Ratings1
Average rating5
কথায় বলে, brevity is the soul of wit. এই ক্ষুদ্র বইটা আমি বেশ কয়েকবার পড়েছি। প্রতিবার পড়ার সময়ই এই কথাটা আমার মাথায় আসে। নাটকের মতো একটি বিচিত্রমুখী এবং যৌগিক শিল্পমাধ্যমকে একটা ছোট্ট সাইজের বইয়ের মাত্র ৫৭ পৃষ্ঠার মধ্যে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা— এটা একটা অভাবনীয় কাজ।
নাটক একটা মিশ্র-শিল্প। মানে এতে অন্য নানারকম শিল্পের মিশেল ঘটেছে। কেউ নাটক লেখে। সেই লেখাটা কেউ পড়ে। তারপর তাকে মঞ্চায়িত করার ভাবনা আসে। লোক জোগাড় করা হয়। মঞ্চ সাজানো হয়। আলো লাগানো হয়। শব্দের ব্যবস্থা করা হয়। মঞ্চের ব্যাকগ্রাউন্ডে প্রেক্ষাপট আঁকা হয়। গানবাজনার আয়োজন করা হয়। এরপর আছেন অভিনেতারা। তাঁরা কেউ কেবল সংলাপ বলেন। কেউ নৃত্য করেন। কেউ বা গান করেন। কেউ আবৃত্তি করেন। কেউ মুখে একটা কথাও বলেন না, শুধুই অভিব্যক্তির মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশ করেন। যিনি নিহত সৈন্যের ভূমিকায় অভিনয় করছেন, তিনি সারাক্ষণ মঞ্চের মেঝেতে চুপচাপ মটকা মেরে শুয়ে থাকেন। অভিনেতারা কেমন পোশাক পরবেন, এই ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তাভাবনা করারও লোক আছে। এরকম ছোটো বড়ো আরো অনেক কিছু। তারপর আমরা দর্শকরা প্রেক্ষাগৃহে নাটকটা দেখতে যাই। এই বিস্তারিত এবং বিপুল একটা আয়োজনকে তখন যেন সামগ্রিকভাবে আমাদের দিকে সজোরে ছুঁড়ে দেওয়া হয়। মঞ্চের উপরের কয়েকজন মানুষের সঙ্গে মঞ্চের সামনে বসে থাকা কয়েকজন মানুষের মধ্যে এই যে একটা তাৎক্ষণিক এবং স্বতস্ফূর্ত সম্পর্ক তৈরি হয়, এটাই নাট্যশিল্পের মূল আবেদন।
এই পুরো আয়োজনটা কিন্তু দাঁড়িয়ে আছে মূলত দুটো ভরকেন্দ্রকে আশ্রয় করে। একটা হলো, লিখিত নাটক। আরেকটা হলো, সেই লিখিত নাটকের অভিনয়। রচনা এবং অভিনয়। দুয়ে মিলে “নাট্যকলা”।
বাদল সরকারের “থার্ড থিয়েটার” মুভমেন্টের মতো ঘটনায় নাটকের দ্বৈত ভরকেন্দ্রের এই বিষয়টা আরো স্পষ্ট বোঝা যায়। থার্ড থিয়েটারের প্রযোজনাগুলোতে আনুষঙ্গিক আয়োজন বলতে কিচ্ছু থাকতো না। এমনকি মঞ্চও থাকতো না। সরাসরি ব্যস্ত রাস্তাঘাটের একপাশে নাটকের অভিনয় হতো। একজন লেখক নাটকটা লিখতেন, আর সেই নাটকটা কয়েকজন মিলে অভিনয় করতেন। ব্যাস, আর কিছু না। দর্শকরা যে যার ইচ্ছে মতো দাঁড়িয়ে পড়তেন। তাঁরাও অবাক হয়ে যেতেন আচমকা এই কাণ্ড দেখে। কখনও কখনও তাঁরাও নাটকের অংশ হয়ে যেতেন।