উপন্যাসটির উত্তরকথনে লেখক মন্তব্য করেছেন : “এই উপন্যাস আসলে বাঙালির বিবেকের প্রায়শ্চিত্ত”। উপন্যাসের কাহিনিসূত্রের পশ্চাতে রয়েছে একটি দুঃখজনক সত্যি ঘটনা। আর জি কর হাসপাতাল নিয়ে আজকে যে তুলকালাম কাণ্ড চলছে, সেই হাসপাতালেই ফিজিওলজি বিভাগের গবেষক ও অধ্যাপক ছিলেন ডাক্তার সুভাষ মুখার্জি। সময় : গত শতাব্দীর আশির দশকের শুরুর দিক। ব্যক্তিগত উদ্যোগে গবেষণাকর্ম চালিয়ে সেই দুর্ভাগা গবেষক “ইন-ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন” (IVF) পদ্ধতি ব্যবহার করে ভারতের প্রথম (বিশ্বের দ্বিতীয়) টেস্টটিউব বেবির জন্মদান সম্ভব করেছিলেন। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন কমিউনিস্ট বামফ্রন্ট সরকার তাঁর এই আবিষ্কারকে নস্যাৎ করে দ্যায় এবং তাঁকে পেশাগতভাবে অপমান করে। সাফল্যের ন্যায্য স্বীকৃতি না দিয়ে উল্টে ঠগবাজ বলে দাগিয়ে দেওয়া হয় তাঁকে। সরকারি উদ্যোগে সংঘটিত সেই অন্যায় অপমানের দায় মাথায় নিয়ে, পেশাজীবনে একঘরে হয়ে যাওয়া সেই প্রতিভাবান মানুষটি আত্মহত্যা করেন। (আরো বিস্তারিত জানতে হলে উইকিপিডিয়ায় “Subhash Mukhopadhyay (physician)” দেখতে পারেন।)
রমাপদ চৌধুরী তাঁর উপন্যাসে এই ঘটনাটিকে হুবহু ব্যবহার করেননি। এমনকি বিষয়বস্তুও বেশ খানিকটা পরিবর্তন করেছেন। যদিও নিজের স্বভাবসিদ্ধ অনুসন্ধানী রচনাশৈলীর দ্বারা রমাপদবাবু মর্মান্তিকভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন বাঙালির জাতিগত চরিত্রের একটি ডেফিনিটিভ বৈশিষ্ট্যকে, যার নাম “কাঁকড়াবৃত্তি”। একটা কাঁকড়া যখন নিজের প্রচেষ্টায় উপরে ওঠার চেষ্টা করে, আশেপাশের বাকি কাঁকড়ারা তাকে টেনে নিচে নামিয়ে দ্যায়। অন্যের সাফল্য কিংবা অগ্রগতিকে ঈর্ষা করার স্বভাব সব মানুষেরই কমবেশি থাকে, কিন্তু বাঙালি একে শিল্পের পর্যায়ে উন্নীত করেছে। মহাভারতের অভিমন্যুর মতো চক্রব্যূহ পার করতে হলে (অর্থাৎ কোনো দুরূহ কাজ করতে হলে) বাঙালিকে একাকী উদ্যোগে করতে হয়। এবং সেই কাজটি যদি সফল হয়, সাফল্যের উপহারস্বরূপ অনেকসময়ই সেই একাকী যোদ্ধার কপালে জোটে ঈর্ষাসঞ্জাত অপমান কিংবা অপদস্থ হওয়ার কাঁটার মুকুট।
মজার কথা হলো, আজ থেকে চল্লিশ বছর আগেকার সেই প্রবল প্রতাপশালী কমিউনিস্ট পার্টি আজকে এই রাজ্যে হাসির খোরাকে পরিণত হয়েছে (যদিও বরাবরের মতোই তারা এখনও নিজেদের সবজান্তা মনে করে এবং তাদের বিরুদ্ধমতের মানুষকে মনে করে “অশিক্ষিত” কিংবা “নির্বোধ” কিংবা... আর কী?— “পেটি বুর্জোয়া!”) ইতিহাসের চক্রাকার বিবর্তনের কী অদ্ভুত পরিহাস! সেই আর জি কর হাসপাতালেই ঘটে যাওয়া একটি মর্মান্তিক ঘটনাকে হাতিয়ার করে পার্টির বর্তমান কমরেডরা আজকে ঘোলা জলে মাছ ধরার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। অন্যের ধুতির কাছা আঁকড়ে ধরে সেটাকে নিজেদের ধুতি হিসেবে চালাতে চাইছে। কিন্তু সারা বিশ্বের সর্বত্র কমিউনিস্ট অপশাসনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পশ্চিমবঙ্গেও দীর্ঘ ৩৪-বছরব্যাপী বামফ্রন্ট সরকারের উন্নাসিক অপশাসনকে মনে হয়না এই রাজ্যের ভুক্তভোগী জনগণ অ্যাতোই সহজে ভুলে যাবে। রমাপদ চৌধুরীর এই সুলিখিত উপন্যাসটি আরো একবার স্মরণ করিয়ে দিলো ডাক্তার সুভাষ মুখার্জির সেই যন্ত্রণাক্লিষ্ট পরিণতির কথা। এই উপন্যাস সত্যিই বাঙালির বিবেকের প্রায়শ্চিত্ত।
(উপন্যাসটি আলাদা করে এখন আর পাওয়া যায় কিনা জানি না। আমি পড়েছি রমাপদ চৌধুরীর “উপন্যাস সমগ্র” তৃতীয় খণ্ড থেকে। উপন্যাসের কাহিনি-অবলম্বনে পরিচালক তপন সিংহ একটি বিখ্যাত সিনেমা বানিয়েছিলেন— “এক ডক্টর কি মওত”।)