নাম কী?” — এই প্রশ্নের জবাবে যে বলেছিল : “আমার রাষ্ট্রের নাম শুখুয়াপাত্তা পাহাড়” (তার গ্রামের নাম)।
বইয়ের একদম শুরুতেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা একটি উদ্ধৃতির উল্লেখ রয়েছে : If we look into our hearts, we will have to admit that the India we know is actually the India of the bhadralok. অন্যের কথা জানিনা, আমার নিজের ক্ষেত্রে এই কথাটি সর্বাংশে সত্যি। পরিমল ভট্টাচার্যের এই পরিশ্রমী বইটির কল্যাণে যৎসামান্য হলেও সেই “অন্য” মানুষদের চিনেছি (আবারও বলছি : যৎসামান্য)। এবং মুখের বুলি, শরীরের পোশাক, কলেজের ডিগ্রি, এইসব বাহ্যিক জিনিস বাদ দিলে, ছোটলোক-ভদ্রলোকের মাঝে প্রকৃত বিভেদ আদৌ কতটুকু আছে সেই ব্যাপারেও সন্দেহ দেখা দিয়েছে মনে। লালন ফকিরের একটি বিখ্যাত গানের উল্লেখ আছে বইতে, সেটা দিয়েই আমার কথা শেষ করি।
পণ্ডিত কানা অহংকারেমাতবর কানা চুগলখোরে পণ্ডিত কানা অহংকারেসাধু কানা অনবিচারে...বেদ-বিধির পর শাস্ত্র কানাআরেক কানা মন আমারএসব দেখি কানার হাটবাজার!