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, নাটকের মতো এই যে এত বিচিত্র এত বিবিধ একটা আয়োজন, এর স্রষ্টা হিসেবে আমরা কাকে চিহ্নিত করবো? যিনি নাটকটা লিখেছেন, তাঁকে? নাকি যিনি পরিচালনা করেছেন? নাকি যাঁরা অভিনয় করেছেন? আর যিনি আলোকসম্পাত করেছেন? যিনি শব্দ-সংযোজন করেছেন? নেপথ্যে যাঁরা বাজনা বাজিয়েছেন? যিনি পোশাক ডিজাইন করেছেন? উইংসের পিছনে অল্পবয়েসি যে-ছেলেটা দৌড়ে দৌড়ে সবাইকে সেই সকাল থেকে লাগাতার চা খাইয়ে গেলেন, তাঁর কিছু দায় নেই? পৃথিবীর দ্বিতীয় কোনও শিল্পে দায়বদ্ধতার এই প্রশ্নটা এত জোরদারভাবে উঠে আসে না। চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রেও না। চলচ্চিত্রে সত্যি করেই সিংহভাগ দায় থাকে পরিচালকের। চলচ্চিত্র নির্মাণের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নৌকার হাল এবং রশি নিজের হাতে ধরে থাকেন তিনি। নাটকের ক্ষেত্রে উল্টো। ঠিক যখন সবার সামনে নাটকটা মঞ্চস্থ হওয়ার মোক্ষম সময় এলো, তখন কোথায় নাট্যকার? কোথায় পরিচালক? তখন আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে! একবার তৈরি হয়ে যাওয়ার পরে একটা সিনেমা হাজার বার দেখলেও সেটা একই জিনিস। একটা নাটক যতবার মঞ্চস্থ করা হয়, প্রতিবার সেটা বদলে বদলে যায়। বহিরঙ্গে। অন্তরঙ্গে।
শম্ভু মিত্র নিজে ছিলেন বাংলা আধুনিক নাট্যজগতের অবিসংবাদিত ব্যক্তিত্বদের মধ্যে একজন। এই ক্ষুদ্র বইটা পড়লে বোঝা যায়, নাটক নামের এই শিল্পমাধ্যমটিকে নিজের ভিতরে সম্পূর্ণভাবে আত্তীকরণ করে ফেলতে না-পারলে, এতটা প্রাঞ্জলভাবে এতটা স্পষ্টভাবে তাকে বিশ্লেষণ করা সম্ভব নয়। নাট্যশিল্পের গোড়ার বিষয়গুলো সহজ উপায়ে বোঝার জন্যে এই বইটার বিকল্প নেই। ক্যানো আজও, অ্যাটেনশন স্প্যানের দুর্ভিক্ষ আর চটজলদি হল্লাবাজির রমরমার এই যুগেও— যখন কোনও সিনেমা দেখতে ইচ্ছে করলে ফট্ করে ল্যাপটপ খুলে ফেলা যায়, গান শুনতে হলে ফট্ করে স্পটিফাই, গুগল ইমেজ-সার্চের ভার্চুয়াল গ্যালারিতে সারি সারি দাঁড়িয়ে থাকে পৃথিবীর বিখ্যাত চিত্রশিল্পের নমুনাগুলো, ইচ্ছে হলেই ফট্ করে দেখে নেওয়া যায় মোনালিসার স্মিত হাসি কিংবা ভ্যান গঘের আলু চাষী। তবু নাটক দেখতে হলে কষ্ট করে আমাদের যেতে হয় থিয়েটারে। আগে থেকে নিতে হয় মানসিক প্রস্তুতি। সবচেয়ে বড় কথা, ঘণ্টা দুয়েকের জন্যে মোবাইলটা সাইলেন্ট করে পকেটে ঢুকিয়ে রাখতে হয়। সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন যখন সন্ধ্যা আসে— প্রেক্ষাগৃহ জুড়ে থাকে শুধু অন্ধকার— তখন আলোকিত মঞ্চ থেকে আমার দিকে সরাসরি তাকিয়ে, মুখোমুখি বসে থাকেন নাটোরের বনলতা সেন। কোন্ চিরন্তন আবেদনের জাদুতে?
সুতরাং, কাকে বলে নাট্যকলা?